Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মাল্যবান || Jibanananda Das » Page 19

মাল্যবান || Jibanananda Das

পৌঁষ মাসের শেষাশেষি মেজদার পরিবার এল। মাল্যবান একটা মেসে গিয়ে উঠল। মেস ঠিক নয়-মাঝারি-গোছের একটা বোর্ডিং। একটা আলাদা কামরা বেশ গুছিয়ে নিল সে। মেজদা আর বৌঠান কিছুতেই ছাড়তে চায়নি মাল্যাবনকে, কিন্তু তবুও সব দিক ভেবে সুবিবেচনা করে মেসেই যেতে হল তাকে।

মেসের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করবার বিশেষ আগ্রহ ছিল না তার। অফিস থেকে এসে নিজের জীবনের বিপর্যয়ের কথাই সে ভাবত–যে পর্যন্ত না ব্যক্তিঅতিক্রমণার দূর সমুদ্রসুর শুনতে পেত সে : সে-শব্দ শুনতে গিয়ে রাত বেশি হয়ে যেত—ঘুম আসত তার আগে; সে-সুর প্রায়ই আজকাল শোনা যেত না, আসত না, স্পষ্ট করে ধরা দিতে চাইত না। গোলদীঘি কাছে ছিল–বেড়াতে যেত। এক-এক দিন নিজের বাড়িতে গিয়ে তত্ত্বতলব নিয়ে আসে—চার দিকে ঘুরে-ফিরে দ্যাখে মেজদা ও বৌঠানের অমায়িক নিয়ে আসে—চার দিকে ঘুরে-ফিরে দ্যাখে মেজদা ও বৌঠানের অমায়িক মুক্ষিমিষ্টত্ব উপভোগ করে। তারা এমন চমৎকার মানুষ হয়তো খুঁটিনাটি নিয়ে দুজনে বচসা করছেন, কিন্তু তার ভেতরেও পরস্পরের জন্যে এক নাড়িরই টান যেন, এক জোড়া বসন্ত বউরির মতো নীড়ের বাইরে, মুহূর্তেই নীড়ের ভেতরে যেন মানুষের মতো শরীর ও বোধ নিয়ে—প্রত্যেক কথার ভেতর দিয়েই যৌনসম্বন্ধের মিছরি মাখানো ভালোবাসার মর্ম ফটে উঠছে। দেখে মাল্যবানের লাগছে মন্দ না, মানে খারাপ লাগে, কেমন বিশ্রী লাগে যেন : ব্যক্তিজলরাশি ভুলে গিয়ে ব্যক্তিকে, নিজের কী হল না হল, সেটাকেই সব চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় বলে।

এ-জিনিসটা উপলব্ধি করে ব্যক্তিজলরাশির নিশ্চিহ্ন জলরৌদ্ররাশির ভেতর মিলিয়ে যেতে চেয়ে ঈষৎ ভাঙ খেয়ে কেমন ভালো লাগছে যেন তার, এমনই একটা আস্বাদে মিষ্টি গলায় মাল্যবান বলে, মেজদা, আপনাদের শুতে তো কোন কষ্ট হয় না?

না। এই তো বেশ বড় ছাপ্পর খাট হয়েছে।

ওখানে একাই শোন বুঝি আপনি?

না।

ছেলেপুলেরা শোয় বুঝি আপনার সঙ্গে?

ওরা নিচে শোয়—পিসির কাছে।

মেজদা বললেন, উনি আর আমি শুই এখানে। একা-বিছানায় ঘুম হয় না—পাশে যা হোক অন্তত একটা শাড়ির খসখসানি উশখুশানি না থাকলে চলে না। বুঝলে কি না…

মাল্যবান নিজের কপাল থেকে একটা ডাঁশ উড়িয়ে দিল।

মেজদা গলা খাকরে বললেন, বিছানার চারদিকটা বেশ উম হয়ে থাকা চাই তো…হা হা…

মেজ বৌঠান হামানদিস্তেয় পান ছেঁচতে-ছেঁচতে ঘরের ভেতরে ঢুকে হেঁচা পানের বড়ি পাকিয়ে বিরাজবাবুকে দিয়ে গেলেন। তার পর হাত ধুয়ে বিরাজবাবুর দাবনা ঘেঁষেই যেন বসলেন—কোনো সঙ্কোচ নেই। মাপলারটা বিরাজের গলায় ভালো করে জড়িয়ে দিলেন, বললেন, বড্ড শীত; বালিশের নিচের থেকে এক জোড়া চকোলেট রঙের মোজা বের করে বিরাজ মিত্তিরের বাঁ পায়ের গোদে, সরু ডান ঠ্যাঙে পরিয়ে দিলেন মাঝবয়েসী আঙুলের সুকুশল সক্রিয়তায়—মোমের ঝরানির থেকে বেশি মধুর ঝরানির থেকে উঠে এসে যেন!

মেসে এসে মাল্যবান যেন ফঁপরে পড়ে গেল, কেউ নেই তার, কিছু নেই। এখানে ছোকরারা থাকে, আর থাকে এমন সব লোক—বিশেষ এক রকম শারীরিক সুখের জন্যে যাদের সব সময়েই লালা ঝরছে; রাতের বেলা বেরিয়ে যায় তারা কোথায় থাকে—কী করে? কোনো দিন শেষ-রাতে ফিরে আসে, কোনো দিন আসে না। মেসের যাদের এ-রকম রাত করা বাতিক নেই, তাদেরও লালা ঝরছে বিশেষ এক রকম শরীর গ্রন্থির সুখের জন্যে মেসের রাতের বিছানায় শুয়ে থেকে। বছরের-পর-বছর সারাটা জীবন এরা মেসেই কাটিয়ে দেয়। এছাড়া এদের গতি নেই—কিছু নেই—সংসার করবার শক্তি নেই।

বিছানায় শুয়ে পড়ল সে; কিন্তু সেই মুহুর্তেই ওঠে বসল। বারান্দায় পায়চারি করতে লাগল। গোলদীঘিতে গেল। ফিরে এল সেখান থেকে। খবরের কাগজ নিল; রেখে দিল; চরুট জ্বালাল; নিভে গেল; ঠাকুর ভাত দিয়ে গেল।

পরদিন সকালবেলা মাল্যবানের মেসের ঘরের কাছে রেলিং-এর ওপর কতকগুলো কাক এসে ডাকছিল। মাল্যবান তার স্ত্রীর মুক্ষি-ওড়ানোর মতো ঝটপট হাততালি দিয়ে হা-হা করতে-করতে উড়িয়ে দিল সেগুলোকে। পাশের ঘরের একজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে বললেন, দেখলেন মশাই, কী-রকম বিরক্ত করে! কাল আট আনার কচুরি-হালুয়া এনে টেবিলে রেখে একটু মুখ ধুতে গেছি, এরই মধ্যে ঘরের ভেতর ঢুকে খাবারের ঠোঙা লোপাট—

এই কাকগুলো?

হ্যাঁ, স্যার।

বড্ড বেয়াদব তো—

কিন্তু মাল্যবানের ইচ্ছে হচ্ছিল, এই কাকগুলোকে ডেকে সে কিছু খেতে দেয়—এগুলোকে উড়িয়ে দিয়েছে বলে কেমন একট খালি-খালি লাগছিল তার। রোজ সকালে সে ঘুমের থেকে উঠবার ঢের আগেই পূবের দিকের এই রেলিং-এর ওপর বসে কাকগুলো ডাকতে থাকে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার পাড়াগাঁর কথা মনে পড়ে-মার কথা; সেই খড়ের ঘর—এম্নি শীতের ভোর—এম্নি কাকের ডাক। কোথায় গেল সে-সব!

মাল্যবান ঘরের ভেতর ঢুকে টেবিলের কাছে বসে এই সব কথা ভাবছিল। এম্নি সময়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটা একা-কাক উড়ে এসে মাল্যবানের ঘরের পাশে ট্রামরাস্তার দিকের রোয়াকের রেলিংএর ওপর বসল আবার। মাল্যবান অনেকক্ষণ একঠাই বসে কাকটাকে দেখতে লাগল–তার ডাক শুনছিল। পাড়াগাঁয় দাঁড়কাক থাকে, পাতিকাক থাকে;-কলকাতায় পাতিকাক; দাঁড়কাক দেখছে না তো। অনেক দিন দাঁড়কাক দ্যাখেনি; একটা দাঁড়কাক দেখেছিল বড় রাস্তার একটা মস্ত বড় বিজ্ঞাপনের ছবিতে; একটা মদের বোতলের টাইট-ছিপি ঠুকরে খুলতে চাচ্ছে—ফ্রান্সের বিখ্যাত মদের গন্ধে এম্নি তোলপাড় হয়ে গিয়েছে প্রাণীটি। মদের বোতলের বিজ্ঞাপনের দাঁড়কাক, কিন্তু তবুও চোখ তুলে দেখবার মতো : এক ঝলকে জীবনের অনেক কটা বছরের আকাশ বাতাস পাখি প্রাণী সমাজ উপলব্ধি উজিয়ে দিয়ে গেছে।

কাকটা উড়ে গেল কুয়াশার ভেতর দিয়ে—গোলদীঘির দিকে—একটা নিম গাছের ভেতর। এম্নি উড়ে যেতে ভালো লাগে।

পাড়াগাঁর বাড়িতে প্রকাণ্ড বড় উঠোন ছিল তাদের, ঘাসে ঢাকা, কোথাও বা শক্ত শাদা মাটি বেরিয়ে পড়ছে, তারই ওপর সারাদিন খেলা করত রোদ ছায়া মেঘের ছায়া আকাশের চিলের ডানার ছায়া—রোদে দ্রুততায় চলিষ্ণু হীরেকষের মতো তার ছটকানো। শালিখ উড়ে আসত উঠোনে; খড়ের চালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত বক—এই সরোবর থেকে সেই সরোবরে যাবার পথে, ডানায় তাদের জলের গন্ধ, ঠোঁটে রঙের আভা চকিত চোখ দুরের দিকে, নীলিমার দিকে। কত উঁচু-উঁচু গাছ ছিল উঠোন ঘিরে; সারাটা শীতকাল ঘুঘুর ডাকে জারুল ঝাউ পাবাদাম আমের বন নিম হিজলের জঙ্গল কেমন ফুকরে ফুকরে উঠত—রোদের দিকে পিঠ রেখে নিজের শরীরটাকে একটু এলিয়ে দিলে সমস্ত শরীর ঘুমে ভরে উঠত সেই পাখির ডাকে। মাঝে-মাঝে উঠোনে এসে পড়ত ঘুঘু, কেমন কলের মতো, পাখিদের দেশের ক্ষুদে পেঁকির পাড়ের মতো ঘুঘুদের লেজগুলো উঠত পড়ত উঠত পড়ত—ঘুর ঘুর ঘুর ঘুর করে ছুটে যেত তারা মাঠে ঘাসে-কী খুঁজত—কী চাইত? সেই পঁচিশ-তিরিশ বছর আগের শীতের ভোরের কুয়াশার ভেতর সেই সব পাখি যেন পৃথিবীর মনে কোনো দিন ছিল না; আজকের পৃথিবীটা কলকাতার বাণিজ্যশক্তির গোলকধাঁধা নিয়ে এম্নি অদ্ভুত অপৃথিবী। ফিকে কফির কোকোর মতো রঙের গলা ফুলিয়ে কত পাতিকাক উড়ে আসত খড়ের চালে, উঠোনে; শন-শন করে উড়ে যেত ঠাণ্ডা জলের ওপর দিয়ে ছুঁই-ছুই করে কোনো নদীকে কোনো দীঘিকেই না ছুঁয়ে, জলের ভেতর ঝাপসা প্রতিফলিত হয়ে, শাঁ-শাঁ করে কোথার থেকে উড়ে যেত তারা কোথায়; সকালের কুয়াশার দিক থেকে দুর বিদিকের পানে উড়ে যেত সেই কাকগুলো পৃথিবীটাকেই টেনে বার করবার জন্যে, উজ্জ্বল সূর্যটাকে সবাইকে পাইষয় দেবার জনে—যারা কাক নয়, পাখি নয়, তাদের জন্যেও কু-ক—কেমন শতচেতনার হাঁকডাক, সালিশি, নির্জনতা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress