একাদশ পরিচ্ছেদ : সাধুতার ভাণ
সেইদিনেই দেবেন্দ্রবিজয়কে সঙ্গে লইয়া অরিন্দম রেবতীর কাকার সহিত সাক্ষাৎ করিতে বেণীমাধবপুর যাত্রা করিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় গোপালচন্দ্রের বাড়ী চিনিতেন। উভয়ে তাঁহার বহির্ব্বাটীতে গিয়া বসিলেন, এবং একজন ভৃত্যকে দিয়া গোপালচন্দ্রের নিকটে সংবাদ পাঠাইয়া দিলেন। গোপালচন্দ্ৰ অন্তঃপুরে ছিলেন;সংবাদ পাইয়া বাহিরে আসিলেন। এবং উভয়কেই মিষ্ট সম্ভাষণে পরিতুষ্ট করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে তাঁহার কুশলাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন।
গোপালচন্দ্রের বয়স হইয়াছে—বয়স আটচল্লিশের কম নহে—বর্ণ গৌর—দেহ স্থূল। উদরটি অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অপেক্ষা দশগুণ স্থূল; যেন সেসকলের সহিত সেটি ঠিক খাপ খায় না। মাথার চুল খুব ছোট করিয়া ছাঁটা, শ্মশ্রুগুম্ফ একেবারে নাই। নাই থাকুক্, মাথায় টাক আছে, তাহার পাশেই দীর্ঘ অকফলা আছে, গলায় হরিনামের মালা আছে, প্রকাণ্ড ভুঁড়ি আছে, এবং তাহার সেই বিপুল দেহের চারিভিতে ছোটবড় অনেক রকমের হরিনামের ছাপ আছে।
গোপালচন্দ্র অরিন্দমকে বলিলেন, “মহাশয়, আপনি দেবেন্দ্রবাবুর মুখে আমার দুরদৃষ্টের সকল কথা বোধ হয়, শুনিয়াছেন। আহা! রেবতী মা আমার—কাকা বলতে অজ্ঞান হ’ত! আর রোহিনি- সে ত আমার ঘাড়ে-পিঠে মানুষ হয়েছে—একদণ্ড আমার কাছ ছাড়া হ’ত না। হায়, হায়, মানুষের এমন সৰ্ব্বনাশ হয়! না জানি, পূৰ্ব্বজন্মে কি মহাপাতকই করেছিলেম, হরি হে—রাধাগোবিন্দ! রাধাগোবিন্দ!”
অরিন্দম বলিলেন, “বড়ই দুঃখের বিষয়, আপনার ন্যায় মহাত্মা, লোকের এমন বিপদ্ হয়! দেখি, মহাশয়ের আশীর্ব্বাদে যদি আমি মহাশয়ের কোন উপকারে আসিতে পারি। এখন মহাশয় যদি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে এ কাজে নিযুক্ত করেন।”
গোপালচন্দ্র বলিলেন, “এ আবার নিযুক্ত কি? আপনাকে সেইজন্য ত আহ্বান করা হয়েছে।”
অরিন্দম বলিলেন, “তাহা হইলে আমি আপনার কার্য্যোদ্ধার করিলে কিরূপ পারিশ্রমিক পাইব, তাহার একটা বন্দোবস্ত করিয়া একখানি স্বীকার পত্র লিখিয়া দিন।”
গো। ইহার জন্য আবার স্বীকার-পত্র কি আপনি যাহা চাহিবেন, আমি আনন্দের সহিত তৎক্ষণাৎ তাহা দিব। যাতে আপনি সুখী হ’ন্, তা’ আমি করিব, সে আমার কর্তব্য;যদি স্বর্বস্ব খোয়াইয়া তাদের দুটিকে পাই, তাতেও আমার বুক দশ হাত হইবে।
অরিন্দম বলিলেন, অবশ্যই মনে মনে, “আর তাদের দুটিকে না পেলে উদরটি যে আরও স্ফীত হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।” প্রকাশ্যে বলিলেন, “একটা লেখাপড়া না থাকিলে কি করিয়া চলিবে? সেজন্য আপনি এত ‘কিন্তু’, হইতেছেন কেন, বুঝিতে পারিলাম না। “
গো। না—না, ‘কিন্তু’ হইব কেন, আমি এখনই লিখিয়া দিতেছি। কি লিখিতে হইবে, আর কত টাকা হইলে আপনি সন্তুষ্ট হইবেন, বলুন?
অরি। একশত হইলে ঠিক হয় না?
গো। একশত! আমি আপনাকে পাঁচশত টাকা দিব।
অরিন্দম মনে মনে হাসিলেন। বলিলেন, “মহাশয়ের হৃদয় যথেষ্ট উদার। যাই হ’ক্, আমি আপনার জন্য আরও উৎসাহের সহিত কাজ করিব।”
গো। কি লিখিতে হইবে?
অরি। বেশী কিছু লিখিতে হইবে না; লিখিয়া দিন, আপনার কার্য্যোদ্ধার হইলে আমাকে পাঁচশত টাকা দিবেন। আর আপনার নামটি সহি করিয়া দিন।
গোপালচন্দ্র সেই মর্ম্মে একখানি অঙ্গীকারপত্র লিখিয়া নিজের নাম স্বাক্ষর করিলেন, এবং সেখানি অরিন্দমের হাতে দিলেন।
অরিন্দম “ইহাই যথেষ্ট”, বলিয়া সেখানি অবিলম্বে পকেটস্থ করিলেন। বলিলেন, “তবে এখন হইতেই কাজ আরম্ভ করা যাক্। মহাশয়, প্রথমে আপনার বাড়ীখানা আমি একবার অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে চাই।”
গোপালচন্দ্র হো হো হো করিয়া উচ্চশব্দে হাসিয়া উঠিলেন। হাসির বেগ মন্দীভূত হইলে বলিলেন, “তবেই হয়েছে, আপনার মত বুদ্ধিমান্ লোকের দ্বারা আমার যে উপকার হ’বে, তা’ আমি দিব্যচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি! এ বাড়িতে অনুসন্ধান করে কি হবে? এখানে অনুসন্ধান ক’রে তাদের কোন সন্ধানই পাবেন না। তারা কি এতদিন বাড়ীর ভিতরে লুকিয়ে ব’সে আছে!”
অরিন্দম বলিলেন, “তাদের সন্ধান না পাই, তাদের যাতে সন্ধান করতে পারি, এমন কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে; সেজন্য বলিতেছি, তাহাতে আপনার আপত্তি কি।”
গোপালচন্দ্র বলিলেন, “আপত্তি কি—আর কিছুই না, তবে বাজে কাজে অনর্থক একটা হাঙ্গামা করা।”
অরিন্দম বলিলেন, “হাঙ্গামার কিছুই নয়। আমি আপনার বাড়ীর সকল ঘর অনুসন্ধান করিতে চাই না, বাড়ীর মেয়েদের না সরালেও চলে। আমি একবার কেবল বাড়ীর চারিদিক্টা দেখতে চাই। এতে আর হাঙ্গামা কি?”
গোপালচন্দ্র বলিলেন, “না, এতে আর হাঙ্গামা কি, তবে এ দেখায় যে কি ফল হবে, বুঝলেম না।”
অরিন্দম বলিলেন, “না, সেটা এখন আপনার বোঝবার কোন দরকার নাই।”
“তবে আমি একবার বাড়ীর ভিতর হ’য়ে আসি”, বলিয়া গোপালচন্দ্র নিজে স্থূল দেহভার বহন করিয়া মন্থরগতিতে অন্তঃপুর মধ্যে প্রবেশ করিলেন। এবং অনতিবিলম্বে ফিরিয়া আসিয়া অরিন্দমকে বলিলেন, “আসুন, মহাশয়।”
সকলে উঠিয়া ভিতর বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন।