ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : রোগী কক্ষে
সেইখানে সেইভাবে একাকী অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিতে যুবকের কষ্ট হইতে লাগিল। বিশেষতঃ সিক্তভূমিতল হইতে এমন একটা দুর্গন্ধ উঠিতেছিল, যুবকের তাহা অকেবারে অসহ্য হইয়া উঠিল। বায়ুর গতিবিধির জন্য কোন বন্দোবস্ত না থাকায়, সেই অসহ্য দুর্গন্ধে যুবকের শ্বাসরুদ্ধ হইবার উপক্রম হইতেছিল। দিবারাত্র অবরুদ্ধ ও অব্যবহার্য্য অবস্থায় পড়িয়া থাকায় এই হলঘর যে এরূপ দুৰ্দ্দশাগ্রস্ত, তাহা যুবক সহজেই বুঝিতে পারিলেন। রমণীর ফিরিয়া আসিতে অধিক বিলম্ব হইতেছে দেখিয়া, যুবক রুদ্ধ বাতায়নের সন্ধানে ভিত্তিগাত্রে উভয় হস্ত সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। যদিও সন্ধান করিয়া একটা রুদ্ধ গবাক্ষ দেখিতে পাইলেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, তাহা উন্মুক্ত করিবার কৌশল সেই অন্ধকারে তখনকার মত অনাবিষ্কৃত রহিয়া গেল। সম্ভব তাহা বাহির হইতে বন্ধ। তখন ইহা অপেক্ষা তথা হইতে বাহির হইয়া—বাহিরে অপেক্ষা করা ভাল মনে করিয়া, যুবক যেমন দু-একপদ অগ্রসর হইয়াছেন, এমন সময়ে সহসা সেপানের ঊর্ধ্বভাগ হইতে একটা উজ্জ্বল আলোক-রশ্মি আসিয়া, সেই সুবৃহৎ হলঘরের কিয়দংশ আলোকিত করিল।
যুবক ঊর্ধ্বমুখে সেইদিকে চাহিয়া দেখিলেন সেই রমণী সেইরূপ অবগুণ্ঠনাবৃতা হইয়া, একটি লণ্ঠন লইয়া সত্বর নামিয়া আসিতেছে। সোপানের অর্দ্ধাংশমাত্র নামিয়া আসিয়া রমণী উৎকণ্ঠিত ভাবে বলিল, “মহাশয় শীঘ্র আসুন, এতক্ষণ যে ভয় করিতেছিলাম, তাহাই ঘটিয়াছে; তিনি এখানে আসিয়াই মূৰ্চ্ছিত হইয়াছেন। হায় হায়, না জানি কতক্ষণ তিনি এইভাবে আছেন! কি হইবে?”
“ভয় নাই, ব্যস্ত হইবেন না,” বলিয়া যুবক সত্বর তাহার অনুসরণ করিলেন। সোপানাতিক্রম করিয়া তাঁহারা একটা বারান্দায় পড়িলেন। তথা হইতে তিনচারিটি ঘর পার হইয়া একটি প্রশস্ত ও উচ্চ প্রকোষ্ঠমধ্যে প্রবেশ করিলেন। রমণী লণ্ঠনটি বারান্দার উপরে রাখিয়া দিল। সেই উজ্জ্বল আলোক রোগীর কক্ষে লইয়া যাইতে তাহার সাহস হইল না। সেই ঘরের একপার্শ্বে একটি অর্দ্ধদগ্ধ মোমবাতি জ্বলিতেছিল. যুবক সেই ক্ষীণালোকে দেখিলেন, তথায় একপার্শ্বে একটি পরিষ্কৃত শয্যার উপরে একজন প্রৌঢ়ব্যক্তি—তাহার বয়স চল্লিশের কম নহে—নিস্পন্দদেহে মৃতবৎ পড়িয়া। তাহার মুখ মৃত্যুবিবর্ণীকৃত, চক্ষু নিমীলিত এবং হস্তপদাদি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত। বিছানার অবস্থাও তদ্রূপ, বালিশগুলি বিশৃঙ্খলভাবে এখানে সেখানে ও মাথার বালিশটি কক্ষতলে পড়িয়া আছে। আচ্ছাদনের বস্ত্রখানা ওলট-পালট হইয়া গিয়াছে।
যুবক সৰ্ব্বাগ্রে সেই সংজ্ঞাশূন্য লোকটির নাড়ী পরীক্ষা কবিয়া দেখিলেন। দেখিয়া সহজ লোকের ন্যায় বোধ হইল; তখন তাঁহার মনে একটু সন্দেহও হইল;মনে হইল, লোকটির এ একটা ভান মাত্ৰ নতুবা এ রোগ এ জগতে এই নূতন।
রমণী ব্যস্ততার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন দেখিলেন?”
যুবক। নাড়ী দেখিয়া রোগের কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; সহজ লোকের নাড়ীর গতি যেরূপ থাকে, ইহারও তদ্রূপ।
রমণী। অনেক ডাক্তার কবিরাজ যাহা বলিয়া গিয়াছেন, আপনিও তাহাই বলিতেছেন
যু। ইনি মূৰ্চ্ছা যাইবার পূর্ব্বে কি বড় ছট্ফট্ করিতে থাকেন?
র। হ্যাঁ, তখন কেহ ধরিয়া রাখিতে পারেন না।
যু। বিছানার অবস্থা দেখিয়া তাহাই বোধ হইতেছে। আপনি বাহিরের লণ্ঠনটি এইদিকে একবার লইয়া আসুন।
র। কেন?
যু। নাড়ী দেখিয়া যখন রোগ নিরূপণ হুইল না, তখন অন্য চেষ্টা করিতে হইবে।
র। ইহাতে আপনার কি রোগ পরীক্ষা হইবে?
যু। আমার বোধ হইতেছে, ইনি ভান করিয়া পড়িয়া আছেন?
র। এমনও কি হইতে পারে?
যু। সেটা একবার পরীক্ষা করিয়া দেখিতে ক্ষতি কি?
রমণী লণ্ঠনটি আনিলে অগ্রে যুবক তন্মধ্যস্থিত শিখাটিকে আরও উজ্জ্বল করিয়া দিলেন। তাহার পর সেটি সেই মূর্ছিত ব্যক্তির মুখের উপরে তুলিয়া ধরিবার জন্য আদেশ করিলেন।
তখন যুবক সেই নিঃসংজ্ঞ লোকটির চোখের পাতা দুইখানি তুলিয়া ধরিলেন; দেখিলেন তাহার চোখের তারা দুটি স্থির, তেমন উজ্জ্বল আলোক লাগিয়া কিছুমাত্র চঞ্চল হইল না, চিত্রলিখিতবৎ স্থির ও নিস্পন্দ। যুবক মনে করিলেন, সত্যই যদি লোকটি ভান করিয়া এরূপভাবে থাকে, তাহা হইলে লোকটি এ বিষয়ে সুদক্ষ এবং এ ভানও তাঁহার প্রশংসনীয়। ·
যুবক তাহাতেও নিরস্ত হইতে পারিলেন না; তাঁহার আগ্রহ ও কৌতূহল আরও বাড়িয়া উঠিল। তখন তিনি সেই রমণীকে লণ্ঠনটি রোগীর চোখের নিকট সঞ্চালন করিতে বলিলেন। রমণী তদ্রূপ করিলে অচেতন লোকটির চোখের তারা দুটিও তদ্রূপ নড়িতে লাগিল। যুবকের সন্দেহ বদ্ধমূল হইল। তখন যুবক একটি চোখের পাতা ছাড়িয়া দিয়া, অপর চোখের তারা অঙ্গুলির দ্বারা যেমন স্পর্শ করিতে যাইবেন, তখন রোগী সভয়ে চোখ কুঞ্চিত করিল; ইহাই যথেষ্ট।
রমণী পূর্ব্ববৎ সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, “কি দেখিলেন?”
মৃদুহাস্যে যুবক উত্তর করিলেন, “এই রোগ আমি আরোগ্য করিয়া দিব—কোন ভয় নাই।”
রমণী বলিল, “এখন কি করিলে জ্ঞান হইবে?”
যুবক মনে করিলেন, জ্ঞান বেশ টন্টনে আছে; রোগী নিজে ইচ্ছা না করিলে, অন্য কিছুতেই তাহার জ্ঞান-লাভ হইবে না। প্রকাশ্যে বলিলেন, “এখন আপনি ইহার চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপ্টা দিতে পারেন। আরও পারেন, যদি আপনাদের নিদ্রাতুর কোন ভৃত্যকে ডাকিয়া যতক্ষণ জ্ঞানলাভ না হয়, ততক্ষণ পাখার বাতাসের একটা বন্দোবস্ত করুন।”
রমণী সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়া সেই কক্ষ হইতে বাহির হইয়া গেল।