এই বাড়ির কাজের লোক
তুমি এই বাড়ির কাজের লোক ভিখু?
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।
কতদিন হল এ বাড়িতে কাজ করছ?
প্রায় দশ বছর।
বাড়ি কোথায়?
ছাপরা জেলা।
এ বাড়িতে কীভাবে কাজে ঢুকলে?
আমার কাকা এ-বাড়িতে কাজ করত। কাকা এখন দোকান করে। আমাকে কাকা চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।
তুমি তো বেশ ভাল বাংলা বলো!
আমি তো জন্ম থেকেই কলকাতায় আছি। এখানেই মানুষ।
এ বাড়িতে তোমার কাজ কী?
এ বাড়িতে তো কেউ থাকে না। আমার কাজ ঘরদোর বিছানা-টিছানা সব পরিষ্কার রাখা। বছরে একবার মেমসাহেব আসেন, তখন তাঁর দেখভাল করতে হয়।
মেমসাহেবের বাপের বাড়ির লোকেরা কোথায়?
মেমসাহেবের তো কেউ নেই। বড় মালিক আর মালকিনও এখানে থাকতেন না। আমেরিকায় থাকতেন। সেখানেই একটা অ্যাক্সিডেন্টে দু’জনেই মারা যান। এ বাড়িও বিক্রির চেষ্টা চলছে।
তোমাকে কত মাইনে দেওয়া হয়?
আড়াই হাজার টাকা।
বাড়ির কাজের লোকের পক্ষে মাইনেটা তো ভালই, কী বলো?
না সাহেব, এ টাকায় সংসার চালানো মুশকিল।
তোমার সংসারে কে আছে?
আমার বউ আর চার ছেলেমেয়ে। দুই বেটা, দুই বেটি।
এ বাড়িতেই থাকো?
না সাহেব। ফ্যামিলি নিয়ে এ বাড়িতে থাকার হুকুম নেই। আমার পরিবার থাকে তিলজলায়, একটা বস্তিতে।
তোমার চলে কী করে?
আমার বউও কাজ করে। বাড়ির কাজ।
ফ্যামিলি নিয়ে এখানে থাকার হুকুম নেই কেন? এ বাড়িতে তো আউট হাউস আছে এবং সেগুলো ফাঁকাই পড়ে থাকে।
বাচ্চাকাচ্চা থাকলে বাড়ি নোংরা করবে, বাগানের গাছপালা ছিড়বে বলেই হুকুম নেই। তা ছাড়া অনেকে বাড়ি দখল-টখল করে নেয়।
এ বাড়িতে তো অনেক দামি জিনিস রয়েছে দেখছি। তোমাকে কি মেমসাহেব খুব বিশ্বাস করতেন?
তা জানি না। তবে থানায় আমার নাম ঠিকানা ফটো সব রেকর্ড করা আছে। কোনও জিনিস চুরি গেলে পুলিশ তো আমাদেরই ধরবে।
এবার ঘটনার দিনের কথা বলো।
ঘটনার দিন সকালে মেমসাহেব আমাকে ডেকে বলে দিলেন, একজন বাবু দেখা করতে আসবেন, ঘরদোর যেন ফিটফাট থাকে।
ঘরদোর তো ফিটফাটই আছে দেখছি।
হা সাহেব। এ বাড়ি সবসময়ে ফিটফাট থাকে। তবু মেমসাহেব বললেন বলে আমি আরও একটু ঝাড়পোঁছ করলাম।
মেমসাহেব কীরকম লোক ছিলেন বলে তোমার মনে হয়?
ভাল লোক ছিলেন।
কীরকম ভাল?
ঝুট ঝামেলা কিছু করতেন না। চুপচাপ থাকতেন।
রাগী মানুষ ছিলেন কি?
বেয়াদবি বরদাস্ত করতেন না। আমাদের খুব ফিটফাট থাকতে হত, নোংরা দেখলে রেগে যেতেন।
কাজে খুশি হলে বখশিশ দিতেন নাকি?
না। বখশিশ দিতেন না।
উনি কি কৃপণ ছিলেন?
না সাহেব। কিন্তু বখশিশ দিতেন না।
তোমাদের মাসের মাইনে কে দিত?
সতুবাবু। মেমসাহেবে সম্পর্কে দাদা। নিউ আলিপুরে থাকেন।
সতুবাবু কি প্রতি মাসে নিজে এসে টাকা দিয়ে যেতেন?
না। আমরা গিয়ে নিয়ে আসতাম।
সতুবাবুই কি এ বাড়ির দেখাশোনা করতেন?
হ্যাঁ। তবে উনি খুব একটা আসতেন না। ইদানীং এক পোমোটার বাবুকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসে মাপ জোক করাতেন।
প্রোমোটারকে চেনো?
ঘোষবাবু। শুনেছি বড় প্রোমোটার।
তাঁর সঙ্গে তোমাদের কোনও কথাবার্তা হয়েছে?
না সাহেব। উনি আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন কেন?
এবার ঘটনার দিনের কথা বলো। সেই বাবুটি কখন এলেন?
আটটার পর।
চেহারা কেমন?
লম্বা-চওড়া চেহারা। হিরোর মতো।
দেখে কীরকম মনে হল?
আমি ভেবেছিলাম ফিল্মস্টার হবেন বোধহয়।
মেমসাহেবের সঙ্গে তাঁর কী কথাবার্তা হল জানো?
না সাহেব।
মেমসাহেব কি গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন?
তা হতে পারে সাহেব। আমি ওসব দেখিনি।
উনি কতক্ষণ ছিলেন?
এক ঘন্টার মতো হবে। একটু কমও হতে পারে।
তুমি কি কফি বা চা দিয়েছিলে?
মেমসাহেব বলেছিলেন যেন কথাবার্তার সময় ওঁদের ডিস্টার্ব না করি। তাই আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আর ভিতরে যাইনি। তবে দরজার কাছেই ছিলাম, যদি ডাকেন তা হলে যেন শুনতে পাই।
ভিতরে কী কথাবার্তা হয়েছিল তা শুনতে পেয়েছিলে?
মেমসাহেব রাগারাগি করছিলেন, তবে আমি ইংরেজি জানি না বলে কথা কিছু বুঝতে পারিনি।
মেমসাহেব কি কান্নাকাটিও করেছিলেন?
হ্যাঁ। বাবুটি চলে যাওয়ার পর মেমসাহেব খুব আপসেট ছিলেন।
তুমি কি একেবারেই ইংরিজি জানো না? এই যে বললে আপসেট।
দুটো-একটা শব্দ জানি সাহেব।
সেরকম কোনও শব্দ মনে করতে পারো?
মেমসাহেব একবার বাস্টার্ড বলে গাল দিয়েছিলেন, মনে আছে।
ব্যস?
হ্যাঁ। আর কিছু মনে নেই।
বাবুটি যখন বেরিয়ে যায় তখন তাকে দেখেছ?
না সাহেব, আমি ভিতর দিকের দরজার পাশে ছিলাম। বাবু সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
তুমি জানো যে মেমসাহেব বাবুটিকে চড় মারেন?
জানি সাহেব, শব্দ শুনেছি।
আর কিছু?
দারোয়ান বলরাম বলেছিল বাবুর বাঁ-গাল থেকে রক্ত পড়ছিল। বাবু রুমাল দিয়ে গাল চেপে গিয়ে গাড়িতে ওঠেন।
মেমসাহেবকে তারপর কেমন দেখলে?
উনি খুব আপসেট ছিলেন। ইংরিজিতে কী সব বলতে বলতে দোতলায় উঠে গেলেন।
উনি সেদিন দুপুরে লাঞ্চ করেছিলেন কি?
না সাহেব আমি বেলা সাড়ে বারোটায় ওঁর দরজায় নক করি।
উনি সাড়া দেননি?
হ্যাঁ, দরজা খুলে দিয়ে বললেন, আমি কিছু খাব না। দুধ থাকলে এক গেলাস ঠান্ডা দুধ দিতে বললেন।
দুধটা খেয়েছিলেন কি?
হ্যাঁ সাহেব।
তারপর কী করলেন?
ঘরে চুপচাপ শুয়েছিলেন বলে মনে হয়।
খুনটা ক’টার সময় হয় তুমি তো জানো।
হ্যাঁ সাহেব, পুলিশের কাছে শুনেছি। বেলা দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে।
তুমি তখন কোথায় ছিলে এবং কেন তা পরিষ্কার করে বলো। পু
লিশকে সব বলেছি সাহেব। কিছু লুকোইনি। বেলা দেড়টা নাগাদ একটা ফোন আসে।
ফোন কি মেমসাহেব ধরতেন না?
না। মেমসাহেব ফোন ধরতেন না। কোনও জরুরি ফোন থাকলে আমি কর্ডলেস ফোনটা নিয়ে ওঁকে দিতাম।
সব ফোন তুমিই ধরো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এবার বলো।
ফোনে একটা লোক আমাকে বলল, ভিখুচাচা তোমার ছেলে অ্যাক্সিডেন্টে জখম হয়েছে। খুব গহেরা জখম। আমরা তাকে পি জি হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। তুমি এখনই চলে এসো।
গলাটা কার তা চিনতে পেরেছিলে?
না।
জিগ্যেস করোনি?
হ্যাঁ। বলল, আরে আমি তোমার পাড়ার ছেলে রামু। তাড়াতাড়ি চলে এসো। বহুত ইমার্জেন্সি। আমার মাথার ঠিক ছিল না সাহেব। আমি দৌড়ে গিয়ে মেমসাহেবকে বললাম। উনি ছুটি দিয়ে দিলেন। আমি পাগলের মতো হাসপাতালে ছুটলাম। গিয়ে দেখি ওখানে আমার ছেলের নামে কাউকে ভরতি করা হয়নি। তখন ছুটলাম বাড়িতে। গিয়ে দেখি আমার বউ ঘুমোচ্ছ। তাকে ডেকে তুলে সব বললাম। তারপর ছুটলাম ছেলের ইস্কুলে। গিয়ে দেখি, ছেলে ঠিক আছে, কিছু হয়নি।
কখন ফিরলে?
বেলা চারটে হবে।
এসে কী দেখলে?
চারটের সময় মেমসাহেবকে রোজ কফি দিই। সোজা রান্নাঘরে গিয়ে কফি করে দোতলায় উঠে দরজা নক করতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা রয়েছে। বাইরে থেকে বললাম, কফি এনেছি। মেমসাহেব সাড়া দিলেন না। ভাবলাম ঘুমোচ্ছন। পরদা সরিয়ে উঁকি মেরে দেখি মেমসাহেবের বডি অর্ধেকটা বিছানায় আর অর্ধেকটা নীচের দিকে ঝুলে রয়েছে। মাথা নীচের দিকে।
ঠিক আছে। বাকিটা আমরা জানি। পুলিশ তোমাকে কী বলেছে?
সাহেব, পুলিশ আমাদের খুব হয়রান করেছে। চড় থাপ্পড় মেরেছে। কিন্তু আমি বা বলরাম আমরা মেমসাহেবকে খুন করতে যাব কেন বলুন! আমরাই তো তা হলে ভাতে মরব।
ঘর থেকে কিছু চুরি গিয়েছিল বলে মনে হয়?
ঘরের জিনিসপত্র সবই আমি চিনি। সেসব কিছু চুরি যায়নি। তবে মেমসাহেবের ব্যাগ বা সুটকেস থেকে কিছু চুরি গিয়ে থাকলে তা বলতে পারব না। মেমসাহেবের জিনিস তো আমি ধরতাম না।
এবার যা জিগ্যেস করব খুব ভেবেচিন্তে তার জবাব দেবে।
বলুন সাহেব।
মাসখানেক আগে মেমসাহেব যখন এলেন তখন কি একাই এসেছিলেন?
হ্যাঁ সাহেব। মেমসাহেবের ফ্লাইট দেরিতে এসেছিল। আমার ওপর হুকুম ছিল সব রেডি রাখতে।
উনি কখন আসেন?
সন্ধেবেলা। সতুবাবু ওঁকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসেন।
সতুবাবু ছাড়া আর কেউ ছিল না?
না সাহেব।
সুব্রতবাবু কবে আসেন?
ছোটসাহেব তো মেমসাহেব মারা যাওয়ার পরে আসেন, খবর পেয়ে।
এসে উনি কী করলেন?
উনি এ বাড়িতে ওঠেননি। কলকাতায় ওঁর বাড়ি আছে, সেখানে উঠেছিলেন।
সুব্রতবাবু কি কখনও এ বাড়িতে উঠতেন না?
বেশিরভাগ সময়ে মেমসাহেব একাই আসতেন। ছোট সাহেবকে আমি খুব একটা দেখিনি।
ঠিক আছে। তুমি যেতে পারো। গিয়ে পাঁচ মিনিট পর বলরামকে পাঠিয়ে দাও।
ভিখু চলে যাওয়ার পর টেপ রেকর্ডারটা বন্ধ করে শবর উঠল। এটাই ছিল মিসেস বকশির শোওয়ার ঘর! খাঁটি আবলুশ কাঠের বিশাল একটা খাট, যার মাথার দিকটা সিংহাসনের মতো কাজ করা। দেরাজ আলমারি সবই একই কাঠের এবং ঝকমক করছে। তাদের পালিশ।
আসবাবগুলো সেকেলে, ভারী এবং অতিশয় মূল্যবান। ঘরে ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেটটাও পুরনো বটে, কিন্তু বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাড়ির স্থাপত্যও আধুনিক নয়। পুরনো ব্রিটিশ আমলের প্যালেসের আদলে তৈরি। ঘরটা বিশাল, লাগোয়া দক্ষিণের বারান্দাটিও চমৎকার সোফাসেট দিয়ে সাজানো। আধুনিক জিনিস বলতে শুধু এয়ারকুলার লাগানো আছে ঘরে। শোওয়ার ঘরের একপাশে নিচু ক্যাবিনেটের ওপর দুটো বড় সুটকেস। আমেরিকায় তৈরি। সন্ট লাগেজ। কালচে রঙের সুটকেস দুটোই আটকে সিল করে দিয়ে গেছে পুলিশ। সুটকেস দুটো খোলার অধিকার আছে শবরের, কিন্তু সে খুলল না।
আসব স্যার?
এসো।
মধ্যবয়সি মজবুত চেহারার বলরাম শঙ্কিত মুখে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল।
তুমিই তো দারোয়ান?
হ্যাঁ স্যার।
কতদিন কাজ করছ এ বাড়িতে?
কুড়ি বছর।
বাড়ির মালিককে তো তা হলে ভালই চেনো।
মাথা নেড়ে বলরাম বলে, না স্যার। মালিকরা কেউ তো এখানে থাকতেন না। ওঁরা অনেক বছর আমেরিকায়, দিদিমণির জন্মও তো হয়েছে ওখানেই। আমি ফাঁকা বাড়ি সামলে রাখতাম।
তোমার কাজ তা হলে কী?
কাজ বলতে কিছুই নেই। শুধু বসে থাকা।
কত মাইনে পাও?
আড়াই হাজার।
মাইনে তো ভালই।
যে আজ্ঞে, আমি একা লোক, চলে যায়।
একা কেন, পরিবার কোথায়?
আমি বিয়ে করিনি স্যার। মা বাবা মারা গেছেন। কেউ বিশেষ নেইও।
তুমি এ বাড়িতেই থাকো? হ্যাঁ
স্যার। গেট-এর পাশেই আমার ঘর। চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি।
খুনের দিন সকালবেলা যে ভদ্রলোক এসেছিল তাকে মনে আছে?
হ্যাঁ স্যার। ওঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল।
দিদিমণির কি অনেক অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকত?
না। বাড়িতে বেশি লোক আসত না।
লোকটা এসে কী করল?
নাম বলল, আমি খাতা খুলে মিলিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিলাম। এক ঘণ্টা পর উনি চলে যান।
তখন তুমি কী লক্ষ করেছিলে?
বাবুর বাঁ-গাল কেটে গিয়েছিল। রুমাল চাপা দিয়ে রেখেছিলেন।
তোমার কী মনে হল তখন?
কিছু ঝামেলা হয়ে থাকবে। ভিখুকে জিগ্যেস করেছিলাম। ভিখু বলল দু’জনে ঝগড়া হয়েছিল, দিদিমণি বাবুকে খিমচে দেন।
সুব্রতবাবু কি এ-বাড়িতে আসত না?
খুব কম স্যার। দিদিমণির বিয়ে হয়েছে ষোলো-সতেরো বছর। দু-তিনবারের বেশি জামাইবাবুকে দেখিনি ভাল করে।
দিদিমণি কি প্রতি বছর নিয়ম করে দেশে আসতেন?
না স্যার। এক-দুই বছর বাদও যেত। শুনছিলাম এ বাড়ি বিক্রি করে দিদিমণি এবার আমেরিকাতেই থাকবেন, দেশের পাট চুকিয়ে। এখন যে কী হবে তা বুঝতে পারছি না। চাকরিটা তো যাবেই। বুড়ো বয়সে খুব অসুবিধেয় পড়তে হবে।
টাকাপয়সা জমাওনি?
কিছু জমিয়েছি স্যার, পোস্টঅফিসে আছে। কিন্তু সেই সামান্য টাকায় কি জীবন কাটবে? টাকার দাম তত কমে যাচ্ছে, কতদিন বাঁচব তার ঠিক কী?
তোমার শরীর তো মজবুত, এখনও খাটতে পারো।
যে আজ্ঞে। কিন্তু লোকে কাজই দিতে চায় না।
চেষ্টা করছ নাকি?
সতুবাবু কয়েকমাস আগেই বলে দিয়েছেন যে, বাড়ি বিক্রির চেষ্টা হচ্ছে, আমি যেন অন্য ব্যবস্থা দেখে নিই। তাই একটু-আধটু চেষ্টা করেছি।
খুনের সময়ে তুমি কোথায় ছিলে?
থানায়। ঝুটমুট আমাকে হয়রান করা হল স্যার। বেলা একটা হবে তখন। একজন সার্জেন্ট মোটরবাইক চেপে এসে বলল, থানার বড়বাবু নাকি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে, এখনই যেতে হবে।
কেন ডেকেছে তা বলেনি?
বলল, কেন ডেকেছে জানি না, তবে বলে দিয়েছে যেতে না চাইলে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে। বলেই চলে গেল। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে দিদিমণিকে বললাম। দিদিমণি তখন বিছানায় শোয়া। হাত নেড়ে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, যাও।
দিদিমণি কি তখন কাঁদছিলেন?
ঠিক বুঝতে পারিনি। হতেও পারে। গলাটা ভারী লাগছিল।
তারপর বলো।
থানায় গেলাম, তা সেপাই আটকাল। কিছুতেই বড়বাবুর কাছে যেতে দেবে না। তখন বললাম বড়বাবুই ডেকে পাঠিয়েছেন। অনেক তত্ত্ব তালাসের পর বড়বাবুর ঘর দেখিয়ে দিল। গিয়ে যখন নামটাম বললাম বড়বাবু কিছুই বুঝতে পারেন না। যখন বললাম সার্জেন্ট গিয়ে এত্তেলা দিয়েছে তখন বড়বাবু বললেন, তা হলে সিরিয়াস কেসই হবে। আর একজন অফিসারকে ডেকে বললেন, এর একটা স্টেটমেন্ট নিন তো, মনে হচ্ছে সিরিয়াস কেস৷ তা সেই অফিসার আমাকে আর-একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে বলল, ধুস, একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে বোধহয়। বলে নামধাম নিয়ে ছেড়ে দিল।
তখন কটা বাজে?
তা তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে।
গেট ততক্ষণ খোলা ছিল?
তালা ছিল না। তবে ফটকে আগল দিয়ে গিয়েছিলাম।
দিদিমণি যে খুন হয়েছে তা কখন বুঝলে?
সাড়ে চারটে নাগাদ ভিখু এসে বলল।
কী করলে তখন?
খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমরা গরিব মানুষ স্যার, বিশেষ লেখাপড়াও জানি না, কী থেকে কী হয় ভেবে আমরা সহজেই ভয় পাই। একবার তো ভেবেছিলাম পালিয়ে যাব। তারপর মনে হল হিতে বিপরীত হবে। তাই পুলিশে খবর দিই। পুলিশ স্যার, আমাদেরই ধরে নিয়ে গেল। তারপর অনেক জল ঘোলা হওয়ার পর সতুবাবু গিয়ে ছাড়িয়ে আনেন।
দিদিমণি কীভাবে খুন হয়েছেন জানো?
কেউ গলা টিপে খুন করে গেছে। যে গলা টিপেছে তার হাতে নাকি দস্তানা ছিল।
ঠিক কথা। আর কিছু বলতে পারো?
কী বলব স্যার?
তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়?
না স্যার, কাকে সন্দেহ করব?
দিদিমণি খুন হওয়ার আগে এ-বাড়ির সামনে দিয়ে কোনও একজন বা দু’জন লোককে বারবার যাতায়াত করতে দেখেছ? কিংবা কোনও অচেনা লোক কি গায়ে পড়ে তোমার সঙ্গে আলাপ জমাতে চেয়েছে?
এ তো বড়লোকদের পাড়া স্যার। লোকের যাতায়াত কম, তবে আমি বেকার বসে থাকি বলে আশপাশের বাড়ির চাকর দারোয়ানরা মাঝে মাঝে এসে গল্পটল্প করে যায়।
অচেনা কেউ?
না স্যার, মনে পড়ছে না। গেটের কাছে টুলে বসে থাকলে অবশ্য অনেকে বাড়ির হদিশ চায়, এত নম্বর বাড়িটা কোনদিকে হবে এইসব।
ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো। সতুবাবু একটু বাদেই আসবেন। তিনি এলেই সোজা আমার কাছে নিয়ে এসো।
ঠিক আছে স্যার। ভিখুকে কি আপনার জন্য চা করতে বলব স্যার?
বলতে পারো।
বলরাম চলে যাওয়ার পর শবর ঘুরে ঘুরে বাড়ির দোতলাটা দেখছিল। ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে। দারুণ সুন্দর সব রঙের কম্বিনেশন। বাথরুমে খুব আধুনিক ফিটিংস লাগানো। প্রতি ঘরেই নানারকম সাবেকি আসবাব। দুই আলমারি বোঝাই বিলিতি আর জাপানি পুতুল। পিয়ানো, অর্গান ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র রাখা প্রকাণ্ড হলঘরে। বিশাল বিশাল ঝাড়বাতি। অথচ এ বাড়িতে থাকার লোকই নেই। অন্তত বিগত চল্লিশ বছর ধরে বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ সতুবাবু বিশাল গাড়ি করে এলেন। বছর পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশের ফরসা নাদুশনুদুশ মানুষ। মোটা গোঁফ আছে। পরনে প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট।
নমস্কার মিস্টার দাশগুপ্ত।
আসুন।
আপনার তদন্ত কতদূর?
চলছে।
আমার কাছে কী জানতে চান বলুন।
এবাড়ির ওয়ারিশান কে?
বাড়ির ওয়ারিশান এখন সুব্রত। স্বাভাবিক আইনে।
এবাড়ি কি বিক্রি হওয়ার কথা চলছিল?
হ্যাঁ, অরুর তো সেরকমই ইচ্ছে ছিল। কলকাতার পাট তুলে দেবে বলেছিল।
সুব্রতবাবুরও কি তাই ইচ্ছে?
সুব্রতর বোধহয় একটু অমত আছে।অরুণিমা বলছিল সুব্রত এরকম প্রস্তাবে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
কোনও কারণ আছে?
তা জানি না।
সুব্রতবাবুদের এখানকার বাড়ির অবস্থা কেমন?
মুখটা একটু বিকৃত করে সতুবাবু বললেন, অবস্থা আবার কেমন হবে? ছিল তো বনগাঁর রিফিউজি ক্যাম্পে। তারপর বিধানপল্লিতে কোনওরকমে টিনের ঘর করে থাকত। এখন অবশ্য পাকা ঘর হয়েছে শুনেছি, তা তারও অনেক ভাগীদার। ওর কাকা-জ্যাঠাদেরও নাকি ও বাড়ির শেয়ার আছে। সুব্রতর বাবা তো চিরকালের ভ্যাগাবন্ড। কোন একটা কো অপারেটিভে সামান্য বেতনের চাকরি করত। ভাগ্য ভাল ছেলেটা হল ব্রিলিয়ান্ট। সেই জোরেই আমেরিকা গেল। এই তো ওদের হিস্ট্রি। এখন বুঝে নিন।
অরুণিমা দেবী আর সুব্রতবাবুর কি লাভ ম্যারেজ?
হ্যাঁ মশাই, নইলে মনাকাকা কখনও এই পরিবারে মেয়ের বিয়ে দেয়? তবে সুব্রত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে বলে কাকা আপত্তি করেননি।
ওদের দাম্পত্য সম্পর্ক কেমন ছিল জানেন?
আগে তো ভালই ছিল। ইদানীং অরু কিছু অনুযোগ করছিল।
কীরকম অনুযোগ?
এমনিতে কংক্রিট কিছু নয়। অরু চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিল। তবে নানা কথায় দু’-একটা মন্তব্য করে ফেলত।
ওঁদের সন্তানহীনতাই কি তার জন্য দায়ী?
না মশাই, সন্তানের জন্য দুঃখ সে তো থাকতেই পারে। তাতে কি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়?
হয়। সন্তান একটা মস্ত বড় ফ্যাক্টর।
মানছি। কিন্তু ওদের সম্পর্কটা খারাপ হয়ে থাকলে হয়েছে অন্য কারণে।
সেই কারণটা কী?
জানি না।
মিসেস বকশি আপনার খুড়তুতো বোন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনার কাকার অবস্থা তো খুবই ভাল ছিল দেখছি।
আমরা ব্যবসায়ী পরিবার। মনাকাকার তো জাহাজ ছিল। সেসব অনেক ব্যাপার।
এ বাড়িটা কি আপনার মনাকাকাই করেছিলেন?
না। আমার দাদুর তৈরি বাড়ি। চার ছেলের জন্য চার জায়গায় উনি বাড়ি করে রেখে গেছেন।
সবকটা বাড়িই এরকম ভাল?
বড়কাকার আলিপুরের বাড়িটা আরও ভাল।
এ বাড়ি কি বিক্রি ঠিক হয়ে গেছে?
সবই তো পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার সব কেঁচে যাবে বলে মনে হয়। এখন তো অরু নেই, সুব্রত মালিক। সে রাজি না হলে বিক্রি আটকে যাবে।
উনি কি বিক্রি করতে রাজি নন?
আমার সঙ্গে কথা হয়নি। কিন্তু অরুর কাছে যা শুনেছি তাতে মনে হয় সুব্রত রাজি হবে না।
দারোয়ান আর চাকর দু’জনেই বলেছে যে, সুব্রতবাবু নাকি এ বাড়িতে আসতেন না।
ঠিকই বলেছে। কলকাতায় এলে সুব্রত ওদের কলোনির বাড়িতেই থাকত। অরুণিমা থাকত এ বাড়িতে। তবে ওরা কেউই এখানে এসে বেশিদিন থাকত না। বড়জোর পনেরো কুড়ি দিন।
অরুণিমা দেবীর জন্ম তো আমেরিকায়। আপনাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন কী করে?
আমাদের পরিবারের অনেকেই বিদেশে আছে। আমি নিজে বেশ কয়েক বছর আমেরিকায় ছিলাম। তখন অরু ছোট। আমি ওর নিজের দাদার চেয়েও বেশি ছিলাম।
খুনের খবরটা আপনি কখন পান?
সেইদিনই বিকেলে। ভিখু ফোন করে আমায় জানায়।
আপনার নিজের কোনও ডিডাকশন আছে কি?
মাথা নেড়ে সতুবাবু বললেন, না মশাই, এ একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত। অরুকে কে কেন খুন করবে তা আমি আজ অবধি বুঝে উঠতে পারিনি। মিহির বলে ছোরাটারই বা কী স্বার্থ ওকে খুন করার তাও জানি না।
মিহিরের সঙ্গে অরুণিমা দেবীর সম্পর্কটা কীরকম ছিল, জানেন?
একেবারে জানি না বললে ভুল হবে। ঘাসে মুখ দিয়ে তো চলি না। অরুণিমা ওর প্রতি সট ছিল।
আপনার কাছে অরুণিমা কিছু বলেছেন কি?
খুব পরিষ্কার করে নয়।
উনি কি সুব্রতবাবুকে ডিভোর্স করার কথা ভাবছিলেন?
আমাকে খুলে কিন্তু বলেনি। তবে অরুর হাবভাব দেখে মনে হয় সুব্রতর প্রতি ওর আর তেমন টান নেই।
তার জন্য মিহিরবাবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই কি দায়ী?
তাও জানি না মশাই।
সুব্রতবাবুকে আপনার কেমন লোক বলে মনে হয়? সতুবাবুর মুখটা ফের বিকৃত হল। তারপর একটু হেসে বলল, কিছু মনে করবেন না মশাই, নিজের মুখেই বলছি উই আর ভেরি রিচ পিপল। বনেদি বড়লোক। সুব্রতরা হল এ ক্লাস অ্যাপার্ট, সুব্রত নিজের যোগ্যতায় ওপরে উঠেছে বটে, কিন্তু ওদের কালচার আর রুচি তো সেই নিম্নমধ্যবিত্তই রয়ে গেছে। ওদের টাকা হলে লোক দেখানো বড়লোকি করতে থাকে। বনেদি পরিবার অন্যরকম হয়। সুব্রতকে অরুর সঙ্গে আমার মিসফিট বলেই মনে হয়েছে।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু সুব্রতবাবু লোকটি কেমন?
মাপ করবেন, আমি জানি না। দু-চারবার দেখা হয়েছে, হেসে দু-চারটে কথাও কয়েছে, কিন্তু ওকে স্টাডি করিনি কখনও।
অরুণিমা দেবীও কি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী ছিলেন?
হ্যাঁ, ওদেশে স্কুলে কলেজে ওর স্কোর দুর্দান্ত। যে জাপানি কোম্পানিতে ওরা দু’জনে কাজ করে তাতে অরুর পজিশনই বেটার।
দু’জনের মধ্যে কি প্রফেশনাল জেলাসি ছিল?
কী জানি, অত জানি না।
সুব্রতবাবুর এক বোন এখন আমেরিকায় আছে, জানেন?
জানি মশাই, জনা, শুটকি মেয়েটার বোধহয় এখানে বর জুটছিল না তাই সুব্রত ওকে নিয়ে গিয়েছে। মার্কিন গন্ধ মাখিয়ে পাত্রস্থ করবে।
শুনেছি মেয়েটা লেখাপড়ায় ভাল।
তা হতে পারে। অরু তো ওকে দু’চক্ষে দেখতে পারত না।
কেন?
বলত খুব ন্যাকা টাইপের মেয়ে, ভাবুক ভাবুক ভাব করে থাকে। আসলে ভিজে বেড়াল।
আপনি নিম্নমধ্যবিত্তদের খুব ঘেন্না করেন, না?
এবার সতুবাবু তটস্থ হয়ে হেসে ফেললেন, আরে না মশাই, ঘেন্না করব কেন? সমাজের নানা স্তর তো থাকবেই, নইলে সমাজ বলেছে কেন? আসলে কালচার ক্রস হলেই প্রবলেম দেখা দেয়। অরুর ক্ষেত্রে যা ঘটেছে। মানুষকে তো ঘেন্না করার কিছু নেই।
শুনে স্বস্তি পেলাম।