Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রাসবিহারী বাগানে কিছু নতুন গাছগাছালি লাগান এ—সময়টাতে। বীজ পুঁতে দেন। কলম লাগান। গাছে ফুল না ফুটলে ফল না ধরলে এ—সময় সব সাফসোফ করে নতুন গাছপালা পুঁতে যান। এই একটাই হবি এখন রাসবিহারীর। বয়স হয়ে গেছে, শরীরের সামর্থ্য কমে আসছে—তবু এই বাড়িটার প্রতি তাঁর ভারি মমতা। এবং গাছপালার মধ্যে যতক্ষণ ডুবে থাকেন ততক্ষণই তাঁর স্বস্তি। কত রকমের খবর বুড়ো বয়সের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। মেয়েদের এক একজন এক এক রকমের খবর পাঠায়—কারও বরের বদলি, কেউ পেটের আলসারে ভুগছে, কারও ছেলে বদমেজাজি—যেন বুড়ো বয়সে কোনো ভালো খবর পেতে নেই। চিঠি এলেই অদ্ভুত শঙ্কায় ভোগেন রাসবিহারী। আর ক’মাস থেকেই মিতার ঠিক পিঠের দিদি অমলা রবিবারে এখানে চলে আসে। অরুণের রবিবারে প্রায় কাজ থাকে। সপ্তাহে একটা ছুটির দিন তাও কাজ। এবং অমলা বাড়িতে এসেই হইচই শুরু করে দেয়। সকালে মিতাকে নিয়ে বের হয়ে যায়। দুপুরে ঘুমোয়, তারপর, কাকার বাসায় যাবে বলে চলে যায়। ঢাকুরিয়ায়। সেখান থেকে বেশ রাত করে ফেরে। একদিন রাসবিহারী ছোট ভাই বঙ্কুবিহারীকে প্রশ্ন করেছিলেন, অমলার দেখছি তোমার প্রতি খুব টান। বঙ্কুবিহারী জানে অমলা ওর বাড়িতে মাসে দু—মাসে এক আধবার যায় কিছুক্ষণ থাকে, কাকিমা এবং ছোটদের বলে যায়, যাচ্ছিরে। একটু মার্কেটিং করতে যাব। কখনও বলে টিকিট কাটা আছে, কলামন্দিরে যাব। একা একা ঘুরতে মেয়েটা খুব ভালোবাসে।

ঠিক এ—সব ভাববার সময়ই মনে হল অমলা আসছে। হাতে মীনা করা বড় বটুয়া। কাঁধে ব্যাগ। ওতে ওর রাতে পরার জন্য শাড়ি সায়া ব্লাউজ থাকে। এক সময় সান্টু আসত খুব এ—বাড়িতে। সান্টু তার ছোট বোনের দেওর। অমলার বিয়ের পর সান্টুর এ—বাড়ি আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ইন্ডিয়ান অকসিজেনে সান্টুর ভালো মাইনের চাকরি অথচ তখন কেন যে অমলার পছন্দ না সান্টুকে তিনি এখনও তা বুঝে উঠতে পারেন না। অথচ একটা প্রবল টান রয়েছে দু’জনের মধ্যে, এবং এটা তিনি নিজে ঠিক চোখে না দেখলেও কোনো এক গোপন খবর থেকে তা টের পান।

ইদানীং এখানে আসা অমলার বেড়ে যাচ্ছে কোন টানে বুঝতে কষ্ট হয় না। অমলা এসেই যেমন বাবাকে প্রণাম করে তেমনি প্রণাম করে সোজা ভিতরে ঢুকে গেলেই আবার একটা প্রবল শঙ্কা সেই বুকের মধ্যে গুড় গুড় করে উঠল।

সেদিক থেকে স্ত্রী হেম খুব সুখে আছেন। তার এখনও একটাই কাজ—বাড়ির রান্নাবান্না এবং ঠাকুর চাকরের প্রতি সজাগ সতর্ক চোখ। হেমের বিশ্বাস, এরা সবাই দুর্বৃত্ত। সংসারের সব জিনিস গোপনে চুরি করে নিয়ে যায় ফলে সারাদিন এ—ঘর ও—ঘর। এটা ওটা সামলাচ্ছে। মাঝে মাঝে মিতার সঙ্গে ধর্মমূলক ছবি এলে দেখতে যায়। নানুর জন্য তার দুর্বলতা কম। মেয়েটার জন্য একটাই সমস্যা—বড় হয়ে গেছে, বিয়ে দিয়ে দাও—ধিঙ্গি করে আর কতদিন রাখবে। সংসারে এই বয়সে সাধারণ একজন নারীর যে স্থান হেমের তাই হয়েছে। কালেভদ্রে রাসবিহারীর মনে হয়, হেম তার স্ত্রী। বরং হেমকে বাড়ির পাহারাদার ভাবতেই এখন বেশি ভালো লাগে। সব সময় সন্তর্পণে সব কিছুর প্রতি নজর রাখছে। কোনো কিছু অপচয় হবার উপায় নেই।

রাসবিহারীর মনে আছে, হেম যৌবনে বিকেল হলেই গা ধোয়া, পাট ভাঙা শাড়ি পরা, গলায়, কাঁধে, মুখে পাউডার এবং সুঘ্রাণ ছড়িয়ে বসে থাকত। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার‍্যা—এটা হেমকে না দেখলে বোঝা যেত না। তবে শেষ পর্যন্ত একের পর এক কন্যাদের জন্ম দিয়ে বোধ হয় হাঁপিয়ে উঠেছিল। একদিন শুতে গিয়ে দেখে রাসবিহারী, বিছানা আলাদা—হেম আলাদা ঘর নিয়েছে। এবং সেই থেকে ক্রমে যে দূরত্ব বাড়ছিল তা এখন চরমে। প্রায় সারাদিন দুটো চারটে কথা ছাড়া ওদের আর কোনো সম্পর্ক আছে অথবা ছিল তা বোঝাই যায় না। রাসবিহারী দুটো বীজ পুঁতে দেবার সময় ভাবলেন, সংসারের বুঝি এই নিয়ম।

রাসবিহারী বুঝতে পারেন মেয়েরা তাদের মায়ের মতই। নানুর মা এখন কী করে দিন কাটায় তিনি তা বুঝতে পারেন। সংসারে সব কথা খুলে বলা যায় না। একবার নানু তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল—

খুব দরকার ছিল চাকরি করার!

নানুর মা বলেছিল, বারে আমার ভবিষ্যৎ আছে না।

সত্যি তো ভবিষ্যৎ বলে কথা। তিনি বোঝেন, ভবিষ্যৎ বস্তুটি কী। তিনি নিজেকে দিয়েই এটা বুঝতে পেরেছেন। ভবিষ্যৎ মানে শেষ পর্যন্ত একটা বড় ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে যাওয়া। সবাই অবলম্বন পেয়ে তাকে নিরালম্ব করে রেখে গেছে একটা পত্র—পুষ্পহীন বৃক্ষের মতো। রাসবিহারী নিজেকে এখন কোনো পত্র—পুষ্পহীন বৃক্ষের মতোই ভাবতে ভালোবাসেন। আর এ—সব কথা বেশি করে মনে হয়—যখন বুঝতে পারেন নাতিটার ভার না নিলেই ভালো হত। কিন্তু ওই যে বলে ফাঁনদে পড়িয়া বগা কান্দে। …..আর তখনই তিনি দেখলেন, নানু এদিকে আসছে। সকালের হাওয়ায় নানু বাগানে পায়চারি করতে বের হয়েছে। মুখে ব্রাস, দাঁত মাজছে—ফস ফস করে কথা বলার চেষ্টা করছে। রাসবিহারী সেই কথার এক বর্ণ বুঝতে পারছেন না।

নানু বলল, দাদু এই গরমে তোমার গাছ বাঁচবে?

বাঁচবে না কেন ভাই, বাঁচাতে জানলেই বাঁচে!

এখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি ভালো করে।

জল দিতে হবে।

এ—সব কথা একেবারেই অকারণ। আসলে রাসবিহারী এখন নানুকে যে—কথাটা বললে খুশি হতেন সেটা হচ্ছে, তুমি রোজ রাত করে বাড়ি ফিরলে আমি খুব উদ্বিগ্ন থাকি। আরও কিছুদিন বাঁচতাম, তুমি আর তোমার মা মিলে সময়টা খুবই সংক্ষিপ্ত করে দিলে।

নানু বলল, আজ জেঠুর বাড়ি যাব ভাবছি।

তোমার জেঠু অবনীশ কাল দুপুরে ফোন করেছিল।

কী বলল?

বলল তুমি রোববারে যাবে।

আজ গেলে কী হবে?

তোমার জেঠিমার শরীর ভালো নেই।

তবে রোববারেই যাব।

তাই যেও। মানুষের সুবিধা অসুবিধা বুঝতে হয়।

সবাই কি বোঝে?

না বুঝলে চলবে কেন?

না সবাই বোঝে না দাদু। বলে মুখ থেকে সে থু থু ফেলল। তাহলে আমাকে এখানে চলে আসতে হয় কেন?

এ—সব কথায় রাসবিহারী ভীত হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন সংসারের সেই মৃত ছবিটা আবার নানু তুলে দেখাতে চায়। একটা জোড়াতালি দিয়ে যা তিনি ভুলতে চেয়েছেন, এবং যা কিছু তিনি মেনে নিয়েছেন, অর্থাৎ সায় না থাকলেও ইজ্জতের খাতিরে মুখ বুজে আছেন, সেই নানু আবার তা ছিন্নভিন্ন করে দিতে চায়। তিনি অন্য কথায় চলে এলেন, তোমার মুখ ধোওয়া হলে বল। একসঙ্গে চা খাব।

নানু বলল, এখন তো দেখছি মার সঙ্গে জেঠুরও খুব ভাব। প্রায়ই নাকি চিঠি দেয়। আমার খবরাখবর নেবার কথা বলে। আগে ও সব কোথায় ছিল! ভিন্ন বাড়ি দেখে জেঠু উঠে গেল কেন! আমার বাবা কি সত্যি খুব খারাপ মানুষ ছিলেন?

রাসবিহারী প্রমাদ গুণলেন। সাতসকালে নানু আবার কী ঝামেলা না বাধায়। তিনি তাড়াতাড়ি বাগান থেকে ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। নানু পাশে পাশে যাচ্ছে। এবং মনে হচ্ছে রাসবিহারীকে কেউ এখন তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থা দেখে নানু হেসে ফেলল। বলল, অত ছুটবে না, পড়ে যাবে।

রাসবিহারী ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, আমি দৌড়লাম কোথায় আবার।

নানু ফের খুব অমায়িক গলায় বলল, আচ্ছা দাদু তোমরা সব সময় বাবার সম্পর্কে এত চুপ থাক কেন? আমি সবই জানি। বাবার মৃত্যুর জন্য কে কে দায়ী তাও জানি যেমন ধর, এক নম্বর খুনি আসামি সেই ধুমসো ভদ্রমহিলাটি, দু নম্বর আমার মা, তিন নম্বর জেঠু। ওরা তিনজন বাবার সংসারে তিনটে ফ্রন্ট খুলেছিল। বাবা ভেবেছিলেন—একটা ফ্রন্ট খোলা আছে, সেখান দিয়ে অন্তত পালানো যাবে—কিন্তু দেখা গেল সেখানেও একজন দাঁড়িয়ে আছে।

রাসবিহারী বললেন, সেটা আবার কে?

নানু মাথা নীচু করে বলল, আমি। আমাকে দেখে বাবা নিজেকে খুব অসহায় বুঝতে পেরেছিলেন। বেশি টাকা রোজগার করবেন বলে কাজ ছেড়ে দিলেন—কারণ সংসারে তখন টাকার দরকার খুব। সংসারে বেশি সুখের জন্য বেশি টাকার জন্য বাবা ব্যাবসা করতে গেলেন এবং ফেল মারলেন। তখন বাবার চারপাশ ফাঁকা। দাদা বউদি ফ্ল্যাট নিয়ে উঠে গেছে। বাবা তবু ভয় পেতেন না। মার গঞ্জনা শুরু হল। একদিন মনে আছে, মা আমার সামনে বাবাকে বলেছিল, পুরুষের রোজগার না থাকলে বেঁচে থেকেও লাভ নেই। পাশে আমি দাঁড়িয়ে। বাবা মাথা নীচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেছিলেন।

রাসবিহারী বারান্দায় দাঁড়িয়ে। নানু মুখোমুখি। এমন একটা নাটকের সময় মিতা বাথরুমে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখছে। হেম চা চিনি মাখন ডিম বের করে ডাকছেন, ও কালোর মা, সব নিয়ে যা।

নানু দেখল দাদু তাকে অপলক দেখছে। কেমন বিমূঢ়। শূন্য দৃষ্টি। আবার না হেসে পারল না। —দাদু, ও দাদু, খুব মিথ্যে বলেছি! তুমি অত ভয় পাও কেন। আমি তো এখন সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি।

রাসবিহারীর এবার বাহ্যজ্ঞান ফিরে আসছে। নানুর মাথায় আবার রেলগাড়ি চলছে। রেলগাড়ি চলতে থাকলেই নানু অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে। রাসবিহারী ভাবে, নানু যা স্বভাবের তাই হয়ে গেছে। তখন নানুকে আর অত খারাপ লাগে না।

রাসবিহারী খুরপিটা রাখার জন্য বাইরের দিকে আউট—হাউসে হেঁটে গেলেন। এখন হাত মুখ ধুয়ে সামান্য জলযোগ। তারপর পত্রিকা এসে যাবে এবং চা। পত্রিকা পড়তে পড়তে বেলা দশটা। তারপর চান, এবং আহার। আহারের পর দিবানিদ্রা, শেষে আবার চা এবং বিস্কুট। বেলা পড়ে এলে হাতে লাঠি এবং সান্ধ্য—ভ্রমণ। মোটামুটি জীবনের এই রুটিন দাঁড়িয়েছে রাসবিহারীর।

তখন ঘরে ঢুকে অমলা বলেছিল, কার সঙ্গে কথা বলছিসরে এত?

কেন তোমার কি ফোনের দেরি হয়ে যাচ্ছে?

অমলা বলল, খুব ফাজিল হয়েছ।

অরুণ মেসোমশাইকে বল একদিন যাব ওদের অফিসে।

কী দরকার।

চাকরি টাকরি যদি হয়।

তোমার চাকরি হলেই হয়েছে।

বোঝাই যায় নানু দুপুরে ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিল। খুব সংযত কথাবার্তা। কিছুক্ষণ কথা বলার পর শিস দিতে দিতে ওপরে উঠে গিয়েছিল। সে তার অমলা মাসিকে আর ফিরে তাকিয়েও দেখল না। সে জানে এখন অমলা মাসি ফোনটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে।

তারপর নানু সুন্দর পোশাক পরে করিডরে পায়চারি করতে করতে মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছিল। তারপর একটা সিগারেট খেয়েছিল গোপনে। এবং এক সময় কী সংকেত পেয়ে নীচে নেমে বাস রাস্তার দিকে হেঁটে গেল।

তারপর নানু সিনেমা হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। এখন সে জটিল চিন্তাভাবনা মাথায় রাখতে ভালোবাসছে না। কারণ এমন একটা আনন্দের দিন তার আসবে সে কখনও কল্পনা করেনি। বনভূমিতে ‘জ্যোৎস্না’ আসছে। ফোনের সেই সংকেত থেকে এতক্ষণ পর্যন্ত সে বড়ই অধীর। তাকে স্পষ্ট বলেছে, ঠিক আছে যাব।

তুমি একা আসবে কিন্তু!

সে কি। একা কী করে আসব। বাড়ি থেকে ছাড়বে কেন। বাবা ফিরে এসে শুনলে কী ভাববে। বকবে না? জানো, মা বলছিল নানু যেন কেমন হয়ে গেছে!

তুমি কী বলেছ?

আমি কী বলব আবার!

না, এই যদি বলে দাও লাল বলটা তোমার কাছে আছে, বলেছি। তুমি বলেছ, না নেই। আমি বলেছি, হ্যাঁ আছে—এইসব আর কি।

আমার বয়ে গেছে বলতে।

নানুর মাথার মধ্যে কথাগুলি বিজ বিজ করছিল। রাস্তা, মানুষজন, ভিড় এবং হকারদের চিৎকারের মধ্যে সে একটা লম্বা মতো মানুষ হয়ে যেতে চাইছে। সে অনেকদূর থেকে নবনীতাকে আবিষ্কার করতে চায়। কিন্তু ক্রমে সময় যাচ্ছে। এখানে সে আধ ঘণ্টার মতো দাঁড়িয়ে নবনীতাকে আবিষ্কার করতে পারল না। তবে কী নবনীতা তাকে ধোঁকা দিল।

নিজের সঙ্গে নিজের এই কথা নানুর আজন্মকালের। নানু সব সময় পৃথিবীতে একটা বাতিঘরে সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে। নবনীতা তার বাতিঘর। যেন নবনীতা ইচ্ছা করলেই তাকে এখন নিরাময় করে তুলতে পারে। এবং তখনই দেখল নবনীতা আসছে। বড় মহিমময়ী। শাড়ি পরেছে। কানে গোল ইয়াররিং। মনটা মুহূর্তে বিশাল সাম্রাজ্য হয়ে গেল তার। সে ছুটে গিয়ে বলল, ও এলে তবে!

কী করব, এত করে বললে না এসে পারা যায়!

কী যে ভালো করেছ না। এসো কোথাও বসে একটু খাই কিছু।

শুধু আইসক্রিম খাব।

আর কিছু খাবে না?

না। আমাকে কিন্তু ছটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে।

কী হবে না ফিরলে?

মা বাবা ফেরার আগেই যেতে হবে।

সে যেও। নবনীতা…ন…ব …নীতা।

এই কী হচ্ছে! গান করছ কেন?

কী গান করলাম।

এই যে ন—ব—নী—তা।

জানি না নবনীতা, যখনই একটু সময় পাই, তখনই জানালা খুলে আকাশ দেখি, তখনই সব আনন্দের প্রকাশ, আজকাল আমার একটি শব্দে শুধু আনন্দের প্রকাশ—

ন—ব—নী—তা!

নবনীতা ঠোঁট টিপে চোখ বাঁকিয়ে বলল, আহা কী কথা! নবনীতা না ছাই।

নানু বলল, নবনীতা, কী যে ভালো লাগছে। এমন সরল প্রকাশ, নানুর নবনীতাকে কেমন একটা টানের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। নবনীতা পাশাপাশি হাঁটছিল। শাড়ি পরায় তাকে আর কিশোরী ভাবা যাচ্ছে না। যেমন নানুকে দেখেও বোঝার উপায় নেই সে কৈশোর পার হয়ে সবে যৌবনে পা দিয়েছে। বরং দুজনকেই পৃথিবীর আদিম নরনারীর মতো মনে হচ্ছিল। সে আর নবনীতা বুনো ফুলের গন্ধ নিতে ছুটছে। এই বয়সে মানুষের আর কিছুরই দরকার নেই—কেবল ছুটে যাওয়া হাত ধরে, কোথাও হ্রদের ধারে বসে থাকা, কখনও নদীর জলে প্রতিবিম্ব দেখা অথবা কোনো এক সবুজ পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট ডাকবাংলোয় রাত্রি যাপন। যদি শীতের সময় হয় সামান্য উষ্ণতা চাই, গ্রীষ্মের সময়ে অজস্র বৃষ্টিপাত—নানু কত কিছু নবনীতাকে নিয়ে ভেবে ফেলে।

কিন্তু নবনীতা এখনও এতটা ভেবে দেখেনি। তার কাছে শহরটা শহরই থাকলে ভালো হয়। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে কিছু মিছে কথা বলে, এই একটু ঘুরে যাওয়া, আইসক্রিম খাওয়া, খুব সাহসী হলে সে ভাবতে পারে সন্ধের অন্ধকারে একটু মাঠে বসে নিরিবিলি নানুদাকে ডেকে নেওয়া। বাবা আসেন সাতটার পর, মা দিবানিদ্রা যান। তারপর ক্লাবে যান। দুপুরে কিংবা সকালে সে মাকে শুধু বলে রাখে বিকালে একটু বের হব মা। অগ্নির কাছ থেকে কিছু ক্লাস—নোটস নিতে হবে।

বাবা মাঝে মাঝে বসার ঘরে তাকে ডাকেন। এবং কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলেন, তুমি সত্যি বড় হয়ে গেছ। বিয়ে দিয়ে দেব।

আর তখনই সে বাপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বল, একথা আর বলবে!

সুনীল তখন তার স্ত্রীর শরণাপন্ন হয়ে বলে, দেখে যাও তোমার মেয়ে আমাকে মেরে ফেলল। বড় হয়েছে বললে কেউ এভাবে রেগে যায়।

এই বড় হওয়া যে কী মজার। যখন একা থাকে, কিংবা গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বুঝতে পারে, তাকে কেউ কোথাও নিয়ে যাবে বলেছে। এবং সব সময়ই সে যেন তাকে বলে যাচ্ছে, আমার ভয় করে।

নানু তখন দুটো আইসক্রিম নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ফিরছে। একটা নবনীতার হাতে দিয়ে বলছে, নাও। নবনীতা ঠিক পদ্মকলির মতো আইসক্রিমটা ধরে আছে।

যদি কেউ দেখে বুঝবে এই নর এবং নারীর মধ্যে এখনও আশ্চর্য পবিত্রতা বিরাজ করছে। এখনও কোনো দ্বিতীয় ভূখণ্ডে ওরা পা রাখেনি। বড় সুসময় এদের এখন। এই সুসময়ে প্রীতিশ আর রাণু কুড়ি বছর আগে ঠিক এই হল ঘরটায় আইসক্রিম খেয়েছিল। কেউ না জানলেও চারপাশের ইট পাথর দালান কোঠা তার সাক্ষী। অথচ মানুষ তার পবিত্র সময় বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না।

নানু ডাকল, ন—ব—নী—তা।

নবনীতা একেবারে পোষা বেড়ালের মতো নানুর গা সংলগ্ন হয়ে হলের ভিতরে ঢুকে গেল। অন্ধকারে সব অস্পষ্ট। নানু হাত ধরে আছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *