Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মানুষ এত গরীব কেন || Sankar Brahma

মানুষ এত গরীব কেন || Sankar Brahma

সায়ন সকালবেলা এসে বারান্দায়দাঁড়াল। তার বয়স টোদ্দ। সে পড়ে যোধপুর বয়েসে, ক্লাস এইটে। দোতলার এই বারান্দা থেকে বড় রাস্তার অনেকটা অংশ দেখা যায়। বড় রাস্তার ওপারে শান্তিসংঘ ক্লাবটা চোখে পড়ে। সেখানে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের তোড়জোরচলছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত হবে। ক্লাবের পাশের বড় রাস্তার দু’পাশে পাটের সুতলিতে কাগজের ছোট ছোট পাতাকাগুলি গঁদের আঠার লেই দিয়ে লাগিয়ে, মালার মতো সাজানো হয়েছে। দারুণ লাগছে দেখতে।
আর মাইকে গান বাজছে-
” আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ,
তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।।

আর বাজছে-
“ও আমার দেশের মাটি,
তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর,
তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা॥

আজ ১৫ই আগষ্ট, স্বাধীনতা দিবস। বাবার মুখে স্বাধীনতার অনেক গল্প শুনেছে সায়ন। পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগে ১৩ই এপ্রিল ১৯১৯ সালে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বার্ষিক বৈশাখী মেলার সময় একটি বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সরকারী পরিসংখ্যান মতে ভিড়ের সংখ্যা ৬,০০০ থেকে ২০,০০০ বলা ছিল।
স্বাধীনতার সমর্থক সাইফুদ্দিন কিচলু ও সত্যপালকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং জনসমাবেশের কারণে, অস্থায়ী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আর. ইএইচ ডায়ার তার গুর্খা এবং ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর শিখ পদাতিক রেজিমেন্টের সাথে জনগণকে ঘিরে ফেলেন।জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে শুধুমাত্র একপাশ দিয়ে বের হওয়ার রাস্তা ছিল, কারণ এর অন্য তিন দিক ভবন দিয়ে ঘেরা ছিল।
সৈন্যদের বেরোনোর সেই ​​পথ অবরোধ করার পর, ডায়ার তাদের ভিড়ের উপর গুলি করার নির্দেশ দেন, এমনকি বিক্ষোভকারীরা পালানোর চেষ্টা করলেও গুলি চালিয়ে যান। সৈন্যরা তাদের গোলাবারুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গুলি চালাতে থাকে। নিহতদের সংখ্যা অনুমান ১৫০০ বা তার বেশি হয়েছিল। কী নির্মম ঘটনা। নিষ্ঠুর এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন।

সায়ন ঘরে ঢুকে দেখল, বাবা বাজারে বের হচ্ছেন। সে বলল, বাপী আমার জন্য একটা স্বাধীনতার পতাকা কিনে আনবে? মা তার সে কথা শুনতে পেয়ে রান্না ঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, স্বাধীনতার পতাকা দিয়ে তুই কি করবি রে সায়ন?

  • আমাদের ছাদে উড়াব। সায়ন বলল।
    বাবা সেকথা শুনে বললেন, তা বেশ ভাল, ভাল। আনব। বলে তিনি বাজারে বেরিয়ে গেলেন।

কাঠের মোটা ফ্রেমে,কাঁচ দিয়ে বাঁধানো নেতাজির ভারি সুন্দর একটি ছবি আছে বাবার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো। নেতাজি বাবার হিরো।বাবার কাছে সায়ন নেতাজির অনেক গল্প শুনেছে।
শুনেছে, সে সময় কংগ্রেসে মহাত্মা গান্ধী উদার দলের নেতৃত্বে ছিলেন, অন্যদিকে সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন আবেগপ্রবণ বিপ্লবী দলের প্রিয় মানুষ। আর এই কারণে নেতাজি ও গান্ধীর আদর্শ-বিচার বোধ এক ছিল না। নেতাজি গান্ধীজির আদর্শের সঙ্গে সহমত ছিলেন না। ভারতকে স্বাধীনতা এনে দিতে হবে, যদিও এই দুই নেতার লক্ষ্য এক হলেও, নেতাজি মনে করতেন যে ইংরেজদের ভারত থেকে তাড়াতে হলে শক্তিশালী বিপ্লবের প্রয়োজন, অন্যদিকে গান্ধী অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাস করতেন।
১৯৩৮ সালে নেতাজিকে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কংগ্রেসের অধ্যক্ষ পদে নির্বাচিত করা হয়, এরপর নেতাজি রাষ্ট্রীয় যোজনা আয়োগ গঠন করেন। ১৯৩৯ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীজির সমর্থনে দাঁড়ানো পট্টাভী সীতারামাইয়াকে হারিয়ে জয়ী হন। এর ফলে গান্ধী ও বসুর মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়, যার ফলে নেতাজি নিজেই কংগ্রেস ত্যাগ করেন।
ভারতকে ইংরেজের হাত থেকে মুক্ত করতে নেতাজি ১৯৪৩ সালের ২১শে অক্টোবর ‘‌আজাদ হিন্দ সরকার’‌-য়ের প্রতিষ্ঠা করার সময়ই ‘‌আজাদ হিন্দ সেনা’‌ গঠন করেন। এরপর সুভাষচন্দ্র বসু নিজেই সেই সেনা নিয়ে ১৯৪৪ সালের ৪ঠা জুলাই বর্মা (‌এখন মায়ানমার)‌ পৌঁছান। এখানে নেতাজি তাঁর বিখ্যাত স্লোগান দেন ‘‌তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাকে স্বাধীনতা দেব’‌।
১৯২১ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্তদেশের স্বাধীনতার জন্য নেতাজি বহুবার জেলে গেছেন। তিনি মানতেন না যে অহিংসার জোরে স্বাধীনতা কখনও আসবে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন, নাৎসি জার্মানি, জাপানের মতো দেশে ভ্রমণ করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সহযোগিতা চান। নেতাজি জার্মানিতে আজাদ হিন্দ ইন্ডিয়া স্টেশন শুরু করেন এবং পূর্ব এশিয়াতে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

বাবা বাজার থেকে ফেরার সময়, সুন্দর সিল্কের কাপড়ে তৈরী একটা পতাকা সায়নের জন্য কিনে এনেছে। পতাকাটার মাপ আড়াই ফুট বাই দেড় ফুট। পতাকাটা দেখে সায়নের খুব পছন্দ হল। সে ভীষণ খুশি হল।

ঘরে পর্দার শেড লাগাবার জন্য কিনে আনা স্টিলের রড, ঘরের সে কাজ শেষ হওয়ার পরেও, বাড়তি এক টুকরো স্টিলের রড ঘরের আলমারির পিছনে পড়ে ছিল। সায়ন সেটা বের করে নিয়ে, একটা ময়লা কাপড় দিয়ে মুছে সেটা পরিস্কার করে নিল, তারপর তাতে পতাকাটা লাগিয়ে নিয়ে, ছাদে গিয়ে টাঙিয়ে দিয়ে দেখল, বাতাস লেগে পতাকাটা কেমন লতপত করে দুলছে। তা দেখে দেশের স্বাধীনতার জন্য তার খুব গর্ব হল। এই স্বাধীনতার জন্য দেশের কত লোক প্রাণ দিয়েছে। তার কন্ঠে ধ্বনিত হল –
“ও আমার দেশের মাটি,
তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা।

সারাদিনটা খুব আনন্দেই কাটল সায়নের।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই, চোখে মুখে জল দিয়ে, সায়ন ছাতে চলে গেল। দেখল, পতাকাটা উড়ছে। পতাকার পিছনে পূবদিক থেকে সূর্য উঠে আসছে। কী অপূর্ব লাগছে দৃশ্যটা দেখতে। সেটা দেখতে দেখতেই তার চোখ চলে গেল বড় রাস্তার দিকে। দেখল, কয়েকটা বস্তির ইজের পরা ছেলে, একজন তো আবার ন্যাংটো, বয়স তিন-চার হবে। তারা সকলে মিলে রাস্তায় মালার মতো টাঙানো কাগজের পতাকাগুলি, একটা আঁকশি দিয়ে টেনে নামিয়ে, তার থেকে কাগজের পতাকাগুলি ছিঁড়ো নিচ্ছে।
এই দৃশ্য দেখে খুব রাগ হয়ে গেল সায়নের। ভাবল সে, কী অসভ্য ছেলেরে বাবা! বস্তির ছেলে সব, এরচেয়ে আর কত ভাল হবে? স্বাধীনতার মূল্য বুঝবে কী করে?
ছেলেগুলি তাদেরই বাড়ির পাশে একটা বস্তিতে থাকে।
ছেলেগুলি যখন সব কাগজের পতাকাগুলি ছিঁড়ে, একটা দড়িতে বেঁধে, তাদেরই বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ফিরছিল। সায়ন তখন একটু রাগত স্বরেই ছেলেগুলিকে বলল, এই , এগুলি ছিঁড়লি কেন রে? কি করবি এগুলি নিয়ে?
তার কথা শুনে দু’জন মুখ তুলে তাকিয়ে একবারদেখল তাকে। তারপর আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে, হাঁটতে লাগল। কোন উত্তর দিল না। ওরা কোন উত্তর দিল না দেখে, সায়নের রাগ আরও বেড়ে গেল।
সে আবারও বলল,কিরে কোন উত্তর দিচ্ছিস না কেন রে?
তাদের মধ্য সবচেয় বড় ছেলেটা এবার উত্তর দিল, এগুলি পুরনো কাগজের দোকানে বেচে, সেই টাকা দিয়ে আমরা মুড়ি কিনে খাব। বলেই আবার তারা হাঁটতে লাগল।
এরপর সায়নের আর কিছু বলার ছিল না। তার মনে খুব দুঃখ হল এই কথা ভেবে যে, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরও মানুষ এত গরীর কেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *