নবম পরিচ্ছেদ – কেশবচন্দ্রের মুক্তি
বাহির হইবার আর কোন উপায় না দেখিয়া কেশবচন্দ্র সেই অবরুদ্ধ কক্ষমধ্যে নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া রহিল। ক্রমে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গেল। এবং অন্ধকারমাত্রাত্মক হইয়া সম্মুখস্থ নিবিড় বনভূমি ভীষণ হইয়া উঠিল। ক্রমে গৰ্জ্জন করিয়া প্রবলবেগে ঝটিকারম্ভ হইল এবং ঝটিকান্দোলিত অসংখ্য বন্যবৃক্ষের সহিত নিবিড়তর অন্ধকার সংক্ষুব্ধসমুদ্রবৎ তরঙ্গায়িত হইতে লাগিল। মেঘমণ্ডিত মসীমলিন আকাশের সহিত তদনুরূপ বনস্থলী একত্রে মিশিয়া নীলিমা ঢাকিয়া, তারা ঢাকিয়া, চন্দ্র ঢাকিয়া প্রকৃতির বক্ষে চিত্রবৈচিত্র্যবিহীন, যতদূর-দৃষ্টি-চলে-ততদূর-বিস্তৃত একখানা কৃষ্ণ যবনিকা টানিয়া দিল।
ক্ষণপরে সেই অন্ধকারের মধ্য দিয়া আর এক অন্ধকার-মূর্ত্তি সেই অবরুদ্ধ প্রকোষ্ঠের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। বাহির হইতে ডাকিল, “রেবতি—রেবতি—”
তাহার কণ্ঠস্বরে কেশবচন্দ্র যেন মৃতদেহে প্রাণ পাইল, বসিয়াছিল—তাড়াতাড়ি বলিতে বলিতে উঠিল, “কে রে গোরাচাঁদ? এদিকে এক সৰ্ব্বনাশ হ’য়ে গেছে,” বলিয়া রুদ্ধদ্বারের নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল।
গোরাচাঁদ বলিল, “এই যে আপনি এখানে আছেন, আপনাকে খুঁজিতেই আমি এখানে এসেছি দরজাটা খুলে দিন, অনেক কথা আছে”।
কেশবচন্দ্র বলিল, “দরজা বাহির হইতে বন্ধ, শীঘ্র দরজাটা খুলে দে।”
অন্ধকারে হাতড়াইয়া গোরাচাঁদ শিকল অনুসন্ধান করিল। দেখিল, তাহা তালাবদ্ধ; বলিল, “ডাক্তারবাবু এ যে চাবি দেওয়া, কেমন ক’রে খু? আপনার কাছে চাবি আছে?’
কেশবচন্দ্র বলিল, “চাবি নাই। যেমন করিয়া হ’ক্, এখন ভাঙিয়া ফেল্।”
গোরাচাঁদ বিস্মিত হইয়া বলিল, “ব্যাপার কি? আমি ত কিছুই বুঝতে পারছি না। কি হয়েছে?”
কেশবচন্দ্র বলিল, “সৰ্ব্বনাশ হয়েছে—পাখী উড়িয়াছে—ভরা জাহাজ ডুবিয়াছে—এক দমসে বিশ হাজার টাকা লোসান। আগে দরজাটা খুলিয়া দে, সব কথা বলিতেছি।”
গোরাচাঁদ অনেক অনুসন্ধানে সেই ভাঙা বাড়ীর এদিক্-ওদিক্ ঘুরিয়া জানালা ভাঙা একটা লোহার গরাদ সংগ্রহ করিয়া আনিল। তাহাতেই তাহার কার্য্যোদ্ধার হইল; শিকলের ভিতর সেই লৌহদণ্ড প্রবিষ্ট করাইয়া একপাক ঘুরাইতেই ভাঙিয়া খুলিয়া গেল—কেশবচন্দ্র তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিল।