ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : রেবতীর আত্মকাহিনী
রেবতী বলিতে লাগিল, “আমাদের বাড়ী বেণীমাধবপুরে; আমার পিতার নাম জানকীনাথ বসু। প্রায় দুই বৎসর হইল, তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। পিতার মৃত্যুর পর এক বৎসর পূর্ব্বে মাতার মৃত্যু হইয়াছিল। আমার আর একটি বোন আছে, তার নাম রোহিণী; আমরা দুই বোনে কাকার নিকটে থাকিতাম। কাকার নাম গোপালচন্দ্র বসু। কাকাবাবুর অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। শুনিয়াছি, তিনি একবার বাবার সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা করিয়া নিজের বিষয়ের সমস্ত অংশ নষ্ট করিয়া ফেলেন। তখন বাবা আবার তাঁহাকে ডাকিয়া নিজের জমিদারী হইতে চারি আনা অংশ দান করেন। তখন থেকে বাবার সঙ্গে কাকাবাবুর যে মনোমালিন্য ছিল, তাহা ঘুচিয়া যায়। বাবার মৃত্যুর পর হইতে আজ দুই বৎসরকাল কাকাবাবু সমস্ত জমিদারীর কাজকর্ম্ম নিজেই দেখিয়া আসিতেছেন। সন্তানাদি না থাকায় কাকা আর কাকীমা আমাদিগকে মাতাপিতার অধিক স্নেহ করেন। না জানি, আমার জন্য কাকা মহাশয় কি কাণ্ডই না করিতেছেন! আপনি আমাকে কোন রকমে কাকাবাবুর কাঠে পাঠাইয়া দিন, তাহা হইলে আমার যথেষ্ট উপকার করিবেন।”
অরিন্দম বলিলেন, “সে কথা পরে হইবে–এখন তোমার এ-দুরবস্থার কারণ কি বল দেখি, যদি আমি কোন প্রতীকার করিতে পারি।”
রেবতী বলিতে লাগিল, “ইদানীং কেশবচন্দ্র নামে একটি লোক কাকাবাবুর সহিত প্রত্যহ দেখা- সাক্ষাৎ করিত। আগে তাহাকে কখনও দেখি নাই। লোকটা বড় মিষ্টভাষী; কাকাবাবুর সঙ্গে তাহার এমন ঘনিষ্ঠতা হইল যে, কোনদিন তাহার আসিতে বিলম্ব হইলে কাকাবাবু তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইতেন। আসিলে কখনও বা তাহার সঙ্গে গল্প করিতেন, কখনও বা দাবা খেলিতেন, কখনও বা বেড়াইতে বাহির হইতেন। যদি কোনদিন কেশবচন্দ্র না আসিত, সেদিন কাকাবাবুকে বড়ই বিমর্ষ থাকিতে দেখিতাম। কেশবচন্দ্রও আমাদিগকে কাকাবাবুর মত স্নেহ দেখাইত; কিন্তু সে মানুষ নয়, পিশাচ—তার মনের ভাব অন্য রকমের। আজ প্রায় এক সপ্তাহ হইল, কি জানি কি ঔষধের সাহায্যে আমাকে অজ্ঞান করিয়া, চুরি করিয়া লইয়া আসে। যখন আমার প্রথম জ্ঞান হইল, তখন কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। মাথার ভিতরে বড় যন্ত্রণা হইতেছিল; সমস্ত শরীরটা যেন কেমন এক রকম অবশ হইয়া গিয়াছিল, এমনকি ভাল করিয়া চোখ চাহিতেও যেন কষ্ট বোধ হইতেছিল। দেখিলাম, আমি নৌকার উপরে রহিয়াছি। নৌকাখানা গঙ্গার একদিক্কার কিনারায় লাগান রহিয়াছে। সে দিক্টা ভয়ানক বন, তেমন বন কখনও আমি দেখি নাই। নৌকার উপর কেশবচন্দ্র, আর চারি পাঁচজন দাঁড়ি মাঝি, তাহারা তামাক খাইতেছে, আর কি বলাবলি করিতেছে। তখন যেন আমার সমস্তই স্বপ্ন বলিয়াই বোধ হইতে লাগিল—কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। মাথাটা আরও ভারী হইয়া উঠিল। তীরে একটা লোক দাঁড়াইয়া ছিল, সেই গোরাচাঁদ। তাহাকে আর কখনও দেখি নাই। সে বলিল, ‘ইহাকে লইয়া যাইব কি? ইহার যে জ্ঞান হইয়াছে, দেখিতেছি।’ তাহার কর্কশকণ্ঠ আমার অবশ কর্ণে আরও কর্কশ শুনাইল; আমার বড় ভয় হইল—বিশেষতঃ তাহার দস্যুর মত বিকট চেহারা দেখিয়া ভয়ে প্রাণ উড়িয়া গেল। আমি চীৎকার করিয়া, কাঁদিয়া উঠিতে চেষ্টা করিলাম—পারিলাম না, বড়ই দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িয়াছিলাম, কাঁদিতে গিয়া বুকে বড় ব্যথা লাগিল; কাঁদিতে পারিলাম না। তখন কেশবচন্দ্র তাড়াতাড়ি আসিয়া আমার নাকের কাছে একখানা রুমাল চাপিয়া ধরিল, মাথায় যেন বজ্র আসিয়া পড়িল;আবার আমি অজ্ঞান হইলাম। তাহার পর আবার যখন জ্ঞান হইল, তখন দেখিলাম, সে গঙ্গা নাই, সে বন নাই, নৌকা নাই, দাঁড়ি-মাঝি কেহ নাই। আমি একটা নিবিড় বনের মাঝখানে দুর্গন্ধ আবৰ্জ্জনাপূর্ণ একটা ঘরে একাকী পড়িয়া আছি। ঘরটি বাহির হইতে বন্ধ। বাহির হইবার আর কোন উপায় নাই। তাহার পর কেশবচন্দ্র প্রত্যহ এক-একবার আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা করিতে লাগিল। আমাকে বিবাহ করিবার জন্য যে সে এই কাজ করিয়াছে, একদিন তাহা প্রকাশ করিল। আমি কিছুতেই সে পাপিষ্ঠের কথায় সম্মত হইতে পারিলাম না। সেজন্য আমাকে পিশাচ কত ভয় দেখাইত, কখনও বা ছুরি লইয়া কাটিতে আসিত—আমি কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ করিলাম না—কিছুতেই সম্মত হইলাম না। তেমন পাপিষ্ঠের স্ত্রী হইয়া আজন্ম মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করা অপেক্ষা তাহার শাণিত ছুরির মুখে মুহূর্ত্তের মৃত্যু শ্রেয় বোধ করিলাম। গোরাচাঁদের উপরে আমার রক্ষার ভার ছিল; সে সেই নরপ্রেতের বিশ্বস্ত অনুচর। শেষে একটা স্ত্রীলোক আমাকে উদ্ধার করে। শুনিলাম, সে কেশবচন্দ্রের স্ত্রী; সে-ই আমাকে এখানে আসিবার পথ দেখাইয়া দেয়। একটা বড় প্রান্তর পার হইয়া আমি এই গ্রামে আসি, তখন ভয়ানক ঝড়বৃষ্টি হইতেছিল। এখানকার গোঁসাইপাড়ায় আমাদিগের গুরু যদুনাথ গোস্বামীর নিকটে যাইব মনে করিয়া এখানকার একটি মুদির দোকানে গোঁসাইপাড়ার পথ জিজ্ঞাসা করিয়া লই। সেখানে আরও অনেক লোক বসিয়া তাস খেলিতেছিল, তাহারা আমায় একটা দীঘির ধার দিয়া যাইতে বলিল। আমি আবার চলিতে আরম্ভ করিলাম। যখন দীঘির ধার দিয়া যাইতেছি, তখন পশ্চাদ্দিকে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলাম। আগে বন ছাড়িয়া যখন প্রান্তরে পড়ি, তখন একবার গোরাচাঁদকে পথে আমার অনুসরণ করিতে দেখিয়াছিলাম। আমি ভয়ে একটা গাছের আড়ালে লুকাইয়া পড়ি, সে আমাকে দেখিতে পায় নাই, সে আর একদিকে চলিয়া গেল। আমি প্রান্তরের মাঝখান দিয়া, সেই ঝড়বৃষ্টি মাথায় করিয়া এই গ্রামে আসিয়া পড়িলাম; দীঘির ধারে আসিয়া যে পদশব্দ শুনিয়াছিলাম, তাহা তখন গোরাচাঁদের বলিয়াই আমার বোধ হওয়ায় আরও ভয় হইল। আমি আবার প্রাণপণে ছুটিতে লাগিলাম। এমন সময়ে আমার আঁচলখানায় টান পড়িল;আবার গোরাচাঁদের হাতে পড়িলাম ভাবিয়া, আকুল হইয়া কাঁদিয়া উঠিলাম মাটিতে পড়িয়া গেলাম; এমন সময়ে কে আসিয়া আমাকে ধরিয়া তুলিলেন। বিদ্যুতের আলোকে তাঁহাকে চিনিলাম, তিনিই যদুনাথ গোস্বামী, ভরসা হইল। দেখিলাম, কেহই আমার আঁচল ধরে নাই, একটা কাঁটাগাছে আঁচলখানা জড়াইয়া গিয়াছিল; যে পদশব্দ শুনিতে পাইয়াছিলাম, তাহা গোস্বামী মহাশয়েরই। পড়িয়া গিয়া কপালের একস্থানে কাটিয়া গিয়াছিল। ক্ষতমুখ দিয়া রক্ত বাহির হইতে লাগিল। গোস্বামী মহাশয়কে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিলাম, দুই-তিনদিনের জন্য আমাকে তাঁহার কাছে লুকাইয়া রাখিবার জন্য অনুনয় করিলাম। তিনি সম্মত হইয়া আমাকে তাঁহার বাড়ীতে লইয়া চলিলেন। তাঁহার নিকটে শুনিলাম, তিনি গোঁসাইপাড়ায় আজ-কাল থাকেন না; সে বাড়ী তাঁহার ভগিনীকে থাকিতে দিয়া নিজে এখন এইখানে থাকেন। আমাকে এইখানে লইয়া আসিলেন। যাহাতে আর কেহ আমার সন্ধান করিতে না পারে, যাহাতে আমাকে খুন করিয়াছে বলিয়া লোকের মনে একটা ধারণা হয়, সেইজন্য আমার রক্তমাখা কাপড়, একখানা বড় ছুরি, আর দুই-তিনটা মাথার কাঁটা লইয়া গোস্বামী মহাশয়, যেখানে আমি পড়িয়া গিয়াছিলাম, সেইখানের একটা জঙ্গলে রাখিয়া আসিলেন। শুনিলাম, ফিরিয়া আসিবার সময়ে এখানকার দুই-একজন লোকের সঙ্গে তাঁহার দেখা হইয়াছিল তাহারাও নাকি আমাকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছিল। যাই হোক্, গোস্বামী মহাশয় যে আমাকে সামান্য টাকার লোভে আবার সেই বিপদের মুখে ফেলিবার ষড়যন্ত্র করিয়াছেন, ইহা ভাবিতেও কষ্ট বোধ হয়। যখন আমার পিতা জীবিত ছিলেন, তখন উনি তাঁহার নিকটে কত বিষয়ে কত টাকা পাইয়াছেন, সেসকল কি একবারও এখন মনে পড়িল না! এ সংসারে কাহাকেও বিশ্বাস করিতে নাই।” বলিতে বলিতে রেবতীর ফুল্লেন্দীবরতুল্য সেই বড় বড় চক্ষু দুটি সজল হইল, হিমনিষিক্তপদ্মবৎ সে-চক্ষু দুটি পরম শোভাময়, দুই চক্ষে দুইটি বড় বড় অশ্রুবিন্দু মুক্তার ন্যায় জ্বল্ জ্বল্ করিতে লাগিল; আবার ভাবনার অপার সমুদ্রে পড়িয়া রেবতী আকুল হইয়া উঠিল।। রেবতী আর কথা কহিতে পারিল না, রেবতীর বুক কাঁপিতে লাগিল; রেবতী চোখে দেখিতে পাইল না, রেবতী নীরবে সেইখানে বসিয়া কাঁদিতে লাগিল।
রেবতীর কথা শুনিয়া অরিন্দম নিজের সন্দেহের সহিত অনেকগুলি বিষয় মিলাইয়া পাইলেন। যেখানে রেবতীর রক্তাক্ত কাপড় ইত্যাদি পড়িয়াছিল, সেই জঙ্গল মধ্যে যদুনাথের দুইবার যাতায়াতের পদচিহ্ন পড়িবার কারণও বুঝিলেন। একবার সেই রক্তাক্ত কাপড় ইত্যাদি রাখিতে গিয়াছিলেন, আর একবার বলাই মণ্ডল ও তাহার সঙ্গিগণকে সেই সকল দেখাইতে লইয়া গিয়াছিলেন। অরিন্দম রেবতীকে অনেক বুঝাইয়া শান্ত করিলেন; জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেশবচন্দ্রের সম্বন্ধে আর কোন কথা তুমি জান?”
রেবতী চোখ মুছিয়া বলিল, না, “আপনি এখন দয়া করিয়া এ বিপদ্ হইতে আমাকে উদ্ধার করুন; আবার যদি সেই পাপিষ্ঠের হাতে পড়ি, তাহা হইলে আর বাঁচিব না। আপনি আমার কাকার কাছে আমায় রাখিয়া আসুন।”
অরিন্দম সে কথায় কোন কথা না কহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এত বয়সেও তোমার বিবাহ হয় নাই কেন? এখন বোধ করি, তোমার বয়স পনেরো বৎসরের কম নহে।”
রেবতী লজ্জিতভাবে বলিল, “বাবা বাঁচিয়া থাকিলে এতদিন তিনি আমার বিবাহ দিতেন। যখন আমার বয়স বারো বৎসর, তখন বাবা কলিকাতা শহরের দক্ষিণে ভবানীপুরে আমার বিবাহ দিবার জন্য ঠিঠাক্ করিয়াছিলেন। তাহার পর হঠাৎ তাঁহার শরীর ভাঙিতে আরম্ভ হয়। কি এক উৎকট পীড়ায় হঠাৎ তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়িলেন; কোন ডাক্তার কি কবিরাজ, কেহই সে রোগ নির্ণয় করিয়া উঠিতে পারিলেন না। বাবা প্রায় ছয়মাসকাল শয্যাশায়ী থাকিয়া ক্রমে আরও দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িলেন। কি রোগ কেহ ঠিক করিতে পারিল না; কাজেই চিকিৎসাও তেমন হইল না, বাবা অসময়ে আমাদের ছাড়িয়া গেলেন।”
অ। তোমার কাকাবাবু তোমার বিবাহে এতদিন উদাসীন ছিলেন কেন?
রে। তিনি জমিদারী কাজকর্ম্মে ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন, এমনকি স্নানাহারেরও সময় পাইতেন না।
অ। এই বলিলে তিনি কেশবচন্দ্রের সঙ্গে সদাসর্বদা গল্প করিতেন, দাবা খেলিতেন, তাস পিটিতেন—বেড়াইতে বাহির হইতেন; তোমার উপরে তাঁহার যেরূপ স্নেহ—তোমার মুখে শুনিলাম—তাহাতে তিনি তোমার বিবাহের কোন বন্দোবস্ত না করিয়া তাস, দাবা, গল্প, বেড়ান দূরে থাক্, তিনি যে কেমন করিয়া স্নানাহার করিতেন, বুঝিতে পারিলাম না। বোধ হয়, কাকাবাবু, তোমায় এত অধিক পরিমাণে স্নেহ করিতেন, তিনি তোমাকে বিবাহ দিয়া, পরের ঘরে পাঠাইয়া, কেমন করিয়া প্রাণ ধরিবেন, সে বিষয়ে তাঁহার একটু সন্দেহ ছিল।
রেবতী, তাঁহার এই ব্যঙ্গোক্তি বুঝিতে পারিল না। অরিন্দম তখন রেবতীকে যাহা যাহা করিতে হইবে, সব বলিয়া দিলেন;এবং এই চতুৰ্দ্দিকব্যাপী বিপদের মুখ হইতে তাহাকে যে কৌশলে উদ্ধার করিবেন, তাহাও বলিয়া দিলেন। আরও অনেকক্ষণ ঐ সম্বন্ধে পরামর্শ করিয়া যাহা স্থির হইল, তাহাতে রেবতী অনেকটা আশ্বস্ত হইতে পারিল। রেবতীর চক্ষু হইতে যেন আর একটা আবরণ সরিয়া গেল।