Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মায়াবী || Panchkari Dey » Page 72

মায়াবী || Panchkari Dey

ফুলসাহেব বলিল, “তোমাদের সকলেই সেই অরিন্দমের হাতে কোন-না কোন রকমে লাঞ্ছিত হয়েছ। তোমরা যদি তাহার প্রতিশোধের কোন চেষ্টা না কর, ইহার অপেক্ষা কাপুরষতা আর কি হইতে পারে? দুই নম্বর কে? আমার সামনে এসে দাঁড়াও।”

দলের ভিতর হইতে তালগাছের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের ন্যায় একটি লোক উঠিয়া ফুলসাহেবের সম্মুখে দাঁড়াইল।। লোকাট অসম্ভব লম্বা, তেমন দীর্ঘ দেহ বড়-একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। মুখখানা দেখিয়া আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের কথা স্বতই মনে পড়ে।

ফুলসাহেব তাহাকে কর্তৃত্বের স্বরে প্রশ্ন করিল, “অরিন্দম তোমার কি করিয়াছে?

২নং। আমার বাঁ হাত ভেঙে দিয়েছে।

ফুল। কিরূপে হাতটা ভাঙলে?

২নং। অরিন্দমের সঙ্গে আমার একদিন হাতাহাতি হয়; শেষে বেটা আমার হাতটা ধ’রে কব্জীর কাছটায় এমন মুচড়ে দিলে যে, হাতটা কেটে বাদ দিতে হ’ল।

ফুল। বটে! তবে তার উপরে তোমার খুবই রাগ থাকতে পারে?

২নং। সে কথা আর একবার করে বলতে? বেটাকে একবার সুবিধায় পেলে মাথাটা চিবিয়ে খাই, তবে রাগ কতকটা যায়।

ফুল। আচ্ছা তুমি বসো। এর মধ্যে তিন নম্বর কে?

“আমি”, বলিয়া একটি লোক দুই নম্বরের স্থান অধিকার করিয়া দাঁড়াইল। দুঃখের বিষয় দুই নম্বরের সমুদয় স্থানটি অধিকার করা তাহার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠিল না। অন্যান্য দিকে যাহাই হউক, ঊর্ধ্বের অনেকটা স্থান খালি রহিয়া গেল। লোকটা লম্বায় দুই নম্বরের যেন সিকিখানা, কিন্তু প্রস্থে খুব স্ফীত। ওজনে বরং চতুর্গুণ হইবার সম্ভাবনাই অধিক। মুখানি এমন বখত্, যেন একটা অতি বিরক্তিকর, অতি-বিকৃতভঙ্গি মুখের উপর জমাট বাঁধিয়া চির-অবস্থিতির একটা পাকা বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া লইয়াছে।

ফুলসাহেব তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “অরিন্দম তোমার কি ক্ষতি করেছে?”

সে লোকটা নিজের ভগ্ন নাসিকা অঙ্গুলি-নির্দেশে দেখাইল। সত্যই বেচারার নাসিকাটি একেবারে ভিতরে বসিয়া গিয়াছে।

ফু। ব্যাপার কি?

৩নং। এই নাকের শোধ তুল—তবে ছাড়ব।

ফু। তুমি নাকের বদলে তার নাকটা চাও, কেন?

৩নং। আমার নাকের বদলে আমি তার প্রাণটা চাই।

ফু। আচ্ছা, তুমি যাও—চার নম্বরের কে আছে হে?

দলের ভিতর হইতে একটি বিশ্রী চেহারার লোক খোঁড়াইতে খোঁড়ইতে আসিয়া ফুলসাহেবের সম্মুখে দাঁড়াইল।

ফু। তোমার কি হইয়াছে?

৪নং। আমার পা ভেঙে দিয়েছে। এ পায়ের শোধ আমি না নিয়ে ছাড়ব না।

ফু। পাঁচের নম্বর কে?

৫নং। আমি।

ফু। তোমার ঘটনা কি, বল?

সে লোকটা নিজের দক্ষিণ হস্ত ফুলসাহেবের সম্মুখে তুলিয়া ধরিল। একমাত্র বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ছাড়া সে হাতে আর কোন অঙ্গুলি বিদ্যমান ছিল না।

ফুলসাহেব বলিল, “কি ক’রে অরিন্দম একবারে তোমার চার-চারটে আঙুল ভেঙে দিলে?”

৫নং। পিস্তলের গুলিতে। যেমন আমি তাকে ঘুসি তুলে ছুটে মারতে যাব সে দূরে থেকে এমন একটা গুলি দাগ্‌লে যে, আমার ঘুসির আধখানা চোখের নিমেষে কোথায় উড়িয়ে দিলে, খোঁজ হ’ল না।

ফু। নম্বর ছয়, উঠে এস।

৬ নম্বরের প্রাণীটি সম্মুখীন হইলে ফুলসাহেব তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কি দুঃখে আমাদের দলে মিশেছ? অরিন্দম তোমার কি অনিষ্ট করেছে?”

৬নং। অরিন্দম আমার একপাটি দাঁত একেবারে উড়িয়ে দিয়েছে।

ফু। আর কিছু?

৬নং। আর আমার দাদাকে ফাঁসী-কাঠে ঝুলিয়ে দিয়েছে।

লোকটার যেমন বিকট চেহারা, তাহার যিনি দাদা, তিনি যে ফাঁসী-কাঠে ঝুলিবেন, তাহাতে আর আশ্চৰ্য্য কি।

ফু। তবে দেখছি তুমি অরিন্দমের রক্তদর্শন না ক’রে কিছুতে সুস্থ হবে না।

৬নং। সে কথা আর মুখে প্রকাশ করে বলতে!

ফু। সাত নম্বর কে আছে, এস।

৭নং। আমি সাতের নম্বর।

ফু। অরিন্দম তোমার কিছু ভেঙেছে?

৭নং। কিছুই না।

ফু। তবে তোমার কি হয়েছে?

৭নং। কিছুই না।

ফু। তবে যে তুমি আমাদের দলে মিশেছ—কারণ কি?

৭নং। কারণ, আমি অরিন্দমকে অন্তরের সহিত ঘৃণা করি!

ফু। কেন ঘৃণা কর?

৭নং। সে আমাকে একবার বোকা বানিয়ে নিজের একটা বড় কাজ হাসিল করে নিয়েছিল। ফু। কিরকম, শুনি?

৭নং। লোখে নামে আমার একটা স্যাঙাৎ একবার একটা লোককে খুন করেছিল। আমরা যে যেখানে খুটা-আটা কম, তা’ কেউ কারও কাছে কোন কথা লুকুতুম না। যা’ করা যেত, তা’ দু’জনে পরামর্শ ক’রেই হত। লোখে একবার একটা খুন করবার পর, একদিন সন্ধ্যার সময়ে বেটা অরিন্দম ঠিক লোখের মত সেজে এসে আমার কাছ থেকে এ-কথা সে-কথার পর সেই খুনটার সব কথা বার ক’রে নিয়ে লোখেকে একেবারে বারো বৎসরের দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দিলে। আমার জন্যই তাকে দ্বীপান্তরে যেতে হ’ল ব’লে, যাবার সময়ে শাসিয়ে গেছে যে, ফিরে এসে সে আমাকে খুন ক’রে ফাঁসী যাবে। তা সে যেরকম ভয়ানক লোক, বেঁচে যদি ফিরে আসে, নিশ্চয় সে যা বলে গেছে, ঠিক তা’ করবেই করবে। এর মধ্যে যদি আমি অরিন্দমের একটা কিনারা করতে পারি, তার রাগটা আমার উপর থেকে কমে যেতে পারে।

ফু। আচ্ছা, তুমি যাও—আট নম্বরের লোক উঠে এস।

সাতের স্থানে আট আসিয়া দাঁড়াইল।

ফু। তোমার ব্যাপার কি হে?

৮নং। বিষম ব্যাপার!

ফু। বটে! কি?

৮নং। আমি রাত্রে ঘুমুতে পারি না—ঘুমুতে গেলেই একটা-না-একটা স্বপ্ন লেগেই আছে; সকল স্বপ্নেই অরিন্দমের যোগাযোগ। কখন স্বপ্ন দেখি, অরিন্দম আমাকে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে ফেলে দিচ্ছে; কখন অরিন্দম আমাকে পচাপুকুরের পাঁকে চুরিয়ে ধরছে। কখন বা আমাকে হাত পায়ে বেঁধে জ্বলন্ত চিতার উপরে তুলে ধরছে। তা’ ছাড়া, কানমলাটা চড়চাপটা, লাথিটা-আস্টা যেন লেগেই আছে; সেগুলো যেন ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। অরিন্দম না মরলে বোধহয়, এই স্বপ্ন-রোগ থেকে আমার কিছুতেই মুক্তি নাই।

ফু। আচ্ছা, তুমি যাও। নয় নম্বরের কে?

৯নং। আমি।

ফু। তোমার ঘটনা কি?

৯নং। তিন বৎসর ছয় মাস।

ফু। বটে!

৯নং। কঠিন পরিশ্রমের সহিত।

ফু। দশের নম্বর কে?

১০নং। আমি।

ফু। তোমার ব্যাপার কি?

১০নং। নয়ের চেয়ে আরও দেড় বৎসর বেশী; ভোগটা বেশি দিন হয় নাই। একমাস পরেই জেলখানা থেকে পালিয়ে এসেছি।

ফু। তবে তুমি খুব কাজের লোক হে! এগারো নম্বরের কে?

এগারো নম্বরের একটি বালক উঠিয়া আসিল। তাহার বয়স এখনও সতেরোর মধ্যেই আছে। তাহার মুখাকৃতি ও দৃষ্টি বড় ভয়ানক, কেউটে সাপের ছানা দেখিয়া ভয়ে বুক্‌টা যেমন চমকে উঠে, তেমনি হঠাৎ যদি এর মুখখানি চোখের সামনে পড়ে, ঠিক তেমনি ভাবের একটা ভীতি স্পষ্ট অনুভূত হয়। তাহার হাতে একখানা খুব ধারাল, খুব বড় ছুরি ছিল। তাহাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিতে হইল না, সে নিজের ছুরিখানা নাড়িয়া নাড়িয়া আরম্ভ করিয়া দিল, “আমি অরিন্দমকে সহজে ছাড়ব না। আমার বাবা একটি লোককে ছুরি মেরে খুন করেছিল ব’লে, অরিন্দম আমার বাবাকে ফাঁসী দিয়ে মেরেছে: আজ তিন বৎসর হ’ল, বাবা মরেছে। যেদিন বাবা মরে, সেইদিন থেকে আমি এই ছুরিব সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব করেছি যে, একদণ্ডও ছুরিখানা ছেড়ে থাকি না। অরিন্দমের বুকে না বসিয়ে এ ছুরি ত্যাগ করব না।”

এমন পুত্রের যিনি জনয়িতা, তাঁহার অন্তিমে যে ফাঁসী-কাষ্ঠ অপরিহার্য্য, ইহা সৰ্ব্ববাদীসম্মত। তাহার পর বারো নম্বরের লোক উঠিয়া আসিল। সে বয়সে বৃদ্ধ। বৃদ্ধ হইলেও এখনও যে তিন-চারিজন সবল যুবককে আছাড় দিয়া ফেলিবার ক্ষমতা তাহার বেশ আছে, তাহার চেহারাখানার বিপুল দৈর্ঘ্য ও বিস্তার সেটা সহজেই হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দেয়। এবং তাহার আকৃতির সঙ্গে প্রকৃতির যে খুব সৌসাদৃশ্য আছে তাহার কালিমা লেপিত কোটরবিবিক্ষু চক্ষুর তীব্র দৃষ্টি, প্রকটগণ্ডাস্থি মুখের ভীষণ ভঙ্গীতে সে সম্বন্ধে আর তিলমাত্র সন্দেহ থাকে না। সে বলিল, “অরিন্দমের উপর আমার রাগের কোন কারণ আছে কি না, তা আমি বলতে চাই না। তোমাদের সকলের চেয়ে তাকে যে আমি অনেক বেশী ঘৃণা করি, সেইটুকু জেনে তোমরা নিশ্চিন্ত হ’তে পার—হও, বিশ্বাস করতে পার, ভাল—থেকে যাই;না হয় বল, আমি আমার নিজের পথ দেখি। অরিন্দমের যমের বাড়ী যাবার পথটা সহজ ক’রে দিবার ক্ষমতা আমার একারই যথেষ্ট আছে।”

তাহার পর তেরো নম্বরের লোকটা উঠিয়া দাঁড়াইল। ফুলসাহেব তাহাকে দেখিয়া হাসিয়া বলিল, “তোমাকে কিছু বলিতে হইবে না, তোমার সম্বন্ধে আমি অনেক কথা জানি।“

লোকটা সেই গোরাচাঁদ। নামটা শুনিলে কাহারও লোকটাকে মনে করিতে বিলম্ব হইবে না।

গোরাচাঁদ বসিলে ফুলসাহেব নিজে গাত্রোত্থান করিয়া বলিল—বেশ হাসিমুখে মিষ্টকথায় শ্রোতাদের কর্ণে অমৃত বর্ষণ করিয়া বলিল, “আমি অরিন্দমকে কেন ঘৃণা করি, তোমরা কেহই জান না। একমাত্র কারণ হচ্ছে, সে ঠিক আমারই মত বলবান, আমারই মত চতুর, আমারই মত বুদ্ধিমান্ এবং আমারই মত সকল কাজে তৎপর। আমি বেঁচে থাকতে আমার মত আর একটা লোক যে পৃথিবীতে থাকে, সে ইচ্ছা আমার একেবারে নাই। সেটা আমার একান্ত অসহ্য বোধ হ’য়ে আছে। হয়, সে পৃথিবী ত্যাগ করুক—আমি নিরাপদ্ হই, নয় আমি যাই—সে সুখী হ’ক্। এ দু’টার একটা আমি না ক’রে কিছুতেই নিশ্চিন্ত হ’তে পারব না। দেখি, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়! যাক্, এখন তোমাদের মধ্যে এমন কেহ এখানে আছে, যে জীবনের মধ্যে কখনও একটা না একটা খুন করে নাই? কে আছ বল।”

কেহ কোন উত্তর করিল না—সকলেই খুনী দস্যু।

ফুলসাহেব বলিল, “ভালই হয়েছে, এসব কাজে এই রকমই লোক দরকার। অরিন্দম-হত্যার জন্য এখন সকলকে শপথ করতে হবে।”

তখন সেই সকল খুনী লোক একমাত্র অরিন্দমের জীবন লক্ষ্য করিয়া শপথ করিল, এবং সঙ্গে সঙ্গে ফুলসাহেবের নিকট হইতে এক-একখানি তীক্ষ্ণধার কিরীচ উপহার পাইল।

সেদিন এই পৰ্য্যন্ত।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *