দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : গুম্ খুন
যখনকার কথা বলিতেছি, তখন অরিন্দম বসু একজন প্রধান ডিটেক্টিভ বলিয়া হুগলী জেলার আবালবৃদ্ধ বনিতার নিকটে তাঁহার খ্যাতি-প্রতিপত্তি ছিল। তাঁহার আফলোদয় অনুসন্ধিৎসা ও উদ্যম, প্রাণপণ যত্ন ও চেষ্টা এবং অসাধারণ আগ্রহ ও অধ্যবসায় তখনকার দস্যু, জালিয়াৎ, খুনী ইত্যাদির নিকটে তাঁহাকে যথার্থই ‘অরিন্দম’ বলিয়া পরিচিত করিয়া দিয়াছিল। আমাদের এই বক্ষ্যমাণ আখ্যায়িকায় তাঁহারই একটি ভীষণ ঘটনা লিপিবদ্ধ করিব।
হুগলী জেলার অন্তর্গত কামদেবপুর গ্রামে অরিন্দম বসুর বাসাবাটী। একদিন অতি প্রত্যূষে স্থানীয় থানার অধ্যক্ষ যোগেন্দ্রনাথ তাঁহার বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন অরিন্দম তাঁহার বাসাবাটীর বাহিরের একটি ঘরে বসিয়া ছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ আসিলে তিনি তাঁহার হাত ধরিয়া যথেষ্ট সম্ভ্রমের সহিত বসিতে বলিলেন।
যোগেন্দ্রনাথ না বসিয়া, দুই হাতে অরিন্দমের হাত ধরিয়া টানিয়া বলিলেন, “আপনি শীঘ্র আসুন—আসিয়াই যখন দেখা পাইয়াছি তখন আর বিলম্ব করা ঠিক হইবে না।”
অরিন্দম তাঁহার সেই উৎকণ্ঠিত ভাব দেখিয়া, বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, কি হইয়াছে? কোথায় যাইতে হইবে?”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “থানায়। আপনি আসুন, সেখানে গিয়া সকলই দেখিবেন—সকলই শুনিবেন, এখানে আমি কিছুই বলিব না।”
এই বলিয়া যোগেন্দ্রনাথ অরিন্দমের হাত ধরিয়া, জোর করিয়া টানিয়া থানার দিকে তাঁহাকে লইয়া চলিলেন।
অরিন্দমের বাটী হইতে থানা বড় বেশীদূর নহে। অল্পক্ষণেই অরিন্দমকে লইয়া যোগেন্দ্ৰনাথ থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তথাকার একটি ঘর চাবিবদ্ধ ছিল; যোগেন্দ্রনাথের নিকটেই চাবি ছিল, তিনি চারি খুলিয়া অরিন্দমকে সেই কক্ষমধ্যে লইয়া ভিতর হইতে কপাট বন্ধ করিয়া দিলেন সেই প্রকোষ্ঠের এক কোণে কাঠের একটি বড় সিন্দুক পড়িয়াছিল। সিন্দুকটি নূতন ঝক্ঝকে। তথায় বসিবার উপযুক্ত আর কোন সামগ্রী না থাকায় অরিন্দম সেইটির উপরে বসিতে যাইতেছিলেন যোগেন্দ্রনাথ নিষেধ করিলেন;এবং অতি দ্রুতহস্তে সেই সিন্দুকটি খুলিয়া অরিন্দমকে দেখাইলেন দেখিয়া অরিন্দম শিহরিয়া উঠিলেন; তাঁহার বিস্ময়বিস্ফারিত চোখ অনেকক্ষণের জন্য সেই সিন্দুকের মধ্যে নির্নিমেষ হইয়া রহিল; রুদ্ধশ্বাসে নিঃসংজ্ঞবৎ অরিন্দম প্রস্তর-গঠিতের ন্যায় নীরব নিস্পন্দ রহিলেন।
সেই সিন্দুক মধ্যে অন্যূন দ্বাদশবর্ষীয়া একটি বালিকার মৃতদেহ। সেই মৃতদেহ শতস্থানে অস্ত্রক্ষত, রক্তসিক্ত এবং অনেক স্থানে হাড় বাহির হইয়া পড়িয়াছে; দক্ষিণ হস্ত একেবারে কাটিয়া লইয়াছে। কী ভয়ানক! কী ভয়ানক পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় এ বালিকাকে যে হত্যা করা হইয়াছে, তাহা ভাবিতেও হৃৎকম্প হইতে থাকে। সেই মৃতদেহের দিকে চাহিয়া কখনই বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হয় না যে, কোন মনুষ্য হইতে ঐ কার্য্য সম্ভবপর। কে এমন নৃশংস নরপ্রেত এই ক্ষুদ্র বালিকার শিরীষকোমলদেহে শাণিত শতছুরিকাঘাত করিতে কাতর হয় নাই?