ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : গুপ্তদ্বার
রাত্রি এগারোটার পূর্ব্বে অরিন্দম ও দেবেন্দ্রবিজয় আহারাদি শেষ করিলেন। এবং সম্মুখ দ্বার অর্গলাবদ্ধ করিয়া, দ্বিতলের একটা ঘরে বসিয়া উভয়ে দাবা খেলা আরম্ভ করিয়া দিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় খেলিতে খেলিতে বারংবার অন্যমনস্ক হইয়া পড়িতেছিলেন। এক-একবার মনটা খেলা হইতে সরিয়া গিয়া ফুলসাহেবের পদধ্বনি শুনিবার জন্য ব্যাকুল হইতেছিল, এবং ফুলসাহেবের দলবলের লোকগুলির ভীষণ চেহারা কল্পনা করিতে চেষ্টা করিতেছিল; কিন্তু অরিন্দম অত্যন্ত মনোযোগের সহিত খেলিতেছিলেন, সুতরাং বাজী জিতিতেছিলেন। মাথার উপরে যে এতবড় একটা বিপদ্, জীবন ও মৃত্যুর এবং ছুরি ও রক্তের একটা সংগ্রামাভিনয় যে আসন্ন, তথাপি সেজন্য তাঁহার মুখে উদ্বেগ, আশঙ্কা অথবা চিন্তার চিহ্ন পর্যন্ত নাই।
রাত্রি দুইটার সময়ে খেলা বন্ধ হইল। অরিন্দম বলিলেন, “এইবার তাদের আবার সময় হ’য়েছে। একঘণ্টার মধ্যেই তাদের শুভাগমন হবে; আমরা দুইজনে মিলিয়া এখন হ’তে তাদের অভ্যর্থনা করবার বন্দোবস্ত করি, এস।”
দেবেন্দ্র। আমি কোথায় থাকব, বলুন দেখি?
অরি। নীচে, সিঁড়ির পাশের ঘরটায় এখন তোমাকে থাকতে হবে। যাবার সময়ে রাবারের জুতা আর দস্তানা প’রে যাবে। সেগুলি এত মোটা রাবারের তৈয়ারী যে, ইলেকট্রীক তারে কিছুই করতে পারবে না।
এই বলিয়া অরিন্দম দুই জোড়া রাবারের জুতা ও দস্তানা লইয়া আসিলেন। উভয়ে সেইগুলি লইয়া হাতে পায়ে পরিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “নীচের ঘরে গিয়ে আমায় কি করতে হবে?”
অরিন্দম বলিলেন, “সেই ঘরের দক্ষিণ কোণে দেখবে, একটি দড়ি ঝুলছে; যখন দেখবে যে, তেরোজন লোক সিঁড়ির উপরে উঠেছে, তখন সেই দড়িটি টেনে ধরবে। তার পর যা’ করতে হয়, আমি করব।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হয়ত তেরোজনের একজন বাহিরে পাহারা দিতে পারে।”
অ। তাদের পাহারা দিবার আরও লোক আছে, সে কাজ জুমেলিয়া বেশ পারবে। জুমেলিয়ার উপরে ফুলসাহেব যথেষ্ট নির্ভর ক’রে থাকে।
দে। তা’ হ’লেও তেরোজন কি একসঙ্গে উপরে উঠবে?
অ। তেরোজনই উঠবে। ফুলসাহেব যে প্রকৃতির লোক, তাতে যে সে চোরের মত চুপি চুপি, ভয়ে ভয়ে কোন কাজ করবে বোধ হয় না; এমন বীরত্বের অভিনয়টা সে কখনই একেবারে মাটি ক’রে ফেলবে না। একেবারে সকলকে সঙ্গে নিয়ে, আমার শয়নগৃহে গিয়া বিছানার চারিদিক্ থেকে তেরোখানা ছুরি একসঙ্গে আমার বুকে বসিয়ে যাতে এ বীরত্বের অভিনয়টা সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হয়, বরং সে সেই চেষ্টা করবে, আমার ত এইরূপ অনুমান;তার পর তার মনে আর কি আছে, সেই জানে। তা’ সে যাহাই মনে ক’রে আসুক, একবার এলে আর ফিরে যেতে হবে না। এই গোয়েন্দাগিরি কাজ বড় শক্ত, দেবেন্দ্রবাবু; যেখানে একটু সন্দেহের ছায়া আছে, সেই সন্দেহকে সত্যের আসনে বসিয়ে, সেখানে আমাদের এক প্রকাণ্ড আয়োজন ঠিক করে রাখতে হয়। তোমার যেরূপ উৎসাহ দেখছি, কিছুদিন আমার সঙ্গে থাকলে তুমি একজন বড় ডিটেক্টিভ হ’তে পারবে। তোমার কিছু কিছু ডাক্তারী জানা আছে, এ-কাজে ডাক্তারী শিক্ষাটাও সময়ে সময়ে উপকারে আসে।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কিন্তু ডাক্তারীর মত এ-কাজটা তেমন মান্য নহে। বিশেষতঃ ডাক্তারীগিরি অনেক লোকের অনেক উপকারে আসে—এমনকি, কত লোককে আসন্ন মৃত্যুর হাত হ’তে উদ্ধার করাও হয়।”
অরিন্দম বলিলেন, “তোমার এ-কথার উত্তরে আমাকে অনেক কথা বলতে হয়; গোয়েন্দাগিরিতে ডাক্তারী অপেক্ষা সহস্রগুণে লোকের উপকার করা হয়। এই গোয়েন্দাগিরি কত ধন-প্রাণে মরণাপন্ন ব্যক্তির ধন ও প্রাণ ফিরিয়ে এনে তার অবসন্ন দেহে নূতন জীবনসঞ্চার করে। গোয়েন্দাগিরি অপহৃত স্নেহের নিধি সন্তানে শোকাতুর পিতামাতার শূন্যক্রোড় পরিপূর্ণ করে। এই গোয়েন্দাগিরি দস্যুর হাত থেকে, খুনীর হাত থেকে কত নিরবলম্বন শিশুর পিতা ও কত অভাগিনী স্ত্রী-স্বামীকে উদ্ধার ক’রে থাকে, তাতে কি পরোপকারের কিছুই নাই? কেবল পণ্ডশ্রম? বোধ করি, কোন ডাক্তারকে পরোপকারের জন্য গোয়েন্দাদিগের মত শ্রম স্বীকার করতে হ’লে, ডাক্তারী বিদ্যাটি মস্তিষ্ক হ’তে শীঘ্র বহিষ্কৃত ক’রে ফেলার জন্য স্মৃতিনাশক কোন আশুফলপ্রদ নূতন ঔষধের আবিষ্কার করতে তিনি সচেষ্ট হ’য়ে উঠতেন। কতক বা কৌতূহল, কতক বা দয়া, কতক বা রোষপরবশ হ’য়ে ডিটেক্টভেরা শরণাপন্নের যেসকল ভয়ানক ভয়ানক বিপদ্ নিজের মাথায় নিয়ে নিজের অসহায় প্রাণটাকে খুনীদের ছুরির নীচে স্বচ্ছন্দে যেমন ছেড়ে দেয়, আর কেহ তেমন পারে, বল দেখি? তথাপি এদেশের লোকেরা ডিটেটিভদের সম্মান করে না। তা’ তাদের দোষ নয়, আমাদেরই অদৃষ্টের দোষ; নতুবা ইংলন্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকার ডিটেক্টিভেরা যেরূপ সম্মানিত হ’য়ে থাকে, এবং আবালবৃদ্ধবনিতার এমন একটা শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে যে, সেখানকার বিচারপতিদিগের অদৃষ্টেও তেমনটি ঘটে না। যদিও আমার মুখে এসকল কথাগুলো ভাল শোনায় না—সম্পূর্ণ আত্মশ্লাগা প্রকাশ পায়; কিন্তু যখন অবসরে এক-একবার নিজেদের কথাগুলি ভাবি, তখন মনে যেমন দুঃখ হয়, তেমনি নিজেদের জীবনের প্রতি একটা ঘৃণাও জন্মে। আমরা অপরের জন্য দেহপাত ও প্রাণপাত করিতে প্রস্তুত, কিন্তু অপরে সেটা স্বীকার করিতে সম্পূর্ণ অসম্মত এবং একটু সম্মান দেখাতে একেবারে অপ্রস্তুত। আমরা যদি তাহাদের দুই চক্ষে অঙ্গুলি দিয়া দেখাইয়া দিই, আমরা পরের জন্য জন্মিয়াছি এবং পরের জন্য বাঁচিয়া আছি; এবং যখন মরিতে হইবে, পরের জন্যই মরিব;তথাপি তাহারা কিছুতেই বুঝিবে না! বোধ করি, বাংলাদেশের ডিটেকটিভশ্রেণীর উপরে বিধাতার একটা অমোঘ অভিসম্পাত আছে। যাক্, সে সকল কথা এখন থাক্, তুমি নীচে যাও। ফুলসাহেবের আসার সময় হ’য়ে এসেছে।”