Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মায়াবী || Panchkari Dey » Page 41

মায়াবী || Panchkari Dey

যেদিন ফুলসাহেব ও জুমেলিয়া ধরা পড়ে, সেইদিন রাত্রি দ্বিপ্রহরের পর আকাশ মেঘ করিয়া বড় ভয়ানক হইয়া উঠিল। সেই দিগন্ত-ব্যাপী মেঘে বাতাস বন্ধ হইয়া এমন একটা গুমোট করিল যে, নিঃশ্বাস ফেলাও একটা শ্রমসাধ্য ব্যাপার বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। সেই অন্ধকারাকার কৃষ্ণমেঘ হইতে অন্ধকারের পর অন্ধকার নামিয়া পৃথিবীর একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত ঢাকিয়া- ভূতল হইতে আকাশতল ব্যাপিয়া জমাট বাঁধিতে লাগিল। সেই নিঃশব্দ অন্ধকারের মধ্যে উন্নত দীর্ঘশীর্ষ, শাখাপ্রশাখাপল্লববহুল বৃক্ষগুলি বিকটাকার দৈত্যের মত দাঁড়াইয়া রহিল। জগৎ অন্ধকারমাত্রাত্মক, নিকটে অন্ধকার—দূরে আরও অন্ধকার—বহুদূরে তদপেক্ষা আরও অন্ধকার—সেখানে দৃষ্টি চলে না। সেই ভয়ানক বিভীষিকাময় অন্ধকারময়ী রাত্রি দ্বিপ্রহরের শেষে হাজতঘরের ভিতরে হস্তপদবদ্ধ ফুলসাহেব একপাশে পড়িয়া অমানুষিক নাসিকা-ধ্বনি করিয়া নিজের গভীর নিদ্রার পরিচয় দিতেছিল। একটু দূরে জুমেলিয়া জাগিয়া বসিয়াছিল—এবং বাহিরে একটা আলো জ্বলিতেছিল, তাহারই কতক অংশ লৌহনির্মিত গরাদযুক্ত দ্বারের ভিতর দিয়া অন্ধকার ঘরের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিল;তাহারই একখণ্ড আলোক লাগিয়া জুমেলিয়ার মুখমণ্ডল বড় উজ্জ্বল দেখাইতেছিল সে মুখ ম্লান নহে—বিষণ্ন নহে—তাহাতে চিন্তার কোন চিহ্নই নাই, বরং কিছু প্রফুল্ল। দ্বার-সম্মুখে সশস্ত্র প্রহরী ঘন ঘন পরিভ্রমণ করিতেছিল,—আর সেই প্রফুল্ল মুখখানি সতৃষ্ণনয়নে দেখিতেছিল। সেই চন্দ্রশূন্য, তারাশূন্য, দিগ্দিগন্তশূন্য, শব্দশূন্য, মেঘময়, অন্ধকারময়, বিভীষিকাময় রজনীর অনন্ত ভীষণতার মধ্যে সেই সুন্দর মুখখানি কত সুন্দর—পাঠক, তুমি আমি ঠিক বুঝি না—প্রহরীর তখন সেই সৌন্দর্য্য বেশ হৃদয়ঙ্গম হইতেছিল। মুগ্ধ প্রহরীর মুখ-চোখের ভাব-ভঙ্গী দেখিয়া জুমেলিয়ার বুঝিতে বাকী ছিল না যে, প্রহরী-পতঙ্গ তাহার রূপাগ্নিতে ঝাঁপ দিতে অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে। বুঝিয়া, যখন প্রহরী আর একবার ঘুরিয়া আসিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিল, তখন জুমেলিয়া তাহার সেই যেমন চঞ্চল-তেমনই উজ্জ্বল নেত্রে প্রহরীর প্রতি এক বিদ্যুদ্বর্ষী কটাক্ষ নিক্ষেপ করিল। বেচারা বড় বিভ্রাটে পড়িল, সে সচেতন থাকিয়াও অচেতন মত হইল, এবং তাহার আপাদমস্তক ব্যাপিয়া একটা বৈদ্যুতিক প্রবাহ সঞ্চালিত হইয়া গেল। তাহার মাথা ঘুরিয়া গেল, পা কাঁপিতে লাগিল, বুক ধড় পড় করিয়া উঠিল, সে চোখে অন্ধকার দেখিল, কান ভোঁ ভোঁ করিতে লাগিল, এবং দেহের লোমগুলি পৰ্য্যন্ত দাঁড়াইয়া উঠিল। সে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরাইয়া–সেখান হইতে সরিয়া—দূরে গিয়া একটা অস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল। বুকের ভিতরে সেই দব্দবানিটা কিছুতেই গেল না। প্রহরী তখন নিজের অবস্থা যত বুঝিতে নাই পারুক—জুমেলিয়া সম্পূর্ণরূপে পারিল। জুমেলিয়া ভাবিল, ঔষধ ধরিয়াছে।

প্রহরী আবার ঘুরিয়া দ্বার-সম্মুখে কম্পিতপদে ফিরিয়া আসিলে জুমেলিয়া তাহাকে বলিল, “পাহারাওয়ালাজী, আমাদের জন্য তোমার কত কষ্ট হচ্ছে–“

প্রহরী মোলায়েমস্বরে বলিল, “আরে নাহি—ইয়ে হাম্বা আপনা কাম্‌ হৈ।”

জুমেলিয়া পূৰ্ব্ববৎ মিষ্টকণ্ঠে বলিল, “তা’ যা’ই বল, পাহারাওয়ালাজী এ মানুষের উপযুক্ত কাজ নয়—এই রাত্রে কোথায় স্ত্রীকে বুকে নিয়ে ঘুমুবে, না বন্দুক ঘাড়ে ক’রে হঘড়ি একবার এদিক্, একবার ওদিক্ ক’রে ঘুর্ছ।”

প্রভুভক্ত প্রহরী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “যিস্কা নিমক্ খ্যায়্, উসকা কাম্ জান্ দেকে কর্না চাহিয়ে।”

তাহার পর জুমেলিয়া এ-কথা সে-কথা অনেক অবান্তর কথা পাড়িল, তাহার পর অনেক সুখ- দুঃখের কথা উঠিল, বিরহব্যথার কথা উঠিল, জুমেলিয়া প্রহরীর দুঃখে অত্যন্ত সহানুভূতি দেখাইল। তাহার সহানুভূতিসূচক কথাগুলি বীণাগীতিবৎ প্রহরীর শ্রুতিতে সুখজনক অঘাত করিতে লাগিল। জুমেলিয়া বলিল, “আচ্ছা পাহারাওয়ালা সাহেব, তুমি ত আজ তিন বৎসর বাড়ী যাও না—তোমার স্ত্রী তোমাকে ছেড়ে কেমন ক’রে আছে? আমি হ’লে ত তোমায় একদণ্ড চোখের তফাৎ করতেম না—তাতে খেতে পাই ভাল, বহুৎ আচ্ছা—না খেতে পাই, সেভি বহুৎ আচ্ছা।”

পাহারাওয়ালা সহাস্যে বলিল, “আলোক বড়া আমী; সভি কর্ সতে। আউর হলোগ গরীব আমী, আগে পেটকা ধান্দা করনে পড়তা।”

জুমেলিয়া বলিল, “তোমার কয়টি ছেলে?”

প্রহরী। দো লেডুকা আউর ছও মাহিনেকী এক লেড়কী হুয়া।

জু। তুমি ত আজ তিন বৎসর দেশে যাওনি, তবে এর মধ্যে আবার ছয় মাহিনেকী এক লেডুকী এল কোথা থেকে?

প্রহরী মাথা নাড়িয়া সগর্ব্বে বলিল, “আরে ক্যায়াবাৎ, হম্ হর্ মাহিনে চিঠি ভেতা আউর জবাব্ ভি আতা, ইসি হাসে মেরা বড় লেড়কা ভিখুরাম নৈ পয়দা হুয়া থা?”

জু। আরে পোড়ার মুখ, চিঠি লিখলে লেড়কা পয়দা হবে কি ক’রে?

প্র। হামলোগ্‌কো চিঠিমে সব কাম হোতা।

কথা শুনিয়া জুমেলিয়া খুব একটা উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিল। তাহার পর বলিল, “তুমি ভিখুর মাকে খুব ভালবাস?”

প্র। ভিখুমায়কি কেয়া ভালা বুরা?

জু। না না—তোমরা যাকে পিয়ার করা বল?

প্র। হাঁ হাঁ, বহুৎ পিয়ার করতে হেঁ।

জু। ভিখুর মা দেখতে আমার চেয়ে সুন্দরী?

প্র। আরে রাম রাম! তোরে মাফিক্ খ্যসুরৎ হোনেসে হামরা হাজার রূপিয়া তলব মিনেসে এক ঘড়িভি নহি ছোড় দেতা।

জু। এখন এ কথা বলিতেছ, তখন বোধ হয়, আমার মুখের দিকে ফিরিয়াও চাহিতে না;হয়ত—হয়ত কেন? নিশ্চয়ই দেশে আমাকে একা ফেলে রেখে, এখানে এসে কোম্পানীর সাজগোজের সঙ্গে চাপরাসের সঙ্গে, আর সঙিন্দার বন্দুকটির সঙ্গে প্রণয় বেশ জাঁকিয়ে ফেলতে পাহারাওয়ালাজী। তুমি ত এখানে কোম্পানী বাহাদুরের পাহারা দিচ্ছ। সেখানে ভিখুর মার পাহারার ভার কার উপরে দিয়ে এসেছ? সেখানে যদি লুঠ হ’য়ে যায়?

প্রহরী জুমেলিয়াকে নির্দ্দেশ করিয়া কহিল, “য়্যাসা জহরৎ ছোড়কে কোই সিসা লুঠনে যাতা হৈ।”

জু। আমি খুব ভাল জিনিষ? একেবারে জহরৎ?

প্র। আলবৎ—ইমে ক্যায়া সক্‌ হৈ?

জু। দেখ, দুর্বল সিং?

প্র। হামরা নাম দুর্বল সিং নাহি হৈ।

জু। তবে কি মরণাপন্ন সিং?

প্র। নাহি নাহি—হামারা নাম লঙ্কেশ্বর সিং।

জু। বাহবাঃ কি বাহবাঃ। চমৎকার নাম! ওই যে কি বলছিলেন—ভাল, হাঁ মনে হয়েছে, দেখ লঙ্কেশ্বর সিং, বলতে লজ্জা হয়—তোমাকে দেখে অবধি আমার মনটা যেন কিস্ মাফিক্ হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার ওই আলু চেরা চোখ্, ওই হাতির মত নাক, এই শতমুখীর মত গোঁফ, আর ঝাউবনের মত দাড়ি, আমার মাথা খেয়েছে—ইচ্ছা করে তোমাকে নিয়ে বনে গিয়ে দু’জনে মনের সুখে বাস করি। তা’ বিধাতার কি মরজি, তোমার হাতে আমাকে না দিয়ে (ফুলসাহেবকে দেখাইয়া) এই খুনীর হাতে আমাকে তুলে দিয়েছে। তুমি যদি এখন পায়ে স্থান দাও, তবে এ জীবনটা সাৰ্থক হয়।

এই বলিয়া জুমেলিয়া আবার এক কটাক্ষ করিল। তাহাতেও লঙ্কেশ্বর সিং এখনও স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া; সুতরাং লঙ্কেশ্বর ধন্যবাদার্হ। সে যে তখনও ঘুরিয়া পড়ে নাই, ইহাই যথেষ্ট, কিন্তু সে ঘুরিয়া না পড়িলে তাহার মাথাটা ঘুরিয়া গিয়াছিল এবং প্রাণটা বুকের ভিতরে মূর্ছিত হইয়াছিল। সে শ্রুতিমাত্ৰাত্মক হইয়া অবাঙ্মুখে জুমেলিয়ার কথা শুনিতেছিল। শুনিয়া হাতে স্বর্গ পাইল, এবং লোভটা অত্যন্ত প্রবল ও অদম্য হইয়া উঠিল। বলিল, “আরে, নাহি নাহি এয়সা বা‍ মৎ বোলো তুম হম্‌কো পাএর মে রাখো, তো হম্ তুমকো শিরুমে র‍্যাখে। মেরা নসিব্‌কা জোর য়্যাসা হোগা, তুম্ হম্‌কো এত্তা মেহেরবানি করেগী?”

জু। আমি ত মেহেরবানি করতে খুব রাজি আছি, এখন তুমি যদি একটু মেহেরবানি কর, তবে বুঝতে পারি।

প্র। তুম্ হাম্‌সে দিল্লগী করতী হৈ।

জুমেলিয়া বলিল, “না লঙ্কেশ্বর সিং, তোমার দিব্য—আমি একটুও দিল্লগী করিনি—আমি সত্যি কথাই বলছি, তোমাকে দেখে অবধি আমার মনটা একদম ম’জে গেছে। দেখ, লঙ্কেশ্বর সিং; যদি কোনরকমে তুমি একটা চাবি যোগাড় করতে পার, তাহলে এখানে যে-পাঁচ-সাতদিন থাকি, এমনি রাত্রে আমার স্বামী ঘুমাইলে রোজ দুই দণ্ড তোমার সঙ্গে আমোদ করতে পারি।”

প্রহরী অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া বলিল, “এক্‌ঠো পুরানা চাবি হৈ, ও চাবি সব হাকড়িমেঁ লাগতা যাতা।”

তালার পরিবর্ত্তে দ্বারে হাতকড়ি লাগানো ছিল। এখানে তালার পরিবর্ত্তে হাতকড়ির ব্যবহারও হইয়া থাকে। লঙ্কেশ্বর কোমর হইতে চাবি বাহির করিয়া হাতকড়ি খুলিয়া জুমেলিয়াকে বাহিরে আনিল। আবার দ্বারে হাতকড়ি লাগাইয়া দিল।

জুমেলিয়া সর্বাগ্রে লঙ্কেশ্বর সিংকে দুই হাতে জড়াইয়া ধরিল; ধরিয়া তাহার সেই শ্মশ্রুগুম্ফপরিব্যাপ্ত মুখমণ্ডলে ঘন ঘন চুম্বন করিল। পরক্ষণেই প্রহরী সংজ্ঞালুপ্ত হইল। সে মাটিতে লুটাইয়া পড়িল; পড়িয়া কৃষ্ণকে জবাব দিল।

জুমেলিয়ার চুম্বনে লঙ্কেশরকে মরিতে দেখিয়া পাঠক আশ্চৰ্য্যান্বিত হইবেন না—সে সাপিনী, তাহার নিঃশ্বাস লাগিয়াও শোণিত বিষাক্ত হইয়া ওঠে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *