মাথা খাটানোর মুশকিল
কাঁধের উপর একটা না থাকলে নেহাত খারাপ দেখায়, এইজন্যই বিধাতার আমাকে ওটা দেওয়া! মাথা কেবল শোভার জন্য, ব্যবহারের জন্য নয়; যখনই কোনো ব্যাপারে ওকে খাটাতে গেছি তখনি এর প্রমাণ আমি পেয়েছি। একবার মাথা খাটাতে গিয়ে যা বিপদে পড়েছিলাম তার কাহিনি স্বর্ণাক্ষরে আমার জীবনস্মৃতিতে লেখা থাকবে।
ক্রমশ যতই দিন যাচ্ছে, আরও যত প্রমাণ পাচ্ছি, ততই আমার ওই ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে। সেই কান্ডর পর থেকে আমার মাথাকে আমি অলংকারের মতোই মনে করি। সর্বদা সঙ্গে রাখি, (না রেখে উপায় কী!) কিন্তু কাজে আর ওকে লাগাই না।
গোবিন্দর জন্যই যত কান্ড! গোবিন্দ আমার বন্ধু, তার উপকার করতে গিয়েই—! তারপর থেকে আমি বুঝতে পেরেছি কারও উপকার করতে যাওয়া কিছু না। একটা পোকারও উপকার করবার মতো বুদ্ধি আমার ঘটে নেই।
গোবিন্দ কিছুদিন থেকে হঠাৎ ম্রিয়মাণ হয়ে উঠেছে। কারণ আন্দাজ করা কঠিন। রোজ বিকেলে বালিগঞ্জে লেকের ধারে বেড়াতে যায়, অনেক রাত্রি পর্যন্ত সেখানে মশাদের সঙ্গে পায়চারি করে। রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে মশা-কামড়ানো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ‘জাম্বক’ ঘসে। তারপর শুতে যায়।
এইরকমই প্রত্যহ ঘটছে। মশারাও যেন ওকে চিনতে পেরেছে, আর-সবাইকে ছেড়ে দিয়ে যেন ওর জন্যই সবাই ওত পেতে থাকে। দাঁতের অবস্থা ধারালো রাখার জন্য অনেক বনেদি বায়ুসেবীকে ওরা পরিত্যাগ করেছে, এমনি গোবিন্দর ওপর ওদের টান। গোবিন্দও দিন দিন বেশি আহত হয়ে বাড়ি ফিরছে।
কিন্তু গোবিন্দর লেকে বেড়ানোর কামাই নেই। বিকেল হয়েছে কী, ওকে দড়ি দিয়েও বেঁধে রাখা যাবে না। হল কী গোবিন্দর? কবিটবি হয়ে উঠল না তো হঠাৎ? কিংবা—?
একদিন আমিও ওর সঙ্গে বেড়াতে গেলাম।
—‘ব্যাপার কী হে গোবিন্দ?’
কিছুতেই কিছু বলে না, অনেক সাধাসাধির পর, একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোককে দেখিয়ে দেয়।—‘উনিই!’
‘উনিই তো বুঝলাম। কিন্তু কী হয়েছে ওঁর?’ কৌতূহলী হয়ে আমি প্রশ্ন করি।
অনেক কষ্টে গোবিন্দর কাছ থেকে যা আদায় করা যায় তার মর্ম হচ্ছে এই যে ভদ্রলোক কোনো এক নামজাদা আপিসের বড়োবাবু, একটা চাকরির জন্য গোবিন্দ অনেক দিন ওঁর পেছনে ঘোরাঘুরি করছে, কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। অনেক মোটা মোটা চাকরি আছে ওঁর হাতে, ইচ্ছা করলেই উনি দিতে পারেন।
‘ওঃ, এই কথা! একটা চাকরি? তা আমাকে বলনি কেন অ্যাদ্দিন? আমিই ব্যবস্থা করে দিতাম—ওঁর কাছ থেকেই।’
‘বল কী!’ গোবিন্দ অবাক হয়ে তাকায়, ‘ওঁর কাছ থেকেই আদায় করতে? ভারি শক্ত লোক।’
‘হোক না শক্ত লোক! সব কিছুরই কায়দা আছে! মাথা খাটাতে হয় হে, মাথা? বুঝেছ?’
গোবিন্দ তেমন উৎসাহ পায় না।
‘ও তো এক্ষুনি হয়ে যায়, এককথায়! তেমন কী কঠিন! ভদ্রলোক কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে লক্ষ করো—’ গোবিন্দকে প্ররোচিত করি, ‘দেখেচ একেবারে জলের ধারে। আমি করব কী, পেছন থেকে গিয়ে হঠাৎ যেন পা ফসকে ওঁর ঘাড়ে গিয়ে পড়েছি এমনিভাবে এক ধাক্কা লাগাব, তাহলেই উনি লেকের মধ্যে কুপোকাত হবেন। তুমি তখন গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওঁকে জল থেকে উদ্ধার করবে। তাহলেই তো চাকরির পথ একদম পরিষ্কার।’
‘কীরকম?’ গোবিন্দ তবুও বুঝতে পারে না, ‘চাকরির পথ, না জেলের পথ?’
‘তুমি নেহাত আহাম্মক! এই জন্যেই তোমার কিছু হয় না। জীবনদাতাকে লোকে চাকরি দেয় না জেলে দেয়?’
‘ওঃ এইবার বুঝেছি। তা বেশ, কিন্তু খুব বেশি গভীর জলে ফেলো না যেন।’
‘না, না, ধারে আর এমনকী বেশি জল হবে!’
কিন্তু ধারে বেশ গভীর জলই ছিল। ভদ্রলোককে ফেলে দেবার পর তখনও দেখি গোবিন্দ ইতস্তত করছে। এই রে, মাটি করলে! দামি দামি সব মুহূর্ত অমনি অমনি ফসকে যায়। অগত্যা আবার মাথা খাটাতে হয়—গোবিন্দকেও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই।
তারপর যা দৃশ্য উদঘাটিত হয় তাতে তো আমার চক্ষুস্থির! দেখি, ভদ্রলোক দিব্যি সাঁতার কাটছেন আর গোবিন্দ খাচ্ছে হাবুডুবু। বন্ধুকে তো বঁাচানো দরকার, আমিও ঝাঁপ দিই। জলের মধ্যে তুমুল কান্ড! গোবিন্দ আমাকে জড়িয়ে ধরে, কিছুতেই ছাড়তে চায় না। আমি ওকে ছাড়তে চাই, কিন্তু পেরে উঠি না।
অবশেষে ভদ্রলোক এসে আমাদের দুজনকেই উদ্ধার করেন, সলিলসমাধি থেকে।
আমি গোবিন্দর উপর দারুণ চটে যাই। গোবিন্দও আমার দিকে রোষকষায়িত নেত্রে চেয়ে থাকে।
ভদ্রলোক চলে যাবার পর আমাদের আলোচনা সুরু হয়—
‘আমাকে ধাক্কা দিতে গেলে কেন? আমাকে জলে ফেলবার কথা ছিল না তো!’ গোবিন্দ ভারি রেগে যায়।
‘বা:, জলে না পড়লে জগদীশবাবুকে উদ্ধার করতে কী করে তুমি?’ আমিও তেতে উঠি।
‘আমিই কি ওঁকে উদ্ধার করলাম? না, উনিই করলেন আমাদের?’
‘তুমি ওঁকে করতে দিলে—তার আমি কী করব?’ আমি ওকে বোঝাতে চাই, ‘এরকমটা হবে আমার আইডিয়াই ছিল না।’
এতক্ষণে গোবিন্দ একটু নরম হয়—‘আমি সাঁতার জানি না যে।’
এরপর বিরক্ত হয়ে আমি পুরী চলে এলাম। যা নাকানি-চোবানিটা লেকে হল। ওরকম জল পরিবর্তনের পর বায়ু পরিবর্তন দরকার।
গোবিন্দও এল আমার সঙ্গে।
সমুদ্রের ধারে বালির ওপর বেড়াতে বেড়াতে একদিন অকস্মাৎ গোবিন্দ অঙ্গুলিনির্দেশ করে—‘ওই ওই!’ সঙ্গে সঙ্গে সেলাফিয়ে উঠে।
‘কি? তিমি মাছ নাকি?’
‘উঁহু, অত দূরে নয়। ওই যে সেই ভদ্রলোক, জগদীশবাবু।’
‘তাইতো বটে! তিনিও তাহলে হাওয়া খেতে এসেছেন।’
‘চাকরিটা ফসকাল! কেবল তোমার জন্যই!’ গোবিন্দ মুমূর্ষু হয়ে পড়ে—‘লেগে থাকলে হত একদিন। কিন্তু যা জলে চুবিয়েছ ভদ্রলোককে—’
আমি চুপ করে থাকি। কী আর বলব?
পরদিন বিকালে সমুদ্রের ধার দিয়ে পোস্ট অফিসের দিকে যাচ্ছি। আবার দেখি সেই ভদ্রলোক। ভদ্রলোক এবং তাঁর সঙ্গে একটা বাচ্চা—মোটা এবং বিশ্রী। মাঝে মাঝে এমন কতিপয় শিশু দেখা যায় যাদের কোলে করতে বললে কোলা ব্যাঙের কথাই মনে পড়ে—এটি তাদের একজন।
বাচ্চাটা বালি দিয়ে বঁাধ তৈরির চেষ্টা করছিল এবং ভদ্রলোক জগদীশবাবু ওকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। শেষটা জগদীশবাবুকেও দেখা গেল ওর সঙ্গে লেগে যেতে। দুজনে মিলে বঁাধ-রচনা যখন সমাপ্ত হল তখন জগদীশবাবু ঘেমেনেয়ে উঠেছেন।
বাচ্চাটা কেন জানি না হঠাৎ যেন খেপে যায়। গোঁ গোঁ করে বঁাধের ওপর পদাঘাত করতে থাকে। অল্পক্ষণেই বঁাধটাকে ধরাশায়ী করে আনে। জীবনের সাধনা সফল হবার পর অনেকেরই এমন দশা হয়, সেই ফল পন্ড করতে সেলাগে তখন।
জগদীশবাবু পকেট থেকে বিস্কুট বার করে ওকে দেন। তারপরে সেঠাণ্ডা হয়।
এই পর্যন্ত দেখে আমি পোস্ট অফিসে চলে গেছি। যখন ফিরলাম তখন বেলা আরও পড়ে এসেছে। ভগ্ন বঁাধের ধারে একাকী সেই ছেলেটি—কিন্তু জগদীশবাবুর চিহ্নমাত্র নেই কোথাও।
তখনই আমার মাথায় বুদ্ধি খেলতে লাগে। এই তো বেশ হয়েছে, এবার গোবিন্দর চাকরির ব্যবস্থা না হয়ে আর যায় না।
ভাবলাম, এই ফাঁকে এই দেড় মন শিশুকে নিয়ে সরে পড়লে কেমন হয়! জগদীশবাবু নিশ্চয়ই তাঁর ছেলেকে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে উঠবেন, ছেলের ওপর তাঁর যেরকম টান দেখা গেল আজ বিকেলে। সেই সময়ে গোবিন্দ ওকে হাতে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজির হবে এবং একটা গল্প বানিয়ে বলে দেবে। ছেলেটা সমুদ্রেই জলাঞ্জলি গেছল কিংবা পুরীর লোকারণ্যে হারিয়ে পথে পথে হায় হায় করে বেড়াচ্ছিল, এমন সময়ে গোবিন্দ ওকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। তাহলেও কি জগদীশবাবুর হৃদয় গলবে না? হারানো ছেলে ফিরে পেলে তো মানুষের আনন্দই হয় (তবে এ যা ছেলে এই একটা কথা!), তখন কৃতজ্ঞতার আতিশয্যে, বালিগঞ্জের জলে-পড়ার কথা ভুলে গিয়ে, গোবিন্দকে একটা চাকরি দিয়ে ফেলতে তাঁর কতক্ষণ?
ছেলেটিকে আত্মসাৎ করে যখন ফিরলাম তখন গোবিন্দ বাংলোর বারান্দায় চেয়ার টেনে নিয়ে চুপটি করে বসে আছে। মুহ্যমানের মতো! চাকরি আর জগদীশের কথাই ধ্যান করছে বোধ হয়।
আস্তে আস্তে আইডিয়াটা ওর কাছে ব্যক্ত করি। সমস্ত বুঝে উঠতে ওর দেরি লাগে। ও ওই রকম! মাথা বলে কিছু যদি থাকে ওর!
প্রথম যখন ছেলেটাকে নিয়ে আমি ঢুকলাম, আমি আশা করেছিলাম, আনন্দে ও, মুখ খুললে বোতলের সোডা যেরকম হয়, সেইরকম উথলে উঠবে—কিন্তু ও হরি! একেবারেই সেরকম নয়। জগদীশবাবুর ছেলে শুনে আরও যেন সেদমে গেল। তবে কি ওর ধারণা, অন্য কারও ছেলেকে ফিরে পেলে জগদীশবাবু আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাবেন? আর চাকরি দিয়ে ফেলবেন সেইজন্যই?
ইতোমধ্যে ছেলেটাও চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।
গোবিন্দ কিছুক্ষণ কান দিয়ে সেই তারস্বর শোনে, তারপর তার অসহ্য হয়ে ওঠে। ‘থামো থামো!’ ছেলেটাকে সেতাড়না করে, ‘তুমি কি ভেবেছ দুনিয়ায় তুমি ছাড়া আর কারু কোনো দুঃখ নেই?…এসব কী ব্যাপার, সমীর?’
আমি আর কী বলব? ছেলেটিই এর জবাব দেয়—কান্নার ধমক দ্বিগুণ উচ্চ করে। লোকের উপকার করা সহজসাধ্য নয়, এ আমি জানি,—করতে যাবার পথেই কত বাধা, কত হাঙ্গাম। কিন্তু এ ছাড়া আর পথ কী? উপকার করবার কি উপায় ছিল?
দোকান থেকে বিস্কুট এনে দিলে তবে ছেলেটা চুপ করে। আবহাওয়া ঠাণ্ডা হলে পর, গোবিন্দ আগাগোড়া আবার সমস্ত প্ল্যানটা ভাবে। ক্রমশ ওর মাথা খুলতে থাকে। মুখে হাসি দেখা দেয়। আইডিয়াটা ওর মাথায় ঢোকে।
‘বাস্তবিক সমীর, যত বোকা তোমায় দেখায়, তত বোকা নও তুমি! তোমার এবারের প্যাঁচটা যে ভালো হয়েছে একথা আমি মানতে বাধ্য।’
রেঞ্জার্সের লটারি জিতলে যত-না খুশি হতাম গোবিন্দর সার্টিফিকেট আমাকে ততখানি পুলকিত করে। যাক, এতদিনে তাহলে গোবিন্দ বেচারার সত্যিই একটা হিল্লে করতে পারলাম।
ছেলেটিকে হস্তগত করে গোবিন্দ ও আমি এবার বেরিয়ে পড়ি—জগদীশবাবুর অনুসন্ধানে।
ছেলেটা দু-পা হাঁটে আর কাঁদতে শুরু করে। তৎক্ষণাৎ ওকে খাদ্য জোগাতে হয়। মুখের দুটি মাত্র ব্যবহার ওর জানা, খাওয়া এবং কাঁদা—একটা স্থগিত হলেই আরেকটার আরম্ভ। বিস্কুট, লজেঞ্চুস, চকোলেট, টফি পালাক্রমে আমি জুগিয়ে চলি। এইভাবেই চালাতে হবে জগদীশবাবু পর্যন্ত।
কিন্তু জগদীশবাবুকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সমস্ত সমুদ্রের ধার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখা হয়, কিন্তু জগদীশবাবুর পাত্তা নেই। আচ্ছা ভদ্রলোক তো? ছেলে হারিয়ে নিশ্চিন্ত মনে আছেন তো বেশ!
গোবিন্দ বলে, ‘থানায় খবর দিতে গেছেন বোধ হয়।’
আমি ভ্রূকুঞ্চিত করি।
ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠে ও। ‘এবার দেখছি জেলেই যেতে হল তোমার জন্য। ছেলে চুরির দায়ে। ছেলে চুরি করলে ক-মাস হয় তোমার জানা আছে?’
আমি চুপ করে থাকি।
‘ক-মাস কি ক-বছর কে জানে!’ গোবিন্দ এবার ভারি রেগে ওঠে; ‘তোমার যেরকম আক্কেল! আমি কিন্তু এ-ব্যাপারে নেই বাপু! তুমি চুরি করেছ, জেল খাটতে হয় তুমিই খাটবে। ছ-বচ্ছরের কম নয়। আমি বেশ জানি!’
ছেলেটার হাত ছেড়ে দেয় গোবিন্দ, এবার আমাকেই সেজড়িয়ে ধরে। ওর কথায় আমি দারুণ অস্বস্তি বোধ করি। না:, এতটাই কি হবে? একেবারে থানায় যাবেন ভদ্রলোক? আর গেলেই কি পুলিশের ঘটে এক বিন্দু বুদ্ধি নেই? আমরা তো খুঁজে পেয়েই একে ফিরিয়ে দিতে নিয়ে যাচ্ছি। চাকরি না দেয় নাই দেবে, কিন্তু তা বলে জেল? না: ছেলের উদ্ধারকর্তার উপর কোনো ভদ্রলোকই কখনো অত নিষ্ঠুর হতে পারে না।
সমুদ্রের ধারে একজনের কাছে খবর পাই স্বর্গদ্বারের কোথায় যেন থাকেন কে এক জগদীশবাবু। স্বর্গদ্বারেই ছুটতে হয়। আমি তখন মরিয়া হয়ে উঠেচি—কিন্তু গোবিন্দ অদ্ভুত! তার জন্যই এত কান্ড আর সেনিতান্ত অনাসক্তের মতোই আমাদের সঙ্গে চলেছে। আমাদের চেনেই না যেন।
অতিকষ্টে জগদীশবাবুর আস্তানা মেলে। প্রবল কড়া নাড়ার পর উনি নেমে আসেন। আলো হাতে নিজেই।
‘এত রাত্রে তোমরা কে হ্যাঁ?’ ভদ্রলোকের বিরক্ত কন্ঠ শুনি!
সবিনয়ে বলি, ‘আজ্ঞে সমস্ত পুরী খুঁজে তবে আপনার বাড়ি পেয়েছি, মশাই!’
‘তা, আমাকে এত খোঁজাখুঁজি কেন?’ ভদ্রলোক আলোটা তুলে আমাদের নিরীক্ষণ করেন, ‘তোমরা সেই বালিগঞ্জের না?’
‘আজ্ঞে বালিগঞ্জেরই বটে। সেজন্য কিছু মনে করবেন না। আপনি স্নেহপ্রবণ পিতা হয়েও এত অন্যমনস্ক প্রকৃতির হতে পারেন, আমরা তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি। আপনার ছেলেকে যে সমুদ্রের ধারেই ফেলে এসেছেন তা বোধ হয় আপনার স্মরণেও নেই। আপনার ছেলে এতক্ষণ সমুদ্রের গর্ভে ভেসে যেত, সত্যিকথা বলতে কী একটা প্রকান্ড ঢেউ ওকে তাড়াও করেছিল, আমার এই বন্ধু নিজের জীবন বিপন্ন করে ওকে বঁাচিয়েছেন। এতক্ষণ আপনার ছেলে—আমার বন্ধু দুজনেই—হাঙর কুমিরের পেটে গিয়ে বেবাক হজম হয়ে যেত, কিন্তু আমার বন্ধু চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু আর ভগবান সহৃদয়—এই দুয়ের যোগাযোগে আজ আপনার ছেলের বহুমূল্য জীবন রক্ষা পেয়েছে—’
ভদ্রলোক এতক্ষণ অবাক হয়ে আমার বাক্যালাপ শুনছিলেন, এবার বাধা দিয়ে বললেন—‘আমার ছেলে কাকে বলছ? এর মধ্যে কোনটি আমার ছেলে?’
আমি আকাশ থেকে পড়ি—‘কেন, এই দেবদূতের মতো স্বর্গীয় শিশুটি, একী আপনার নয়?’
‘হ্যাঁ, একে দেখেছিলাম বটে আজ বিকেলে। সমুদ্রের ধারে। বিস্কুটও খেতে দিয়েছি, কিন্তু একে তো আমি চিনি না।’
এই বলে সশব্দে আমাদের মুখের ওপরই তিনি দরজা বন্ধ করে দেন।
গোবিন্দ সেই বালির ওপরেই বসে পড়ে—‘সমীর, বরাতে কি শেষটা এই ছিল? কঠোর কারাদন্ড? এই করলে তুমি মাথা খাটিয়ে?’