তৃতীয় পরিচ্ছেদ : অত্যাশ্চর্য্য অন্তর্দ্ধান
সেদিন দেবেন্দ্রবিজয় অনুরুদ্ধ হইয়া অরিন্দমের বাসায় আহারাদি শেষ করিলেন। আহারাদির পর অনতিবিশ্রামে উভয়ে ফুলসাহেব-সন্দর্শনে বাহির হইলেন। তাঁহারা যত শীঘ্র ফুলসাহেবের সহিত দেখা করিবেন, মনে করিয়াছিলেন, কাজে তাহা ঘটিয়া উঠিল না। দেবেন্দ্রবিজয় অনেকবার পথ ভুল করিয়া ফেলিলেন। যখন বেলা প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে, তখন তাঁহারা ফুলসাহেবের বাগান-বাটীর সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। একজন কৃষক সেখান দিয়া যাইতেছিল, অরিন্দম তাহাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ- বাগান কার?”
কৃষক বলিল, “জানকী বোসেদের।”
অরিন্দম একটু চিন্তিত হইলেন। বলিলেন, “কোন্ জানকী বসু? তিনি কোথায় থাকেন?” কৃষক বলিল, “তিনি মারা গেছেন, তেনার বাড়ী বেণীমাধবপুর, আমাদের জমিদার।” কৃষক চলিয়া গেল।
অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়কে বলিলেন, “রেবতীর পিতার নাম জানকীনাথ বসু না? দেবেন্দ্ৰবাবু, রেবতীর অপহরণ সম্বন্ধে অনেক রহস্য প্রচ্ছন্ন আছে, বোধ করি। আপনিও এখন তাহা কিছু বুঝতে পারছেন। রেবতীর কাকা গোপাল বসুকে আপনি যতদূর সদাশয় মনে করেন, সন্দেহ হয়, ঈশ্বরের ইচ্ছায় তিনি ঠিক তেমনটি নন্। একদিন অরিন্দমের হাতে পড়লে তিনি রাং কি সোনা সহজেই জানা যাবে।”
তখনই দুজনে বাগানের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। অযত্নে বাগান বনের মত ভীষণ হইয়াছে, এবং বন্য আগাছায়, লতাপাতায় কণ্টকাকীর্ণতায় মানুষ্যের দুরতিক্রম্য। কিছুদূর অগ্রসর হইলেই গাছের আড়ালের ফাঁক দিয়া সেই বাগান বাড়ীর ছাদের কিয়দংশ তাঁহাদের দৃষ্টিগোচর হইল। উভয়ে দ্রুতপদে চলিতে লাগিলেন। কিছুদূর গিয়া তাঁহারা দেখিলেন, বাড়ীটির পশ্চিমপার্শ্বের দ্বিতলস্থ একটি গবাক্ষ উন্মুক্ত রহিয়াছে; সেখানে দাঁড়াইয়া রূপলাবণ্যময়ী মুক্তকেশী কোন নারীমূর্ত্তি। দূর হইতে দেখিয়াই অরিন্দম তাহাকে চিনিতে পারিলেন। এ সেই মতিবিবি—স্বামীহন্ত্রী, মানবী-মূৰ্ত্তিতে দানবী, বিধাতার একটি অনাগত সৃষ্টি। দেবেন্দ্রবিজয়ও তাহাকে চিনিতে পারিলেন, চিনিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। তিনি অরিন্দমকে বলিলেন, “মহাশয়, এই সেই ডাকিনী, আমি ইহারই কথায় ভুলিয়াছিলাম।”
অরিন্দম মৃদুস্বরে বলিলেন, “হাঁ, আমি উহাকে খুব জানি; তবে এখন এক কাজ করুন, এখন আমরা এদিক্ দিয়া না গিয়া ঐ উত্তর দিকের পথ ধরিয়া যাই, তাহা হইলে জুমেলিয়া আমাদের দেখিতে পাইবে না; অথচ আমরা ঐদিক্ দিয়া অলক্ষ্যে বাড়ীর ভিতরে যাইতে পারিব।”
অরিন্দমের কথামত কাজ হইল। যাহাতে জুমেলিয়া তাঁহাদের দেখিতে না পায়, এরূপভাবে তাঁহারা অন্যদিক্ দিয়া বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন। এবং সরাসরি উপরে উঠিয়া—যে-ঘরে জুমেলিয়া দাঁড়াইয়াছিল—সেই ঘরের ভিতরে ঢুকিলেন। অরিন্দম যেমন জুমেলিয়াকে ধরিতে যাইবেন, জুমেলিয়া ছুটিয়া গিয়া পাশ্ববর্ত্তী ঘরে এবং সে-ঘর হইতে বাহির হইয়া, বাহিরের বারান্দায় পড়িয়া কক্ষ হইতে কক্ষান্তরে পলাইতে লাগিল। অরিন্দমও তাহার পশ্চাতে পশ্চাতে ছুটিতে লাগিলেন। অবশেষে জুমেলিয়া একটি ঘরের ভিতরে ঢুকিয়া ভিতর হইতে দ্বার অর্গলাবদ্ধ করিয়া দিল। সেই মুহূর্ত্তেই অরিন্দম এমনি জোরে সেই কবাটের উপর পদাঘাত করিলেন যে, সেই একটি আঘাতই কবাট জোড়ার একান্ত অসহ্য হইয়া উঠিল, এবং বিকট শব্দ করিয়া ভাঙিয়া পড়িয়া গেল। একলম্ফে অরিন্দম গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। কি আশ্চর্য্য! সেখানে কেহই নাই—না জুমেলিয়া, না তাহার কোন চিহ্ন। সেই ঘর হইতে বাহির হইবার আর কোনও দরজা ছিল না, যে দুই-একটা জানালা ছিল, তাহাও লৌহের গরাদ দেওয়া; এবং গরাদগুলি যেরূপ সুদৃঢ়ভাবে গ্রথিত, নাড়িয়া ভাল রকম করিয়া পরীক্ষা করিতে হতভম্ব, বিস্মিত অরিন্দমের আর সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ রহিল না। তন্ন তন্ন করিয়া তিনি ঘরের চারিদিক্ দেখিতে লাগিলেন; জুমেলিয়ার সন্ধান হইল না। ঘরের ভিতরে এমন কিছু ছিল না, এক পার্শ্বেই একটি আলমারী ও একটি ছোট খাটে ছোট বিছানা। আলমারীটি খোলা ছিল, সেটাকে তিনি আরও ভাল করিয়া খুলিয়া দেখিলেন, সেখানেও জুমেলিয়ার অস্তিত্বের সম্পূর্ণ অভাব; এবং জুমেলিয়ার মানবীত্বের উপরে তাঁহার ঘন ঘন সন্দেহ হইতে লাগিল।
এদিকে যেমন একটা অপূর্ব্বদৃষ্ট রহস্যপূর্ণ অদ্ভুত নাটকের একটা অলৌকিক দৃশ্য অভিনীত হইয়া গেল, ঠিক এই সময়ে অপর স্থানে এই রকমের আর একটা অভিনয় চলিতেছিল।