মানুষের হাহাকার – বাইশ
নানুর সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। এখনও সূর্য ওঠেনি। অথচ ঘুম ভেঙে গেল। এত সকালে ওঠার অভ্যাস কোনোদিন নেই। এবং সুনিদ্রা হলে যা হয়, নানু উঠেই আড়মোড়া ভাঙল, হাই তুলল। ছেঁড়া মাদুরের ওপর কারুকাজ করা কাঁথা লীলা পেতে দিয়েছিল। অর্থাৎ এত অভাবের মধ্যেও লীলার পরিচ্ছন্নতা বোধ খুবই তীব্র। ঘুমের এজন্য কোনোই ব্যাঘাত ঘটেনি। বরং কতকাল পর ঘুমের শেষে এক আশ্চর্য প্রশান্তি। সে দেখল, তরুলতার ফাঁক দিয়ে লাল সূর্য উঠে আসছে। আর চারপাশে তরুলতার সবুজ ঘ্রাণ, হালকা হলুদ রঙ। এবং একধরনের নির্জনতায় সে ডুবে যাচ্ছিল। বাড়িতে কেউ নেই যেন। গোবড়া সন্টি মন্তিরা গেল কোথায়, লীলা কোথায়! তখনই মনে হল সে কি কাল কোনো স্বপ্নের মধ্যে লীলাকে আবিষ্কার করেছিল। আসলে সে কি লীলার খোঁজ করতে করতে এক গভীর বনের মধ্যে প্রবেশ করেছে! এসব মনে হতেই বুকটা গুড় গুড় করে উঠল। তখনই দরজার ভিতর কাশি শোনা গেল। লীলার মা কাশছে। সে অবাক হল, এমন কেন হয়, সবসময় লীলাকে তার এত হারাবার ভয় কেন! সে ডাকল, লীলা! লীলা!
লীলা দুধ আনতে গেছে বাবা।
দুধ দিয়ে কী হবে?
আজ্ঞে আপনি চা খাবেন না!
নানু জেঠুর বাড়িতে গেলেই বলত, চা করো লীলা। লীলা করতে পারত না। লীলার কষ্ট হত তখন। সে কী ভালোবাসে না বাসে লীলা এত টের পায় কী করে! লীলা তো তখন রান্নাঘর থেকে বের হতে চাইত না। ডেকে ডেকে সারা হতে হত। দাদাবাবুরা বোধহয় ভালো হয় না। লীলা এর আগে অন্য কোথাও কাজ করেছে কী না এখনও জানে না। ভাবল লীলা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করবে—লীলা আমি কী খুবই খারাপ। আমি কী তোমাকে অসম্মান করব ভেবেছ! তারপর নানুর মনে হল লীলাকে আসলে এসব কথা সে কখনও বলতেই পারবে না। লীলাকে এসব বললেই মাথা নিচু করে রাখবে। এমনকি চোখ থেকে টস টস করে জলও ফেলতে পারে।
সে এবার বাইরে বের হয়ে এল। সত্যি মুক্ত আকাশ। যত দূরেই সে চায় দূরদিগন্ত প্রসারিত মাঠ সামনে। কেমন শস্যবিহীন, এবং অনুর্বর। লীলাদের বাড়ির তিন দিকেই আগাছা এবং জঙ্গল। সামনে সদর রাস্তা। দূরের গঞ্জে বোধহয় চলে গেছে।
তখনই ভিতর থেকে লীলার মার ক্ষীণ গলা পাওয়া গেল, ও গোবড়া গেলি কুথি! বাবাকে জল দে। হাত মুখ ধুবে বাবা।
নানু বলল, আমি দেখছি গোবড়া গেল কোথায়। আসলে নানু লীলার ভাইদের নাম এখনও ঠিক ঠিক জানে না। কোনটাকে লীলা গোবড়া বলে কাল রাতে ডেকেছে সে এখনও তা মনে করতে পারল না! পর পর লীলার চারটি ভাই। সব কটির রঙ শ্যামলা—চোখ বড় বড়, হাত পা কাঠি কাঠি। শুধু মাথাটা সম্বল করে এরা বেঁচে আছে। ছোটটা এত শীর্ণ যে জোরে কথা বলতে পারে না। তারপরই কোলে পর পর দুটো। একটা ঘরে আছে সে টের পেল। বাকিগুলির একটাও বাড়ির ত্রিসীমানায় নেই। ধুলো কাল খেয়েই চলে গেছে। বলেছে, আজ আবার আসবে খেতে। নানুকে বলে গেছে, বাবা আপনি থাকুন। নিজের বাড়ি মনে করে থাকুন। কথাবার্তায় এত সুন্দর যে মনেই হয় না লোকটার মনে কোনো পাপ চিন্তা আছে। এসব ভাবতে গিয়েই সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। শ্রীহরি লোকটিকেও তার ভালো লেগেছে।
নানু হাঁটতে হাঁটতে সদর রাস্তায় চলে এল। এই রাস্তাটাই গতকাল তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। একটা নদী পার হলে রাস্তাটা পাওয়া যায়। কিছু গ্রাম গঞ্জ পার হয়ে দুক্রোশের মতো ফাঁকা মাঠ। ফাঁকা মাঠের মাথায় এই গ্রাম! গ্রামটার নাম তার জানা ছিল। আবার দু ক্রোশ হেঁটে গেলে সামনে কোনো গ্রামটাম পাওয়া যেতে পারে। উত্তরে বিশাল একটা বনভূমি আছে বলে তার মনে হল। আসলে ওটা বনভূমি না অন্য কিছু এখনও ঠিক জানে না। লীলাকে নিয়ে সব একবার দেখবে ভাবল। কিন্তু লীলা সোমত্ত মেয়ে—তাকে নিয়ে ঘুরলে কথা হতে পারে। লীলার বড় ভাইটা যদি সঙ্গে থাকে অথবা শ্রীহরি, শ্রীহরিই তার যেন সহায়—সেই সব খবর দিতে পারবে।
লীলা দূর থেকেই দেখল দাদাবাবু রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সে লোহারদের বাড়ি গেছিল দুধ আনতে। এ গাঁয়ে ওরাই এখনও দু বেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পায়। অনেক জমিজমা—কিছু আবাদ হয় কিছু অনাবাদি। পুকুরে মাছ আছে গোয়ালে গোরু আছে। এখনও শ্যাম লোহার গাঁ ছেড়ে যায়নি। ওর অন্য ভাইরা শহরে চলে গেছে। পাটকলে কাজ করে তারা। লোহারদের সেজ বউ শহরের ইস্কুলের মাস্টারনি। সেই লীলাকে কাজ ঠিক করে দিয়েছিল। গাঁয়ের দুঃস্থ পরিবারগুলির ভরসাও এই লোহার পরিবার। সম্বৎসরই এই লোহার পরিবারকে ধরে কেউ না কেউ শহরে কাজ নিয়ে চলে যায়। লীলাকে নিয়ে গিয়েছিল লাবণ্য বউদি। নেবার সময় বলেছিল, মাকে, খাবে থাকবে সঙ্গে ত্রিশ টাকা মাইনা। পূজায় শাড়ি পাবে—কাজকর্ম বলতে তিনজন লোকের দেখাশোনা। এই কড়ারেই লাবণ্য বউদি লীলাকে নিয়ে গিয়েছিল। ত্রিশটা টাকা মার অনেক। ত্রিশ টাকায় এখনও এক মণ ধান পাওয়া যায়। এক মণ ধান লীলাদের সংসারে অনেক। এক মণ ধানের জন্য মা তাকে প্রায় বিক্রি করে দিয়েছিল। দাদাবাবুকে নিয়ে সে এখন কী যে করে! মানুষটা যেন এ—পৃথিবীরই মানুষ নয়।
লীলাকে দূর থেকে দেখেই নানু চিৎকার করে বলল, লীলা কী ফাইন। লীলাকে দূর থেকে বড় রহস্যময়ী নারীর মতো মনে হচ্ছে। লীলার হাতে একটা এনামেলের গেলাস। গেলাসটা হাতে নিয়ে বড় সন্তর্পণে হাঁটছে লীলা। সামনে পেছনে লীলার সেই সৈন্যবাহিনী—কেউ দৌড়ে আসছে, কেউ হেঁটে আসছে, কেউ লাফিয়ে আসছে। লীলা কাছে এসে বলল, তুমি দাদাবাবু হাত মুখ ধুয়ে নাও। তখনই নানু সামান্য থেমে বলল, গোবড়া কার নাম?
গোবড়া এগিয়ে বলল, আমি গোবড়া।
লীলার বড় ভাইটিকে নানু বলল, তুই একবার শ্রীহরিকে ডাকবি?
লীলা সামান্য হেসে বলল, ডাকতে হবে না। চায়ের গন্ধে ও এমনিতে চলে আসবে।
আর আশ্চর্য নানু দেখল, ঠিক চায়ের গন্ধে শ্রীহরি সত্যি চলে এসেছে। মুড়ি চা—প্রায় গোল হয়ে বসে গেল। খেতে খেতেই নানু বলল, শ্রীহরিদা, তোমাকে একটা কথা বলব?
বলেন বলেন। আজ্ঞে আপনি বলবেন না তো কে বলবে!
প্রথমে তুমি আমাকে এখানকার সব ঘুরিয়ে দেখাবে।
যথার্থ কথা। আজ্ঞে দেখাব।
তোমার তো একটা দেখছি ভাঙা সাইকেল আছে?
তা আছে দাদাবাবু।
ওটাতে দুজন যাওয়া যায়?
ও আমার পুরনো বান্দা। বড় বিশ্বাসী দাদাবাবু। —কোথায় যাবেন।
চম্পাহাটিতে।
কখন?
এখুনি বের হব।
লীলা বলল, দাদাবাবু রাতে তোমার ঘুমের কষ্ট গেছে। এখানে থাকলেই কষ্ট। তোমাকে বরং শ্রীহরিদা ট্রেনে তুলে দিয়ে আসুক।
নানু বলল, আমাকে চলে যেতে বলছ?
লীলা নিজের মাথা খেয়ে ভাবল, কেন যে এমন কথা বলতে গেল! মানুষটা এত ভিতর থেকে কষ্টের কথা বলে যে স্থির থাকা যায় না। মানুষটার মাথাও বোধহয় ঠিক নেই। মামিমা ঠিকই বলত, নানুটা পাগল হয়ে যাচ্ছে। তা না হলে এমন পাণ্ডববর্জিত জায়গায় লীলার খোঁজে কেউ চলে আসতে পারে। সুস্থ মস্তিষ্ক হলে দাদাবাবু আর দশজন দাদাবাবুর মতো হতেন। সে নানুকে আর একটা কথা বলতেও সাহস পেল না।
তখন নানু কেমন ছেলেমানুষের মতো শ্রীহরিকে বলল, আচ্ছা শ্রীহরিদা তুমি আমাকে একটু থাকবার জায়গা দেবে? আমাকে কেউ কাছে রাখতে সাহস পায় না। কেন এটা হয় বলো তো! সবাই তাড়িয়ে দেয়।
এমন কথায় লীলার মুখ খুবই ব্যাজার হয়ে গেল। সে তবু শক্ত হয়ে থাকল। কোনো কথা বলল না।
শ্রীহরি বলল, আরে দাদাবাবু আপনি একটা মানুষ—একটা মানুষের ভাবনা কী বলেন। আমারে দ্যাখেন আমি একটা মানুষ, সেই কোন সালে বাপ গেল, মনে নেই, সেদিন মা চিঠি পেল—বড়ই ভাগ্যবান না হলে কপালে এত সুখ লিখা থাকে শ্রীহরির।
লীলা মাথা নিচু করে রেখেছে বলে, সে গোবড়াকে বলল, কীরে তোর দিদি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। তুই কিছু বলবি না।
লীলার মা তখন ভিতর থেকে বলল, আপনি চলে যাবেন কীগো বাবা, ঝোল—ভাত খাব বলে বসে আছি। জিয়ল মাছের ঝোল। ও লীলা তুই কী রে—বাবা কি তোদের পর। না বাবা দু’দিন থেকে খেয়ে যান—লীলা কে এ বাড়ির! তুই কেরে আবাগির বিটি আমার বাবাকে তাড়িয়ে দিস!
লীলা বুঝতে পারে মানুষের স্বার্থপরতা কতটা হীন হলে এতটা নিচে নেমে কথা বলতে পারে মা। দাদাবাবু কিছুই বুঝবে না। দাদাবাবু তার মার এই লোভের দিকটা টের পেলে ভালো হত। আঙুল উঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হল, দাদাবাবু অভাবে আমাদের কারও মাথা ঠিক নেই। আমাদের মধ্যে থাকলে তুমিও মাথা ঠিক রাখতে পারবে না। তোমার যা আছে আমরা সব রাক্ষসের পাল দুদিনে শেষ করে দেব! তুমি আমাদের কত খাওয়াবে? শেষে মানুষটার দিকে চোখ তুলতেই লীলা কেমন সংকুচিত হয়ে গেল। যেন সত্যি মানুষটাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে অগত্যা বলল, তুমি যেন কোথায় যাবে বললে দাদাবাবু!
চম্পাহাটিতে যাব। কিছু মাছ টাছ, তোমার জন্য সায়া শাড়ি বলেই সে শ্রীহরির দিকে তাকাল। তারপর বলল, যদি আমি একটা ঘর করে থাকি তোমরা বাধা দেবে না তো কেউ?
শ্রীহরি বলল, কে বাধা দেবে। কত জায়গা পড়ে আছে। দিন দিন ঝোপঝাড় বাড়ছে, মানুষজন গাঁ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, পাঁচ কুড়ি টাকা দিলে আপনাকে এক কাঠা ভুঁই দেব দাদাবাবু!
নানু লাফিয়ে উঠল, সত্যি বলছ! এত সস্তা!
কেউ আসে না। জমিতে কিছু ফলে না। জল হলে কিছু হয়, না হলে সম্বৎসর অজন্মা। এ—পোড়া দেশে কে থাকে দাদাবাবু বলেন।
শ্রীহরির কথায় নানু হাতের কাছে যেন এক বড় আকাশ পেয়ে গেল। অনাবাদি থেকে থেকে ক্রমে খড়ের জমি হয়ে যাচ্ছে। লীলার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তাড়িয়ে দিলে কী হবে। শ্রীহরিদা আমার আছে। আমি শ্রীহরিদার কাছে থাকব।
লীলা বলল, সেই ভালো। এখন যেখানে যাবে বলছিলে তাড়াতাড়ি যাও। ফিরতে বেশ বেলা হবে। শ্রীহরির দিকে তাকিয়ে বলল, শ্যাম লোহারের সাইকেলটা দ্যাখো পাও কিনা। তুমি চাইলে না করবে না। পেছনে বসে যেতে ওঁর কষ্ট হবে।
নানু বলল, আমার কষ্টে তোমার কী আসে যায়?
লীলা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আমার কেন আসতে যাবে, আমি আপনার কে?
নানু লীলার কথায় বিমর্ষ হয়ে গেল। লীলা আঘাত পেয়েছে। সে লীলাকে আঘাত দিতে চায় না। এখানে আসার পর সে অন্য মানুষ হয়ে গেছে। এখন আর কেন জানি তার কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। সে তাড়াতাড়ি কথা ফিরিয়ে নিয়ে বলল, লীলা কিছু মনে করো না। তুমি আঘাত পাবে জানলে সত্যি এভাবে বলতাম না।
লীলার চোখ জলে ভার হয়ে গেল। এই মানুষটার মধ্যে কী যে আছে! কথায় কথায় আজকাল তার চোখে জল আসে। এমনটা তার আগে কখনও হত না। সাইকেল নিয়ে এলে শ্রীহরিকে লীলা বলল, তুমি একটা ভালো দেখে মাদুর নিয়ে এসো। বালিশ চাদর কিছু ঘরে নেই। রাতে আমি ভালো ঘুমতে পারিনি।
নানু বলল, তোমার আর কী লাগবে বলে দাও।
লীলা বলল, আমার? সামান্য হেসে বলল, যা বলেছি ঐটুকু মনে করে এনো। তা হলেই আমার সব হয়ে যাবে।
তারপর লীলা শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে উদ্ধব দাসের বাড়ি গেল। উদ্ধব দাসের বউ কামিনীর কাছ থেকে কোদালটা চেয়ে নিল। গোবড়া এবং সে মিলে বাড়ির আনাচে কানাচে যে ঝোপজঙ্গল ছিল সব সাফ করে ফেলল। মানুষটার মর্জি বোঝা ভার। কতদিন থাকবে, কে জানে। সাপের উপদ্রব আছে। এতক্ষণে মনে হল, একটা টর্চ বাতি আনতে বললে ভালো করত। চারদিক থেকে সে সতর্ক থাকতে চায়। পুকুরের জল সহ্য নাও হতে পারে। সে গোবড়াকে দিয়ে এক কলসি জল আনিয়ে নিল—এবং স্নান সেরে রান্নার জন্য উনুনে শুকনো খড়কুটো গুঁজে দিল। সন্টি মন্তিকে পাঠাল মাঠে, ওরা ছাগল দুটোকে ঘাস খাওয়াবার জন্য নিয়ে গেল। মোরগগুলি ঠুকরে ঠুকরে ঘাসের পোকামাকড় খাচ্ছে। ছোট বোনটা কাঁদছিল—একটু বাড়তি দুধ ছিল, সবটা গরম করে খাওয়াল। শ্যাম লোহারকে বলতে হবে—এ’ কদিন দুধের দরকার হবে। একটু বেশি দুধ চাই। বাবু মানুষের ছেলে দাদাবাবু। ভালোমন্দ খেতে অভ্যস্ত।
এখন কত সব এমন ভাবনা মাথায় কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে লীলার। বাপ ধুলো দুপুর হলেই চলে আসবে—এখানেই খাবে। সে বড় এনামেলের হাঁড়িটা চাপিয়ে মাকে বলল, এসো মাথাটা ধুয়ে দি। ওরা ফিরে এলে সময় পাব না!
রাস্তায় নানু বলল, শ্রীহরিদা এখানে চাষ—আবাদ বুঝি ভালো হয় না?
শ্রীহরি বেশ দ্রুত সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। পাশে নানু। বাতাসের সাঁ সাঁ শব্দে শ্রীহরি নানুর কথা বুঝতে পারছিল না। সে নানুর দিকে তাকিয়ে বলল, আজ্ঞে আমাকে কিছু বললেন?
নানু বুঝতে পারছে আর জোরে তাকে কথা বলতে হবে। ওরা এখন পাশাপাশি যাচ্ছে—এখানে রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত। নানু প্রায় শ্রীহরির সংলগ্ন হয়ে এল—এখনও সে সাইকেল ভালোই চালায়, কতদিন সাইকেল চড়া অভ্যাস ছিল না, কতদিন পর আবার একটা সাইকেলে সে সকালের মাঠে বের হয়ে পড়েছে। সে বেশ জোরে বলল, শ্রীহরিদা এখানে চাষ—আবাদ কেন হয় না?
জল নেই। জল হলে সোনা ফলতে পারে।
নানু বলল, তুমি চাষ বোঝো শ্রীহরিদা?
ঐটাই সংসারে বুঝি দাদাবাবু।
তুমি নাকি পুলিশে নাম লিখিয়েছিলে?
ওরে ব্বাস, ও—কথা আর বলবেন নি!
কেন কী হয়েছে?
কাল রাতে লীলা যখন ওর বিছানা করে দিচ্ছিল, তখন শ্রীহরিদার সম্পর্কে অনেক খবর দিয়েছে। কোথাও গিয়ে থাকতে পারে না মানুষটা। গাঁয়ের টানে চলে আসে। ওর মামা পুলিশে কাজ করে—সেই বাউণ্ডুলে ভাগ্নেকে পুলিশে নাম লেখাতে বলেছিল। শ্রীহরিদা সাইকেল থেকে হাত তুলে হাওয়ায় দুলিয়ে বলল, আর যাচ্ছিনে ও লাইনে।
কোন লাইনে যাবে তবে?
ও একটা লাইন ঠিক ধরে নেব।
নানু বলল, আমারও যে একটা লাইন ধরতে হবে শ্রীহরিদা। খেতে হবে তো!
কী যে বলেন! শ্রীহরি খুব লজ্জায় যেন পড়ে গেছে নানুর এমন কথা শুনে। কোনো মরণে ধরেছে যে নানুবাবুকে লাইন ধরতে হবে! সে তো আর তার মতো উলটোপালটা লোক নয়। শ্রীহরি বলল, চম্পাহাটির ঘোষালরা খুবই অর্থবান লোক দাদাবাবু। ছোট ঘোষালের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আমাকে খুব ভালো চোখে দেখে। সলা করলে দুটো একটা বুদ্ধি দিতে পারবে ছোট ঘোষাল।
নানু শ্রীহরির কথায় হেসে ফেলল। —কেন তুমি কোনো সলা দিতে পারবে না?
আমার কথা কে লয় দাদাবাবু। আমি একখানা আবার মানুষ!
নানু বলল, আমার একখানা ঘরের দরকার।
সে করে দেবনে।
কোথায় করবে?
লীলাদের বাড়িতেই দেবনে।
ওরা দেবে কেন?
শ্রীহরি বলল, আপনি দাদাবাবু পাগল আছেন।
ও—কথা কেন হরিদা! সবাই আমাকে পাগল ভাবে কেন?
আপনি আর থাকার জায়গা পেলেন না! এমন একটা আজাগাঁতে চলি এলেন! মাথায় খুন আছে!
নানু বলল, হরিদা আমি আর কোথাও সত্যি যাব না। মাথায় আমার সত্যি খুন আছে।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ হরিদা।
শ্রীহরির কেন জানি এই বাবু মানুষটাকে বেশ ভালো লেগে গেছে। গতকাল গাঁয়ের সবাই খবরটা জেনে গেছিল। শ্রীহরিই বাড়ি বাড়ি বলে বেড়িয়েছে, লীলার দাদাবাবু এয়েছে। এই দাদাবাবুটি কে, এই নিয়ে গাঁয়ের কেউ কেউ টীকাটিপ্পনি কেটেছে। তবে এখন যা সময়কাল কার ঘরে কে আগুন দেয়। সব ঘরেই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। খিদের আগুন। একটা লোকের দয়াতে ধুলো দফাদারের বিটি বউ ছানাপোনারা ভরপেট খাচ্ছে, এজন্য কোনো কোনো ঘরে কিছুটা হিংসার উদ্রেক হচ্ছিল। লীলার ভয় অন্য রকমের। পাঁচ রকমের কথার ভয় তো আছেই, তার ওপর এই দাদাবাবুর মর্জির কথাও সে জানে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভয় পুতনা রাক্ষসীর মতো সেই বিশাল জীবটিকে, যার চোখের পলকে লীলার বুকের জল নিমেষে শুকিয়ে যেত। সে যদি চলে আসে। এবং এসেই যা করবে, দরকার হলে পুলিশ—টুলিশও নিয়ে আসতে পারে—এতসব ভয়ের মধ্যে সারাটা রাত লীলার কেটেছে—লীলা সারারাত ভালো ঘুমাতে পারেনি, এবং মনে হয়েছে দাদাবাবুকে যে করে হোক বুঝিয়ে সুজিয়ে ট্রেনে তুলে দিতে হবে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেলে লীলার নিশ্চিন্তি। কিন্তু সকালে লীলা বলতে গিয়েই থেমে গেছিল। তেমনি শ্রীহরিও থাকা নিয়ে কোনো আর কথা বলতে পারল না নানুকে। রোদে শ্রীহরি ঘামছিল। দাদাবাবুর মুখটাও লাল হয়ে উঠেছে রোদে। সামনে রোদ পড়লে যা হয়। শহুরে মানুষের এত কষ্ট সহ্য হলে হয় শেষপর্যন্ত। নানুর সেসব কোনো হুঁশই ছিল না। দেখলেই বোঝা যায় বেঁচে থাকার এক প্রচণ্ড আবেগে সে টগবগ করে ছুটছে এখন। সে গুন গুন করে গাইছে….. ন—ব—নী—তা।