চতুর্থ পরিচ্ছেদ : সতর্কীকরণ
ডাক্তারের প্রস্থানের পরমুহূর্ত্তেই কুলসম দ্রুতপদে সেই কক্ষে প্রবিষ্ট হইল। সেই কক্ষে এখনও, তাহার পিতার মৃতদেহ পড়িয়াছিল। অরিন্দম মনে করিলেন, কুলসম বুঝি তাহার মৃত পিতাকে আবার দেখিতে আসিয়াছে; কিন্তু সে পিতার মৃতদেহের দিকে একবার ফিরিয়াও চাহিল না; যেখানে অরিন্দম বসিয়াছিলেন, সেইদিকে অগ্রসর হইয়া একখানা চেয়ার টানিয়া বসিল। বলিল, “অরিন্দমবাবু, সাবধান! ঐ ডাক্তার বড় সহজ লোক নয়, আমি উহার ভাব-গতিক দেখিয়া বুঝিতে পারিয়াছি, সে আপনাকে ফাঁদে ফেলিবার চেষ্টায় আছে।”
অরিন্দম তাহার কথা বুঝিতে পারিলেন না। মনে করিলেন, শোকে-দুঃখে কুলসমের মতিভ্ৰম ঘটিয়া থাকিবে;কুলসম অরিন্দমকে নিরুত্তর থাকিতে দেখিয়া তাঁহার মনের ভাব এক রকম অনুভবে বুঝিতে পারিল। সেই সময়ে একটা দুঃখের হাসি সেই ম্লানমুখে একবার দেখা দিল। কুলসম বলিল, “আমাকে পাগল মনে করিবেন না, আমি সকলই দেখিতেছি—সকলই শুনিতেছি—সকলই বেশ বুঝিতে পারিতেছি। আপনি যাহা বুঝিতে পারেন নাই, তাহাও আমি বুঝিতে পারিয়াছি।” মৃত পিতার নিস্পন্দ কঠিন বক্ষে হস্তার্পণ করিয়া বলিল, “আমার পিতার এ দশা কে করিল? কে? ঐ পিশাচ ডাক্তার, ডাক্তার ফুলসাহেব আমার পিতাকে খুন করিয়াছে। দুই বৎসর পূর্ব্বে—যখন ফুলসাহেবকে আমরা জানিতাম না, তখন আমার পিতা কেমন দেখিতে ছিলেন! সেই সবল শরীর আজ দুই বৎসরের মধ্যে জরাতুর বৃদ্ধের অপেক্ষাও জীর্ণশীর্ণ। আজ দুই বৎসরের মধ্যে ফুলসাহেব এ সোনার সংসার শ্মশান করিয়া তুলিয়াছে। এখনও বলিতেছি, অরিন্দমবাবু, আপনি আমাকে পাগল মনে করিবেন না। আমি আমার পিতার মৃতদেহ স্পর্শ করিয়া শপথ করিয়া বলিতেছি, ফুলসাহেবকে যতদূর চিনিতে হয় চিনিয়াছি। আজ তাহার ভাবগতিক দেখিয়া বুঝিতে পারিতেছি, এবার সে আপনাকে বিপদগ্রস্ত করিতে মনস্থ করিয়াছে। আমি তার মুখ দেখিয়া মনের ভাব বুঝিতে পারি। সেইজন্য আপনাকে সতর্ক করিলাম। সাবধান—খুব সাবধান—ফুলসাহেব বড় ভয়ানক লোক!”
কুলসমের সেই আগ্রহাতিশয্যে, তাহার সেই সোজাসুজি সারল্যপূর্ণ কথায় অরিন্দমের মনে কেমন একটা খট্কা লাগিল। তিনি বলিলেন, “সকল কথা খুলিয়া না বলিলে, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”
“না—না, এখন নয়;এখনই পিশাচ আসিয়া পড়িবে—এখন সে সময় নয়।” এই বলিয়া কুলসম সভয়ে একবার ইতস্ততঃ চাহিল।
অরি। যদি বা তিনি আসেন, তাহাতে কি হইয়াছে?
কুল। আমাকেই তার ফলভোগ করিতে হইবে।
অ। যতক্ষণ আমি উপস্থিত, ততক্ষণ বোধহয় নয়।
কু। ততক্ষণ না হইলেও হইতে পারে। এমন নারকী আর আছে কি? এদিকে কথাগুলি এমন মধুমাখা ভাবভঙ্গিতে এমন সাধুতার ভান, কার সাধ্য তাহার মনের ভাব বিন্দুবিসর্গ জানিতে পারে? কখনও তাহার মুখে কর্কশ কথা শুনিতে পাওয়া যায় না, কখনও রাগিতে দেখা যায় না; আজ আপনার সহিত যেরূপ অতিশয় ভদ্রভাবে উহাকে আলাপ করিতে দেখিলেন, চব্বিশঘণ্টা ঠিক ঐ ভাবেই থাকে। আর আজ যাহাকে দেখিলেন, যাহার বয়স আমার বয়সের চেয়ে বড় বেশী হইবে না, উনি আমার বিমাতা—উনিও বড় সহজ নহেন। আমার পিতার মৃত্যুতে তিনি যে শোক প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ মৌখিক, তিনি ইহাতে বরং মনে মনে বড়ই আহ্লাদিত হইয়াছেন। হায়, আজ সকল রকমে আমার যতদূর সর্ব্বনাশ হইতে হয়, তাহা হইয়াছে। আজ আমার আপনার বলিতে কেহ নাই, পিতা নাই, মাতা নাই—–ভ্রাতা নাই—–জানি না, কাহার কাছে গিয়া দাঁড়াইব—আমার কি হইবে?
কুলসমের চক্ষুদ্বয় অশ্রুপূর্ণ হইয়া আসিল। সে দুই হাতে মুখ চাপিয়া কাঁদিতে লাগিল। তাহার চম্পককলিসদৃশ অঙ্গুলি সকলের পার্শ্ব দিয়া, অবিরলধারে অশ্রু নির্গত হইয়া তাহার হাত দুখানি প্লাবিত করিল। অরিন্দম প্রবোধ দিয়া তখন তাহাকে শান্ত করিলেন। কুলসম বলিতে লাগিল, “ফুলসাহেবের এ সংসারে পদার্পণ করিবার দুইমাস পরে আমার মাতার মৃত্যু হইল। তাহার আরও দশমাস পরে আমার অপেক্ষা দুই বৎসরের ছোট একটি ভাই ছিল, তাহার মৃত্যু হইল। তাহার পর আরও ছয় মাস গত হইতে না হইতে আমার পিতার স্বাস্থ্যভঙ্গ হইল। তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হইয়া পড়িলেন। এ-সকলের ভিতরে পিশাচের আরও একটা অভিপ্ৰায় আছে;পাপিষ্ঠ যে আমাকেও আর অধিকদিন, জীবিত রাখিবে; এমন বোধ হয় না।”
অরিন্দম বলিলেন, “কেন—এ কথা বলিতেছ, কেন?”
কুলসম বলিল, “যদি না তাহাকে আমি বিবাহ করি, সে শীঘ্রই আমাকে হত্যা করিবে। তেমন নরাধমকে বিবাহ করিয়া আজীবন মৃত্যু-যন্ত্রণা ভোগ করা অপেক্ষা একদণ্ডের মৃত্যু-যন্ত্রণা সহস্র গুণে শ্রেয়ঃ। সেইজন্য পিশাচ থাক, ও কথা এখন থাক, আমি আমার দুঃখের কথা আপনাকে বলিব মনে করিয়া এখানে আসি নাই;আপনাকে সাবধান করিতে আসিয়াছি। এখনও আপনাকে বলিতেছি, ফুলসাহেবকে সাবধান; সম্মুখে সর্প দেখিলে লোকের যেরূপ সাবধান হওয়া আবশ্যক, আপনি সেইরূপ সাবধানে থাকিবেন। যখন প্রথমেই সে এখানে আপনাকে দেখে, তখনকার মুখের ভাব দেখেই আমি বুঝিয়াছি, যদিও আপনি ফুলসাহেবকে চেনেন না, সে আপনাকে বেশ চেনে;শুধু চেনে না, আপনাকে সে যে তেমনি ঘৃণা করে আপনার নাম শুনেই তার চোখ দুটা একেবারে জ্বলিয়া উঠিতেই আমি তা’ বেশ বুঝিতে পারিয়াছি। যদিও ফুলসাহেব আপনার সহিত নম্র কথা কহিতেছিল, কিন্তু নিশ্চয় জানিবেন, তার বিনীত, মিষ্ট হাসিমাখা কথার অপেক্ষা কালসাপের গর্জ্জনও মঙ্গলজনক। এখন আমি চলিলাম।’
এই বলিয়া কুলসম উঠিল।
“বসো আমারও একটি কথা আছে,” বলিয়া অরিন্দম একদণ্ড কাগজে নিজের ঠিকানাটি লিখিয়া কুলসমের হাতে দিলেন। বলিলেন, “যদি কখনও দরকার হয়, এই ঠিকানায় সংবাদ দিতে বিলম্ব করিয়ো না।”
কুলসম মাথা নাড়িয়া স্বীকার করিল। তাহার পর চঞ্চলপদে তথা হইতে চলিয়া গেল।