Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মন মোর মেঘের সঙ্গী || Tarapada Roy

মন মোর মেঘের সঙ্গী || Tarapada Roy

যদি কোনও পাঠক ‘ভুলোমন মাস্টারমশায়’ এবং ‘পাগলের কাণ্ডজ্ঞান’ পড়ে থাকেন,তবে তাঁর পক্ষে আজকের এই রচনা পড়ে হাসা হয়তো একটু কঠিন হবে।

ভুলোমন মাস্টারমশায় এবং উদ্দাম পাগলের মধ্যে হাজার হাজার লোক রয়েছে যারা খাচ্ছে-দাচ্ছে, অফিস যাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে কিন্তু কোথায় যেন মনের মধ্যে কী একটা ব্যাপারে কীরকম যেন গোলমাল রয়েছে, কীসের খটকা, অস্পষ্টতা।

আমাদের এক বিখ্যাত বন্ধু নানারকম ছক এঁকে স্থাপত্য বিজ্ঞানের নকশা বানিয়ে এবং বীজগণিতের অতি দুরূহ সমস্ত সমীকরণ করে বার করেছিল যে উনিশশো চুয়াত্তর সালের সাতই জুলাই, রাত এগারোটা বেজে সাতাশ মিনিট সাড়ে বত্রিশ সেকেন্ডে কলকাতা ময়দানের অক্টরলোনি মনুমেন্ট মানে শহিদ মিনার ভেঙে পড়ে যাবে, একেবারে মুখ থুবড়ে, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পড়ে যাবে। কুতুব মিনার, তাজমহল, ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি ওইগুলি কবে ভেঙে পড়বে সে বিষয়েও তার বেশ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসেব ছিল। তার বাধ্যবাধকতায় এবং বন্ধুর প্রতিভার প্রতি চক্ষুলজ্জার খাতিরে দশ বছর আগের আষাঢ় শেষের এক প্রবল বৃষ্টির রাতে আমরা সাত-আটজন বন্ধু ছাতা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে এগারোটা সাতাশ মিনিট বেজে যাওয়ার পরেও আরও ঘণ্টাখানেক এক হাঁটু কাদাজলের মধ্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছিলাম। সেদিন রাতে কেন, মনুমেন্ট আজও ভাঙেনি, অদ্যাবধি তাজমহল ইত্যাদিও অটুট আছে। আমার সেই বন্ধুটি এ বিষয়ে আর উচ্চবাচ্য করেননি।

এ রকম মানসিক সমস্যা অনেকের সাময়িকভাবে দেখা দেয়। তারপর কিছু সময় অথবা কোনও এক বিশেষ ঘটনার পরে সেটা মন থেকে উবেও যায়।

কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে মানসিক রোগীর মনে কোনও কোনও ধারণা বদ্ধমূল হয়ে থাকে। খিদিরপুরের দিকে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোককে জানি। তাঁর বাল্যকাল কেটেছিল জাপানি যুদ্ধের আমলে ওই খিদিরপুরের পাড়ায়। কেন যেন তাঁর ধারণা রয়েছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। জাপানি যুদ্ধবিমান যে কোনও মুহূর্তে হানা চালাতে পারে। এখনও মাঝরাতে তিনি কখনও কখনও ছাদে উঠে যান, চিলেকোঠার জানলার নীচে হামাগুড়ি দিয়ে বসে সন্তর্পণে সারা আকাশ তন্নতন্ন করে দেখেন, কোথাও বোমারু বিমানের ছায়া চোখে পড়ে কি না।

এক সাহেবের কথা পড়েছি হাসির গল্পের বইতে। তার ধারণা সে গোরু। মাঝেমধ্যে মাঠে নেমে চার পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে কচি ঘাস খাওয়ার চেষ্টা করে। কখনও কখনও হাম্বা-হাম্বা করে ডাকে।

অফিস-কাছারি সবই ঠিকঠাক চালিয়ে যাচ্ছিল সেই সাহেব। শুধু ফাঁকে ফাঁকে, ছুটিতে-অবসরে একটু-আধটু গোরুগিরি করত। রবিবারের সকালে মাঠে নেমে ঘাস খাওয়া, হঠাৎ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে হাম্বা-হাম্বা রব তোলা-সাহেবের মিসেস সাহেব, মানে এককথায় মেমসাহেব, কোনওরকমে মানিয়ে-শুনিয়ে প্রায় চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

বিপদ হল, একদিন ওই সাহেব কী এক উত্তেজনার আতিশয্যে নিজেকে ওভার-এস্টিমেট করে ফেললেন। একটি প্রকৃত চার পেয়ে, লেজঝোলা, দুগ্ধ-দায়িনী গোরুর সঙ্গে হঠাৎ গুঁতোগুঁতি বাধিয়ে ফেললেন। তবু ষাঁড় নয়, বলদ নয়, নিতান্ত গোরু সেটা। অস্থিচর্মসার, বেঁটে নিতান্তই আটপৌরে দিশি গোরু না হলেও বিলিতি গোরু। ষাঁড় কিংবা বলদের তুলনায় কম শক্তিশালী। তাই সাহেব প্রাণে বেঁচে গেল। এক রবিবার বিকেলে গ্রামের মাঠে নেমে নিরীহ একটি গোরুর সিংয়ের সঙ্গে নিজের কপাল ঠেকিয়ে হাম্বা রব তুলে লড়ে গিয়েছিলেন। হতভম্ব গোরুটি এক গুঁতোয় তাঁকে মাটিতে ফেলে, পিছনের দুই খুর দিয়ে লাথি মেরে ছুটে পালিয়ে গেল।

এই অঘটনের পর মেমসাহেব প্রায় জোর করে তাঁকে নিয়ে গেলেন মনোবিকারের ডাক্তারের কাছে।

নানা রকমের কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা করে ডাক্তার সাহেব তাঁর রোগীর কোনও বিকার আবিষ্কার করতে পারলেন না। সব বিষয়ে সব প্রশ্নের ঠিকঠাক, যে কোনও বুদ্ধিমান, সাব্যস্ত ব্যক্তির মতো উত্তর দিচ্ছেন তথাকথিত রোগীটি কিন্তু যে মুহুর্তে গোরুর প্রশ্ন তুলছেন, গোরুর প্রসঙ্গে ফিরে আসছেন, সাহেব হাম্বা করে উঠছেন, বিকট সেই হাম্বা চিৎকার অনেকক্ষণ ধরে। ডাক্তার সাহেব যতই বোঝান ততই সাহেবটি বলেন যে, তাঁকে বুঝিয়ে কোনও লাভ হবে না, কারণ বোঝার কিছু নেই, তিনি নিজের মনে মনে অনেক বুঝে দেখেছেন এবং তিনি ভাল করেই জানেন তিনি সত্যিই গোরু, একটি আসল গোরু, মানুষ নন, কিছুতেই মানুষ নন।

এমন রোগী এমনকী ওই মনোবিজ্ঞানের স্বর্গভূমি বিলাত দেশেও খুব বেশি পাওয়া যায় না। ডাক্তার সাহেব ক্লান্ত হয়ে পড়লেন এবং স্বভাবতই জানতে চাইলেন, ‘কবে থেকে আপনি বুঝতে পারলেন যে, আপনি মানুষ নন, আপনি গোরু?’ সাহেবটি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘সে অনেক কাল থেকে।’ ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘তবু বলুন কতদিন আগে থেকে।’ রোগীটি এবার একটু মৃদু হাসলেন, তারপর এক লাফ দিয়ে চেম্বারের কোচের উপর চতুষ্পদ জন্তুর মতো চার পায়ে দাঁড়িয়ে, মৃদু হাম্বা-হাম্বা ধ্বনি তুলতে তুলতে বললেন, ‘সেই যবে বাছুর ছিলেম তবে থেকে।’ ডাক্তার সাহেব এবার বুঝতে পারলেন, ইনি শুধু বর্তমানের গোরু নন, ইনি একদা বাছুরও ছিলেন। এরপর ডাক্তারের আর কিছু করার রইল না, হাল ছেড়ে দিলেন। তবে মেমসাহেবকে পরামর্শ দিলেন, ‘আপনার স্বামীর জন্য আর কিছু করার নেই। তবে ঘাস-বিচালি খেয়ে পুষ্টির অভাবে যাতে মারা না পড়ে সেইজন্য ঘাসের সঙ্গে একটু করে ভিটামিন কমপ্লেক্স মিশিয়ে দেবেন।’

অবশ্য এ কাহিনী একেবারে প্রত্যন্ত সীমার। কাছাকাছির মধ্যে একজন নামকরা কবিকে জানি, যাঁর বয়েস এখন অন্তত ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ। তাঁর ধারণা তিনি এখনও লম্বা হচ্ছেন। তাঁর বাড়ির দেয়ালে স্কেলকাঠি দিয়ে ছকে রেখেছেন। মাঝেমধ্যেই দেয়ালে পিঠ দিয়ে নিজেকে মাপেন, কখনও মনে হয় একটু বেড়েছেন, কখনও তত বাড়ছেন না বলে আপসোস করেন। চোদ্দো-পনেরো বছরের যে কোনও উচ্চতাকাঙ্ক্ষী, লম্বাপরায়ণ কিশোরের মতো তাঁর উৎসাহ এ বিষয়ে। তিনি নিয়মিত রিং করছেন এবং যোগব্যায়াম। কে তাঁকে বোঝাবে এ জন্মে তাঁর আর লম্বা না হলেও চলবে এবং হাজার চেষ্টাতেও তিনি লম্বা হবেন না, হতে পারেন না।

আমার ভাইয়ের এক সহকর্মী ট্রামের ব্যবহৃত টিকিট সংগ্রহ করতেন। কত লোকের কতরকম বাতিক থাকে, দেশলাইয়ের খোলা থেকে বাঘের চামড়া কত মানুষ কত কী জমায়—সুতরাং টিকিট সংগ্রহকারীর বন্ধুবান্ধব, অফিসের লোকেরা তাঁর ওই বাতিক নিয়ে কিছু মাথা ঘামায়নি।

একবার ভদ্রলোক মাসখানেক অফিসে আসেননি। তাঁর স্ত্রীর চিঠি পেয়ে আমার ভাই তাঁর বাড়িতে যায়, গিয়ে দেখে তিনি শয্যাশায়ী। ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন অতিরিক্ত ট্রামের টিকিট খেয়ে নাকি তাঁর ওই অবস্থা। আমার ভাই বিছানার পাশে টেবিলের উপরে তাকিয়ে দেখল নানা রংয়ের, নানা দামের রাশি রাশি ট্রামের টিকিট আলাদা আলাদা করে তাড়া বেঁধে রাখা আছে। সামনে একটা প্লেট, প্লেটের পাশে কাসুন্দি, টম্যাটো সস, চিলি সসের শিশি, নুনদান, মরিচদান। আমার ভাই অবাক হয়ে ওইদিকে তাকিয়ে থাকায় শয্যাশায়ী বন্ধু আমার ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, অল্প কাসুন্দি ও চিলি সস দিয়ে কয়েকটা ধর্মতলা টু হাওড়ার সেকেন্ড ক্লাসের সবুজ রংয়ের তাজা টিকিট টেস্ট করে দেখবে কিনা, কিংবা টম্যাটো সসে চুবিয়ে কয়েকটা ধবধবে সাদা বালিগঞ্জ-পার্ক সার্কাস লাইনের টিকিট? ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন, ‘এতদিন তো তবু ভালই ছিল; চিৎপুর, বাগবাজার, বেলগাছিয়ার টিকিট তবু মোটামুটি হজম হচ্ছিল, কিন্তু এই হাওড়ার আর বালিগঞ্জের টিকিট কিছুতেই ওঁর সহ্য হচ্ছে না। ডাক্তারও দেখাবে না, অথচ হাওড়ার টিকিটের জন্য কী লোভ কী বলব?’

সেই ট্রাম-টিকিটলোভী ভদ্রলোকের কী হয়েছিল, ঈশ্বর জানেন। তিনি আর অফিসে আসেননি। আমার ভাইও ভয়ে ভয়ে যায়নি।

কিন্তু শুধু কাগজ খাওয়া বা গোরু মনে হওয়া নয়, অনেক ছোটখাটো মানসিক অস্বাভাবিকতায় আমরা ভুগি। কেউ হয়তো বিনা কারণে ভয় পাই, কারও হয়তো বারান্দার রেলিংয়ের কাছে দাঁড়ালে মাথা ঘোরে, বন্ধ ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসে। আবার কেউ হয়তো একা একা কথা বলে।

এইরকম এক একা একা কথা বলার রোগী এক মনঃসমীক্ষকের কাছে গিয়েছিলেন। মনের ডাক্তার ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিলেন না, বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে ? অনেকেই একা একা কথা বলে, আমি নিজেই বলি।’ রোগী করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘কিন্তু, জানেন না তো ডাক্তারবাবু, আমি যে কী সাংঘাতিক বোর ! নিজে নিজে কথা বলে আমি একদম টায়ার্ড হয়ে যাই।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *