দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : বাগান বাটী
তাহার পর সেই যুবক ও অবগুণ্ঠনবতী অনতিবিলম্বে একটি বাগানের সম্মুখে আসিয়া পড়িল। বাগানটি প্রকাণ্ড, এমনকি পঞ্চাশ বিঘার কম নহে; বাগানের চারিপ্রান্তের বড় বড় জ্যোৎস্নাস্নাত গাছগুলি দৃষ্টিসীমার যবনিকার উপরে সুদৃশ্য রঞ্জিতবৎ অতি সুন্দর! কোথায় সুদীর্ঘ ঝাউ, কোথায় ততোধিক দীর্ঘ নিবিড়তর দেবদারুর শ্রেণী চলিয়াছে। তাহার সম্মুখে আম, লিচু, কাঁঠাল, তাল, নারিকেল আরও কত কি ফলের গাছ। মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড পুরাতন দ্বিতল অট্টালিকা, বহুদিন মেরামত না করায় একান্ত শ্রীহীন। অনেক স্থানে বালি খসিয়া পড়ায় তাহার ইষ্টকপঞ্জর বাহির হইয়া পড়িয়াছে।
রমণী যুবককে লইয়া সেই দ্বিতল অট্টালিকার দ্বার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। যুবক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বাড়ী কি আপনাদের?”
রমণী কৃতজ্ঞভাবে মাথা নাড়িয়া স্বীকার করিল। বলিল, “অনেক রাত হইয়াছে, বোধহয়, চাকরেরা সব ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। মনিবের শাসন না থাকিলে চাকর-বাকরদিগের স্পর্দ্ধা এইরূপ সীমাতিক্রম করিয়া উঠিয়া থাকে।” এই বলিয়া দ্বার ঠেলিয়া দিলে খুলিয়া গেল, তখন যেন অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া বলিল, “বাঁচ্লেম, এই যে কবাট খোলা আছে, তবে তিনি বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়াছেন দেখিতেছি।” যুবক বলিলেন, “তবে আপনি বাড়ীর ভিতরে যান, যদি তিনি আসিয়া মূৰ্চ্ছিত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আমাকে খবর দিবেন; আমি এখানে দাঁড়াইয়া আছি।”
“সে কি—মহাশয়! তাহা হইবে না।” এই বলিয়া সেই রমণী চকিতে ফিরিয়া দাঁড়াইল। সেই সময়ে একটা দমকা বাতাস লাগিয়া তাহার অবগুণ্ঠন সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত হইয়া গেল। তখন সেই রমণী অতিশয় লজ্জিত ও ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া, অবগুণ্ঠনটি আবার বেশী করিয়া টানিয়া দিল। সেই ক্ষুদ্র অবসরে যুবকের সতৃষ্ণদৃষ্টি একবার সেই সুন্দরীর সুন্দর মুখমন্ডলের সৌন্দর্য্যসুধা ক্ষণেকের জন্য অতৃপ্তভাবে পান করিয়া লইল। রমণীর তখনকার ভঙ্গিটি যুবকের মুগ্ধ হৃদয়ে মৃদু মৃদু আঘাত করিল। সেই ক্ষণেকের মধ্যে যুবক দেখিল, একটি মলিনতার ছায়াপাতে বিপুল কৃষ্ণচক্ষুর সলজ্জ অথচ উৎকণ্ঠাব্যঞ্জক চাঞ্চল্য, এবং ইষপ্রোদ্ভিন্ন অধরোষ্ঠের শ্রমজনিত মৃদুকম্পনে, সেই মাধুর্য-পরিপূর্ণ মুখশ্রী আরও উজ্জীবিত হইয়াছিল, তাহাতে যুবকের অপরিতৃপ্ত-নেত্রের তৃষ্ণা আরও বাড়িয়া উঠিল।
পরস্ত্রী-দর্শনে এরূপ একটা অধৈর্য্য আকুল তৃষ্ণা একজন সচ্চরিত্র ও শিক্ষিত যুবকের পক্ষে বড় পাপের বিষয় হইলেও তাঁহার মনে কোনরূপ কলুষিত ভাব ছিল না। স্ত্রী-সৌন্দর্য্যের জন্য পুরুষ হৃদয়মাত্রেই যে একটি আকাঙ্ক্ষার মধ্যে যখন বিন্দুবিসর্গ-পাপ মিশিতে পারে, তখন ইহা মনুষ্যের একান্ত অদম্য, ও অত্যন্ত প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠে। যাই হ’ক্, যুবকের সম্বন্ধে এত ওকালতী করিয়া পুঁথি বাড়ান আমার ভাল দেখায় না, বরং তাহাতে অনেক পাঠকের বিরক্তির আশঙ্কা করিতে হয়। এই যুবক এজন্য দণ্ডাহ কি মার্জ্জনীয়, সে বিচারের ভার সদ্বিবেচক পাঠক ও পাঠিকার উপরে তাঁহাদিগের সদ্বিচারে যাহা হয়, আমাদের এ যুবক তাহাই।
বাজে কথায় আমাদিগের দেরি হইতেছে। রমণী অবগুণ্ঠনের পুনঃ স্থাপনা করিয়াই বলিল, “আপনি ভিতরে আসুন, আপনি শ্রান্ত হইয়াছেন; বাহিরে একাকী এরূপ অবস্থায় কতক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিবেন!“
যুবক দ্বিরুক্তি না করিয়া বাটীমধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং সেই সুন্দরীর অনুসরণ করিতে লাগিলেন। প্রথমেই একটি প্রাঙ্গণে পড়িলেন। প্রাঙ্গণটি খুব বড়, বড় অপরিষ্কার। তাহার পূর্ব্বপার্শ্বে একটি হলঘর সেখানে আলো ছিল না। তথায় গভীর অন্ধকার আর একান্ত নিস্তব্ধতা নির্বিঘ্নে রাজত্ব করিতেছিল। তন্মধ্যে উভয়ে প্রবেশ করিলেন। সেই প্রগাঢ় অন্ধকারের মধ্যে রমণীকে আর দেখিতে পাওয়া গেল না; নিজেকে নিজেই দেখিতে পাওয়া যায় না, স্থানটি এমনই অন্ধকারময়। মৃদুপদশব্দ, কঙ্কনের মৃদুমধুর কিঙ্কিনী সেই সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে, দুর্ভেদ্য তিমিররাশির মধ্যে অগ্রগামিনী অদৃশ্য সুন্দরীর অস্তিত্বের প্রমাণ দিতেছিল।
সেই হলঘরের উত্তরপূর্ব্ব কোণে দ্বিতলে উঠিবার একটা সোপান ছিল। রমণী সোপানের উপর পদার্পণ করিয়া যুবককে বলিল, “আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি একটা আলো আনিতেছি।” পরমুহূর্ত্তে রমণীর চঞ্চল চরণবিক্ষেপের শব্দ ক্রমশঃ ঊর্ধ্বে মিলাইয়া গেল।
তখন যুবক সেখানে একা।
যুবকের চারিদিকে সূচিভেদ্য অন্ধকার।