মানুষের হাহাকার – আঠারো
কলেজ থেকে ফেরার পথে পিয়া মাঝে মাঝে মোড়ের পানের দোকানটার সামনে দাঁড়াত। বলত, তুই দাঁড়া, আমি একটা পান খেয়ে আসছি। সে পানের খিলি এনে বলত, তুইও খা। দেখবি কী সুন্দর লাল টুকটুকে ঠোঁট হয়। সামান্য পান চিবিয়ে ঠোঁট উলটে দেখাত, কীরকম রে!
খুব লাল।
জয়া বলত, আমার লাল হয় না।
যে যত বেশি ভালোবাসতে জানে তার ঠোঁট তত লাল হয় জানিস।
অদ্ভুত সব কথা বলত পিয়া। আমি এখন ভালোবাসায় ডুবে আছি। কী সুখ কথাটা বলেই পিয়া চোখ বুজে ফেলত। মুখটা পিয়ার আশ্চর্য লাবণ্যে ভেসে যেত। চোখ ভারী ভারী দেখাত। চিবুক রাঙা হয়ে উঠত। গোপনে বোধহয় পিয়া কিছু করছে। লজ্জা সংকোচ পিয়ার একদম আজকাল নেই। সুখ কত তীব্র একদিন জানার ইচ্ছে হয়েছিল জয়ার। বলেছিল, এই তোর কেউ আছে?
বলব কেন?
বল না। আমি কাউকে বলব না। আমারও তো কী যে হয় রে। রাতে বিছানায় গেলেই যেন একজন যুবার শরীর আমার পাশে শুয়ে থাকতে চায়। এত দুষ্টুমি আরম্ভ করে দেয় কী বলব, ঘুমই আসে না।
যুবকটি কে? আমি চিনি? প্রিয়া বলল।
পৃথিবীর সব যুবকদেরই বলতে পারিস। সুন্দর মতো যুবক দেখলেই সারাদিন মনটা আনচান করে। রাতের বেলা কী করি বল। বিছানায়ও দেখতে পাই সে লম্বা হয়ে পাশ ফিরে আছে।
পিয়া বলল, খুকি। তোমার কিছু হবে না।
আমার ভয় করে।
এবং এই ভয় সূত্রে ধীরে ধীরে তার সব জানা হয়ে গেছে। কোথায় কত নম্বর ধর্মতলায় কত টাকার বিনিময়ে শরীর ফের পবিত্র হয়ে যায় তাও তার জানা। কী কী ব্যবহারে রহস্যময় আধারে ডুব দিলেও দাগ ধরে না তা জানতেও বাকি নেই। কেবল ভেবেই গেছে। মানুই তার একমাত্র মানুষ যার কাছে সহজেই সে তার ইচ্ছের কথা বলতে পারে। মানুকে সে যেটুকু দিয়েছিল, পৃথিবীর কোনো কাকপক্ষী টের পায়নি, জয়া মানুর চোখে চুমো খেয়েছে! কী আরাম! ট্রামটা তখন গড়িয়াহাটের মোড়ে এসে গেছে। এখানে নেমে উলটোদিকে যাবে। পঁয়তাল্লিশ নম্বরেই সহজ হবে। কালিদাসকে না হলে এড়ানো যেত না। সে ভাবল এবার সেই দোকানটায় যাবে। একবার পিয়া লাল ত্রিকোণ চিহ্নিত কিছু কিনে বলেছিল ‘তুইও কিনে নে’। কখন কাজে লেগে যাবে টেরও পাবি না। সে পিয়ার মতো মহিলা হতে পারেনি, বরং পিয়ার এমন একটা নষ্ট চরিত্র তাকে পীড়া দিয়েছে। অথচ আজ ওর কী যে হচ্ছে যেন সে লাল ত্রিকোণের সাহায্য না নিয়ে কিছুতেই আর বাঁচবে না। মানুটা কোথায় কী করছে কে জানে।
সে খুব বিনীতভাবে কথাটা বলল। এবং দোকানি বোধহয় সামান্য বিস্মিত হয়েছে কথাটায়। কারণ এ মুখ তার ঠিক চেনা নয়। এখানে এ—পাড়ায় কোনো কোন বাড়িতে কী কী ভাবে পরিবার পরিকল্পনা চলছে মোটামুটি তার জানা। জানাশোনার ভিতর এ মেয়েটা কিছুতেই পড়ছে না। জয়া মুখ ঘুরিয়ে প্যাকেটটা কিনে কোনোরকমে দোকানিকে সে দু টাকার নোট দিয়ে দিল। এত বেশি ঘামছিল যে কিছুতেই ফেরত পয়সাটা আর হাত পেতে নিতে পর্যন্ত পারেনি। এবং বাসে উঠেও মনে হয়েছিল সবাই দেখে ফেলেছে। কার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই ওর ভীষণ সংকোচ হচ্ছিল।
সারাটা বাস কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। এবং সেই প্রবল এক পুরুষ বিশাল দু বাহু নিয়ে সাপটে ধরেছে এমনই একটা দৃশ্য সারাক্ষণ চোখের ওপর ভেসে চলছিল। শহরের গাছপালা, বাড়ি, ঘর, ট্রাম, বাস, ভিড় কিছুই সে অনুভব করতে পারছিল না। বটুয়ায় সেই নিষিদ্ধ বস্তুটি সারাক্ষণ তাকে উদভ্রান্ত করে রেখেছে।
এবং সে বাড়ি ফিরে এলেই মা বলল, জয়া এলি। আমার পাশে একটু বোস না। সারাদিন কোথায় যে টো টো করিস।
বারে আজ আমাদের কবিতার আসর ছিল না।
কোথায়?
কালিদাস বিনয় এসে নিয়ে গিয়েছিল। ভবানীপুরের দিকে।
তুই কবিতা পড়লি?
বারে পড়ব না।
কোন কবিতাটা পড়লি।
ওগুলো তোমাকে শুনাই নি।
জয়া যে কবিতা পাঠ করেনি, সে চলে এসেছে এবং ভেতরে মানু নামক যুবকের ভয়ংকর দাপট সারাক্ষণ মাতালের মতো রেখেছে, এবং এই বটুয়ার ভেতরে রয়েছে এক সঞ্জীবনী সুধা, যার বিনিময় সে জীবনে প্রথম গভীরে আরও সুগভীরে ঢুকে যাবার জন্য ছটপট করছে—সে সম্পর্কে মাকে কিছুই আঁচ করতে দিল না। খুব স্বাভাবিক গলায় গান গাইল। হাতের আঙুল বটুয়া ঘোরালো! পায়ে পায়ে বাঘা ঘুর ঘুর করল। সেলফের অত্যধিক নিচে লুকিয়ে রাখল তার অন্তর্যামীকে। এবং বাথরুমে ঢুকে তারপর শুধু স্নান। কী কী আছে এই শরীরে প্রায় নাভিমূলে সেই স্বর্ণ কেশদামের মতো অতীব বিলাসিনী রাই। সে স্নান করতে করতে ডাকল মন্টু মন্টু।
কোনো সাড়া নেই।
মা মন্টুর সাড়া নেই কেন!
মা শুনতে পাচ্ছে না কিছু। বিছানায় শুয়ে থেকেই বলছে, কিছু বলছিস জয়া।
মন্টু কোথায় মা?
মন্টু কোথায় জানি না, তো।
আজ আসুক! মাথাটা ভাঙব—বাড়ি না থাকলে স্বাধীন।
বাথরুম থেকে বের হয়ে ঘাড় গলা এবং চুল মুছতে নীল আলোটা জ্বেলে দিল করিডোরের। তারপর ফের ডাকল, মন্টু তুমি কী আমার মতো মরেছ!
মন্টু বলল, যাই দিদিমনি! আমি মরিনি।
দ্যাখ তো, মানুবাবু বাড়ি আছে কিনা!
কিছু বলব?
থাকলে এই চিঠিটা দিয়ে আসবি। খুব দরকার।
আর এসব কথাগুলো বলতে গলা কাঁপছিল জয়ার এবং কেমন একটা জ্বরের মতো ঘোরে পড়ে আছে। ঘোরের ভেতরই সে এতসব করতে পারছে। সামান্য অসুস্থতা শরীরে না জন্মালে বুঝি এতটা বেপরোয়া হওয়া যেত না। সে হাত পা লম্বা করে শুয়ে পড়ল। আলোটা চোখে বড় লাগছে। উঠে আলোটা নিভিয়ে দিল। এবং পৃথিবীতে মা বাবা কিংবা পিসির আদুরে সব ন্যাকামো চিন্তাভাবনা কিছুই আর মাথায় নেই। কেবল এক যুবককে দেখতে পাচ্ছে, সুদূর থেকে হেঁটে আসছে, কত কাল, কত যুগ ধরে হেঁটে আসছে আর বারবার শরীরে মিশে যাচ্ছে। সে কেমন জ্বালা বোধ করল। চোখ জ্বলছে। ওর মনে হচ্ছিল, মানু আসতে না আসতেই সে মরে যাবে।
স্কুটারটা কিছুদূর বাতাসে ভেসে গিয়ে ঝুপ করে একটা জায়গায় থেমে গেল।
রমা বলল, কী হল অরুণ!
অরুণ দেখল, নাকের ডগা দিয়ে আর একটা স্কুটার বের হয়ে যাচ্ছে। এত দ্রুত বের হয়ে গেল বোঝা গেল না কিছু। আরোহী একেবারে বাঘের মতো বাতাসের ওপর দিয়ে লাফিয়ে চলে গেল। মরীচিকা মতো সে কিছু দেখেই তার গতিপথ পালটে সামনের আরোহীকে ধাওয়া করল।
রমা বলল, ওদিকে কোথায় যাচ্ছ!
অরুণ কিছু বলল না। চোখে ভারী গগলস। মাথায় লোহার টুপি এবং কোমরে বেল্ট থাকলে তাকে এখন দস্যুর মতো মনে হতে পারত। সে রেড রোড ধরে হাওয়ার আগে ছুটে যেতে চাইছে।
রমা দেখল, নিমেষে বাস—স্ট্যান্ড পার হয়ে কখন মিন্টের পাশ দিয়ে অরুণ বেগে ছুটে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে স্কুটারের স্পিড তোলার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কোথায় যাবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
স্কুটারটা বাঁক ঘুরতেই দূরে আর একটা স্কুটার রমার চোখে ভেসে উঠল। ঠিক ওর মতো কেউ যেন পিছনে বসে রয়েছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সোজা ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে একটা হলুদ বলের মতো দিগন্তে চলে যাচ্ছে স্কুটারটা। রমা এবার আর্ত গলায় বলল, অরুণ কোথায় যাচ্ছ! এত জোরে চালিয়ো না। মরে যাব অরুণ।
অরুণের যেন কিছু শোনার সময় নেই। সামনে আড়াল পড়ছে একটা ট্রাকের। দেখা যাচ্ছে না আর। সূর্য এবার দিগন্তে হেলে পড়ছে। কিছু কাঞ্চন ফুলের গাছ দু—পাশে। মাঠ, জলা জমি, উর্বরা শস্যক্ষেত্র পার হয়ে সে চলে যাচ্ছে। রমা কিছুতেই আঁচল কোমরে গুঁজে রাখতে পারছে না। খোঁপা খুলে গেছে। এবার সব চুল পালের মতো উড়বে। সামনের ট্রাকটা অরুণ নিমেষে পার হয়ে গেল। জীবন নিয়ে এক আশ্চর্য ছিনিমিনি খেলায় মেতে উঠেছে অরুণ। দূরের স্কুটার তার আরোহী এবং যুবতী কিছু যেন চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছে, অরুণ যত দ্রুত পারছিল তাদের চেষ্টা করছে ধরার।
রমা বলল, অরুণ তোমার কী হয়েছে।
বাতাসের বিশাল থাবায় সব শব্দ গন্ধ ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। রমার কোনো কথাই আর তার কাছে স্পষ্ট নয়। সে কেবল পাগলের মতো হাঁকপাঁক করছে সামনের স্কুটারটা ধরার। আর তারপরই বিশাল একটা দ্রুতগামী যান উঠে এল রাস্তায়। সবকিছু আড়াল দিয়ে একেবারে চিরস্থায়ী হয়ে গেল। যেন আশ্চর্য নিয়তি খাড়া হয়ে আছে সামনে। দ্রুতগামী যান নিশ্চল নিথর। সে চিৎকার করে উঠল, শা…আর কিছু প্রকাশ করতে পারল না। টলতে টলতে স্কুটার থেকে নেমে লাফিয়ে গেল সামনে। আর দূরে দেখল স্কুটারটা বিন্দুবৎ হয়ে যাচ্ছে। ক্রমে ছোটো হতে হতে তার আর দেখা পাওয়া গেল না। প্রকৃতি ভীষণ নির্দয় নিষ্ঠুর। হা হা করে যেন গাছপালা মাঠ, আকাশ হাসছিল।
রমা বলল, কী হয়েছে তোমার।
পেছনে কে বসেছিল।
রমা বলল, লোকটার কেউ হবে।
তুমি মেয়েটার মুখ দেখেছ?
স্পষ্ট কিছু দেখিনি। চুল খোলা ছিল।
অরুণ কেমন নিস্তেজ গলায় বলল, আমি শেষ।
কী বলছ যা তা!
আমার আর অহংকার করার মতো কিছু থাকল না।
অরুণ কী হয়েছে তোমার, বলবে তো?
কিছু হয়নি। চলো।
এবং সোজা সে রমাকে ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল, একটা ফোন করব।
রমা অরুণকে নিয়ে নিচের তলায় গেল। ফোনে অরুণ বলল, অমলা আছে?
কে?
আমি অরুণ বলছি।
ও অরুণ মেসো। কেমন আছেন।
অরুণ বুঝতে পারল না কে কথা বলছে। বিরক্তি এবং অধৈর্য আর কী যে বলবে, যেন পারলে সে এখন গালাগাল দিতে পারলে বাঁচে। তারপরই মনে হল মেজদির ছেলে এখানে বেশ কিছুদিন থেকে আছে। বেয়াদপ ছোকরাটার সঙ্গে তার এখনও দেখাই হল না। যখনই গেছে তখনই শুনেছে বাড়ি নেই। বোধহয় সেই। এবং এতসব ভাবার তার সময়ও ছিল না। তড়িৎপ্রবাহের মধ্যে সব কথাগুলি বড় দ্রুত টরে টক্কা বাজিয়ে গেল। সে বলল, অমলা আছে?
অমলা মাসির কথা বলছ?
তবে আর কার কথা বলব?
অমলা বলতে কত মেয়ে আছে পৃথিবীতে।
সামনে থাকলে হয়তো গালে চড় বসিয়ে দিত একটা। ছোকরার মার সঙ্গে বনিবনা হল না বলে এখানে চলে এসেছে। অমলা কতবার নাকি বলেছে, যাস আমাদের বাসায়। ধুস সে কেন আবার মাথার মধ্যে এতসব টরে টক্কা নিয়ে বেঁচে থাকবে। চোখমুখ জ্বলে উঠছিল। রাগে দুঃখে সে কী যে বলে ফেলত। কিন্তু নিজেকে খুব সামলে নিয়ে বলল, মিতা আছে? মিতাকে ফোনটা দাও।
ছোটমাসি নভেল পড়ছে।
তোমার ন’মাসি কোথায় জান?
মানে অমলা মাসি। সকালে একবার দেখেছিলাম। তারপর আর দেখিনি। দাদুকে ডেকে দেব। দাদু জানতে পারে।
এই দাদুই খেল ছোকরাটাকে। একটা কথার সোজা জবাব দেয় না। একেবারে সব সময় আশ্চর্য রকমের বেয়াড়া কথাবার্তা। অরুণ বলল, তাই দাও।
তখনই ও—পাশ থেকে আবার কথা—ছোটমাসি এসে গেছে।
তুই কার সঙ্গে এত কথা বলছিস নানু?
অরুণ মেসো। অমলা মাসিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
মানে?
মানে অরুণ মেসো জানতে চাইছে—এখানে অমলা মাসি আছে কি না। বলেই সে ফোন ছেড়ে আবার রা রা করে গান গাইতে থাকল।
অরুণ ও পাশ থেকে সব শুনে আরও অস্থির হয়ে উঠল। বুঝতে পারছে নানু নামে ছোকরাটা যথার্থই ইতর।
মিতা বলল, অরুণদা।
হ্যাঁ।
দিদিতো ছোটকাকার বাসায় যাবে বলে দুপুরে বের হয়ে গেছে। মুখটা অরুণের ভারি ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল।
তারপরই মিতা বলল, আপনি কোত্থেকে বলছেন? বাসায় দিদি ফিরে যায়নি।
অরুণের সত্যি মনে হল ভুল করে ফেলেছে। আগে বাসায় না গিয়ে এভাবে ফোন করা ঠিক হয়নি। কাকে না কাকে স্কুটারের পেছনে বসে থাকতে দেখে এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়া ঠিক হয়নি। সে কেমন নিস্তেজ গলায় বলল, না এমনি ফোন করেছিলাম। তারপর অরুণ ভাবল আর কী বলা যায়। শেষে সামান্য বানিয়ে বলল, বাসায় ফিরতে একটু দেরি হবে দিদিকে বলো।
যদি সোজা চলে যায়!
তা হলে আর বলতে হবে না। তোমাদের ফোন করতে পারে!
অরুণের মাথাটা তারপরেই কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। সামনে রমা দাঁড়িয়ে আছে—এই রমাকে নিয়ে আজ পাতালে প্রবেশ করার তালে ছিল—সামান্য একটা স্কুটার তার মাথার মধ্যে কীসব গণ্ডগোলের ছবি জুড়ে দিয়ে গেল—আর সেই থেকে কী যে ভীষণ সংশয়। সে পাগলের মতো রমাকে বলল, যাচ্ছি!
রমা অত্যন্ত ক্লান্ত অবসন্ন। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠতে পারছে না।
ভুবনবাবু তখন দৈনিক কাগজটা নীরজাকে পড়ে শোনাচ্ছিলেন। নীরজা চোখে আজকাল ভালো দেখতে পায় না। দিনের বেলাতে সাত পাঁচ কাজের মধ্যে ডুবে থাকে। সন্ধের সময় তিনি নীরজাকে একটু অবসর বুঝে কাগজটা পড়ে শোনান। তিনি পড়তে পড়তে বললেন, শুনতে পাচ্ছ।
নীরজা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ পড়ে যাও না।
তিনি আবার বললেন, শুনতে পাচ্ছ। বাকিটা যেন এমন শোনাত সিঁড়িতে পায়ের শব্দ…।
তুমি পড়ে যাও না!
তিনি পড়লেন, বাড়ছে পারিবারিক হিংসা। কমছে মানুষের সহিষ্ণুতা। বিবাহ বিচ্ছেদ তো বাড়ছিলই। বাড়ছে আত্মহত্যা। অজ্ঞাত রহস্যময় মৃত্যু বিশেষত নারীদের। তিনি কাগজটা রেখে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাবেন ভাবলেন। কিন্তু যেতে সাহস পেলেন না! রমা বিপর্যস্ত হয়ে ফিরছে। হিংসা দ্বেষ লোভ, শারীরিক মোহ, স্বার্থপরতা সব মিলে মেয়েটার অস্তিত্বে ঝড় তুলেছে বুঝি।
রমা তখন সোজা বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিল। বিকট শব্দ করে জল চারধারে লাফিয়ে ছড়িয়ে ওকে ক্রমে ঠান্ডা করে দিতে লাগল। আর একটা ব্যথাতুর কাতর যন্ত্রণা শরীর বেয়ে যা তাকে সারাদিন অতিশয় সব নিষ্ঠুরতার ভিতর দৌড় করিয়ে মেরেছে ক্রমে শীতল হতে হতে কেমন হিমঠান্ডা হয়ে গেল। আর আশ্চর্য এত কান্না কেন বুক গুমরে উঠে আসছে তার! কী যে থাকে, অপমান আর লাঞ্ছনার যেন শেষ নেই জীবনে। যুবতীর সব ঐশ্বর্য হেলায় লোকটা আস্তাকুঁড়ে কোন অহংকারে ছুড়ে দিতে পারল বুঝল না। তার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।
আরও রাত করে ফিরল ভানু। সে কেমন গুমরে বসে থাকল কিছুক্ষণ। মানু ফিরে এলে নীরজা বলল, জয়া তোকে যেতে বলেছে কী একটা বই নিয়ে। মানু বলল, কাল যাব।
দুবার খোঁজ করেছে। তাছাড়া একটা ছেলে এই চিঠিটা দিয়ে গেছে। নীরজা বলল।
করুকগে। মানু রেডিয়োর নব ঘুরিয়ে আর একটা নতুন সেন্টার ধরার চেষ্টা করার সময় চিঠিটা খুলে ফেলল—সেই অহংকারী ছেলেটার চিঠি। চিঠিতে লিখেছে, বুঝতে পারছি তুমি আর ভালো নেই। বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় মানুষ ভালো থাকে না। এখন চাই সৎ মানুষ, পরিশ্রমী মানুষ। ঠিকঠাক বেঁচে থাকার জন্য আজ এটা আমাদের বড় বেশি দরকার। মানু রেডিয়ো বন্ধ করে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সামনে বিরাট উদার আকাশ। তার নিচে কত অবহেলিত জনপদ। সে যেন কবে থেকে কোথাও যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠছে।
সবাই ঠিক ঠিক ফিরে আসায় ভুবনবাবু আজকের মতো রাতে ভালো ঘুমাতে পারবেন। কাল পরশু এবং তারপর অন্য কাল পরশু কী হবে তিনি জানেন না। শুধু এটুকু জানেন, যতদিন আছেন নির্বিঘ্নে আর জীবন কাটাতে পারবেন না। সমস্যা দিন দিন সবার মতো তারও কেবল বাড়ছে। আগে একমাত্র সমস্যা ছিল তিনি নিজে, নীরজা এলে দু’নম্বর সমস্যা। সন্তান হলে তিন নম্বর সমস্যা। ওরা যত বড় হতে থাকল, তত অজস্র সমস্যায় নিপীড়িত হতে থাকলেন তিনি।