দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : পদচিহ্ন
যোগেন্দ্রনাথ অরিন্দমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “যদুনাথ গোস্বামীকেই কি আপনি এ খুন সম্বন্ধে সন্দেহ করিতেছেন?”
অরিন্দম বলিলেন, “খুন কোথায়, যোগেনবাবু? আপনি কি মনে করিয়াছেন, সেই বালিকাকে কেহ হত্যা করিয়াছে?”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এই রক্তমাখা কাপড়, ছোরা দেখিয়া তাহা ভিন্ন আর কি মনে করা যাইতে পারে? বিশেষতঃ একটা দস্যু ছুরি লইয়া সেই বালিকার অনুসরণ করিয়াছিল, শুনিলাম। আপনি কি বলেন।
অরিন্দম বলিলেন, “আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আমি যতটুকু বলিতে পারি, সেই বালিকা মরে নাই, কোথাও যায় নাই, এই গ্রামের মধ্যে আছে।”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “বলাই মণ্ডল যে বালিকাকে খুন করিল’ বলিয়া বারংবার আর্ত্তনাদ করিতে শুনিয়াছিল, সেটুকু কি বলাই মণ্ডলের একটা স্বপ্ন?”
অরিন্দম বলিলেন, “স্বপ্ন নহে, ঐ জন্য আমারও মনের ভিতর একটু গোলযোগ বাঁধিয়াছে; নতুবা এখানে আসিয়া আর যা’ শুনিলাম, আর যা’ দেখিলাম, তাহাতে বালিকা যে এখনও বাঁচিয়া আছে, বেশ বুঝা যাইতেছে।”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সেই বালিকা যে এখনও বাঁচিয়া আছে। এমন কি প্রমাণ পাইলেন?” অরিন্দম বলিলেন, “যে দুই-চারিটি প্রমাণ পাইয়াছি, তাহাতে আমি অনেকটা নির্ভর করিতে পারি। প্রথমতঃ এই জঙ্গলের ভিতরে ও বাহিরে কদমের উপর যেসকল পদচিহ্ন রয়েছে, তন্মধ্যে কোনটিই ত বালিকার বলিয়া বোধ হয় না। সকলগুলিই যথেষ্ট লম্বা এবং যথেষ্ট চটলা।”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তাহা যেন হইল, কিন্তু হত্যাকারী অপর স্থানে সেই বালিকাকে হত্যা করিয়া সেই জঙ্গলের ভিতরে রক্তমাখা কাপড় আর ছুরিখানা লুকাইয়া রাখিতে পারে।”
অরিন্দম বলিলেন, “দ্বিতীয়তঃ হত্যাকারীর কোন চিহ্ন দেখিতেছি না। এই জঙ্গলের ভিতরে কেবল আমি চারি মানুষের পায়ের দাগ দেখিতেছি। চারিজনের মধ্যে একজন বলাই মণ্ডল, একজন সাধুচরণ, একজন হরেকৃষ্ণ, একজন আমাদের গোস্বামী প্রভু। এই চারিজনেই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়াছিল বলিতেছে; চারিজনেরই পায়ের দাগ পাওয়া যাইতেছে;এই চারিজন ছাড়া এই জঙ্গলের মধ্যে কেহ যায় নাই, তাহা হইলে চারিটা ছাড়া অপর রকমের দাগ একটি-না একটি দেখিতে পাইতাম। আর সত্যই যদি বালিকা খুন হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই চারিজনের মধ্যেই কেহ সেই বালিকার হত্যাকারী।”
[* বলাই মন্ডলের সঙ্গিদ্বয়—যাহারা গতরাত্রে লাঠি হাতে বলাই মন্ডলের অনুসরণ করিয়াছিল।]
এই বলিয়া অরিন্দম উঠিলেন, জবানবন্দি দিতে আসিয়া বলাই মণ্ডল, সাধুচরণ, হরেকৃষ্ণ ও যদুনাথ গোস্বামীর যেসকল পায়ের দাগ ভিজা মাটিতে পড়িতে তিনি দেখিয়াছিলেন, সেইগুলির সহিত জঙ্গল মধ্যস্থিত পায়ের দাগগুলি এক একটি করিয়া মাপে মিলাইয়া যোগেন্দ্রনাথকে দেখাইলেন। সকলগুলিই মাপে ঠিক হইল। কোটি কাহার পায়ের দাগ, তাহাও বলিয়া দিলেন। যোগেন্দ্ৰনাথ বিস্ময়-পুলকিত দৃষ্টিতে অবাঙ্মুখে অনেকক্ষণ অরিন্দমের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
অরিন্দম বলিলেন, “আরও একটা কথা হইতেছে, এই কাপড়খানিতে যেভাবে রক্ত লাগিয়াছে, তাহাতে হত্যাকাণ্ডের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। আমার বোধ হয়, কেহ কাপড়খানাতে রক্ত মাখাইয়া দিয়াছে। তা’ ছাড়া যদি ঐ ছুরি, কিংবা ঐরূপ কোন অস্ত্র দিয়াই সেই বালিকাকে খুন করা হইত, তাহা হইলে ঐ কাপড়ের কোন এক অংশ সম্পূর্ণরূপে রক্তে ভরিয়া যাইত। এমন এখানে একটু, সেখানে একটু করিয়া চারিদিকে রক্ত লাগিবে কেন? হত্যাকারীর কাপড়ে এরূপভাবে রক্ত লাগা অসম্ভব নহে। তা’ ছাড়া, খুন করিয়া মৃতদেহ হইতে কাপড়খানি খুলিয়া লইবারও কোন কারণ দেখিতেছি না। কাপড়খানি এমন কিছু একটা ভারী জিনিষ নয় যে, হত্যাকারী মৃতদেহের সহিত এ কাপড়খানি বহন করা কষ্টকর বিবেচনা করিয়াছিল।”
মুগ্ধচিত্তে যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনি যে এইসব সামান্য বিষয় হইতে এতদূর ঠিক করিতে পারিয়াছেন, ইহাই আশ্চর্য্য; আমি ত এসকলের বিন্দুবিসর্গ লক্ষ্য করি নাই।”
অরিন্দম বলিলেন, “ইহাই বা কি, অনেক সময়ে একগাছি সামান্য চুলের উপর নির্ভর করিয়াও আমাদের চলিতে হয়;সন্দেহের একটি পরমাণু পাইলেও সেটি লইয়া আমাদের সহস্রবার নাড়াচাড়া করিয়া দেখিতে হয়।”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “যদি খুনই হয় নাই, বালিকা বাঁচিয়া আছে, তবে যদুনাথ গোস্বামীর উপরে আপনি অনর্থক সন্দেহ করিতেছেন কেন?”
অরিন্দম বলিলেন, “খুন হয় নাই বলিয়াই যে কাহাকেও সন্দেহ করিব না, এমন কি কথা? আমি ত গোস্বামীকে খুনী বলিয়াই সন্দেহ করি নাই। গোস্বামী এইসকল কাণ্ডের কিছু-না-কিছু জানেন বলিয়াই আমি তাঁহাকে সন্দেহ করিতেছি; নতুবা কোন্ প্রয়োজনে তিনি মিথ্যা বলিলেন? অবশ্যই মিথ্যা বলিয়া তিনি আমাদের দৃষ্টি হইতে কোন বিষয় প্রচ্ছন্ন রাখিতে ব্যর্থ চেষ্টা করিতেছিলেন। গোস্বামী মহাশয় বলিলেন, তিনি একবার ভিন্ন এই জঙ্গলের ভিতর আর যান নাই; কিন্তু তিনি যে দুইবার এই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়াছেন, তাহার প্রমাণ এই দেখুন, গোস্বামীর পায়ের দাগগুলি এক মুখে দুইবার অঙ্কিত হইয়াছে। এই দেখুন, গোস্বামী মহাশয়ের এইগুলি দক্ষিণ পায়ের দাগ, এইগুলি এক ইঞ্চি তফাতে ঠিক পাশাপাশি; দেখুন ঐ ভাবে ঐ মুখে আরও এক একটি ঐ দক্ষিণ পায়ের দাগ। যদি এ দাগগুলি বিপরীত মুখে পড়িত, তাহা হইলে মনে করিতে পারিতাম, এ দক্ষিণ পায়ের দাগ ফিরিবার সময়ে পড়িয়াছে।”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এরূপ ত হইতে পারে, হয়ত ভিতরে ঢুকিবার সময়ে ঐখানে তিনি একবার দাঁড়াইয়াছিলেন। ঐ কারণে আবার একবার একটু পাশে সরিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। তাহাতে এক পায়ের দাগ একমুখে দুইবার ঐরূপ পাশাপাশি অঙ্কিত হওয়া বিচিত্র নহে।”
অরিন্দম বলিলেন, “শুধু একস্থানে ঐরূপ দাগ পড়িলে আপনার এ যুক্তি অন্যায় বোধ করিতাম না; দেখুন, প্রত্যেক স্থানে ঐরূপ দাগ রহিয়াছে। কোন কোন স্থানে দাগের উপরেও দাগ পড়িয়াছে, কোন স্থানে বা একটু বেশী তফাৎ; কেবল ফিরিবার সময়ের দাগগুলি এরূপ একপায়ের দাগ একমুখে পাশাপাশি দেখা যাইতেছে না। তাহার কারণ, তিনি প্রথমবার এখানে আসিয়া এইদিক্ দিয়া বাহির হ’ন্ নাই। এই দেখুন উত্তর মুখে এই যে সকল পায়ের দাগ ভিন্নদিকে চলিয়া গিয়াছে; এগুলিও গোস্বামী মহাশয়ের। তিনি একবার এই উত্তরদিক্ দিয়া জঙ্গল হইতে বাহির হইয়াছিলেন। আমি এই দাগগুলি দেখিয়াই চিনিতে পারিতেছি, ইহা গোস্বামী মহাশয়ের;কিন্তু আপনাকে মাপিয়া না দেখাইলে চিনিতে পারিবেন না।”
এই বলিয়া অরিন্দম যোগেন্দ্রনাথকে সেই দাগগুলি মাপিয়া দেখাইলেন। তাহার পর বলিলেন, “গোস্বামী মহাশয় যে, দুইবার এখানে আসিয়াছিলেন, সে প্রমাণ ত এখন আপনি স্পষ্ট দেখিলেন কিন্তু গোস্বামী মহাশয় একবার ভিন্ন আর ইহার মধ্যে যান্ নাই, এই মিথ্যা কথাটির ভিতরে অবশ্যই একটা গূঢ় অভিপ্রায় সংলগ্ন আছে। আর এই ছুরিখানা সম্বন্ধে দুই-একটি কথা আছে; ছুরিখানা যেরূপ লম্বা চওড়ায় বড় দেখিতেছি—খুনীর ছুরির মতনই বটে। হইলে কি হয়, ইহাতে কিছু দেখিতেছি না, যাহাতে এই ছুরিতে বালিকার কোন অনিষ্ট হইয়াছে, এমন বোধ করিতে পারি। তাহা হইলে এই ছুরির একস্থানে না একস্থানে কণামাত্রও রক্তের দাগ দেখিতে পাইতাম।”
যোগেন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করিলেন, “যেরূপ বৃষ্টি হইয়াছিল, তাহাতে রক্তের দাগ ধুইয়া যাইতে পারে।”
অরিন্দম বলিলেন, “ছুরিখানার যে অংশ উপরের দিকে ছিল, সে অংশের রক্তের দাগ বৃষ্টিতে ধুইয়া যাইতে পারে; কিন্তু ছুরিখানির যে অংশ নীচের দিকে ছিল, সেদিকে একটুকুও রক্তের দাগ দেখিতে পাইতাম। ছুরির বাঁটের খাঁজের ভিতরেও একটু-না-একটু রক্ত লাগিয়া থাকিত। এই সকলের পর তেমন খুব বেশী বৃষ্টি হইয়াছিল, বোধ হয় না। তেমন বৃষ্টি হইলে এ সকল পায়ের দাগ এমন স্পষ্ট দেখিতে পাইতাম না। আর কাপড়ে রক্তের দাগগুলি এমন গাঢ় থাকিত না, বৃষ্টির জলে বেশী রকমের ভিজিলে অবশ্যই অনেকটা ফিকা দেখাইত। এখন এই মাথার কাঁটা দুটি সম্বন্ধে দুই-একটি কথা বলিবার আছে। এই দুটি কাঁটায় আমার অপর একটি কাজের অনেকটা সুবিধা হইয়াছে। যোগেনবাবু, দুইদিন পূর্ব্বে থানায় সিন্দুকের ভিতরে আপনি যে বালিকার মৃতদেহ দেখেছিলেন, সেই বালিকার হত্যাকাণ্ডের সহিত আজকার এ ঘটনার কিছু সংস্রব আছে, বুঝিতেছি। সেদিন সিন্দুকের মধ্যে যে দুটি কাঁটা পাইয়াছিলাম, আর আজ এখানে আসিয়া যে দুটি কাঁটা পাইলাম, এক কারিগরের হাতেই তৈয়ারী, এক মাপ—এক ধরনের।”
তখন পূর্ব্বের সেই দুটি কাঁটা বাহির করিয়া অপর দুইটির সহিত মিশাইয়া দিয়া যোগেন্দ্রনাথের সম্মুখে ধরিয়া অরিন্দম বলিলেন, “এইবার আপনি এই কাঁটাগুলি হইতে আগেকার সেই দুটি চিনিয়া বাহির করিয়া দিতে পারেন কি?”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সকলগুলিই ত এক রকমের দেখিতেছি; কিরূপে চিনিব।”
তাহার পর অরিন্দম নিজের নোটবুকখানি বাহির করিয়া শেষের দিক্কার একখানি পাতা খুলিয়া যোগেন্দ্রনাথের হাতে দিলেন। তাহাতে এইরূপ একটি রজকের চিহ্ন অঙ্কিত কাপড়ের কোণ সংলগ্ন ছিল। যোগেন্দ্রনাথ দেখিয়া বলিলেন, “এ আবার কি–বুঝিতে পারিলাম না। আপনার সকল অদ্ভুত।”
অরিন্দম বলিলেন, “এমন বিশেষ কিছু নয়, তবে ইহা এখন একটা বিশেষ উপকারে লাগিল। থানায় সেই মৃতা বালিকার কাপড়ে যে রজকের চিহ্ন ছিল, ইহা তাহাই;আজ এখানকার ঘটনার এই রক্তমাখা কাপড়খানিতে যে মার্কা দেখিতেছি, ইহার সহিত এই মার্কারও কিছু প্রভেদ নাই; তাই বলিতেছি, সেই ঘটনার সঙ্গে আজিকার এ কাণ্ডের অনেকটা যোগাযোগ আছে। সেদিন সেই বালিকার মৃতদেহ দেখিয়া এই মাথার কাঁটা আর রজকের চিহ্ন ছাড়া হত্যাকারীকে ধরিবার কোন সূত্র পাই নাই। আপনার মুখে সেদিন যাহা শুনিয়াছিলাম, তাহাও বড় জটিল বোধ হইয়াছিল। যেমন করিয়া হউক, পরে যে কৃতকাৰ্য্য হইব, এখন এমন আশা করিতে পারি, কি বলেন?” বলিয়া অরিন্দম বিদ্যায় লইলেন।
যোগেন্দ্রনাথ একজন পাহারাওয়ালাকে দিয়া সেই রক্তাক্ত কাপড়, ছুরিখানা থানায় লইয়া চলিলেন।