সপ্তম পরিচ্ছেদ : নূতন প্ৰক্ৰিয়া
দেবেন্দ্রবিজয় নীচে নামিয়া গেলেন। এবং সোপানের পার্শ্ববর্ত্তী একটি অন্ধকারময় ঘরে নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন! অল্পক্ষণ পরেই বাহিরে একটা কি শব্দ হইল। দেবেন্দ্রবিজয় সেই ঘরের কবাটের ফাক দিয়া দেখিলেন, বৈঠকখানা ঘরের রাস্তার দিক্কার একটা জানালা দিয়া এক-একজন বিকটাকার দস্যু প্রবেশ করিতেছে;এবং একজন দুইহস্তে গবাক্ষের লোহার গরাদ দুইটি ফাঁক করিয়া ধরিয়া রহিয়াছে। অন্ধকারে কাহারও মুখ স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন না; কিন্তু তাহারা যে ফুলসাহেবের দল-বল, তাহাতে আর দেবেন্দ্রবিজয়ের তিলমাত্র সন্দেহ রহিল না।
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, নিঃশব্দে অনেকগুলি লোক উঠানে গিয়া দাঁড়াইল। এমন সময়ে তাহাদের ভিতর হইতে একজন লোক একবার একটা দিয়াশলাই জ্বালিয়া সকলে আসিয়াছে কি না, গণনা করিয়া দেখিল। সে গণনাকারী স্বয়ং ফুলসাহেব। সেই অবসরে দেবেন্দ্রবিজয়ও একবার তাহাদিগের গণনা করিয়া লইলেন। মোটের উপরে তাহারা তেরোজন। সকলের হাতে এক-একখানা তীক্ষ্ণধার কিরীচ।
তাহার পর তাহারা অন্ধকারে ধীরে ধীরে সোপানারোহণ আরম্ভ করিল। নিঃশব্দে—কাহারও মুখে কোন কথা নাই। দেবেন্দ্রবিজয় দেখিয়া ভীত হইলেন; যদি ইলেকট্রীক্ ব্যাটারী এ সময়ে কোন কাজ না করে, তাহা হইলে এখনই যে ভয়ানক ঘটনা ঘটিবে, তাহা ভাবিতেও ভয় হয়। এ সময়ে তাহারা সকলেই মরিয়া—প্রাণের ভয় ভুলিয়া গিয়াছে। তাহাদিগের সকলেই যখন সিঁড়ির উপরে উঠিয়াছে, তখন দেবেন্দ্রবিজয় সেই ইলেকট্রীক্ ব্যাটারীর দড়ি সজোরে টানিয়া ধরিলেন।
তখনই চক্ষুর নিমেষে কী ভয়ানক!
তখনই দস্যুদলের আর্তনাদে, চীৎকারে তর্জ্জনে-গৰ্জ্জনে, গালাগালিতে সমস্ত বাড়ীখানা যেন ভাঙিয়া পড়িবার মত হইল। তখনকার ব্যাপার বর্ণনায় পাঠকের ঠিক হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দেওয়া আমার সাধ্যাতীত। পাঠক, পারেন যদি অশ্বশালায় অগ্নিসংযোগের কল্পনা করিতে একবার চেষ্টা করুন, অনেকটা সেই রকমের। অবশ্যই সেই দহ্যমান অশ্বশালায় অনেকগুলি অশ্ব আছে।
এমন সময়ে অরিন্দম একটা লণ্ঠন হাতে বাহিরে আসিলেন। এবং সেই সোপানের উপরে দাঁড়াইয়া হাসিমুখে সেই অপূৰ্ব্ব দৃশ্য দেখিতে লাগিলেন। আর নীচে দেবেন্দ্রবিজয় ভিত্তিগাত্রে পৃষ্ঠস্থাপন করিয়া হাসিয়া হতজ্ঞান হইতেছেন।
কী সুন্দর দৃশ্য—সিঁড়ির উপর হইতে নীচে পর্য্যন্ত তেরোজন সারি-সারি দাঁড়াইয়া! তর্জ্জন গৰ্জ্জনের ত কথাই নাই—তাহার পরে তাহাদের কী চমৎকার মুখভঙ্গি! যন্ত্রণায় কেহ নৃত্য করিতেছে, কেহ সেই উদ্যোগে আছে, এবং কেহ রেলিং হইতে হাত ছাড়াইয়া লইবার জন্য মুখ বিকৃত করিয়া লাফাইতে আরম্ভ করিয়াছে। কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারিতেছে না। যাহার যেখানে সেই ইলেকট্রীক ব্যাটারীর সংস্পর্শ হইয়াছে, দেহ হইতে সেই অঙ্গটি যেন ছিঁড়িয়া উঠিয়া যাইতেছে।
ডাক্তার ফুলসাহেব সিঁড়ির উপরের শেষ সীমায় অরিন্দমের সম্মুখে দাঁড়াইয়া; যদিও তাহার মুখে চীৎকার, গোঙানি কি কোন যন্ত্রণাসূচক ধ্বনি ছিল না, তপাপি তাহার মুখের ভাব এবং দেহের সুদৃঢ় মাংসপেশীগুলি যেরূপ স্ফীত হইয়া উঠিতেছিল, তাহা দেখিয়া তাহার ভীষণ যন্ত্রণা বেশ অনুভব করা যায়।
অরিন্দম মৃদুহাস্যে বলিলেন, “ডাক্তারবাবু, ভাল আছেন ত? অনেক দিনের পর একেবারে সবান্ধবে শুভাগমন করেছেন, এ আমার পরম সৌভাগ্যের কথা; বোধহয়, আপনাদের অভ্যর্থনার আয়োজনটা ঠিকই করা হয়েছে—কোন ত্রুটি হয় নাই—কি বলেন?”
ফুলসাহেব কোন উত্তর করিল না;অপর দিকে মুখ ফিরাইয়া রহিল। অরিন্দম বলিলেন, “আগে আপনার বুন্ধুদের মুক্তি দিই, তারপর সকলের শেষে আপনার মুক্তিলাভ হবে।” এই বলিয়া অরিন্দম রাশীকৃত হাতকড়ি লইয়া নীচে নামিয়া গেলেন। তাঁহার হাতে রাবারের দস্তানা ও পায়ে রাবারের জুতা থাকায় ব্যাটারীতে তাঁহার কিছুই হইল না।
অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়কে কতকগুলি হাতকড়ি দিলেন; এবং দুইজনে মিলিয়া দস্যুদের হাতে হাতকড়া লাগাইতে আরম্ভ করিলেন। ক্রমে বারোজন এইরূপে বন্দী হইল—বাকি ফুলসাহেব