মহাভারতের এক বিস্মৃত চরিত্র একলব্য
মহাভারত মানে এক কথায় কৌরব এবং পাণ্ডবদের মাঝে তাদের অধিকার রক্ষার লড়াই। আঠারো দিন ব্যাপী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আর্যাবর্ত্তের প্রায় সকল রাজারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাণ্ডবদের নায়ক ও কৌরবদের খলনায়ক হিসেবে মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে। কৌরব ও পাণ্ডব ছাড়া মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণকে প্রধান চরিত্র ও কর্ণকে এক অবহেলিত চরিত্র হিসেবে আমরা দেখতে পাই। জন্মগত ভাবে কৌন্তেয় হয়েও আমৃত্যু তাঁকে এই পরিচয় হীনতা বয়ে বেড়াতে হয়েছে। কর্ণ আজীবন অর্জুনকে তাঁর প্রতিস্পর্ধী ভাবলেও একলব্য প্রথমে অর্জুনকে প্রর্তিস্পর্ধী ভাবতেন না। কিন্তু ঘটনাক্রমে তিনি পাণ্ডব বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। কর্ণের মতো একলব্যও এসেছিলেন তৎকালীন শ্রেষ্ঠ অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্র শিক্ষা করতে। একমাত্র রাজবংশীয় ছাড়া আর কাউকে তিনি অস্ত্র শিক্ষা দেবেন না এই ছিল দ্রোণাচার্যের পণ ; তাই তিনি কর্ণকে অস্ত্র শিক্ষা দেননি কিন্তু নিষাদ রাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্যকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন নি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। নিষাদ রাজ হিরণ্যধনু ছিলেন মগধরাজ জরাসন্ধের মিত্র আর কুরু বংশীয়রা ছিলেন যদু বংশের বন্ধুরাষ্ট্র। যেহেতু যদুবংশীয় শ্রীকৃষ্ণ মগধরাজ জরাসন্ধের জামাতা কংসকে হত্যা করেছিলেন তাই যদু বংশের সঙ্গে মগধরাজ জরাসন্ধের সম্পর্ক ছিল অহি নকুলের মতো। জরাসন্ধ বারবার মথুরা আক্রমণ করেছিলেন যদু বংশকে ধ্বংস করার জন্য। ঠিক এই কারণেই কুরুবংশের শিক্ষালয়ে একলব্যকে শিষ্য হিসেবে তিনি গ্রহণ করতে পারেন নি। কিন্তু একলব্য দ্রোণাচার্য্যকেই তার অস্ত্রগুরু হিসেবে বরণ করে তাঁর মৃন্ময় মূর্তির সামনে অস্ত্রাভ্যাস করতে থাকেন এবং একসময় অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী অর্জুন ও দ্রোণাচার্য এক অরণ্যে একলব্যকে দেখতে পান একজন নিপুণ ধনুর্দ্ধর হিসেবে। অর্জুন বুঝতে পারলেন একলব্য ধর্নুবিদ্যায় তার চেয়েও নিপুণ অথচ দ্রোণাচার্য তাকেই আর্যাবর্ত্তের শ্রেষ্ঠ ধনুর্দ্ধর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দ্রোণাচার্যও বুঝতে পারলেন একলব্য অর্জুনের থেকেও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। তিনি একলব্যের কাছে গুরুদক্ষিণা চেয়ে নিলেন তার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলী ; দ্রোণাচার্যের চাতুরতায় এভাবেই একজন সেরা ধনুর্দ্ধরকে অকালে পাদপ্রদীপের তলা থেকে সরে যেতে হলো। একলব্যকে এরপর আর মহাভারতীয় আখ্যানে খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানেই প্রশ্নটা উঁকি দেয় কর্ণ অর্জুনের সাথে উচ্চারিত এতবড় একজন ধনুর্দ্ধরের পরিনতি কি এভাবেই শেষ হতে পারে?
নিষাদ রাজ হিরণ্যধনু ও রানী বিশাখার পুত্র একলব্য বুঝতে পারলেন গুরু দ্রোণাচার্য তার সঙ্গে ছলনা করেছেন। অঙ্গুষ্ঠ ছাড়া তির চালনা করে কখনও সব্যসাচী অর্জুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব নয়। একমাত্র অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব নিরঙ্কুশ করতেই গুরু দ্রোণাচার্যকে তার বৃদ্ধাঙ্গুলী গুরুদক্ষিণা হিসেবে দান করতে হলো। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তার সব রাগ ও হিংসা অর্জুনের উপর এসে পরে। তিনি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ছাড়াই আরো গভীর অনুশীলনে ব্রতী হলেন। একলব্য জানতে পারলেন সূত জাতীয় বলে কর্ণকেও অর্জুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দিয়ে যথেষ্ট হেনস্থা করা হয়েছে এবং তাকে অস্ত্র শিক্ষা দিতে অস্বীকার করেছেন গুরু দ্রোণাচার্য। এজন্য তিনি কর্ণের প্রতি এক স্বাভাবিক সমবেদনা পোষণ করতেন। কালক্রমে এক মহান ধনুর্দ্ধর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কর্ণের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পাণ্ডব বিরোধী হয়ে ওঠেন। নিষাদ রাজ হিরণ্যধনু যেহেতু মগধরাজ জরাসন্ধের মিত্র ছিলেন তাই একলব্য অতি সহজেই জরাসন্ধের সৈন্যদলে স্থান করে নিলেন এবং যুদ্ধবিদ্যায় নিপুণতার জন্য জরাসন্ধ তাকে মগধের সেনাপতি পদে বরণ করে নেন। জরাসন্ধ যখন বারবার মথুরা আক্রমণ করছিলেন তখন সেই আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একলব্য ; তার সৈন্য পরিচালনায় যাদবদের প্রভুত ক্ষতি হয়েছিল ।
ভীমের হাতে জরাসন্ধের মৃত্যুর অনুঘটক যে শ্রীকৃষ্ণ এটা বুঝতে একলব্যের বুঝতে পেরে রাগে প্রতিহিংসায় দ্বারকা আক্রমণ করে বসলেন ; তার কাছে অধিকাংশ যাদব বীরেরা পরাজিত হলে শ্রী কৃষ্ণের সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়। অবশেষে শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হন একলব্য।
তার এই বীরত্ব ও যুদ্ধবিদ্যায় নিপুণতার জন্য স্বাভাবিক ভাবেই জানতে ইচ্ছে করে একলব্যের সত্যিকার পরিচয় কি ? তিনি কি নিষাদ রাজ হিরণ্যধনুর পুত্র? না তার অন্য কোন পরিচয় আছে? হরিবংশ পুরাণে একলব্য সম্পর্কে যে তথ্য পাই তাতে তিনি একজন যদু বংশীয়। শ্রীকৃষ্ণের পিতা বসুদেবের এক ভাই দেবশ্রবার পুত্র ছিলেন একলব্য। তাঁর জন্মকালে আকাশবাণী হয়েছিল এই জাতক যদু বংশের কারও হাতে নিহত হবেন। দেবশ্রবা তার পুত্রকে যাদবদের হাত থেকে রক্ষা করতে জলে ভাসিয়ে দিলে নিষাদ রাজ হিরণ্যধনু তাকে নিজের পুত্র হিসেবে মানুষ করেন এবং একলব্য নামকরণ করেন। ক্রমশঃ তিনি একজন মহান ধনুর্দ্ধর হয়ে ওঠেন এবং যুদ্ধবিদ্যায় কর্ণ ও অর্জুনের সমগোত্রীয় হয়ে ওঠেন।
শ্রীকৃষ্ণের মাতা দেবকীর এক বোনের পুত্র ছিলেন শিশুপাল আকাশবাণী ছিল এই জাতক শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হবে । শিশুপালের মা তার সন্তানের জীবন রক্ষার আবেদন করলে শ্রীকৃষ্ণ তার একশত অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন কথা দিলেন। অবশেষে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে শিশুপাল একশত অপরাধ অতিক্রম করলে শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হন। ঠিক সেভাবেই একলব্যের সৈন্যাপত্তে জরাসন্ধ সতের বার মথুরা আক্রমণ করে যাদবদের হত্যা করায় এবং অবশেষে একলব্য দ্বারকা আক্রমণ করলে শ্রীকৃষ্ণের হাতে একলব্য নিহত হন। এভাবেই মহাভারতীয় কালের একজন শ্রেষ্ঠ ধনুর্দ্ধরের জীবনাবসান হয়।