নবম পরিচ্ছেদ : মৃত্যুমুখে অরিন্দম
ঘরের এক কোণে একটা টেবিল ছিল; অরিন্দম দুই হাতে সেই টেবিলের একটা কোণ চাপিয়া ধরিয়া দাঁড়াইলেন। দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না—পড়িয়া গেলেন—আবার উঠিলেন—আবার পড়িয়া গেলেন। সেইরূপ অবস্থায় তিনি সেই উজ্জ্বল দীপালোকেও দুই চক্ষে ঘোরতর অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। কিছুতেই তিনি প্রকৃতিস্থ হইতে পারিলেন না। হাই চাপিয়া রাখিবার জন্য চেষ্টা করিলেন—পারিলেন না। একটার পর একটা—তাহার পর আর একটা—তাহার পর আর একটা সেইরূপ হাই উঠিতে লাগিল। তিনি মর্মান্তিক যন্ত্রণায় উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, “এখন না—এখন না—এখন কিছুতেই মরা হইবে না। মরিবার আগে যেমন করিয়া পারি, একটা কাজ শেষ করিবই।” এই বলিয়া তিনি টলিতে টলিতে উঠিলেন, অন্ধকার গৃহমধ্যস্থবৎ তিনি হাড়াইয়া টেবিলের ভিতর হইতে একখানি চিঠির কাগজ বাহির করিলেন। অতিকষ্টে কলম ও দোয়াতের সন্ধান করিয়া লিখিতে আরম্ভ করিলেন। কি লিখিতেছেন দেখিতে পাইলেন না। অভ্যাস মত লেখনী চালনা করিতে লাগিলেন। যাহা লিখিলেন, তাহার কোন অক্ষর খুব বড়, কোনটি আবার তেমনি ছোট—কোনটার সঙ্গে কোনটা মিলে না। পংক্তিগুলি আঁকাবাঁকা হইল;ঠিক তাঁহার হস্তাক্ষর বলিয়া কিছুতেই বুঝাইল না। তিনি অতিকষ্টে লিখিলেন,
“যোগেন্দ্র বাবু,
ফুলসাহেব বড় ভয়ানক লোক। যত শীঘ্র পারেন তাহাকে গ্রেপ্তার করুন। সে খুনে—সে-ই বালিকার হত্যাকারী। সে চুরুটের সঙ্গে আমাকে বিষ দিয়েছিল;আমি চুরুটের আধখানা মাত্র খাইয়াছি বোধহয় বাঁচিব না। ফুলসাহেবকে শীঘ্র না ধরিতে পারিলে সে একদিন আপনাকে —”
আর লিখিতে পারিলেন না। তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ ক্রমশঃ অসাড় হইয়া আসিতেছিল; সেই অসম্পূর্ণ পত্রে তিনি নিজের নাম সহি করিয়া পত্র শেষ করিলেন। এবং একখানি খাম সংগ্রহ করিয়া পত্রখানি তন্মধ্যে বন্ধ করিলেন। আর একটি বর্ণও লিখেন, এমন শক্তি তখন তাঁহার ছিল না। এখনও শিরোনামা লিখিতে বাকী, ক্রমশঃ তিনি নিঃসংজ্ঞ হইয়া পড়িতেছিলেন, আর তখন তাঁহার নড়িবার শক্তি মাত্র ছিল না। হাত পা অবশ হইয়া আসিতেছিল; তিনি আর কোন উপায় না পাইয়া করতলে সেই লৌহলেখনী বিদ্ধ করিলেন, তাহাতে হাতের সেই দারুণ অবসন্নতা তখনকার মত একটু দূর হইল; লেখনী সেইরূপ বিদ্ধ রহিল। তিনি অপর লেখনী লইয়া শিরোনামা লিখিলেন যাহা লিখিলেন, তাহা সহজে অপরকেহ পড়িতে পারিবে বলিয়া বোধ হইল না।
তখন ভৃত্য দ্বারা যাহাতে যোগেন্দ্রনাথের নিকট পত্রখানি পাঠাইতে পারেন, সেজন্য অরিন্দম ভৃত্যকে ডাকিতে লাগিলেন। তাঁহার যে স্বরভঙ্গও ঘটিয়াছে, তাহা তিনি এখন বুঝিতে পারিলেন। স্বর এত মৃদু হইয়া আসিয়াছে, নিম্নতলে নিদ্রিত ভৃত্য শুনিবে কি, সে যদি তখন তাঁহার পার্শ্বে সম্পূর্ণ সজাগ দাঁড়াইয়া থাকিত, তাহা হইলেও বোধহয়, শুনিতে পাইত না। এমনকি অরিন্দম নিজের স্বর নিজেই শুনিতে পাইলেন না, তখন তিনি নিজেই ভৃত্যের নিকট যাইবার জন্য সেই কক্ষ হইতে ছুটিয়া বাহির হইতে গেলেন। ইতিপূর্ব্বে আহারাদি শেষে নিজ হস্তে তিনি দ্বার বন্ধ করিয়াছিলেন, কিছুতেই এখন তিনি সেই রুদ্ধ দ্বারের সন্ধান করিতে পারিলেন না—তাঁহার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। একপার্শ্বে একটি গবাক্ষ উন্মুক্ত ছিল, তিনি তাহাই দ্বার মনে করিয়া তন্মধ্য দিয়া বাহির হইতে গেলেন, কাপালে সজোরে আঘাত লাগিল;তিনি পত্রখানি সেই গবাক্ষের ভিতর দিয়া বাহিরে নিক্ষেপ করিলেন। পত্রখানি বাহিরের বারান্দায় গিয়া পড়িল। অরিন্দম সেইখানে পড়িয়া গেলেন মৃতবৎ পড়িয়া রহিলেন।
এসময়ে যোগেন্দ্রনাথ হয়ত পয়ঃফেননিভশয্যায় শয়ন করিয়া কত সুখ-স্বপ্ন দেখিতেছিলেন। কেমন করিয়া তিনি জানিবেন, আজ তাঁহার পরমবন্ধু অরিন্দম শত্রুর চক্রান্তে মরণাপন্ন নিঃসহায় অবস্থায় মরিতে বসিয়াছেন?