Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

০৭. আবার দুঃস্বপ্ন

দেশে এসেছি।

আমাদের শোকাচ্ছন্ন পরিবারের দুঃখ-দুর্ভাগ্যের কথা নিয়ে এখানে আলোচনা করে আমার আসল বক্তব্যকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। দুনিয়ার এমন কে মানুষ আছে, শোক-দুঃখের আস্বাদ যে পায়নি? এক্ষেত্রে মানুষ মাত্রই ভুক্তভোগী। সুতরাং আমার একান্ত সাধারণ অশ্রুজলের কাহিনি এবং প্রিয়বিয়োগকাতর আত্মীয়স্বজনের হা-হুতাশের ইতিহাস বর্ণনা করলেও আপনি অনায়াসেই অনুভব করতে পারবেন।

একে দীর্ঘকালব্যাপী রোগশয্যা থেকে উঠেই ভগ্নদেহে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি, তার ওপরে বাড়ির ভেতরকার এই বুকচাপা আবহ;—প্রাণ-মন যেন শ্রান্ত হয়ে পড়ল। ছোটো ভাইকে আমি যে ভালোবাসতুম না, তা নয়; অশোক ছিল আমার আত্মার মতন প্রিয়। কিন্তু যতই কাঁদি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি, সে আর ফিরবে না। নিয়তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লাভ নেই।

শোকের চেয়ে আমার মনে প্রবল হয়ে উঠেছিল প্রতিহিংসার ভাব। অতটুকু নিষ্পাপ অবোধ শিশু—পৃথিবীতে ছিল যে স্বর্গের প্রতিনিধির মতো, কোন পাষণ্ড তাকে অকারণে হত্যা করলে? এ যেন কেবল হত্যার আনন্দ উপভোগ করবার জন্যেই হত্যা করা এত বড়ো নরাধম যে এখনও ধরা পড়ল না, সে যে এখনও সমাজে-সংসারে সাধুর মুখোশ পরে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে, এই ভেবেই আমার আক্রোশ ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠতে লাগল।

দিনরাত কেবল ওই কথাই ভাবি। শিশু-রক্তে হাত রাঙা করে কোথায় সে লুকিয়ে আছে? কে তার সন্ধান দেবে? কোন কৌশলে তাকে ধরা যায়?

ভগ্ন দেহের দুঃখ, বাবার ও মমতার শোক-অধীর মুখ, হত্যাকারীর বিরুদ্ধে অশান্ত জল্পনা-কল্পনা ক্রমেই আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠতে লাগল। তাই একদিন মনকে একটু ছুটি দেওয়ার জন্যে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়লুম।

পশ্চিমের যে ছোটো শহরটিতে আমার বাড়ি, তার সীমানা পার হলেই দেখা যায় চারদিকে পাহাড়, ঝরনা, বন, মাঠ আর নদী। প্রকৃতিকে চিরদিন আমি ভালোবাসি, তার কোলে গিয়ে দাঁড়ালে কেবল সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য নয়, লাভ করি সান্ত্বনার আশীর্বাদও।

ভুট্টাখেতের পর ভুট্টাখেত—সেখানে দিকে দিকে বসেছে পাখিদের ভোজসভা। সুদূরের নীল অরণ্যের এপারে পড়ে রয়েছে অসমোচ্চ প্রান্তর এবং তারই ভেতর দিয়ে একেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির রৌপ্য-ধমনির মতন একটি ছোট্ট নদী।

সামনেই একটি পাহাড়। তারই পদতলে চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলুম, আজকের বিদায় লগ্নে পশ্চিম আকাশের পটে রঙিন ছবি আঁকবার জন্যে সূর্য কোন কোন রঙের ডালা নিয়ে বসেছে।

কিন্তু আর একদিকে চোখ ফিরিয়ে দেখলুম, সূর্যের চিত্রলেখা মুছে দেওয়ার জন্যে দ্রুত ধেয়ে আসছে মস্ত একখানা কালো মেঘ। দেখতে দেখতে বজ্র-বাজনা বাজাতে বাজাতে সেই বিদ্যুভরা মেঘখানা প্রায় সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ল ব্লটিং কাগজের ওপরে ওলটানো দোয়াতের কালির মতো।

বহুদূর থেকে আগতপ্রায় ঝটিকার চিৎকার শুনতে পেলুম। তারপর হয়তো বৃষ্টিও আসবে।

এখানকার সমস্তই আমার নখদর্পণে। বাল্যকালে এই মাঠে, নদীর ধারে ও পাহাড়ের বুকে কত খেলাই করেছি। শ-দেড়েক ফুট ওপরে পাহাড়ের এক জায়গায় একটি গুহা আছে তাও আমি ভুলিনি। আসন্ন ঝড়-বৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যে সেই গুহার উদ্দেশ্যে পাহাড়ের ওপরে উঠতে লাগলুম।

শুকনো ধুলো-পাতা-বালি উড়িয়ে, বড়ো বড়ো গাছগুলোকে দুলিয়ে হু হু শ্বাসে ঝড় এসে পড়ল-কিন্তু তখন আমি গুহার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।

আচম্বিতে অন্ধকার ভেদ করে আমার চোখ দেখতে পেলে, গুহার মুখেই রাত্রির মতন কালো কী একটা ছায়া। চমকে উঠলুম। ভালো করে দেখবার চেষ্টা করলুম।

অকস্মাৎ মুহূর্তের জন্যে সারা আকাশে যেন আগুন ধরিয়ে দপ করে জ্বলে উঠল তীব্র এক বিদ্যুৎ শিখা।…আর কোনও সন্দেহ রইল না। ক্ষণিক আলোকেই সেই অসম্ভব দীর্ঘ ও বিরাট ও বীভৎস মূর্তিকে চিনতে পারলুম আমি অনায়াসেই। এ আর কেউ নয়— আমারই হাতে গড়া দানব!

আবার বিদ্যুৎ চমকাল। দেখলুম, দৈত্যটা আশ্চর্য এক লাফ মেরে প্রায় দশ-বারো ফুট উঁচু একখানা পাথরের ওপাশে গিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপরেই ঝড়ের হুংকার ড়ুবিয়ে কানে এল হা-হা-হা-হা করে বিকট এক অট্টহাস্য। কী সেই অট্টাহাস্য—পৃথিবীর সমস্ত নৃশংসতার আনন্দ যেন তার মধ্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।

ঝড় বইছে, বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু আমার পা দুটো যেন পাথরের মধ্যে প্রোথিত হয়ে গেল। প্রকৃতির দুর্যোগ অনুভব করতেও পারলুম না—আমার দেহ ও হৃদয় স্তম্ভিত!

বিদ্যুতের আলোক কেবল সেই ঘৃণ্য দানবকেই প্রকাশ করলে না—সেই সঙ্গে ফুটিয়ে তুললে আর এক ভীষণ সত্যকে।

এই দানবই অশোকের হত্যাকারী!

হ্যা, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না। প্রথমত যে-কোনও নির্দয় মানুষের পক্ষেও বিনা কারণে অমন কচি শিশুকে হত্যা করা অসম্ভব। এ হচ্ছে অমানুষিক পাপ। দ্বিতীয়ত, কোথায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, আর কোথায় আমাদের এই ছোট্ট নগর। দুনিয়ার এত দেশ থাকতে দানবটা কেনই বা এখানে এসে হাজির হয়েছে আর কেনই বা এখানে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে? তৃতীয়ত, আমাকে দেখে অমন বিদ্রুপের হাসি হাসতে হাসতে সে পালিয়ে গেল কেন?

নিশ্চয়, নিশ্চয়! অশোকের হত্যাকারী হচ্ছে এই দানব নিশ্চয়।

একবার ভাবলুম, পিশাচের পিছনে পিছনে ছুটে যাই। তারপরেই বুঝলুম, সে হবে একেবারেই ব্যর্থ চেষ্টা। যে সৃষ্টিছাড়া জীব দশ-বারো ফুট উঁচু পাথর এক লাফে অনায়াসে টপকে যেতে পারে, তাকে ধরবার শক্তি কোনও সাধারণ মানুষেরই নেই। আর তার দেহ গড়েছি আমি স্বহস্তেই। তাকে যে কতখানি আসুরিক ক্ষমতার অধিকারী করেছি, একথা আমার চেয়ে ভালো করে আর কেউ জানে না। আমি তার সৃষ্টিকর্তা কিন্তু দৈহিক প্রতিযোগিতায় আমি হব তার হাতে খেলার পুতুল মাত্র। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নিজে শয়তানকে সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনিই কি শয়তানকে দমন করতে পেরেছেন?

নোগশয্যা ত্যাগ করবার পর আজ পর্যন্ত আমি যে শরীরী-দুঃস্বপ্নকে ভুলে ছিলুম, আবার সে আমাকে নতুন করে দ্বিগুণ বিক্রমে আক্রমণ করলে। একে একে আবার মনে পড়তে লাগল আমার সৃষ্টির আগেকার কল্পনা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার ও সাধনার কথা; মূর্তিমান প্রেতের মতো গভীর রাত্রে গোরস্থানে গিয়ে রোমাঞ্চকর উপাদান সংগ্রহের কথা; তারপর সৃষ্টির নামে সেই কিম্ভুতকিমাকার অনাসৃষ্টির কথা; তারপর আমার সুখস্বর্গ থেকে যন্ত্রণার নরকে পতন-কাহিনি।

হায়রে আমার কপাল, নিজের হাতে সাক্ষাৎ অভিশাপের ও সর্বনাশের জীবন্ত মূর্তি গড়ে আজ আমি মানুষের শান্তির তপোবনে ছেড়ে দিয়েছি!

দানব আমার ভাইকে হত্যা করেছে। কিন্তু এই বি এর প্রথম হত্যা? আমার অজ্ঞাতসারে এ কি আরও কতবার মানুষের রক্তে স্নান করেনি?

ঝড় বিদায় নিয়েছে। জলভরা মেঘ অদৃশ্য হয়েছে। পরিষ্কার আকাশে চাঁদ উঠেছে। কিন্তু সেই আলো ঝলমল বিশ্বে আমার চোখ অন্ধ।

নানারকম দুর্ভাবনা ভাবতে ভাবতে আবার বাড়িতে ফিরে এলুম। কী কষ্টে বিছানায় ছটফট করতে করতে সে রাত্রি কাটল, ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব।

প্রভাত হল—নবসূর্যের আনন্দ ধারা নিয়ে। কিন্তু আমার পক্ষে কী-বা রাত, কী-বা দিন। আমার প্রাণপাত্র কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে রইল নিরাশার বিষে। আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি আছে কার?

নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলুম বারংবার। মনে হল, ভাইয়ের রক্তে—নির্দোষ শিশুর রক্তে হাত আমার রাঙা হয়ে উঠেছে! আমারই হাতে তৈরি সাংঘাতিক রাক্ষস, আমি যদি পাগলামির খেয়ালে তার কুগঠিত মূর্তির মধ্যে জীবনদান না করতুম, তাহলে অশোক তো আজও হালকা বাতাসে উড়ন্ত সুন্দর প্রজাপতির মতন খেলা করে বেড়াত। পিঞ্জরের দ্বার খুলে রক্তলোভী হিংস্র পশুকে যে বাইরে ছেড়ে দেয়, যত কিছু হানাহানির জন্যে দায়ী তো সে নিজেই। অনুতাপে বুক যেন জ্বলে-পুড়ে যেতে লাগল।

পুলিশ চারদিকে তন্নতন্ন করে খুনিকে খুঁজছে, বাবা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করবার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, আমি কিন্তু জেনে শুনেও আসল হত্যাকারীর কথা প্রকাশ করতে পারছি না। আমার এ যেন বোবার স্বপ্ন, প্রকাশ করবার কোনও উপায়ই নেই।

প্রকাশ করলে কে আমার কথা বিশ্বাস করবে? যদি বলি, আমি জড়পিণ্ডকে জীবন্ত করবার উপায় আবিষ্কার করেছি এবং অশোকের হত্যাকারী হচ্ছে আমারই সৃষ্ট এক অতিকায় দানব, তবে কে আমার কথা বিশ্বাস করবে? সকলে—এমনকি বাবাও ভাববেন, আমার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। শেষটা হয়তো আমাকে বাস করতে হবে পাগলা গারদে। এত দুর্ভাগ্যের পর গারদে বাস করবার সাধ আমার হল না।

আমার স্বাস্থ্য আবার ভেঙে গেল। পাছে আবার কোনও মারাত্মক পীড়ায় আক্রান্ত হই, সেই ভয়ে বাবা কাতর হয়ে পড়লেন।

আমাকে বললেন, অজয়, তোমার বায়ু পরিবর্তন করা উচিত। বিন্ধ্য পর্বতে আমার যে বাংলো আছে, কিছুদিন তুমি সেইখানে গিয়ে বাস করো। আপাতত আমার বাড়ি তোমার মন আর স্বাস্থ্যের অনুকূল নয়।

প্রণব ও মমতাও সেই মত প্রকাশ করলে। আমিও আপত্তি করলুম না–কারণ এখানে থাকলে আমার সেই দুষ্টগ্রহের সঙ্গে আবার দেখা হতে পারে, হয়তো সে শিকারি বাঘের মতন লুকিয়ে সর্বদাই আমার ওপরে পাহারা দিচ্ছে—আবার কোনও ধারণাতীত দুর্ভাগ্যের আয়োজন করবার জন্যে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *