পঞ্চম পরিচ্ছেদ : পথিমধ্যে
তখন অরিন্দমের মনের ভিতর কুলসমের কথাগুলি তোলপাড় হইতে লাগিল। একবার ভাবিলেন হয়ত কুলসম যাহা বলিল, সমস্ত সত্য না হইলেও একেবারে মিথ্যা বলিয়া বোধ হয় না। যেরূপভাবে কুলসম ফুলসাহেবের পরিচয় দিল, ফুলসাহেব কি তেমনই একটা ভয়ানক লোক, তেমনই একটা পিশাচ-চেতা? আবার ভাবিলেন, কই, ফুলসাহেবকে তেমন ত দেখিলাম না; লোক্টাকে ভাল বলিয়াই বোধ হইল। হয়ত বা কুলসমের কিছু পাগলের ছিট্ আছে; যেরূপভাবে সে আমার সহিত কথা কহিল তাহাকে পাগলই বা বলি কি করিয়া? যাই হোক্, ব্যাপারটা ভাল করিয়া দেখিতে হইবে বুঝিতেছি, ইহার ভিতর অনেক রহস্য প্রচ্ছন্ন আছে; চেষ্টা করিয়া দেখিলে সময়ে সকলই বাহির হইয়া পড়িবে। দেখা যাক্, ডাক্তার মহাশয় আসিয়া কি বলেন।
অরিন্দম এইরূপ ভাবিতেছেন, এমন সময়ে নিঃশব্দে ফুলসাহেব তথায় প্রবেশ করিলেন। তাঁহাকে তখন বড় চিন্তান্বিত দেখাইল। অরিন্দম কোন কথা কহিলেন না। ফুলসাহেব ত্রুটি স্বীকার করিয়া বলিলেন, “অরিন্দমবাবু, কিছু মনে করিবেন না, অনেকক্ষণ আপনাকে এলা বসাইয়া রাখিয়াছি।” অরিন্দম বলিলেন, “না, সেজন্য আপনি কিছু মনে করিবেন না; যা হোক্, বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা আপাততঃ অনেকটা শান্ত হইয়াছেন ত?”
ফুলসাহেব বলিলেন, “হাঁ, এক রকম বুঝাইয়া আপাততঃ তাহাদিগকে অনেকটা শান্ত করিয়া আসিলাম। মতিবিবি আমারই একজন দূরসম্পর্কীয়া আত্মীয়া;এমন গুণবতী স্ত্রীলোক প্রায়ই দেখা যায় না। উহাকে আমি বড় স্নেহ করি। কই, কুলসমকে সেখানে দেখিলাম না, সে কি আবার এখানে কান্নাকাটি করিতে আসিয়াছিল না কি?”
অরিন্দম মৃদুহাস্যে সত্য কথাই বলিলেন, “কই না, সে আর এখানে কান্নাকাটি করিতে আসে নাই।“
ফুলসাহেব বলিলেন, “এখন চলুন, একসঙ্গে যাওয়া যাক্।”
অরিন্দম উঠিলেন। উভয়ে বাহির হইয়া একটা সোজা পথ ধরিলেন।
কিছুদূর আসিয়া অন্যান্য কথাবার্তার পর ফুলসাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনাকে কতদূর যাইতে হইবে? এখন কি সেই রঘুনাথপুরেই ফিরিবেন?”
অরিন্দম বলিলেন, “না, কামদেবপুরের বাসা বাটীতে এখন যাইব।”
ফুল। সেইখানেই কি এখন কিছুদিন থাকিবেন না কি?
অ। হাঁ, একটা কাজ আছে; বোধহয়, সেইখানে এখন কিছুদিন থাকিতে হইবে।
ফু। কামদেবপুরে আমার দুই-একজন রোগী আছে, মধ্যে মধ্যে আমাকে যাইতে হয়। এবার যখন ওদিকে যাইব, আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চেষ্টা করিব।
অ। যে আজ্ঞা।
কিছুদূর যাইয়া ফুলসাহেব একটি চুরুট বাহির করিয়া তাহাতে অগ্নি সংযোগ করিলেন। তখন একবার অরিন্দমকে বলিলেন, “মহাশয়ের কি চুরুট খাওয়া অভ্যাস আছে?”
অরিন্দম একটু হাসিয়া বলিলেন, “মধ্যে-মধ্যে খেয়ে থাকি বটে, তবে তেমন অভ্যাস নাই।“
ফু। আমার এই চুরুট একটি খেয়ে দেখুন। একটু নূতন বোধ হইবে।
এই বলিয়া ফুলসাহেব পকেট হইতে আর একটি চুরুট বাহির করিয়া অরিন্দমের হাতে দিলেন।
অরিন্দম চুরুট লইয়া বলিলেন, “এখন থাক্, ইহার পর এক সময়ে খাইব, এখন শরীরটা বড় ভাল নাই।”
ফু। বেশ যখন ইচ্ছা আপনি খাইয়া দেখিবেন। তখন বুঝিতে পারিবেন, এরূপ উৎকৃষ্ট চুরুট আপনি আর কখনও ব্যবহার করেন নাই। নিজের ব্যবহারের জন্য আমি এই চুরুট স্বহস্তে তৈয়ার করিয়াছি। ইহার গন্ধ অন্যান্য চুরুটের মত নয়। ইহার এমন অনেক গুণ আছে, যাহা, অপর চুরুটে নাই; বিশেষতঃ মুখের দুর্গন্ধ ও দন্ত-সংক্রান্ত যেকোন পীড়া সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে। একটা ব্যবহার করিয়া দেখিলে সে প্রমাণ পাইবেন।
তাহার পর তাঁহাদিগের অন্যান্য কথাবার্তায় আরও কিছু পথ অতিবাহিত হইল। যখন উভয়ে কামদেবপুরের পথের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন অরিন্দম বলিলেন, “তবে ডাক্তারবাবু, আমি এখন বিদায় লইতে পারি?”
ঘাড় নাড়িয়া, বিশেষ সৌজন্য দেখাইয়া ফুলসাহেব বলিলেন, “ওঃ! এই পথেই আপনাকে যাইতে হইবে বটে। মহাশয়ের সহিত আলাপ পরিচয় হওয়ায় আমি বড়ই সুখী হইলাম। আসুন আপনি, এদিকেও সন্ধ্যা হইয়া আসিল; আপনাকে অনেকদূর যাইতে হইবে।”
ফুলসাহেব গৃহাভিমুখে চলিলেন। অরিন্দম চিন্তিতমনে কামদেবপুরের পথ ধরিয়া চলিতে লাগিলেন।