দশম পরিচ্ছেদ : চিকিৎসক না মূর্তিমান্ মৃত্যু?
পরদিন প্রভাতে পাচক ঠাকুর অরিন্দমের নিকটে অন্যদিনের ন্যায় অদ্যও বাজার খরচ লইতে আসিয়া দেখিল, তখনও অরিন্দম উঠে নাই। তাঁহার শয়ন-গৃহের কবাট বন্ধ রহিয়াছে। বাহির হইতে দুই-চারিবার ‘বাবু’ ‘বাবু’ বলিয়া ডাকিল, কোন উত্তর নাই। দ্বার ঠেলিল, তথাপি কোন উত্তর নাই। তখন গবাক্ষ দিয়া দেখিল, গৃহতলে অরিন্দম পড়িয়া আছেন। তাঁহার ললাটের এক স্থান কাটিয়া রক্ত বাহির হইয়াছে, দেখিয়া পাচক ঠাকুরের অত্যন্ত ভয় হইল। কি করিবে কিছুই ভাবিয়া পাইল না তাহার সেই ইতস্ততের সময়ে অরিন্দমের লিখিত সেই পত্রখানি তাহার নজরে পড়িল; তাহার একটু লেখাপড়া জানা ছিল, অনেক কষ্টে একটির পর একটি বর্ণ উচ্চারণ করিয়া একটি শব্দ, সেইরূপে আর একটি শব্দ, এইরূপে শব্দে শব্দে মিলাইয়া শিরোনামার কতক অংশ পাঠ করিল। কতক অংশ না পড়িতে পারিলেও আন্দাজে বুঝিয়া লইল।
পত্রখানি লইয়া নিম্নতলে আসিয়া গভীর নিদ্রা হইতে ভৃত্যকে জাগাইল। তাহাকে আগে তিরস্কার করিল; তাহার পর সে যাহা জানিত, তাহা বলিয়া নিজে সেই পত্র লইয়া থানায় যোগেন্দ্রনাথের নিকটে চলিল।
থানায় তখন যোগেন্দ্রনাথ ছিলেন না। একজন দারোগা আর দুইজন জমাদার বসিয়াছিল। পাচক ঠাকুর গিয়া দারোগাকে সেই পত্রখানি দিয়া যাহা ঘটিয়াছে, সংক্ষেপে বলিল। তখনই দারোগা একজন জমাদারকে দিয়া সেই পত্রখানি যোগেন্দ্রনাথের বাটীতে পাঠাইয়া দিল;এবং নিজে অরিন্দমকে দেখিতে চলিল। অপর জমাদার থানা রক্ষার ভার গ্রহণ করিয়া সেইখানে বসিয়া রহিল।
পাচক ঠাকুর দারোগাকে অরিন্দমের শয়ন-কক্ষের সম্মুখে লইয়া আসিল। দারোগা সেই উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়া অরিন্দমকে যেরূপ অবস্থায় অনাবৃত গৃহতলে মুখ গুঁড়াইয়া পড়িয়ে থাকিতে দেখিল, তাহাতে তাহার বড় ভয় হইল। তখনই রুদ্ধদ্বার ভাঙ্গিয়া ফেলা হইল। সর্ব্বাগ্রে দারোগা পাচক ঠাকুর ও ভৃত্যের সাহায্যে অরিন্দমকে পার্শ্ববর্ত্তী শয্যায় তুলিল। নাসিকায় হাত দিয়া দেখিল, নিঃশ্বাস পড়িতেছে না; কিন্তু দেহ শীতল নহে, বরং কিছু উষ্ণ। সেইজন্য তাহার মনে সন্দেহ হইল যে, অরিন্দমের তখনও মৃত্যু হয় নাই। দারোগা পাচক ঠাকুরকে তখনই একজন ডাক্তার ডাকিতে অনুমতি করিল।
পাচক ঠাকুর ছুটিয়া বাহির হইল। অনতিবিলম্বে সে একজন চিকিৎসককে সঙ্গে আনিল। চিকিৎসক আর কেহই নহেন—সেই ডাক্তার ফুলসাহেব। দারোগা তাঁহাকে দেখিয়া অত্যধিক আনন্দিত হইয়া বলিল, “এই যে আপনি আসিয়াছেন, ভালই হইয়াছে—আপনাকে দেখিয়া অনেকটা ভরসা হইল।” ফুলসাহেব বলিল, “হাঁ, আমি এইখানে একজন রোগী দেখিতে আসিয়াছিলাম। পথ হইতে তোমাদের লোক গিয়া ডাকিয়া আনিল। এখন ব্যাপার কি, বল দেখি।”
দারোগা অরিন্দমকে দেখাইয়া দিল। ফুলসাহেব অরিন্দমকে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ পরে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “আর কি হইবে, লোকটার মৃত্যু হইয়াছে।” মৃত্যু হইয়াছে শুনিয়া দারোগা চমকিত হইয়া উঠিল। বলিল, “মৃত্যু হইয়াছে! কি সৰ্ব্বনাশ! কি রোগে হঠাৎ ইনি মারা পড়িলেন?”
ফুল। সম্ভব হৃদরোগ। ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া না দেখিলে ঠিক বলিতে পারিতেছি না।
দারো। এমন বলবান্ ইনি, হৃদরোগে আচম্বিতে যে মারা গেলেন, কেমন করিয়া বিশ্বাস করিব?
ফু। [ ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া ] আমি কি মিথ্যা কথা বলিলাম?
দারো। আত্মহত্যা করেন নাই ত?
ফুল। তাহাও হইতে পারে। কই, আপাততঃ তাহার কোন প্রমাণ পাইলাম না।
দা। আপনি যেরূপ দেখিলেন, তাহাতে ইহার মৃত্যু সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ নাই?
ফু। না।