Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

নানুর ঘুম আসছিল না। সে পাশ ফিরে শুল। জানালা খোলা। আকাশে কিছু নক্ষত্র। সে শুয়ে শুয়ে এক দুই করে নক্ষত্র গুনতে থাকল। সব দেখা যায় না। যতবার গুনছে ততবারই মনে হচ্ছে অসংখ্য নক্ষত্র বাদ পড়ে গেল। অনেকক্ষণ এসব করার পর হাতে মুখে জল দেবার জন্য বারান্দায় এল। পাশে বাথরুম। বাথরুমে ঢুকে ঘাড়ে গলায় জল দিল। চোখে জলের ঝাপটা দিল। বেশ নিশুতি রাত—কিছুক্ষণ বাইরের ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকল। একটা রেলগাড়ি এইমাত্র চলে গেল। শেষ বাস গুমটিতে ঢুকে যাচ্ছে। সে মানুর কাছে গিয়েছিল, ভেবেছিল মানু কলেজে আসবে। ওর সঙ্গে পরামর্শ করার দরকার ছিল। সে একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এত বড় শহরে মানুকেই সব খুলে বলতে পারে।

ঘুমটা হয়তো এজন্যই আসছে না। মানুষের জীবন এক—একটা সময় আসে যখন একজন কাছের জন দরকার হয়ে পড়ে। সারাদিনটা আজ বিদঘুটে সব ঘটনার মধ্য দিয়ে কেটে গেল। শেষমেশ অরুণ মেসোর ফোন। আশ্চর্য, মাসিদের কী কোনো রোগ আছে—অমলা মাসি দেখতে কী সুন্দর—কেমন মিষ্টি কথা বলে, চোখ দুটো দেখলে বড় পবিত্র পবিত্র লাগে। মাসি কোথায় যায় মেসো খবর রাখে না কেন এবং ফোন ধরে কেন জানি অমলা মাসির খোঁজ করতেই তার মার মুখ মনে পড়ে গেছিল। যেমন মা তাকে একা রেখে কোনো কোনো দিন বেশ রাত করেই ফিরেছে। সে ভারি ছটফট করত। অথচ তার ভিতরের দুঃখ অথবা অভিমানের কোনো দামই দিত না। মেসোর ফোন পেয়ে প্রথম মনে হয়েছিল, বেশ জব্দ তুমি বাপ—বউ কোথায় জান না। তারপরই মনে হয়েছে—সে মানুষটাকে দেখেই নি। কেমন দেখতে অরুণ মেসো—বিয়ের সময় সে অথবা মা কেউ আসতে পারেনি। এখানে আসার পরও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে সে কখনও যায়নি। ওর মনে হয়েছে সবাই জানে তার বাবার আত্মহত্যার খবর। যে ছেলের বাবা আত্মহত্যা করে তার মাথা তুলে কথা বলারও যেন অধিকার নেই। এসব কারণেই তার কোথাও আর যাওয়া হয় না। অথবা কী এ—সময়ে মানুষেরা সব্বাই গ্রন্থিমোচনে ব্যস্ত। সম্পর্কহীন মানুষই কী শহরে বেশি—ঠিক তার মতো। ফলে এইসব আজেবাজে চিন্তায় নানুর সত্যি ভালো ঘুম হল না রাতে। শেষ রাতের দিকে সে একটা দীর্ঘ স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নটা জলজ্যান্ত একটা চাটুর। গোল চাটুটা আগুনে দগদগে লাল। চাটুটা ঘুরছে। এবং চাটুটার মধ্যে বাবার সেই চশমাটা। চশমার একটা কাচে নানুর মুখ আর একটা কাচে নবনীতার মুখ। নবনীতা ঠোঁট টিপে হাসছিল।

অদ্ভুত সব ঘটনার মধ্যে স্বপ্নটা শেষ হয়ে গেল। সে দেখল একটা রাজবাড়ি, দরজায় এক হাত গন্ডারের ছবি—এবং ফুটপাথে অজস্র না খেতে পাওয়া মানুষের বিপ্লব। রাজবাড়ির পাঁচিল থেকে ইঁট খসিয়ে কারা নিয়ে যাচ্ছিল। দলের মধ্যে সেও একজন। আবার একটা মস্ত মই দেখল সে সিঁড়ির মতো আকাশে উঠে গেছে। সিঁড়িটা ধরে বেশ উঠে যাচ্ছিল। কখন যেন কারা সিঁড়ির নিচটা আলগা করে দিল। সিঁড়িটা শূন্যে ঝুলে আছে। নিচে দেখল লীলা দাঁড়িয়ে বলছে, তুমি কোথায় যেতে চাও দাদাবাবু। নেমে এসো। সে লাফ দিয়ে পড়তে গিয়ে মনে হল, ডানা গজিয়েছে এবং নীল আকাশের নিচে তখন সে আর লীলা। ওরা পাখি হয়ে গেছে। তখনই দেখল একটা বড় মাঠ, মাঠে নবনীতা ছুটছে। পেছনে ওর বাবা ছুটছে। নবনীতার ম্যাকসি বাতাসে উড়ছিল। চুল উড়ছিল। নবনীতাকে ধরার জন্য এখন আর তার বাবা ছুটছে না, তার পাড়ার দাদারা ছুটছে। একটা নদীর ধারে নবনীতা এসে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে চেয়ে আছে। তখন নবনীতার গায়ে পোশাক নেই। সে দূরে দেখতে পাচ্ছে দাদারা আসছে—ওদের হাতে গাছের ডাল, ইঁটের টুকরো। নবনীতা প্রাণভয়ে নদীতে ঝাঁপ দিল। এখানেই স্বপ্নটা শেষ। দেবী বিসর্জনের মতো জলে ঝাঁপ দিলে যে শব্দ হল সে শব্দমালা তাকে জাগিয়ে দিয়ে গেল। সে উঠে দেখল সকাল হয়ে গেছে। তার অনেক করণীয় কাজ। এবং বাথরুম থেকে আরম্ভ করে সকালের খাবার সে তাড়াতাড়ি শেষ করল। তারপর ব্যাংক এবং দাদু এই দুই কর্তাব্যক্তির সঙ্গে দিনটা কেটে গেল তার।

এর কিছুদিন পরেকার কথা। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর গরম হাওয়া বইছে। বৃষ্টি হবে হবে করেও হচ্ছে না। রোজই খবরের কাগজে বড় করে বিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাতের কথা থাকে। কিন্তু দিন শেষে না ঝড় না বিদ্যুৎ। কেবল এলোমেলো বাতাস। প্রবল দক্ষিণা বাতাসে ভ্যাপসা গরম এবং সূর্য হেলে গেলে কিছুটা ঠান্ডা আমেজ নেমে আসছে শহরে। শহরতলির একটা বাড়িতে লীলা তখন ভাঙা আয়নার সামনে চুল বাঁধছিল।

তখনই খুট খুট শব্দ দরজায়। এই পড়ন্ত বিকেলে মামাবাবুর সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসতে পারে ভেবে সে দরজা খুলতেই দেখল, দাদাবাবু। খুব মিষ্টি হাসি মুখ। হাতে কীসের একটা প্যাকেট। লীলা বলল, ওরা কেউ বাড়ি নেই।

নানু বলল, তুমি আমাকে ঢুকতে দেবে তো।

লীলা সরে দাঁড়াল। ওর চুল বাঁধা এখনও শেষ হয়নি। সে কিছু না বলেই চুল বাঁধতে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। বসার ঘরটায় তালা ঝুলিয়ে যায়নি, তাই রক্ষা। নানু বসার ঘরে ঢোকার আগে বলল, দরজা বন্ধ করে দিয়ে যাও।

দরজা বন্ধ করতে গিয়ে লীলার হাত কাঁপছিল।

চা করতে পারবে?

লীলা রান্নাঘর থেকে বলল, কিছুই বাইরে নেই দাদাবাবু।

ঠিক আছে। তুমি এসো। ও ঘরে তুমি কী করছ?

লীলার গলাটা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। দাদাবাবুর চোখের দিকে সে তাকাতে পারে না। তাকালেই ভিতরটা গুড় গুড় করে ওঠে। সে বলল, কী হবে গিয়ে?

এসোই না।

মামিমা বকবে।

কে বকবে?

মামিমা।

গুলি মারো মামিমাকে। আসতে বলছি আসবে।

লীলা কোনোরকমে দরজা পর্যন্ত হেঁটে এল। ভারি ভয় তার। সে ভয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকল।

এই নাও। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন। আমি বাঘ না ভালুক। ভয় পাচ্ছ কেন?

লীলা ভেতরে ঢুকে বলল, কী নেব?

দেখই না খুলে।

লীলার মুখটা ভীষণ লাল হয়ে গেছে। চোখ দুটোতে আশ্চর্য নীরবতা। এবং বুকের মধ্যে সমুদ্রের ঝড়। সে তাকিয়ে থাকল শুধু।

কী হল, নাও। দাঁড়িয়ে থাকলে কেন। ছেঁড়া ফ্রক গায়ে দিয়ে লোককে না দেখালে বুঝি ভালো লাগে না।

লীলা খুব শান্ত হবার চেষ্টা করছে। সে বলল, দাদাবাবু আপনি খুব ছেলেমানুষ।

তুমি বুঝি খুব বুড়ি।

নানুর কথার কোনো জবাব না দিয়ে বলল, আমাকে আস্ত রাখবে না।

সাহস হবে না লীলা।

লীলা আর জোর পাচ্ছে না। সে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল। সমস্ত শরীর তার ভেঙে আসছে। কতকাল পর একজন ভালো মানুষের কাছ থেকে এই সহৃদয় ব্যবহার। সে বলল, দাদাবাবু কপালে আমার এত সুখ সইবে না।

নানু লীলাকে হাত ধরে টেনে তুলল—ওঠো। তুমি যাও। পরে এসো। আমি দেখব লীলা। তোমাকে শাড়ি পরে কেমন লাগে দেখব।

লীলা অগত্যা উঠে চলে গেল। এবং যখন শাড়ি পরে এসে সামনে দাঁড়াল, নানু প্রথমে তাকাতে পারল না। সে বলল, ন…ব…নী…তা।

লীলা কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, আমি যাব?

নানু ভারী আবেগে সেই কথাটাই শুধু বলল, ন…ব…নী…তা। গানের মতো করে বলল।

নানু আজকাল কোনো কারণে ভারী আবেগ বোধ করলে শিস দেবার মতো বলে ওঠে নবনীতা। তার সব আনন্দের প্রকাশ এই একটিমাত্র কথাতেই। সব দুঃখ এবং হতাশা থেকে আজকাল এই একটা মাত্র কথাই জীবনে তাকে মুক্তি এনে দেয়। সে বলল, নবনীতা আবার আমি আসব।

লীলা বলল, ওরা বাড়ি থাকলে আসবেন।

নানু বলল, আমার খুশিমতো আসব। আসলে নানু একটা কিছু করতে চায়। সেটা যে কী সে নিজেও জানে না। রোজই সকালে উঠে ভাবে, সে একটা ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে এবং সেই সিদ্ধান্তটা যে কী ঠিক কিছু তার কাছে স্পষ্ট নয়। ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতা দানা বাঁধছে। কলেজে যাচ্ছে না। মানুর সঙ্গে দেখা নেই। মানুর সঙ্গে দেখা হলে ভালো লাগত। কিন্তু তার এখন কোথাও যেতেও ইচ্ছে করছে না। একা এবং নিজের মধ্যে থাকার স্বভাব ধীরে ধীরে তার গড়ে উঠছে সে এটা ক্রমশ টের পাচ্ছে।

এবং সত্যি সে আর একদিন খুশিমতো চলে এল। যখন শহরে ঘুরে সিনেমা দেখে অথবা কোনো পার্কে চুপচাপ বসে থেকে তার কিছু ভালো লাগে না, তখনই মনে হয়, অসহায় সেই তরুণীর কাছে তার ভালো লাগবে।

একদিন কী হল, একটা বড় রেস্তোরাঁয় বসে ফ্রাইড রাইস, চিকেন কারি, এবং আইসক্রিম খেতে তার মনে হয়েছিল, লীলা জানে না, ফ্রাইড রাইস এবং চিকেন কারি বলে কোনো সুন্দর খাবার আছে। সে নিজে খেয়ে এক প্যাকেট ফ্রাইড রাইস এবং চিলি চিকেন নিয়ে সোজা সেই শহরতলির বাড়িটার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। সকালের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় বেশ ঠান্ডা আমেজ রয়েছে বাতাসে। এবং বর্ষা এবারে চলে আসবে বলে হাওয়ায় আর্দ্রতা অনুভব করা যাচ্ছে। শহরতলিতে নেমেই দেখল, গাছপালা সবুজ, ঝোপঝাড় জলের গন্ধ পেয়ে বেড়ে উঠেছে—পাশাপাশি অন্য সময়ের চেয়ে যেন বেশি উড়ছে। বলতে গেলে বেশ সুসময়। সে লীলার জন্য এক প্যাকেট ফ্রাইড রাইস নিয়ে আসতে পেরেছে। ভারি তৃপ্তি বোধ করছিল মনে মনে। এবং যখন দরজা ঠেলে বাড়িটায় ঢুকল, দেখল, জেঠু কলতলায় বসে চায়ের বাসন ধুচ্ছে।

দাদা এসেছে। দাদা এসেছে। কুটু এসে নানুকে জড়িয়ে ধরল। জেঠি অসময়ে শুয়ে আছে। ঘটর ঘটর টেবিল ফ্যানটা চলছে। তাকে দেখে জেঠি উঠে বসল, এলি? আমার শরীরটা ভালো নেই বাবা। শুয়ে আছি।

সে ভেবেছিল, সেদিনের মতো বাড়ি কেউ থাকবে না। সে এবং লীলা শুধু থাকবে। লীলাকে বলবে, তুমি আমার সামনে বসে খাও। লীলা যখন খাবে অথবা লজ্জায় লীলা যদি খেতে না পারে সামনে বসে তখন সে বলবে লজ্জা কী মানুষই তো খায়। না খেলে কেউ বাঁচে। কিন্তু সেই লীলাকেই দেখতে পাচ্ছে না। সে তখন সোজা বলল, লীলা কোথায় জেঠি?

জেঠির মুখ কুঁচকে গেল। বলল, আর বলিস না বাবা, এমন মেয়ে কোথায় কী কেলেঙ্কারি করবে, তাই ছাড়িয়ে দিয়েছি।

কীসের কেলেঙ্কারি জেঠি?

এই মানে, আমরা বাড়ি থাকি না, কিছু হলে কলঙ্কের ভাগী। মেয়েটার স্বভাব ভালো না বাবা।

নানুর মাথায় সেই যে বলে না, একটা রেলগাড়ি ঢুকে যায় মাঝে মাঝে, সেটা আবার ঢুকে যেতে থাকল। সে দাঁড়িয়ে প্রথমে মাথার মধ্যে গোটা রেলগাড়িটাকে ঢুকতে দিল। তারপর যখন রেলগাড়িটা মাথার মধ্যে ঢুকে চোখ তুলে লাল লাল হয়ে গেল, মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, পেশি ফুলে উঠতে থাকল, তখনই জেঠির চিৎকার, ও মা দ্যাখ এসে ও কুটু তোর বাবা কোথায়, তাড়াতাড়ি আসতে বল, নানুর চোখমুখ কেমন হয়ে যাচ্ছে।

কলতলা থেকে অবনীশ কাপ প্লেট ফেলে ছুটে এল, কী হয়েছে নানু? তোর কী হয়েছে?

নানু বলল, কিছু হয়নি তো।

জেঠি বলল, তোমার মরণ। দেখছ না নানুর চোখ কোথায় উঠে গেছে।

নানু বুঝতে পারছিল না, সে একটা অন্যরকমের মানুষ হয়ে যাচ্ছে। খবরটা শোনার পর সে কিছুতেই আর ধাতস্থ হতে পারছে না। সবকিছু তচনচ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। তখন জেঠু সামনে দাঁড়িয়ে শুধু বলল, বোস। দাঁড়িয়ে রইলি কেন?

কুটু বলল, দাদা হাতে তোমার কী দেখি?

নানু হাত সরিয়ে নিল। কুটু আবার কোমর জড়িয়ে বলল, দাদা তুমি রাগ করেছ?

কুটু ফের বলল, না দাদা আমি তাড়াইনি। মা লীলাদিকে চুল ধরে বের করে দিয়েছে।

তখনই মহীয়সী বলল, কুটু চুউপ। তুমি আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে খাচ্ছ। কে বলেছে আমি বের করে দিইছি। নারে নানু কুটুর কথা তুই বিশ্বাস করিস না।

নানু কিছুই আর শুনতে পাচ্ছে না। কতদিন ধরে সে একটা অন্ধকার পথে হেঁটে যাচ্ছিল। কতদিন ধরে চারপাশে কেউ আলো জ্বেলে দেয়নি।

লীলাকে দেখার পর মনে হয়েছিল, ভারী অসহায় এই মেয়ে—আশ্চর্য আকর্ষণ রয়েছে লীলার চোখে মুখে—সে লীলার জন্য প্রাণপাত করতে পর্যন্ত পারে।

সে কুটুকে বলল, লীলা কোথায় গেছে জানিস?

কুটু বলল, না।

সে অবনীশকে বলল, লীলা কোথায় আছে তুমি জান?

অবনীশ তাকাতেই তার স্ত্রী চোখ টিপে দিল। অগত্যা সে বলল, কোথায় আর যাবে। কোথাও কাজটাজ আবার ঠিক করে নিয়েছে হয়তো।

ওর বাড়ির ঠিকানাটা দেবে?

অবনীশের স্ত্রী বলল, লাবণ্য জানে। লাবণ্যই ঠিক করে দিয়েছিল।

লাবণ্য কে? কোথায় থাকে?

সত্যি ফ্যাসাদে পড়া গেল। অবনীশের স্ত্রী বলল, মাথা খারাপ করিস না নানু। ঝি—মেয়ের জন্য তুই মাথা খারাপ করিস না।

নানু বলল, আমার মাথা খারাপ, ভালোই বলেছ। আমার মাথা খারাপ, বাবার মাথা খারাপ, বাবা মরে যাবার পর তো তোমরা পুলিশকে এমনই সব বলেছিলে। অথচ তোমরা বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। তুমি, তোমাকে আমি খুন করব।

ওগো, ও কী বলছে।

অবনীশ বলল, নানু, আয় ঘরে আয়।

কোথাও যাব না। বলো, লীলা কোথায় আছে?

খুন হওয়ার চেয়ে ঠিকানা দেওয়া অনেক সহজ। অবনীশের স্ত্রী একটা গাঁয়ের নাম বলল, একটা রেল স্টেশনের কথা বলল। চার ক্রোশ পথ হেঁটে যেতে হয় বলল। একটা বড় অশ্বত্থ গাছের নিচে নদী বয়ে গেছে বলল। এবং নদীটা পার হলেই মেঠো পথ ধরে গেলে লীলাদের বাড়ি দেখা যায়।

গাঁয়ের নাম, স্টেশনের নাম নিয়ে নানু বের হল। অশ্বত্থ গাছের নিচে নদী এবং নদী পার হয়ে মেঠো পথ খাঁ খাঁ মাঠ এবং শেষে কিছু গ্রাম গঞ্জ। গ্রাম গঞ্জ পার হলে আবার খাঁ খাঁ মাঠ তারপরই খড়ের বাড়ি—লীলা এমন একটা বাড়ি থেকেই এসেছে। সে আর দেরি করল না। বাইরে এসে সাইড ব্যাগের মধ্যে খাবার গুলি পুরে রাখল। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। গাছপালা সবুজ হয়ে আছে, এবং পাখিদের কলরব সবই আগের মতো। শুধু লীলা নেই। লীলা না থাকলে এইসব কত অর্থহীন। নানু টের পেল। সে হাঁটছে ঠিকই কিন্তু পায়ে জোর পাচ্ছে না। কতদূরে লীলা চলে গেছে। আর তারপর এক সকালে সেই স্টেশনে নেমে সে হাঁটা দিল। কথামতো অশ্বত্থ গাছ এবং নদী পেয়ে গেল। নদী পার হলে মেঠো পথ ধরে সে এগোতে থাকল। কথামতো সে খাঁ খাঁ মাঠও পেয়ে গেল। খড়ের মাঠ দিগন্ত বিস্তৃত রোদে সব যেন পুড়ে যাচ্ছে। সে হাঁটছে। সে হেঁটে যাচ্ছে। দুপুর গড়াতেই দূরে দেখতে পেল খড়ের ঘর। একটা পরিত্যক্ত গাঁ। মানুষজন সব কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।

যত খড়ের বাড়িটা এগিয়ে আসছিল, তত বুক ধুকপুক করছিল নানুর। সে কত গ্রাম—মাঠ—গঞ্জ ভেঙে এসেছে, তার ব্যাগে এখনও খাবার রয়েছে। খাবারগুলো পচে যাচ্ছে। এগুলো খেলে লীলার অসুখ হতে পারে। এ কথাটা মনে হওয়ামাত্র সে খাবারগুলো ফেলে দিল। শূন্যদিগন্ত, চারপাশে, অন্য টিলার মতো উঁচু জায়গায় সেই খড়ের বাড়িঘর নিয়ে একটা গাঁ। লীলা এখানে বড় হয়েছে—এমন নীরস অনুর্বর ভূমিতে লীলার জীবন কেটে গেছে ভাবতেই সে দেখল, একটা লোক এক কাঠা ধান নিয়ে রাস্তায় বসে আছে নদী পার হয়ে যাবে বলে। নানু তাকে লীলার কথা বললে, সে চিনতে পারল না। নানু লীলার মার নাম বলল, লোকটা বলল, এগিয়ে যান, ধুলো দফাদারের বউয়ের হল গে এই বেটি।

সেই উঁচু টিলার মতো জায়গাটা ক্রমে এগিয়ে আসতে থাকল। দু—পাশে শুধু ধু ধু প্রান্তরের মতো খড়ের মাঠ। কোথা কিছু ছাগল, রাখাল বালক এবং শীর্ণকায় গভীর দল চোখে পড়ল তার। দূর থেকে গাঁটা যতটা পরিত্যক্ত মনে হয়েছিল আসলে ততটা পরিত্যক্ত নয়। গরিব—দুঃখীদের বাস এই গাঁয়ে। কোনো বড় বাড়িঘর এখনও চোখে পড়ছে না।

বারবারই তার মনের মধ্যে একটা সংশয় পাক খাচ্ছে। লীলা আছে তো। লীলা যদি এখানে না এসে অভিমানে কোথাও চলে যায়! যদি লীলাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়! যদি লীলা নদীর জলে ডুবে মরে—অথবা সবসময় কেন জানি লীলার সেই বড় বড় চোখ তাকে বারবার তাড়া করে আসছিল। হয়তো লীলা একটা গঞ্জের মতো জায়গায় গাছের নিচে শুয়ে আছে। একটা পুঁটলি মাথায়। না খেয়ে না খেয়ে চোখে কালি পড়ে গেছে। চুল উসকোখুসকো। অথবা কোনো নির্জন নদীতীরে মেয়েটা আউল—বাউলের মতো কেবল হেঁটে যাচ্ছে। নানুর মনে কত রকমের যে কুচিন্তার উদয় হচ্ছে।

এবং তখনই সেই ঘরের সামনে সে হাজির। ভাঙা মাটির দেয়াল, খড়ের ছাউনি, কিছু কলাগাছ, একটা ছাগল খুঁটিতে বাঁধা, দুটো মোরগ ঘাড় বাঁকিয়ে ওকে দেখল, সে বাধ্য হয়ে গলাখাঁকারি দিল একটা। কেউ বের হচ্ছে না। সে এবার বলল, ধুলো দফাদার আছো? তবু সাড়া নেই। চারপাশে ঝোপ—জঙ্গল, পেছনে বাঁশের ঝাড় কেমন অত্যন্ত শ্রীহীন মানুষের আবাস। সে একটা গাছের গুঁড়িতে অগত্যা বসে পড়ে ডাকল লীলা, লীলা।

এবার কেউ যেন সাড়া দিল। ঘরের ভেতর থেকে কারও গোঙানি আসছে। তাহলে কেউ আসছে। আর তখনই সে দেখল জঙ্গলের ভিতর থেকে চার—পাঁচটা নগ্ন কচিকাচা ছেলেমেয়ে বের হয়ে আসছে। তাকে দেখেই চোখে ওদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। কলকাতায় নকশালবাবুরা সব গাঁয়ে গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি যদি তাঁদের কেউ হন। সে বলল, লীলা আছে? লীলা? ওর কথা শুনে ওরা যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে এসেছিল আবার তেমনি লাফিয়ে লাফিয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং তখনই মনে হল সে কোনো এক নারীকণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে বনের গভীরে। সে বুঝতে পারল, লীলার কণ্ঠস্বর। ওর ভিতর থেকে কে যেন বলল, তখন, ভগবান লীলাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। সে জোরে ডাকল, লীলা—লীলা।

কিছুক্ষণের মধ্যে সেই নারী এসে হাজির। মলিন বসন। চোখে অপার বিস্ময়।—তুমি দাদাবাবু?

কোথায় ছিলে? কখন থেকে ডাকছি।

শেয়াল মুরগি ধরে নিয়ে গেছে। খুঁজতে গেছিলাম।

ওর চারপাশে সেই কাচ্চাবাচ্চা। প্রায় দু গন্ডা, লীলার কোলে একটা সাত আটমাসের বাচ্চা। এরা কারা? এই প্রশ্নটাই নানুর মাথায় বিজবিজ করছিল।

তখন সেই নারী সুধা পারাবার বলল, দাদাবাবু, কেন তুমি এলে?

বারে কতদিন তোমাকে দেখি না। এখন আমাকে আগে এক গেলাস জল খাওয়াও তো।

একটা নিকেলের তোবড়ানো গেলাসে নানুকে লীলা জল এনে দিল। তারপর বলল, একী চেহারা করেছ শরীরের।

সব ঠিক হয়ে যাবে।

লীলা হাসবে কী কাঁদবে ভেবে পেল না। বাড়িঘরের এই দশা, কোথায় এমন পাগল মানুষটাকে যে সে বসতে দেবে। ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় লেপ্টে আছে তার জননী। জ্বর কতদিন থেকে। লীলাকে বলছে কে রে লীলা।

লীলা শুধু বলল, দাদাবাবু।

কোথাকার দাদাবাবু?

আমি যেখানে ছিলাম মা।

সহসা আর্তচিৎকারে সেই জননীর গলা ভয়ংকর হয়ে উঠল! তোর মরণ হয় না কেন রে, তোরে যমে দেখে না কেন রে, তুই আবার মরতে ফিরে এলি, কটা তোর বাপ আছে যে খাওয়াবে? দাদাবাবুর সঙ্গে পীরিত করতে গিয়ে তোর কাজ গেল রে। লীলা বলল, মা চুপ চুপ। দাদাবাবু খুব ভালো মানুষ।

সঙ্গে সঙ্গে কেমন জল হয়ে গেল লীলার মা। সত্যি বলছিস ভালোমানুষ। ভালোমানুষের বংশ তবে মারধর করে তোকে তাড়িয়ে দেয় কেন?

নানু বুঝতে পারল অভাবে অনটনে লীলার মার মাথাটি গেছে। সে ঘরে ঢুকে বুঝল, আসলে এটা মানুষের আবাসই নয়। খড় বিচালী সরে গিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। একদিকের মাটির দেওয়াল ধসে পড়েছে। এক কোণায় একটা তালপাতার চাটাইয়ে এক অস্থিচর্মসার রমণী পড়ে আছে। শুধু গলার আর্ত চিৎকারই সম্বল। নানু শিয়রে বসে বলল, ধুলো দফাদার কোথায়?

পাত্তা নেই। কোথায় থাকে, কী খায়, কেউ জানে না বাবু। আমার গতরে আর রস নেই।

নানু বলল, তোমার কী হয়েছে মা?

আমার মরণ অসুখ ধরেছে বাবা।

কিছুই হয়নি। তুমি দেখো ভালো হয়ে যাবে। তারপর লীলার দিকে তাকিয়ে বলল, ডাক্তার পাওয়া যায় না এখানে?

স্টেশনে আছে, সে তো অনেক দূর।

গাঁয়ের কাউকে পাঠাবে? টাকা দিচ্ছি সাইকেলে যদি যায়।

লীলার মা উঠে বসল। বলল, তুমি সাক্ষাৎ দেবতা বাবা। ভগবান আমার কপালে এত সুখ।

নানু বলল, উঠে বসো না। খুবই দুর্বল দেখছি। এবং লীলার একটা ভাই কোথাকার একজন খাকি প্যান্ট পরা মানুষকে নিয়ে এসে বলল, শ্রীহরিদা এয়েচে।

সে শ্রীহরিকে বলল, এই টাকা নাও। লীলার দিকে তাকিয়ে বলল, কী কী আনতে হবে বলে দাও। ঘরে তো কিছুই নেই মনে হচ্ছে। তারপর নানু শ্রীহরির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিও রাতে এখানে খাবে।

সন্ধ্যার দিকে সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে ডাক্তার এল। অষুধ এবং পথ্যি দিয়ে নানুর দিকে তাকিয়ে বলল, মহাশয়ের কোথা থেকে আগমন?

নানু বলল, কলকাতা থেকে।

সেই একবার কলকাতায় গেছিনু। কতকালের কথা! এখন চোখে ভালো দেখতে পাই নে। কোথাও যাই না।

নানু পাঁচটা টাকা দিলে অনন্ত মাঝি বলল, তিন পুরিয়া করে অষুধ থাকল। দিনে তিনবার। বার্লি আর কাগজি লেবু। ভালো খেলে শরীর সুস্থ হয়ে যাবে। সকালে ভাত দিতে পারেন কাল। শিঙি মাছের ঝোল হলে ভালো হয়। গাঁদাল পাতার ঝোলও দিতে পারেন।

তারপর ঘণ্টি বাজিয়ে চলে গেল ডাক্তার অনন্ত মাঝি। নানু উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল মাথার ওপরে আজ কতদিন পর মুক্ত আকাশ। লীলা চাল ডাল তেল বুঝে নিচ্ছে শ্রীহরির কাছ থেকে। শ্রীহরি বলল, বিড়ি আনলাম দাদাবাবু এক প্যাকেট। নানু বলল, বেশ করেছ। তোমার গাঁটা আমি দেখব শ্রীহরি। এবং তখনই লীলা বলল, দাদাবাবু তুমি থাকবে কোথায়?

নানু বলল, সে নিয়ে ভাববে না। উঠোনে একটা চাটাই পেতে দিয়ো। তাতেই হবে।

যেন কতদিন পরে নানু প্রবাস থেকে ফিরে এসেছে। আশ্চর্য মুক্তির স্বাদ। যেন নতুন জীবন শুরু হল। সে কোথাকার নানু, তার বাবা আত্মহত্যা করেছিল, মা একটা নতুন লাল বল পেয়ে তার কথা ভুলে গেল এবং সে কত যে অসহায় ছিল, এখন আর তা কিছুই মনে পড়ছে না। জীবন জুড়ে এক নতুন অস্তিত্বের আস্বাদ। লীলা এরই মধ্যে একটা ফুলতোলা আসন নিয়ে এল। নানুকে বারান্দায় বসতে দিল। এবং এত সংকোচ লীলার যে সে প্রায় সবসময়ই নির্বাক—নানুই যেমন একসময় বলল, আমি চান করব লীলা। অবশ্য এখানে আসার আগে তার মনে হয়নি রাতের পোশাক দরকার, জামাকাপড় আলাদা দরকার। সে এক জামাকাপড়ে এখানে চলে এসেছে। এখন এই রাতটা কাটাতে পারলে তার ভাবনা নেই। সকালে উঠে যেমন একজন গৃহীমানুষ সওদা করতে যায়, সে তেমনি কাল সওদা করতে যাবে। সঙ্গে লীলা থাকবে। এবং এমনই যখন ভাবছিল তখন লীলা বলল, দাদাবাবু পুকুরের জলে চান সইবে?

খুব সইবে। অর্থাৎ যেন বলার ইচ্ছা নানুর, তুমি এত সইতে পারো, আর আমি এটুকু সইতে পারব না।

লীলা বলল, তোমাকে কী পরতে দিই বলতো। কিছু নেই। আমার ধোওয়া শাড়িটা নাও। ওটা পরবে। নানু দেখল, তার দেওয়া একটা শাড়ি লীলা সুন্দর করে ভাঁজ করে রেখেছে সামনে। তারপর নানু চান করল পুকুরের জলে। ছোট ছোট দু’গণ্ডা ভাইবোন, কিছু লীলার বাবার, ধুলো দফাদারের—এ পঙ্গপাল বলা চলে, শহরের এমন ছিমছাম ভদ্রমানুষ দেখে সবসময় ব্যাকুল হয়ে আছে—কখন কী লাগবে এগিয়ে দেবার জন্য দু’গণ্ডা ভাইবোন মিলে নানুকে চান করাতে নিয়ে গেল। আকাশে তখন কিছু নক্ষত্র উঠে গেছে। পুকুরের জলে চান করে আশ্চর্য পবিত্র মনে হচ্ছে জগৎ সংসার।

লীলার পরের ভাইটা কোথা থেকে কলাপাতা কেটে নিয়ে এল। ধুলো দফাদারও কোত্থেকে খবর পেয়ে ভাত খাবার লোভে ছুটে এসেছে। লীলা এক হাতে খোলা আকাশের নিচে উনোনে রান্না করছিল। অদূরে একটা আসনে নানু বসে আছে। দু’গণ্ডা কাচ্চাবাচ্চা তাকে ঘিরে আছে। গাঁয়ের কেউ কেউ খোঁজখবর নিতে এল—নতুন মানুষটা কে? লীলা বলল, দাদাবাবু। এই পর্যন্ত। আর কিছু বলতে তার এই সময় ভারি সংকোচ হচ্ছিল।

নানু বলল, ও লীলা তোমার রান্নার আর কত দেরি? আমার খুব খিদে পেয়েছে।

তখন লীলা মুগের ডাল সম্ভার দিচ্ছে। মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, চাটনি। কলাপাতা সার সার পেতে দেওয়া—লীলার মুখ ঘামছে। উনুনের আলোতে লীলাকে কোনো সূদুর নীহারিকাপুঞ্জের মতো মনে হচ্ছিল, হাতে একগাছা করে কাচের চুড়ি। আহা লীলা জীবনে আর এত পবিত্রতা নিয়ে কখনও কিছু রাঁধেনি। মুগের ডালের চমৎকার গন্ধটা বাতাসে ম ম করছিল।

ধুলো বলল, তুমি এসেছ যখন দুদিন থেকে যাও। হাঁ আমাকে কাল এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দেবে কিন্তু।

নানু বলল, আর কী চাই তোমার?

আমার খুব বাসনা ছিল একটা শান্তিপুরী ধুতি পরি!

নানু বলল, হবে।

লীলার ভাইবোনগুলো সমস্বরে বলে উঠল, আমার জামা চাই, আমার প্যান্ট চাই।

নানু বলল, হবে। হবে।

লীলা তখন ধমক না দিয়ে পারল না। এই গোবড়া, সন্টি, মন্তি, কালো, এদিকে আয়। দাদাবাবু তুমি অত আসকারা দেবে না। সুখের গন্ধ বড় গন্ধ। তখন লীলার মা পর্যন্ত হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসে দরজায় বসে। চাঁদের হাট দেখছে। এবং বলছে, লীলা আমায় দুটো খেতে দিস।

নানু বলল, আজ না মা। কাল খাবেন। কাল মাগুর মাছ নিয়ে আসব। ঝোল ভাত। আজ আপনাকে বার্লিই খেতে হবে।

লীলার ভেতরে তখন ঝড় বইছিল। মানুষটার জন্য তার মায়ার শেষ নেই। অথচ সে বড়ই অভাগী। মনে হয় ছুঁয়ে দিলেই মানুষটার জীবনে তাদের মতো বিড়ম্বনা নেমে আসবে। সে ভাবল কাল যে করে হোক ঘরের ছেলেকে ঘরে পাঠিয়ে দেবে। এদের সে ভালো করেই জানে। দু’হাতে নানুবাবু টাকা ওড়ালে ধুলো দফাদারও বাড়ি থেকে আর বের হবার নাম করবে না। সংসারের এতবড় হাহাকারের জন্য দায়ী যারা তাদের সে ক্ষমা করতে পারে না। লীলা মনে মনে শান্ত হতে চাইল। স্বার্থপর কূট এই ধুলো দফাদার—মাকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে পাঁচ বাচ্চার জননী করে দিল। সে জানে বাবা বেঁচে থাকতে এত বিড়ম্বনা ছিল না তাদের জীবনে। বাবা বেঁচে থাকলে, তাকে একটা সুন্দর মানুষ দেখে বিয়েও দিয়ে দিত। এবং তখনই কেন যে মনে হল সুন্দর মানুষটা দেখতে ঠিক নানুবাবুর মতো হত। এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের আস্পর্ধার কথা ভেবে লীলা হতচকিত হয়ে গেল।

তখনই ধুলো মেটে হাঁড়িতে এক হাঁড়ি জল নিয়ে এল। গাঁয়ের শেষ মাথায় সরকারি নলকূপ থেকে ধুলো জল এনেছে। উৎসবে কেউ বসে থাকে না। সেজন্য জলটা কাঁধে করে নিয়ে এসেছে। এবং ভাঙা তোবড়ানো এনামেলের গেলাসে জল, কলাপাতায় গরম ভাত, এবং টুকরো কাগজি লেবু এবং বেগুন ভাজা। লীলা কোমরে আঁচল গুঁজে সবাইকে ভাত দেবার আগে নানুর পাতে সুন্দর করে ভাত বেড়ে দিল। সেই সময় নানু তাকাল লীলার দিকে, লীলা তাকাল নানুর দিকে—বড়ই সুখে নানুর বুক বেয়ে অজস্র কান্না অত্যধিক বেগে বের হয়ে আসতে চাইল। সে চোখ নামিয়ে নিল। ভাত মেখে খাবার সময় কেউ লক্ষ্য করল না—নানু গোপনে আজ কাঁদছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *