ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : যথাসময়ে অরিন্দম
ফুলসাহেবকে সেইরূপ অবস্থায় রাখিয়া অরিন্দম বাহিরে আসিলেন। এবং দেবেন্দ্রবিজয়ের অনুসন্ধান করিয়া উৎকণ্ঠিতচিত্তে বাড়ীর চারিদিকে ফিরিতে লাগিলেন। ফুলসাহেবের মুখে দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্বন্ধে যাহা শুনিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি অত্যন্ত ভীত হইয়াছেন। কারণ, ভীষণপ্রকৃতি খুনী ফুলসাহেবের অসাধ্য কৰ্ম্ম কিছুই নাই।
উপরের সকল স্থান যখন তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের অথবা তাঁহার মৃতদেহের কোন সন্ধানই হইল না, তখন অরিন্দম নীচে নামিয়া আসিয়া নীচের ঘরগুলিতে সন্ধান করিতে লাগিলেন। যে ঘরে দেবেন্দ্রবিজয়ের পাতাল প্রবেশ হইয়াছিল, অরিন্দম অবশেষে সেই ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
তখন একটা অস্ফুট গোঙানির শব্দ অতি মৃদুভাবে তাঁহার শ্রুতিগোচর হইল;কিন্তু কোথা হইতে সেই শব্দটা আসিতেছে, তিনি অনেকক্ষণ স্থিরকর্ণে থাকিয়াও তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। এক একবার জলের ছপাৎ ছপাৎ শব্দও শুনা যাইতে লাগিল। বোধ হইতে লাগিল, অতি দূর হইতে সেইসকল শব্দ আসিতেছে; কিন্তু ঘরের বাহিরে আসিলে আর কিছুই শুনা যায় না। ভীতিবিহ্বল অরিন্দম ঘরের ভিতরে চারিদিকে ঘুরিতে লাগিলেন। এক স্থানে দেখিলেন, গৃহতলে একটি লৌহনিৰ্ম্মিত গুপ্তদ্বার রহিয়াছে; সেটি মাপে দুই হাতের অধিক নহে, সমচতুষ্কোণ। সেই গুপ্তদ্বার উন্মুক্ত করিবার জন্য অরিন্দম শরীরের সমস্ত বল প্রয়োগ করিয়া, যতদূর সাধ্য চেষ্টা করিয়া কিছুতেই সেটা টানিয়া তুলিতে পারিলেন না;কিন্তু পরক্ষণে উপর হইতে একটু চাপ দিতেই নীচের দিকে একটু ফাঁক হইয়া গেল। আর কিছু বেশী জোর দিতে একেবারে উন্মুক্ত হইয়া গেল। সেই সঙ্গে কি একটা ভয়ানক দুর্গন্ধ অরিন্দমের নাসিকারন্ধ্রে প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে অন্নপ্রাশনের অন্ন অবধি উঠাইয়া ফেলিতে চেষ্টা করিল।
অরিন্দম অতি কষ্টে সেই দুর্গন্ধ সহ্য করিয়া অবনতমস্তকে, তীব্রদৃষ্টিতে নীচের দিকে চাহিতে লাগিলেন; কিছুই দেখিতে পাইলেন না, কেবল সেই গোঙানি শব্দটা এখন বেশ স্পষ্ট শুনা যাইতে লাগিল। অরিন্দম পকেট হইতে লণ্ঠন বাহির করিয়া জ্বালিলেন, এবং সেই আলোকরশ্মি অন্ধকূপ মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দেখিলেন, নীচে—অনেক নীচে অস্পষ্ট এক মনুষ্য-মূৰ্ত্তি, পঙ্কিল জলে আবক্ষ নিমজ্জিত হইয়া রহিয়াছে। তন্মধ্য হইতে উপরে উঠিয়া আসিবার কোন উপায় নাই। অরিন্দম উচ্চকণ্ঠে ডাকিলেন, “দেবেন্দ্রবাবু—”
ভিতর হইতে মৃদুকণ্ঠে উত্তর হইল, “আপনি আসিয়াছেন। আমি মরিতে বসিয়াছি—আমাকে রক্ষা করুন—ওঃ! প্রাণ যায়—উঃ! কী ভয়ানক—”
অরিন্দম বলিলেন, “ভয় নাই—দেবেন্দ্রবাবু আমার পরম সৌভাগ্য আপনি এখনও জীবিত আছেন—আমি নিজের প্রাণ দিয়া আপনার প্রাণ রক্ষা করিব।”
এই বলিয়া অরিন্দম গুপ্তদ্বার ছাড়িয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বোধকরি, ভিতরে স্প্রীং ছিল, তখনই ঝনাৎ করিয়া গুপ্তগৃহের কবাট আপনি রুদ্ধ হইয়া গেল।
অরিন্দম ছুটিয়া বাহিরে আসিলেন। উঠানের একপার্শ্বে একখানা লম্বা মই ছিল, সেই মইখানা দুই হাতে তুলিয়া আনিলেন, এবং সেই অন্ধকূপের মধ্যে সেটা নামাইয়া দিলেন। সেটা যে তখন তাঁহার এত বড় একটা উপকারে আসিবে, অরিন্দম প্রথমে তাহা ভাবেন নাই।
অরিন্দম প্রজ্জলিত লণ্ঠন লইয়া সেই মই অবলম্বনে নীচে নামিয়া গেলেন; মধ্যে মই থাকায়, গুপ্তদ্বার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না হইয়া অৰ্দ্ধোন্মুক্ত রহিল।
ভিতরে নামিয়া অরিন্দম দেখিলেন, দেবেন্দ্রবিজয় ক্রমশই সেই কূপের গভীর পঙ্কের মধ্যে ঢুকিয়া যাইতেছেন। তাঁহার মস্তকের এক স্থান কাটিয়া রক্ত ঝরিতেছে; সে-আঘাত তেমন সাঙ্ঘাতিক না হইলেও অবস্থাটা অত্যন্ত সাঙ্ঘাতিক। সেই ভয়ানক মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য অরিন্দম দুই হাতে দেবেন্দ্রবিজয়কে ধরিয়া প্রাণপণে টানিতে লাগিলনে। সেই আকণ্ঠ পঙ্কের মধ্য হইতে একটা লোককে টানিয়া তোলা কি সহজ কথা!