সপ্তম পরিচ্ছেদ : বাঘ ও সাপিনী
“মোহিনী, মোহিনী, কেন মরিবি? দে, কবাট খুলে দে—কেন মরিবি?” বলিয়া ভিতর হইতে কেশবচন্দ্র পিঞ্জরাবদ্ধ ক্ষুধার্ত্তব্যাঘ্রবৎ বিকট গৰ্জ্জন করিতে লাগিল এবং বারংবার কবাটের উপর সবলে পদাঘাত করিতে লাগিল। শালকাঠের কপাট সেই শত পদ প্রহারে কিছুমাত্র ভিন্ন না হইয়া, বোধহয়, সেই নিরাশ্রিতা বালিকার মুখ চাহিয়া পূর্ব্ববৎ স্থির রহিল।
পাঠক বুঝিয়াছেন কি, যে স্ত্রীলোকটির কথা বলিলাম, সে আমাদের সেই মোহিনী, সেই মরিয়া, দুঃখিনী, নৈরাশ্যপীড়িতা, লাঙ্গুলাবসৃষ্টা সর্পিণী, উন্মাদিনী।
ভিতর হইতে কেশবচন্দ্র সেই রুদ্ধদ্বারে দেহের সকল শক্তি একত্র করিয়া পদাঘাতের উপরে পদাঘাত করিতে লাগিল, আর বজ্রনিঃস্বনে বলিতে লাগিল, “মোহিনী, পিশাচি, এখনই কবাট খুলে দে, কেন মরিবি!”
মোহিনী গবাক্ষপার্শ্বে দাঁড়াইয়া বিদ্রূপের মৃদুহাসি হাসিয়া বলিল, “আমার মরণের জন্য ইহার পর চিন্তিত হইয়ো—তখন অনেক সময় পাইবে। এখন নিজের মরণের ভাবনা ভাবিতে আরম্ভ কর। এ যে-সে মরণ নয়, এইখানে—অনাহারে—তৃষ্ণায় ছাতি ফাটিয়া মরণ—তোমার উপযুক্ত মরণ—তিল তিল করিয়া অনেকদিনব্যাপী যন্ত্রণাময় সুদীর্ঘ মরণ। তোমার মরণ-প্রতীক্ষা করিয়া আমি এখনও মরি নাই। আগে যেমন দিনরাত তোমার আরাধনা করিয়া মরিতাম—এখন তেমনি দিনরাত তোমার মরণের আরাধনা করিয়া ঘুরিতেছিলাম। এখন তোমাকে সেই মরণের মুখে তুলিয়া দিয়া অনেকটা নিশ্চিন্ত হইতে পারিলাম?”
যে তালা-চাবি, কেশবচন্দ্র ব্যবহার করিত, তাহা শিকলের আংটায় লাগান ছিল; মোহিনী সেই শিকলে সশব্দে তালাবদ্ধ করিয়া চাবিটি দূরবনমধ্যে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল।
কেশবচন্দ্র পুনরপি বলিল, “মোহিনী, এখনও কবাট খুলে দে, কেন মরিবি?”
হাসিয়া মোহিনী উত্তর করিল, “ভয় দেখাইতেছ কাকে? আমার আর মরণের ভয় নাই।”
কে। ইহাতে আমার কী ভয়ানক ক্ষতি হইবে, তুমি জান না।
মো। তোমার ক্ষতিতে আমার কতখানি লাভ হইবে—তুমি তাহা জান না।
কে। ইহার জন্য কখনই আমি তোমাকে ক্ষমা করিব না।
মো। ক্ষমা করিবার জন্য কেহ তোমায় মাথার দিব্যি দিবে না।