মানুষের হাহাকার – পনেরো
রাসবিহারী সান্ধ্য ভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরে দেখলেন, কেমন নির্জন এবং ফাঁকা বাড়িটা। বাইরের বাগান থেকে নিধু খুরপি কোদাল তুলে নিয়ে যাচ্ছে কলতলায়। কেউ আলো জ্বালেনি বাড়ির। হেম কিংবা মিতার তো যাবার কথা নেই কোথাও। দরজা জানালাও সব হাঁট করে খোলা। তিনি প্রথমে দরজার ভেতরে ঢুকে নিজের ঘরের আলো জ্বেলে দিলেন। তারপর লাঠি এক পাশে রেখে বেশ জোর গলায় ডাকলেন, মিতা মিতা। কোনো সাড়া নেই। নানু এখনও ফিরে আসেনি। অবনীশ কি নানুকে থেকে যেতে বলেছে! নাদন কী আবার এ—বাড়িটায় এসেছিল। মিতা কি নাদনের সঙ্গে কোথাও গেছে। তিনি এটা পছন্দ করেন না। মিতা বাবার পছন্দ অপছন্দের দাম দেয়। বাবা অপছন্দ করে বলেই একসময় রাসবিহারী দেখেছেন, নাদন এ বাড়িতে আসা কমিয়ে দিয়েছে। মিতা বলতেও পারে নাদনকে, তুমি আর আমাদের বাড়িতে এসো না। বাবা তোমার আসা পছন্দ করেন না। সেই মেয়েটাও নেই। তিনি বুঝতে পারছেন বয়স যত বাড়ছে তত সংকট চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে তাকে। তিনি আবার ডাকলেন, হেম তোমরা কোথায় সব! আর তখনই যেন ও—ঘর থেকে হেমর ক্ষীণ গলা পাওয়া গেল। —এখানে, কেন কী হয়েছে?
বাড়িটাতে আলো জ্বালা নেই।
কী হবে জ্বেলে?
রাসবিহারী পাশের ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বেলে দেখল হেম শুয়ে আছে। শরীর খারাপ। না হলে হেমর শুয়ে থাকার কথা না। তিনি মোড়া টেনে পাশে বসলেন। —শরীর ভালো নেই?
না। খুব সংক্ষিপ্ত জবাব।
কী হল?
কিছু হয়নি!
সহসা রাসবিহারীর চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হল, কিছু হয়নি তো শুয়ে আছ কেন। কিন্তু তিনি জানেন, এতে সংসারের অনর্থ বাড়বে বই কমবে না। তিনি দেখেছেন, বাড়িতে ঝি চাকর কামাই করলেও হেমর শরীর খারাপ হয়ে যায়। বিকেলে ঠিকা ঝি বীণার কামাই হলে হেম গজ গজ করে। সব একটা মানুষের আসকারাতে গেল এমনই ভাব হেম। মাইনে কাটলে ঠিক শিক্ষা হয়—কিন্তু রাসবিহারী জানেন, লোকজনের যা সমস্যা তাতে এক দু দিনের মাইনে কেটে কিছু হয় না। আবার নতুন একটা লোক ঠিক করতে রাসবিহারীর মাথার ঘাম পায়ে নেমে আসবে। অথচ কাজের লোক এলেই দেখা যাবে হেমর সংশয় বেড়ে যাচ্ছে। এবং এমন নিষ্ঠুর আচরণ করবে মাঝে মাঝে যে রাসবিহারীর মনে হয় হেমর মন বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। কেমন নির্মম এবং অবিবেচক হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। একে ঠিক অবুঝ বলা যায় না, বরং যেন ছ’টি মেয়ের জননী করার জন্য শেষ বয়সে প্রতিশোধ নিচ্ছে। রাসবিহারী সে—জন্য ঠান্ডা মাথায় বললেন, রান্নার লোকটা আসেনি!
আবার সংক্ষিপ্ত জবাব, না।
মিতা কোথায়?
দেখতে গেছে কেন এল না।
নানু ফিরে আসেনি?
জানি না।
এরপর আর কী করা যায়। তিনি উঠে পড়লেন। একটু চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। সান্ধ্য ভ্রমণ সেরে এসেই তার চা খাবার অভ্যাস। তিনি রোজ হাত মুখ ধুয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পান কাজের মেয়েটা চা দিয়ে গেছে। আজ কপালফেরে তাও জুটবে না। তিনি ডাকলেন, নিধু। তুই একবার যা তো পঞ্চাননের কাছে। ওদের বস্তিটা জানিস কোনদিকে?
সে বলল, জানি কর্তা।
এই নিধুই সংসারে একমাত্র সরল মানুষ যার কোনো চাহিদা নেই। সে এসেছিল, দূর বালেশ্বর থেকে। রাসবিহারীর হাতে পায়ে ধরে একটা বেয়ারার কাজ জুটিয়েছিল। এবং রিটায়ার করার চার পাঁচ বছর আগে নিধু রাসবিহারীর খাস বেয়ারা হয়ে যায়। সেই থেকে দশ বারো বছর ধরে দু’জনের একসঙ্গে জীবন কাটছে। এই নিধুকেও খুব একটা পছন্দ নয় হেমর। উটকো লোক মনে করে থাকে নিধুকে। বাড়ির বাগান দেখাশোনা করার জন্য দুবেলা, দু—কেজি চালের ভাত খাওয়ানোটা কোনো বিবেচক গেরস্থর কাজ নয়। রাসবিহারী জানেন, এটাও হেমর বাড়াবাড়ি, নিধু ভাত সামান্য বেশি খায়—আটা খেয়ে ওর সহ্য হয় না, সে—জন্য নিধু এ বাড়ির দুবেলাই অন্ন ধ্বংস করে। ধ্বংস শব্দটি হেমর দেওয়া। এই শব্দটি তিনিও এ—সময় ব্যবহার করলেন এ—জন্য যে নিধুর উচিত ছিল খোঁজ খবর নেওয়া। হেম ইচ্ছে করলে নিধুকেই পাঠাতে পারত। কিন্তু ভেতরে এত জ্বালা এই রমণীর যে মিতাকে পাঠিয়ে এক সঙ্গে রাসবিহারী এবং নিধুর ওপর প্রতিশোধ নেওয়া গেল। বুঝে দেখো তুমি যাকে গুরুঠাকুর করে রেখেছে সংসারে তাকে দিয়ে কী কাজটা হয়!
রাসবিহারী নিধুকে পঞ্চাননের খোঁজে পাঠিয়ে সামান্য বিশ্রাম নেবেন ভাবলেন।
বাথরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুলেন, ঘরে এসে পাখা ছেড়ে দিলেন। তারপর মুখে এক টুকরো হরীতকী ফেলে চিবুতে থাকলেন। জিভে লালা জমতেই মাথার ঘিলুর মধ্যে কে যেন খোঁচা দিতে থাকল। বুঝতে পারলেন নানুর জন্য চিন্তা হচ্ছে। খচ খচ করছে মনটা। এই ছেলেটা বাড়ি না থাকলেই আজকাল কেমন একা লাগে রাসবিহারীর। অমলা কখনও বাসায় ফিরে যাবার আগে বাড়ি হয়ে যায়। অমলা তার আরও কাছের। সে কী করছে না করছে এই জন্য কেন যে তেমন চিন্তা হয় না। যা হবার হবে। তিনি নানুর জন্যও এমন ভাবতে পারলে অনেক দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেতেন। আসলে তিনি বুঝতে পারেন মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলেই পর হয়ে যায়। সম্পর্ক আলগা হয়ে যায়। একটি পুত্র সন্তান থাকলে সম্পর্ক এতটা বোধ হয় আলগা হত না। একটা দীর্ঘনিশ্বাস বুক বেয়ে এ—সময় তাঁর উঠে এল। তারপরই মনে হল, আসলে সবারই হাজার সমস্যা। মানুষের বয়স যত বাড়ে সমস্যা তত বাড়ে। এখন তাঁর মেয়েদেরই হাজার রকমের সমস্যা। কোনো কোনো সমস্যার খবর তিনি রাখেন, কিছু তাঁকে আঁচ করে নিতে হয়—বাকিটার তিনি কিছুই জানেন না। আর তখনই মনে হল বারান্দা পার হয়ে কেউ চলে যাচ্ছে। তিনি ডাকলেন, কে রে?
আমি।
তিনি বুঝতে পারলেন, মিতা ফিরে এসেছে।
কী বলল?
আসবে। ওর মেয়েটার জ্বর হয়েছে।
এই আসবে। শব্দটিতে রাসবিহারী আশ্চর্য রকমের একটা স্বস্তি বোধ করলেন। না হলে রাতের খাবার নিয়ে এই বাড়িতে একটা কুরুক্ষেত্র হত। মিতা রান্নাঘরে গেলেই সব ভণ্ডুল করে দেয়। সুতরাং হেমর শরীর খারাপ সত্ত্বেও কাজ কাম করত, সায়া শাড়ি ঠিক থাকত না আর রাসবিহারীর চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করত, বে—আক্কেলে মানুষের কপালে এই লেখা থাকে বলত। এমনকি এক সময় চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে ফিট হয়ে যেতেও কসুর করত না। যেন তেন প্রকারেণ বুঝিয়ে দেওয়া কাপুরুষ মানুষের এমনই হয়। কেউ ভয় পায় না, কেউ ভয় পায় না। সেদিনকার নানু সেও মুখের ওপর কথা বলে।
তিনি ফের ডাকলেন, মিতা চলে গেলি!
মিতা দূর থেকে জবাব দিল, আমাকে কিছু বলছ।
একটু শুনে যাবি।
মিতা বলল, আসছি।
তারপর খানিকটা সময় কেটে গেছে। নিধু ফিরে এসেছে। সে গলা বাড়িয়ে বলল, এসে গেলি! আর নিধুর মুখটা সহসা আলোর মধ্যে আবিষ্কার করে কেমন ভড়কে গেলেন রাসবিহারী। আশ্চর্য নিশ্চিন্ত মুখ। মানুষের এমন নিশ্চিত মুখ কী করে হয়! তিনি কতদিন পর, কতদিন পর কেন, যেন এই প্রথম তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, তোর আর কে আছে? তুই এখানে আর কতদিন পড়ে থাকবি! তোর জমানো টাকা বুঝে নিয়ে দেশে চলে যা। ওতে বাকি জীবন আরামে কেটে যাবে তোর। তারপরই মনে হল নিধু ওর চেয়ে বয়সে বড়ই হবে। নিধুর দেশে ছেলেমেয়ে সবই আছে। একবার মাত্র ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছিল, বউর অসুখ শুনে। তিনমাস পরে এল। বলল, চুকে বুকে গেল সব বাবু। তারপর আর কোনো টান বোধ করেনি দেশে ফিরে যাবার! বরং এখন দেখলে মনে হয়, তিনি শহরের প্রান্তে যে খোলামেলা জায়গা নিয়ে বাড়িটা করেছেন এটাই তার প্রাণ। ফসল তোলার সময় কিছুদিন সোনারপুর তাকে চলে যেতে হয়। সেখানে পঞ্চাশ বিঘার বড় একটা জোত আছে রাসবিহারীর। ধান, পাট, কলাইর দিনে কলাই সবই সে বুঝে আদায় করে নিয়ে আসে। তারপর বলতে গেলে বাড়ির দুটো গাভী, গোয়ালঘর আর এই বাগান মিলে তার জীবন। মানুষ কীভাবে কোথায় যে অবলম্বন পেয়ে যায় কেউ বোধ হয় বলতে পারে না।
তখনই হাজির মিতা! বলল, ডাকছিলে কেন?
নানু আজ ফিরে আসবে ত।
আমাকে কিছু বলে যায়নি।
আমাকেও তো বলেনি।
নানু কাকে বলে!
সত্যি নানু কাউকে কিছু বলে যায় না। পৃথিবী সুদ্ধু লোকের ওপর নানুর আক্রোশ। অমলা কতবার বলেছে, আমাদের বাসায় যাস নানু। যদি একবার যেত! সেজ মাসি কত বলে গেছে, যাস। কিছুই তোয়াক্কা করে না ছেলেটা। মা যার এমন তার আর কী হবে! তাঁর মনে হল, মেয়েদের জন্মসূত্রেই দোষ থেকে গেছে। এখন বুঝতে পারেন সব কটা মেয়েই ছিল তার অবাঞ্ছিত। ওদের কপালেও অবাঞ্ছিত কিছু লেখা থাকবে তাতে আর বিস্ময়ের কী!
রাসবিহারী বললেন, ও তো অবনীশের বাড়িতে গেছে। বিকেলেই ফেরার কথা। বলে ঘরের দেয়ালে চোখ রাখলেন। তাঁর ঘরটার দেয়ালে কিছু ছবি আছে। বিশেষ করে একটি ছবি খুবই বড়। ছবিটি সি আর দাশের। পাশে নেতাজীর ছবি। উত্তরের দেয়ালে আছে মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ। তা ছাড়া বিদ্যাসাগর মশায়েরও একটা ছোট ছবি টাঙানো আছে। এত সব মহাজনের এই দেশ, এই দেশে তিনি জন্মেছেন বলে গর্বিত। অথচ তাঁর পরের প্রজন্ম থেকেই কেমন দোষ পেয়ে গেল।
রাতে নানু ফিরলে রাসবিহারী বললেন, তোমার মা চিঠি দিয়েছে।
নানু বলল, আচ্ছা দাদু, বাবা আমার নামে কিছু টাকা রেখে গেছেন। সেটা কত টাকা?
এমন কথায় রাসবিহারী খুবই বিস্মিত হলেন। বললেন, দেখতে হবে।
তুমি জান না কত?
সুদে আসলে যা আছে তা মন্দ না।
ঠিক আছে কত টাকা আমার জানার দরকার নেই। আমাকে কালই ব্যাংকে নিয়ে চল, তুমি তো জান, বছরখানেক হয়ে গেল আমি সাবালক হয়ে গেছি।
দাদু বললেন, টাকার খুব দরকার?
দরকার অদরকারের কথা হচ্ছে না। বাবা তাঁর দুঃসময়েও এ’ কটা টাকা আমার অ্যাকাউন্ট থেকে তোলেননি। এখন আমি সে টাকা সদ্ভাবে খরচ করতে চাই।
রাসবিহারী বললেন, ঠিক আছে, তোমার টাকা তুমি বুঝে নেবে। তবে তোমার মাকে জানালে হত না।
নানু চিৎকার করে উঠল, সে কে?
অগত্যা রাসবিহারী প্রসঙ্গ পালটে বললেন, নবনীতা বলে কেউ আছে?
হ্যাঁ আছে।
তোমাকে ফোন করেছিল!
কখন?
দুপুরে।
কিছু বলল?
না। বাড়ি নেই জেনে কিছু বলল না।
ঠিক আছে। নানু তড় তড় করে নিচে নেমে ফোন করল, এবং অপর প্রান্ত থেকে গলা পেয়ে বলল, কাকিমা আমি নানু বলছি। নবনীতা আছে?
এত রাতে কোথায় যাবে?
এই কোথাও যদি বেড়াতে যায়।
না বাড়িতেই আছে। দিচ্ছি। ধর।
নবনীতা।
আমাকে ফোন করেছিলে?
হ্যাঁ। কেমন ঘুমকাতুরে গলা। নানুদা আগামী রোববার আমাদের সঙ্গে যাবে?
কোথায়?
আমরা হাজারদুয়ারী যাচ্ছি।
কে কে?
আমার মাসি, মেসো, দাদা, দাদার বন্ধুরা। আমি যাব, মা যাচ্ছে। বাবা শুধু যাবে না।
নানু মুখ কুঁচকে বলল, তোমার আবার দাদা এল কোত্থেকে?
ন’মাসির ছেলে। বরুণদা। খুব ভালো গিটার বাজায়।
খুব গেঞ্জাম হবে মনে হচ্ছে।
তা একটু হবে।
নবনীতা তুমি যদি না যাও কেমন হয়?
নবনীতা কেমন অপর প্রান্তে আমতা আমতা করতে থাকল।
সে কী করে হবে! মা আমাকে রেখে যাবে না।
কেন রেখে যাবে না!
নবনীতা বলবে কী বলবে না করেও বলে ফেলল, ধরা পড়ে গেছি।
আমরা তো কিছু করিনি। তুমিই বল। আমরা কিছু করেছি।
আজকালকার মায়েরা ও সব বিশ্বাস করতে চায় না। আমরা তো এ বয়সে কত কিছু জেনে ফেলেছি।
যাকগে যাবে কী যাবে না তুমি বুঝবে। তারপরই দুম করে বলল, আমি গেলে কাকিমা মনে কিছু করতে পারে।
মাকে বলেছি।
তুমি জানলে কী করে আমি যাব।
বা রে আমি যাব, তুমি যাবে না সে কী করে হয়। তাই বললাম, নানুদা যাবে বলেছে।
তোমার মা কী বলল!
বলল, এই মানে!
ঠিক করে বল। মানে ফানে বুঝি না।
বলল, ওর মাথার ঠিক নেই। সঙ্গে নিবি, সামলাতে পারবি তো।
নানু কেমন কাতর গলায় বলল, সত্যি নবনীতা আমার মাথার ঠিক নেই। কী করতে কী করে বসব আমি নিজেও আগে থেকে বুঝতে পারি না। তুমিই বরং ঘুরে এসো। বলে নানু ফোন নামিয়ে রাখল।
তারপর সে কিছুক্ষণ ফোনের পাশে গুম হয়ে বসে থাকল। তার মধ্যে মাথা খারাপের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে—কিন্তু সে বুঝতে পারে আসলে যদি একজনও সুস্থ মানুষ থাকে, তবে সে। কারণ সে যখনই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় অথবা কখনও বাসে কিংবা কোনো গাছের নিচে যখন দাঁড়িয়ে থাকে তখন মনে হয় রাস্তার ফুটপাথে বড়ই দুঃখী মানুষের ভিড়। লীলার কথা তার মনে হল। কিছু একটা করার মতো হাতের কাছে কাজ পেয়ে সে মুহূর্তে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল।
সে উঠে আবার সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। সে ভেবে ফেলেছে পড়াশোনা আর তার হবে না। মাথার মধ্যে নানা রকম চিন্তা ভাবনা—এবং সংসারে বড় হতে হতে সে যা দেখল, খুব কম মানুষের জীবনেই বোধ হয় এত কম বয়সে এমন বোধোদয় ঘটে। আজই যা সে দেখে এল, তাতে মনে হয়েছে মানুষের জীবন শেষ পর্যন্ত যদি তার জেঠু অবনীশের মতো হয়ে যায়, অথবা বাবার মতো হয়ে যায় কিংবা দাদুর মতো—তা হলে জীবনযাপনের মহিমা কোথায়। সংসারে সে নিজেকে বড়ই অসহায় বোধ করল। মানুষ এমন অসহায় বোধ করলেই বুঝি শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার ঝুঁকি নেয়। যদি তাই হয়, তবে জেঠুর তো বেঁচে থাকার কথা না। এমন একটা নিষ্ঠুর মেয়েমানুষ নিয়ে জেঠু কোন প্রবল প্রাণশক্তির জোরে এখনও বেঁচে আছে, ভাবতেই তার বিস্ময় লাগল।
আর তখনই নানু দেখতে পেল, কুটু, সেই ছোট্ট মেয়ে বব করা চুল, দু চোখ পৃথিবী সম্পর্কে অপার বিস্ময় নিয়ে জেগে আছে। কুটুর কত রকমের প্রশ্ন, বাঘ কেন মানুষ খায়, ভিখিরি ভিক্ষা চায় কেন, পাখিরা উড়ে কোথায় যায়, আকাশের তারারা দিনের বেলায় কোথায় থাকে, চাঁদের বুড়ি সুতো কাটে কেন এবং শেষ প্রশ্ন তার বোধ এমন সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মানুষ চলেই বা যায় কেন। এগুলো খুবই জটিল প্রশ্ন। সহজে তার পক্ষে উত্তর দেওয়া সম্ভব না। বিকেল বেলাটা কুটু এমন অজস্র প্রশ্ন করেছে তাকে। এই কুটুই সংসারে বেঁচে থাকার মতো একমাত্র জেঠুর শেষ অবলম্বন। আত্মহত্যার আগে কুটুর মতো বাবা যদি তার কথা ভেবেও অন্তত আর কিছুদিন বেঁচে থাকত—অন্তত মার শেষ বয়স পর্যন্ত, তাহলে কোনো অঘটনই ঘটত না।
সেই যেদিন বাসায় ঢুকে দেখল, মেসো অসময়ে বসে আছে বাড়িতে, মার সঙ্গে হৈ—হল্লা করছে, মা পিঠে পায়েস করছে, যেন উৎসব বাড়িতে—সেদিন সে স্কুলের বইপত্র ফেলে সোজা বাইরে ছুটে চলে গেছিল—ভিতরে কীসের যে হাহাকার—সেই থেকে পড়াশোনায় সে মন বসাতে পারত না। কোনোরকমে সে ক্লাসের পর ক্লাস পার হয়ে গেছে, এই পর্যন্ত। পালাবে পালাবে করে তার কত বছর কেটে গেল! আজ আবার মনে হচ্ছে, সব ছেড়ে ছুড়ে পালালে কেমন হয়। তখনই দেখল সেই লীলার মুখ ছল ছল করছে। সে বুঝতে পারছে—জীবনের কোথাও দু’জনের মধ্যে একটা ভারি মিল রয়ে গেছে।