দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : পত্রাবলী
নৌকা যথাসময়ে হুগলির ঘোলঘাটে আসিয়া লাগিলে, দেবেন্দ্রবিজয় তন্মধ্য হইতে অবতরণ করিলেন। মাঝির মুখেই শুনিয়াছিলেন, নৌকার ভাড়া পূর্ব্বেই তাহারা পাইয়াছে, সেজন্য এক্ষণে তাঁহাকে উৎকণ্ঠিত হইতে হইল না। নো-বাহকদিগের নির্দোষতার প্রমাণ সেই পত্র-ত্রয়ের একখানির মধ্যে লিপিবদ্ধ ছিল; দেবেন্দ্রবিজয় তাহাদিগকে ছাড়িয়া দিলেন।
অরিন্দমের বাটীর অনুসন্ধান করিতে দেবেন্দ্রবিজয়কে কিছুমাত্র আয়াস স্বীকার করিতে হইল না। সেখানকার সকলেই অরিন্দমকে চিনিত। যখন দেবেন্দ্রবিজয় অরিন্দমের বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন, তখন তিনি বাহিরের ঘরে বসিয়া একান্ত মনঃসংযোগপূর্বক একখানি সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিলেন। সহজেই সাক্ষাৎ হইল। অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়কে বসিতে বলিয়া, সংবাদপত্রখানা টেবিলের উপর রাখিয়া-দিয়া নিজে ভাল হইয়া বসিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, আপনার নাম কি অরিন্দমবাবু?”
অরিন্দম ঘাড় নাড়িয়া স্বীকার করিলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনার নামে একখানি পত্র আছে।”
এই বলিয়া তিনি সেই তিনখানি পত্রের ভিতর হইতে অরিন্দমের পত্রখানি বাছিয়া বাহির করিলেন।
অরিন্দম পত্রখানি পাঠ করিলেন, পত্রখানি এইরূপ—
“সুহৃদ্বরেষু-
বহুদিন হইতে তোমার কোন সংবাদ না পাইয়া অত্যন্ত চিন্তিত আছি; আপাততঃ আমার কুশল জানিয়া নিশ্চিন্ত হইয়ো। তুমি অযাচিতভাবে আমার যে কত উপকার করিয়াছ, তাহা আমি যতদিন তোমার মৃত্যু না হয়, ততদিন কিছুতেই বিস্মৃত হইতে পারিব না।
কিন্তু যতদিন না বিস্মৃত হইতে পারিব, ততদিন আমি কিছুতেই সুস্থ হইতে পারিব না; সেজন্য যাহাতে তোমার মৃত্যুটি অপেক্ষাকৃত নিকটবর্ত্তী হয়, সেজন্য যত্নের ত্রুটি করিব না।
বুঝিয়াছি, তুমি কোনরকমে আমার সন্ধান করিতে পারিতেছ না; সেজন্য এখনও যথেষ্ট চেষ্টা করিতেছ; কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারিতেছ না দেখিয়া, অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম। পত্রবাহক শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রবিজয় মিত্রের নিকটে আমার সন্ধান পাইবে। উক্ত ভদ্রলোকটি আমার চিকিৎসা করিতে আসিয়াছিলেন।
—”ফুলসাহেব।”
পত্রখানি পড়িয়া অরিন্দম বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার জন্য ফুলসাহেব কর্তৃক আবার এক অভিনব রহস্যের সুচারু আয়োজন হইতেছে। তিনি দেবেন্দ্রবিজয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি এ-পত্ৰ কোথায় পাইলেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “পত্র আমি কোথায় পাইয়াছি, কখন পাইয়াছি, কে দিয়াছে আমি তাহার কিছুই জানি না। আমার কথা শুনিয়া আপনি বিস্মিত হইবেন না—আপনাকে সকল কথা ভাল করিয়া বুঝাইয়া না বলিলে, আপনি ইহার কিছুই বুঝিতে পারিবেন না; ইহার ভিতরে অনেক কথা আছে।”
অরিন্দম বলিলেন, “কোন বাধা না থাকিলে আপনি সেসকল কথা আমাকে বলিতে পারেন।” দেবেন্দ্রবিজয় গতরাত্রের সমুদয় বৃত্তান্ত বলিতে আরম্ভ করিলেন। বিন্দু-বিসর্গ গোপন না করিয়া অকপটে সমুদয় বলিয়া গেলেন। সেসকলের পুনরুল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন। শুনিয়া অরিন্দম কিছুমাত্র বিস্মিত হইলেন না; তিনি জানিতেন, ফুলসাহেবের নিকট সকলই সম্ভব। দেবেন্দ্রবিজয় যে তাঁহার হাত হইতে প্রাণসমেত ফিরিতে পারিয়াছেন, এত বড় দীর্ঘ কাহিনীর মধ্যে ঐটুকু কিছু বিস্ময়জনক।
অরিন্দম বলিলেন, “আপনি যে আরও দুইখানি পত্রের কথা বলিলেন, সেই দুইখানি বোধহয়, আপনি নষ্ট করেন নাই?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার কাছেই আছে, আপনি পড়িতে পারেন।”
এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় নিজের সেই পত্রখানি অরিন্দমের হাতে দিলেন। অরিন্দম ব্যগ্রচিত্তে পড়িতে লাগিলেন—
“দেবেন্দ্রবিজয়!
তুমি আমাকে চেন না, কিন্তু তোমাকে আমি খুব চিনি। তোমার বাড়ী ভবানীপুর, এবং তুমি কিজন্য বেণীমাধবপুরে গিয়েছিলে, তাহাও আমি জানি, এবং সেখানে গোপালচন্দ্রের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া রেবতীর উদ্ধারের জন্য কোন একজন সুদক্ষ গোয়েন্দা নিযুক্ত করিতে কলিকাতায় ফিরিতেছিলে, তাহাও জানি। যদি বাপু, আমার পরামর্শ শুনিতে চাও—যদি গোয়েন্দার মত গোয়েন্দার হাতে কাজটি দিতে চাও তাহা হইলে হুগলি জেলার অরিন্দম বসুকে যাহাতে ঠিক করিতে পার, আগে সে চেষ্টা দেখ। আমি জানি, তুমি রেবতীকে অত্যন্ত ভালবাস, এবং তোমারই সহিত তাহার বিবাহ হইবার কথা ছিল। তোমার মামা মহাশয় সেজন্য যথেষ্ট সচেষ্ট ছিলেন; কিন্তু বিধাতার অভিপ্রায় অন্যরূপ। অত্যন্ত অর্থাভাব হইয়াছিল বলিয়া তোমাকে একটু কষ্ট দিলাম। বেণীমাধবপুরের যে কেশববাবুর নাম শুনিয়াছ, আমি সেই কেশববাবু।” অপর পত্রখানি স্ত্রীলোকের হাতের লেখা, এইরূপ—
“দেবেন্দ্রবিজয়!
তোমাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল বলিয়া মনে করিয়ো না, তুমি আমার হাত হইতে মুক্তি পাইলে মনে করিয়ো না, আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম। ছিপে মাছ ধরা পড়িলে, যেমন সেটাকে খেলাইয়া শেষে উপরে তুলিতে বেশী আনন্দ হয়, তোমার মৃত্যুতে আমার সেই রকমের একটু আনন্দ উপভোগ করিবার ইচ্ছা আছে বলিয়াই, তোমাকে আপাততঃ ছাড়িয়া দিলাম। তুমি এখনও বুঝিতে পার নাই, তুমি কাহার ক্রোধে পড়িয়াছ; যেদিন তোমার বুকের রক্তে জুমেলিয়া তাহার উভয় করতল ধৌত করিবে, সেইদিন হইতে সেই অপমান, সেই লাঞ্ছনা এবং সেই ঘৃণার ঠিক প্রতিশোধ হইবে, এবং সেইদিন বুঝিতে পারিবে, উপেক্ষিতা রমণী সর্পিণী অপেক্ষাও ভয়ঙ্করী।
-সর্পিণী জুমেলিয়া।”
অরিন্দম পূর্ব্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন, কেশব আর ফুলসাহেব সংক্রান্ত লীলাখেলা একজনেরই। ইহাতে নূতনত্ব কিংবা আশ্চর্য্যের কিছুই নাই। পত্রপাঠ শেষে অরিন্দম মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “দেবেন্দ্রবাবু, আপনার পূর্ব্বজন্মের খুব একটা সুকৃতি ছিল, তাই আপনি এমন খুনীদের হাত থেকে নিজের দেহটাকে সচেতন অবস্থায় বাহির করিয়া আনিতে পারিয়াছেন।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি কি ওদের চিনেন?”
অরিন্দম বলিলেন, “ঐরকম দুই-একজন মহাত্মাকে না চিনিলে আমাদের পেশা চলে কই? আপনি রেবতীর কাকা গোপালবাবুর স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে কোন বিশেষ সংবাদ রাখেন কি?”
দেবেন্দ্র। তিনি মহৎ লোক, সেখানকার সকলেই তাঁহাকে যথেষ্ট সম্মান করিয়া থাকে।
অরিন্দম। আপনি যদি আমার সহিত দুই-চারি দিন থাকিয়া আমার কিছু সহায়তা করেন, আমি রেবতীর উদ্ধারের উপায় করিয়া দিতে পারি। সম্মত আছেন?
দেবেন্দ্র। আমার আপত্তি কিছুই নাই, তবে আমার দ্বারা আপনার এমন কি বিশেষ সাহায্য হবে, বলিতে পারি না।
অরি। (সপরিহাসে) যে বাড়ীতে কাল আপনি শুভ নিশিযাপন করেছিলেন, সেখানে আমাকে একবার নিয়ে যেতে হবে। পথ মনে আছে কি?
দেবে। না, বনের ভিতর দিয়ে রাত্রে গিয়েছিলাম; এখন সে পথ ঠিক করা কঠিন; তবে চেষ্টা করিলে সেখানে আপনাকে নিয়ে যেতে পারি।
অরি। বেশ চলুন, আজ আহারাদির পর যাত্রা করা যাক্। যেরূপে হউক, আজ সেখানে পৌঁছিতেই হইবে।
তখন তাঁহাদের মধ্যে ফুলসাহেব ও রেবতী সম্বন্ধে অনেক কথা হইল। সেসকলের উল্লেখ এখানে বাহুল্য বোধ করিলাম। অরিন্দমের মুখে ফুলসাহেবের অশ্রুতপূর্ব্ব অলৌকিক গুণগ্রাম শ্রবণে দেবেন্দ্রবিজয় অসম্ভবরূপে বিস্মিত ও চমকিত হইলেন। এবং ফুলসাহেব ও জুমেলিয়া মানবমূর্ত্তি তাঁহার ধারণা-পটে ভীষণ আসুরিক বিভীষিকায় অবিকল চিত্রিত হইয়া গেল। অরিন্দম রেবতীর সম্বন্ধে কোন কথাই তখন দেবেন্দবিজয়ের নিকটে প্রকাশ করিলেন না; বরং তিনি দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকট হইতে রেবতীর অপহরণ সম্বন্ধে অনেক কথা জানিয়া লইলেন।