মানুষের ধাঁচা : এক পলকের অস্তিত্ব
আমি এক হাড় মাংসের ধাঁচা, এক টুকরো মাংসের লোথড়া—তবে এর মধ্যে লুকিয়ে আছে হাজারো অনুভূতি, শত রঙের মিশ্রণ। রাগ, অভিমান, কাম, ক্রোধ, মোহ, মায়া, দুঃখ, কষ্ট, প্রেম, ভালোবাসা, আনন্দ, উত্তেজনা—এসব মিলিয়েই গড়ে ওঠে মানুষের অস্তিত্ব। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই অনুভূতিগুলো মানুষকে বয়ে নিয়ে চলে, তাকে সংজ্ঞা দেয়, তাকে মানুষ করে তোলে। কিন্তু এটাই কি চূড়ান্ত সত্য?
জীবনের প্রতিটি দিন মানুষ ছুটে চলে—পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, নিজের স্বপ্নের জন্য। কখনো সে হাসে, কখনো কাঁদে, কখনো ভালোবাসে, কখনো কাউকে আঘাতও দেয়। কিন্তু সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। একদিন যখন শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে, শ্বাস থেমে যায়, চোখের দৃষ্টি নিভে যায়, তখন সেই সব অনুভূতি কোথায় হারিয়ে যায়? যে মানুষ এতদিন পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, বন্ধুদের ভালোবাসার আধার ছিল, সমাজে নিজের একটি অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল, সে এক নিমিষেই কেবল একটি নিথর শরীরে পরিণত হয়।
তারপর? তারপর শ্মশানের আগুন তাকে গ্রাস করে, অথবা মাটির গভীরে সে মিশে যায়। যাকে একদিন আদর করে স্পর্শ করা হতো, যার স্পর্শে অন্যেরা সান্ত্বনা খুঁজত, সে-ই একসময় ধুলোয় পরিণত হয়। আগুন নিভে গেলে থেকে যায় একরাশ ছাই, কয়েক খণ্ড হাড়। এই হাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে কি মনে হয় না—এগুলো একদিন প্রাণবন্ত ছিল? একসময় এদের মধ্যেও হৃদস্পন্দন ছিল, স্বপ্ন ছিল, ভালোবাসা ছিল?
এই হাড়ও একদিন কারও চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছে, কারও হাত ধরে পথ চলেছে, কারও বুকের গভীরে আশ্রয় দিয়েছে। অথচ এখন? কেবল ধুলো হয়ে বাতাসে উড়ে বেড়ায়, হয়তো বৃষ্টির ফোঁটায় গলে মাটির সাথে মিশে যায়।
তবু মানুষের অস্তিত্ব কি পুরোপুরি মুছে যায়? না, যতদিন তার ভালোবাসার মানুষরা তাকে মনে রাখে, যতদিন তার স্পর্শের স্মৃতি বয়ে বেড়ায় কেউ, সে ততদিন বেঁচে থাকে। কিন্তু সময়ের প্রবাহে একদিন তার নামটুকুও হারিয়ে যায়, স্মৃতির আকাশ থেকে মুছে যায় তার অস্তিত্ব।
তবু, যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ আমাদের অনুভূতি, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখাই জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য। কারণ একদিন, আমরাও ধুলো হয়ে যাবো, কিন্তু আমাদের ভালোবাসা, আমাদের কর্ম—সেগুলোই থেকে যাবে অন্য কারও হৃদয়ে।