চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গুপ্ত মন্ত্রণা
থানার একটি নিভৃত কক্ষে বসিয়া যোগেন্দ্রনাথ ও অরিন্দমের একটা গুপ্তমন্ত্রণা চলিতে লাগিল। প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টা পরে উভয়ে বাহিরে আসিলেন। যোগেন্দ্রনাথ একজন দারোগাকে ডাকিয়া তাহাকে ধড়াচূড়া ত্যাগ করিয়া ছদ্মবেশ ধরিতে অনুজ্ঞা করিলেন। সহজে কেহ না চিনিতে পারে, এমন একটা ছদ্মবেশে তিনি নিজেও সাজিলেন। অরিন্দম সেই বেশেই রহিলেন। তখনই তিনজনে একখানি গাড়ীতে উঠিয়া অতি সত্বর ফুলসাহেবের গৃহাভিমুখে চলিলেন। যাইবার সময়ে যোগেন্দ্রনাথ দশজন পাহারাওয়ালাকে কিছুক্ষণ পরে ফুলসাহেবের বাটীর নিকটবর্ত্তী একটি গুপ্তস্থানে উপস্থিত হইতে বলিয়া গেলেন।
যথাসময়ে সকলে ফুলসাহেবের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ফুলসাহেবের বাড়ীখানি মন্দ নহে, দ্বিতল—ছোটর উপরে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সম্মুখে একখানি ছোট ফুলের বাগান। বাগানে দুই-একটি করিয়া অনেক রকমের ফুল গাছ। সেই বাগানের মধ্যে একজন মালী বসিয়াছিল—তাহাকে যোগেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডাক্তারবাবু এখন আছেন কি?”
মালী বলিল, “উপরে আছেন, একটু পরে নীচে আসিবেন।”
বাহিরের একটি সুসজ্জিত বৈঠকখানায় গিয়া তিনজনে উপবেশন করিলেন। তখন সেখানে আর কেহই ছিল না। অরিন্দম নীরবে একস্থানে অধিকক্ষণ বসিয়া থাকিতে পারিতেন না—তিনি নিঃশব্দে উপরে উঠিলেন। সেখানে গিয়া একটি অবরুদ্ধ কক্ষমধ্যে দুই ব্যক্তিকে কথোপকথন কহিতে শুনিলেন। সেই দুইজনকে তিনি তখন না দেখিতে পাইলেও কণ্ঠস্বরে তদুভয়কে বেশ চিনিতে পারিলেন, একজন ফুলসাহেব, অপর লোকটি সেই গোরাচাঁদ। যে কক্ষে বসিয়া তাহারা কথোপকথন করিতেছিল, সেই কক্ষের দ্বারে একটি অঙ্গুলি দিয়া ধীরে ঠেলিয়া দেখিলেন, তাহা ভিতর হইতে অবরুদ্ধ। তিনি সেই কবাটের উপর কান রাখিয়া তাহাদিগের কথোপকথন শুনিতে লাগিলেন।
ফুলসাহেব। কেমন, তুমি কি বোধকর, এদিকের কাজ অনেকটা শেষ করিয়া আনিতে পারি নাই?
গো। এখন এই শেষটা রাখাই বড় শক্ত কথা।
ফুল। তুমি সহায় রহিয়াছ, জুমেলিয়া সহায় রহিয়াছে, ইহাতেও যদি শেষ রক্ষা শক্ত কথা হয়, তবে আর সহজ হইবে কিসে?
গো। জুমেলিয়ার সাহায্য না পাইলে বোধহয়, আপনি এত শীঘ্র এতটা কাজ কখনই হাঁসিল করিতে পারিতেন না।
ফু। জুমেলিয়াই আমার দক্ষিণ হস্ত। সেইজন্যই ত কৌশল করিয়া আমি আগে তমীজউদ্দীনের স্ত্রীকে মারিয়া তাহারই আসনে জুমেলিয়াকে মতিবিবি করিয়া বসাই। তারপর সেই জুমেলিয়ারই খাতিরে তমীজউদ্দীনের সংসারে আমার একাধিপত্য; কিন্তু জুমেলিয়াকেও বিশ্বাস করিতে আমার প্রাণ চায় না—সে আমার একটা উপপত্নী ব্যতীত আর কেহই নয়। তা’ ছাড়া তার কূটবুদ্ধিতে, তার সাহসে, তার পরাক্রমে অনেক সময়ে সে আমাকেও ছাড়াইয়া অনেক দূরে উঠে। সেইজন্য একটু ভয় হয়, আমাকে আবার কোনরকমে ফাঁকি না দেয়।
গো। একটা স্ত্রীলোক আপনাকে ফাঁকি দেবে? সেইজন্য আবার আপনার ভয় হয়? শুনে হাসি পায়। ফুল। জুমেলিয়াকে যে-সে স্ত্রীলোক মনে করিও না, জুমেলিয়ার যেরূপ ক্ষমতা—যেরূপ মনের বল, অনেক পুরুষেরও এমন নাই। সে না করিতে পারে, এমন কাজ কিছুই নাই। জুমেলিয়ার সাহায্য না পাইলে তমীজউদ্দীনের সংসার হইতে তিনটি প্রাণীকে এত সহজে আমি মৃত্যুমুখে তুলিয়া দিতে পারিতাম বলিয়া বোধ হয় না। দেখ দেখি, কেমন নির্বিঘ্নে তিন-তিনটি খুন হইয়া গেল; অথচ কেহ কিছুই জানিল না–কেহ একটু সন্দেহও করিতে পারিল না! এরূপ বেমালুম খুন করিবার একশত আট রকম বিষ আমার হাতে আছে; তমীজউদ্দীনের বাড়ীতে যে বিষ ব্যবহার করিয়াছিলাম, প্রত্যহ খাবার জলের সঙ্গে একবার এক ফোঁটা করিয়া দিলে ঠিক ছয় মাসের মধ্যে মানুষ মরে; খুব বলিষ্ঠ হইলে আটমাসও লাগে—স্ত্রীলোককে চারিমাসের অধিক খাওয়াইতে হয় না। তবে শীঘ্র কাজ শেষ করিতে হইলে রোজ দুই ফোঁটা এমনকি তিন ফোঁটা করিয়া খাওয়ান চলে—তার বেশী দেওয়া চলে না—তাহা হইলে জলটা একটু কষায় বোধ হয়। অরিন্দমকে চুরুটের সঙ্গে যে বিষ দিয়ে হত্যা করিলাম, উহাতে দশ ঘণ্টার মধ্যে যেমন বলবান্ লোক হউক না কেন—নিশ্চয়ই মরিবে।
গো। অরিন্দমকে হত্যা করায় ঐখানেই সকল কার্য্যের গোড়া বাঁধা হইয়াছে;এখন আর কাহাকে ভয় করিব?
ফু। অরিন্দম বড় সহজ লোক ছিল না;আজ-কাল না হ’ক্ দুদিন পরে না হ’ক, এক-সময়ে-না- এক সময়ে সে আমাকে ধরিতে পারিত। লোকটি বড়ই তীক্ষ্ণবুদ্ধির ছিল, তা’ বলিয়া তাহাকে কখনও এক মুহূর্তের জন্যও ভয় করি নাই। ঐরকম সাতটা অরিন্দম যদি মিশিয়া একটা হইয়া আসিত—তাহা হইলেও ফুলসাহেব তাহাকে দেখিয়া ভয় করিত না—ভয় কাহাকে বলে অদৃষ্টক্রমে এ পর্যন্ত ফুলসাহেবের সে শিক্ষা হয় নাই।
গো। অরিন্দম শুধু বুদ্ধিমান ছিল না—বলবাও যথেষ্ট ছিল, সেদিন সেই মাঠে লইয়া তাকে হত্যা করিতে গিয়া সে প্রমাণ আমি বেশ পাইয়াছি। আগে আমার এমন বিশ্বাস ছিল না যে, কোন লোক আমাকে এত শীঘ্র কাবু করিতে পারে। সে যাই হোক্, আমার বোধ হয়, সেই সময়ে যদুনাথ গোস্বামীর সেই পত্রখানি অরিন্দম আমার কাছ হইতে হস্তগত করিয়া থাকিবে; সে পত্রে অনেক কথা খুলিয়া লেখা ছিল। তাহাতেই সে তখন রেবতীর মাতামহকে খবর দিয়া যদুনাথের বাড়ী থেকে রেবতীকে সরাইয়া দেয়।
ফু। তুমি ভুল বুঝিয়াছ, রেবতী মাতামহের নিকটে গিয়াছে, এ কথা একটা ছলমাত্র। রেবতীর সন্ধান করিতে না পারিলে ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না। যখন অরিন্দমকে এ সংসার হইতে বিদায় করিতে পারিয়াছি তখন আর ভয় কি? সকল কাজই আমরা নির্ব্বিঘ্নে অথচ খুব শীঘ্রই শেষ করিয়া উঠিতে পারিব।
গো। এদিকে রেবতীকে সন্ধান করিয়া শীঘ্র বাহির করিতে না পারিলে, গোপালচন্দ্রের কাছে একটি পয়সাও পাবার সম্ভাবনা নাই।
ফু। তাহা ত জানি, তুমি কি মনে কর, সেজন্য আমি কোন চেষ্টা করিতেছি না? অরিন্দম যখন মরিয়াছে, তখন আর ভাবনা কি? আমি সকল সন্ধান রাখিয়া থাকি। ইদানীং যে অরিন্দম কেশবচন্দ্রের সন্ধানে ঘুরিতেছিল, তাহাও জানি;কিন্তু বোকারাম জানিত না যে, সেই কেশবচন্দ্র এদিকে ফুলসাহেব মূর্ত্তিতে তাঁর চোখের উপরে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।
অরিন্দম শুনিয়া বিস্মিত হইলেন বটে—ততদূর নহে, কারণ পূব্বেই তিনি অনেকটা এইরূপ আশা করিয়াছিলেন। আরও মনোযোগের সহিত কবাটের উপর কান রাখিয়া রুদ্ধশ্বাসে শুনিতে লাগিলেন।
গোরাচাঁদ বলিল, “এখন কুলসম যদি আপনাকে বিবাহ করিতে অস্বীকার করে, তাহা হইলে আপনি ত অনেকটা তফাতে পড়িলেন।”
ফুলসাহেব বলিল, “না স্বীকার করে, তার পিতা, মাতা, ভ্রাতা যেখানে গিয়াছে, কুলসমকে ও সেখানে পাঠাইব।”
গো। কুলসমকে হত্যা করিলেই একটা গোলযোগ ঘটিবার সম্ভাবনা
ফু। কিছু না—কিছু না। এমনভাবে কাজ করিব যে, কেহ জানিতে পারিবে? হাহাহা (হাস্য) তা’ হ’লে তুমিও এখন আমাকে ঠিক চিনিতে পার নাই, দেখিতেছি। দিনকে রাত করিতে পারে, রাতকে দিন করতে পারে, এমন ক্ষমতা ফুলসাহেবের যথেষ্ট আছে।
গো। আমিও তা’ যথেষ্ট জানি। সিরাজউদ্দীনকে কতদিন সেইখানে রাখিবেন।
ফু। যতদিন আবশ্যক বোধ করিব।
গো। কুলসমকে আগে বিবাহ করিয়া তাহার পর তাহাকে কি ছাড়িয়া দিবেন?
ফু। তার কোন ঠিক নাই; হয়ত সিরাজও মরিবে। তাহাকে যে এতদিন খুন করি নাই, তাহার একটা কারণ আছে। শুধু কুলসমের জন্য তাহাকে আমি সেখানে আটক রাখি নাই। ইহার ভিতরে আমার আর একটা গূঢ় অভিপ্ৰায় আছে।
গো। সে অভিপ্রায়টা কি?
ফু। পরে জানিতে পারিবে, এখন থাক।
এই বলিয়া ফুলসাহেব উঠিল;উঠিয়া বলিল, “তুমি ব’সো, আমি নীচে হ’তে এখনই আসিতেছি।”