বিংশতি পরিচ্ছেদ : সাফল্য
বৃদ্ধকে তৃষ্ণাতুর মৃতপ্রায় দেখিয়া ব্রাহ্মণী সেই যে জল আনিতে গেলেন এখনও ফিরিলেন না—কারণ? ব্রাহ্মণী যখন জল লইয়া আসিলেন, তখন রেবতী ও অরিন্দমকে পরস্পর কথোপকথন করিতে শুনিয়া ঘরের ভিতরে আর ঢুকিলেন না; জলের ঘটী হাতে, বাহিরে দাঁড়াইয়া তাঁহাদিগের কথাবার্তা একান্ত নিবিষ্টমনে শুনিতে লাগিলেন। শুনিতে লাগিলেন, আর জলপূর্ণ ঘটীটি তাঁহার হাতে থরথর্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল। ঠাকুর মহাশয় বাড়ীতে নাই, তিনি একাকী কি করিবেন ভাবিয়া পাইলেন না। স্ত্রীলোকের মন বড় কৌতূহলপ্রিয়। কৌতূহলী মন বলিল, “আগে শোনা যাক্, তাহার পর যাহা করিতে হয়, করা যাইবে। তার আগে যদি তিনি আসিয়া পড়েন, তিনিই যা’ হয় করিবেন। এখন শুনিই না—কি কথা হয়।” ব্রাহ্মণী একমনে শুনিতে লাগিলেন। কতক শুনিতে পাইলেন, কতক বা না; আবার যাহা শুনিলেন তাহার কতক বা বুঝিতে পারিলেন, কতক বা না।
তাহার পর যখন অতি মৃদুস্বরে তাঁহাদিগের পরামর্শ চলিতে লাগিল, যাহা আমরাও এখন জানিতে পারি নাই, তখন ব্রাহ্মণীর কানে আর কিছুই আসিল না। কেবল জানালার ফাঁক দিয়া ব্রাহ্মণীর আগ্রহপূর্ণ চক্ষু এই সময়ে ক্ষণে ক্ষণে রেবতীর মুখের রকম রকম ভাব দেখিতে লাগিল। সেই সময়ে সেই সকল বিষয়ে তাঁহার মন এমনই আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল, যে হাতের জলের ঘটীর কথা কিছুই মনে ছিল না। কাঁপিতে কাঁপিতে সেটি হাত হইতে সশব্দে ভূতলে পড়িয়া গেল। তখন অরিন্দম প্রস্থান করিবার জন্য উঠিয়াছেন; যাইবার সময়ে বলিয়া গেলেন, “আর জল খাইব না।”
অনতিবিলম্বে যদুনাথ গোস্বামী কবিরাজ সমভিব্যাহারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন! ব্রাহ্মণী তাঁহাকে কতক বা ঠিক, কতক বা বেঠিক অনেক কথা শুনাইলেন। শুনিয়া গোস্বামী মহাশয়ের বাক্য স্ফূৰ্ত্তি হইল না। কবিরাজ ম্লানমুখে ফিরিয়া গেল। তখন গোস্বামী মহাশয় ও তাঁহার পত্নী রেবতীকে বড় পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিল, কে সে? কেন আসিয়াছিল? কোথায় থাকে? কি বলিয়া গেল? ইত্যাদি—ইত্যাদি।
রেবতী একটি কথারও উত্তর করিল না।
সেইদিন অপরাহ্ণে আর এক কাণ্ড ঘটিল। রেবতীর মাতামহ (?) পুলিস-প্রহরী সঙ্গে লইয়া রেবতীকে লইতে যদুনাথ গোস্বামীর বাটীতে উপস্থিত। রেবতী সেখানে আছে কি না, যদুনাথ গোস্বামীকে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি স্বীকার করিবেন, কি অস্বীকার করিবেন, তাহা ভাবিয়া দেখিবার পূর্ব্বেই রেবতী ছুটিয়া বাহিরে আসিল। সে তাহার মাতামহকে চিনিল। তখন পাল্কী ডাকাইয়া রেবতীকে তন্মধ্যে শোয়াইয়া লওয়া হইল। অরিন্দম ও যোগেন্দ্রনাথ উভয়েই তথায় উপস্থিত হইলেন।
অরিন্দম যদুনাথ গোস্বামীকে বলিলেন, “কি গোস্বামী মহাশয়, পাঁচশত টাকা যে একেবারে ফাঁকা হইয়া গেল। যাহা হউক, রক্তমাখা কাপড়ের সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে যে মর্চ্চেধরা ছুরিখানা রাখিয়া আসিয়াছিলেন, যখন অবসর হইবে, সেখানা থানায় গিয়া লইয়া আসিবেন; অনর্থক আর কেন ঘর থেকে ছুরিখানা লোকসান দিবেন?”
গোস্বামী মহাশয় চুপ করিয়া রহিলেন।
অরিন্দম বলিলেন, “আপনি একান্ত ভাল মানুষ, একটা খুব. খেলাই খেলিলেন!”
ঠাকুর মহাশয় তথাপি কোন উত্তর করিলেন না।
সকলে চলিয়া গেল।
ঠাকুর মহাশয় কিসে কি ঘটিয়া গেল, ভাবিয়া কিছুই ঠিক করিতে পারিলেন না।