মজার একটা খবর পাওয়া গেল
সকাল দশটায় মজার একটা খবর পাওয়া গেল। খবরটা হল–রিমির মা ফরিদা খালা বিয়ে করেছেন। ভদ্রলোকের নাম সেলিম। বিয়েটা কয়েকদিন আগেই হয়েছে। খবর পাওয়া গেল আজ। বাইরের কারো মুখ থেকে খবর পাওয়া গেলে আমরা চট করে বিশ্বাস করতাম না। খবর দিলেন খালা নিজেই। টেলিফোন করে মাকে বললেন, বড় আপা, আপনাকে একটা খবর দিতে চাই। খবর দিতে লজ্জা লাগছে। কে কিভাবে ইন্টারপ্রিট করে কে জানে। আমাদের নেচারই হচ্ছে নেগেটিভ সাইডটা আগে দেখা।
মা বললেন, খবরটা কি?
এই সমাজে মেয়েদের একা থাকা যে কী যন্ত্রণা, তা তো সবাই জানে। মেয়েদের একা থাকা অসম্ভব ব্যাপার। এক জন অভিভাবক লাগেই। তাছাড়া আপা, আপনি তো জানেন না রিমির বাবার দিকের আত্মীয়রা আমাকে কী রকম বিষদৃষ্টিতে দেখে। সারাক্ষণ চেষ্টা কী করে আমাকে ঠকাবে। ঐদিন রিমির মেজো চাচা আমার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার চাইল। আমি বললাম, এত টাকা আমি পাব কোথায়? এতে রেগেমেগে যেসব কথা বলল; আপনি শুনলে হার্টফেল করবেন।….
খবরটা কী সেটা আগে বল।
আপনি কিছু শোনেন নি?
না।
আমি বিয়ে করেছি বড় আপা। মাথার উপর যেন এক জন অভিভাবক থাকে এই জন্যে করা। রিমিও মত দিয়েছে।
রিমিও মত দিয়েছে?
হ্যাঁ। আসলে ও আমাকে ইনসিস্টও করেছে।
ফরিদা খালা দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। মার স্মৃতিশক্তি তেমন ভালোনা। বেশিরভাগ কথাই তিনি ভুলে যান কিন্তু টেলিফোনের কথোপকথনের পুরোটা তিনি গড় গড় করে আমাদের বললেন। দাঁড়ি-কমাও বাদ দিলেন না। বাড়ির মেয়েদের খুব দুঃখিত মনে হলেও তেমন দুঃখিত হয়ত তারা হল না। তাদের চোখে-মুখে চাপা উল্লাস। বিভিন্ন জায়গায় টেলিফোন করে এই খবর ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা। দেখা গেল বাসায় প্রায় সবাই জানতো যে এরকম একটা কিছু হবেই। ভবিষ্যতে কী হবে, সেটাও দেখা গেল সবাই জানে।
মীরার ধারণা, সেলিম নামের এই, লোক ভুজুংভাজুং দিয়ে বাড়িটা নিজের নামে লিখিয়ে নেবে। টাকা-পয়সা হাত করবে। তারপর লাথি দিয়ে স্ত্রীকে খেদিয়ে দেবে।
ইরা অবশ্যি মীরার সঙ্গে একমত হল না। ইরার ধারণা, ফরিদা খালা ঐ লোকটার টাকা-পয়সা সব হাত করবে, তারপর লোকটাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে আরেকটা বিয়ে করবে।
ফরিদা খালার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখা ঠিক হবে কি হবে না, এই নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা হল। দুই রকম অভিমত পাওয়া গেল। এক দল বলছে, সম্পর্ক রাখা ঠিক হবে না। অন্যদল বলছে, রিমির কারণে সম্পর্ক রাখতে হবে। প্রয়োজনবোধে রিমিকে ঐ বাড়ি থেকে এনে এ বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
এই জাতীয় ক্রাইসিসে আমার সব সময় একটা ভূমিকা থাকে। বেশিরভাগ সময় আমাকে গুপ্তচরের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এবারেও তাই হল। মা আমাকে ডেকে বললেন, তুই সন্ধ্যাবেলায় ঐ বাড়িতে যা। ব্যাপারটা কি ভালো করে জেনে আয়।
রিমির সঙ্গেও কথা বলবি। ওর মনোভাব জানবি।
আমি আঁৎকে উঠলাম। ঐ রাতের পর রিমিদের বাড়িতে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। খালা জুতাপেটা না করলেও যা করবেন তাও কম না। আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, মেয়েরা কেউ গেলেই তো এসব ভালো জানতে পারবে।
আরে না। মেয়েরা গেলেই সন্দেহ করবে। কিছু বলতে চাইবে না। তোর বোকা বোকা চেহারা; তোকে কেউ সন্দেহ করে না। তুই সন্ধ্যার পর যা।
আমি আমার বোকা বোকা চেহারা নিয়ে সন্ধ্যার পর গেলাম। খালা বেশ সহজ স্বাভাবিক। আমাকে দেখে হাসিমুখেই তাকালেন। রিমিও বেশ স্বাভাবিক। সুন্দর শাড়ি পরে ঘুর ঘুর করছে। আমাকে বলল, বাবার দ্বিতীয় সংস্করণ কেমন দেখছিস? কাছে। গেলেই সেন্টের গন্ধ পাবি। ভুরভুর করে সেন্টের গন্ধ বের হয়।
সেলিম সাহেবের সঙ্গে দেখা হল। আগেও এ বাড়িতে কয়েকবার দেখেছি, কখনো কথা হয় নি। আজ তিনি প্রচুর কথা বললেন। তৃতীয় বিশ্বে ক্ষমতা কী করে দখল করা হয়, এই বিষয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। একাত্তরে ত্রিশ লাখ লোক মারা গেছে বলে চারদিকে যে প্রচার, এটার ভিত্তি কী সে সম্পর্কেও অনেক কথা বললেন, কথার ধরন ধারণ থেকে মনে হয়, বিরাট চালবাজ লোক। তবে ভদ্রলোকের চেহারা ভালো। স্মার্ট লোক। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি বললেন, কই ফরিদা, বেচারাকে কিছু খেতে-টেতে দাও। আমি বক্তৃতা দিয়ে তো বেচারার মাথা ধরিয়ে দিয়েছি।
খালা চা-বিসকিট নিয়ে এলেন এবং অসম্ভব আদুরে গলায় বললেন, এই নিয়ে তোমার আট কাপ চা খাওয়া হল। আর কিন্তু চা হবে না।
ডোন্ট বি টু হার্ড অন মি।
অসম্ভব, আর তোমাকে চা দেব না। শেষে রাতে ঘুম হবে না। দেখ না টুকু, সারাদিন চুক চু করে চা খায়, তারপর রাতে ঘুম হয় না। জেগে থাকে। বাধ্য হয়ে আমাকেও জেগে থাকতে হয়। এই বয়সে কি আর রাতজাগা পোষায়, তুই বল?
এই রকম আদুরে মিষ্টি গলায় খালা কি তার আগের স্বামীর সঙ্গেও কথা বলেছেন? হয়ত বলছেন। বলাই স্বাভাবিক। তবে আমি শুনি নি। আমি সব সময় তাদের ঝগড়া করতেই দেখেছি। তুচ্ছ সব বিষয় নিয়ে কুৎসিত ঝগড়া। একবার আমার সামনেই ফরিদা খালা চেঁচিয়ে বললেন, তোমার সঙ্গে বাস করা আর রাস্তার এক কুকুরের সঙ্গে বাস করার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।
খালু সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমাকে তুমি কুকুর বলছ? ফরিদা খালা শীতল গলায় বললেন, হা বলছি। এক শ বার বলছি। এখন তুমি আমাকে কী করবে? মারবে? মার। মারটা বাকি থাকে কেন? বউ মেরে হাতের সুখ কর। হাতের সুখ বাকি থাকে কেন?
সেই খালা আর এই খালায় আকাশ-পাতাল তফাৎ। আজ তিনি কি সুন্দর করে কথা বলছেন। চেহারাটাও ভালো লাগছে। চোখে-মুখে আনন্দ ও সুখের ছাপ। খালাকে দেখতে ভালো লাগছে। বিয়ে করে কোনো অন্যায় করেছেন বলে আমার মনে হল না। মনে হচ্ছে, তিনি ঠিকই করেছেন। খালা বললেন, তুই খেয়ে যা। না খেয়ে যাবি না। পাবদা মাছ মটরশুটি দিয়ে রান্না করেছি। সেলিম সাহেব বললেন, সব রান্নায় তুমি খানিকটা মটরশুটি দিয়ে দাও কেন বল তো?
তুমি না বললে মটরশুটি তোমার ভালো লাগে। একবার বলেছিলাম, তারপর থেকে সবকিছুতেই মটরশুটি। আচ্ছা বাবা যাও, আর দেব না।
আমার সামনেই তাঁরা রাগ এবং অভিমান দেখাতে লাগলেন। আমার দেখতে ভালোই লাগল। রাতে তাঁদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করলাম। রিমি একের এর এক মজার মজার গল্প করে আমাদের হাতে লাগল।
একটা লোক গাড়ি করে যাচ্ছিল, এক্সিডেন্ট করল। ট্রাফিক পুলিশ জিজ্ঞেস করল—এক্সিডেন্ট হল কিভাবে? সে বলল, আমি খুব সাবধানী ড্রাইভার। গাড়ি চালাচ্ছি, হঠাৎ দেখি সামনে রিকশা। রিকশাকে সাইড দিলাম। তারপর দেখি একটা টেম্পো। টেম্পোকে সাইড দিলাম। তারপর দেখি ঝড়ের বেগে ট্রাক আসছে। ট্রাককেও সাইড দিলাম। তারপর দেখি একটা ব্রিজ। ব্রিজটাকে সাইড দিতে গিয়েই এক্সিডেন্ট।
গল্প শুনে হাসতে হাসতে রিমির নতুন বাবা গড়িয়ে পড়লেন। একেকবার হাসি থামিয়ে তিনি বহু কষ্টে বলেন—সো ফানি। তারপর আবার হাসি।
খাওয়ার শেষে রিমি আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। আমি বললাম, যাই রিমি?
আচ্ছা যা। টুকু, একটা কথা শুনে যা।
বল।
আমার যদি কখনো চরম কোনো দুঃসময় আসেতুই কি আমার পাশে থাকবি?
থাকব।
তোর থাকা-না-থাকা অবিশ্য সমান। তুই তো মানুষ না। তুই হচ্ছিস মানুষের ছায়া। তবু থাকিস।
দুঃসময়টা কখন আসবে?
শিগগিরই আসবে। এক রাতে এই নব-দম্পতির ঘরের দরজার শিকলে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেব। তারপর বলব-মা এবং বাবা নাম্বার টু, আমি এখন ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছি। পেট্রোল ঢালা হয়েছে। দেয়াশলাই জ্বালিয়ে আগুন দেব। তোমরা বাঁচার চেষ্টা কর। তারপর খুব ঠাণ্ডা মাথায় তাই করব। আচ্ছা টুকু, তুই এক গ্যালন পেট্রোল যোগাড় করে দিতে পারবি?
আমি জবাব না দিয়ে চলে এলাম। রিমির পাগলামির সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই আমি পরিচিত। তার পাগলামি চোখে পড়ার মত হলেও কখনো সীমা অতিক্রম করে না। আমি জানি, এইবারও করবে না—তবুবুকে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করছি। কেন কছি জানি না।
বাসায় ফেরামাত্র ছোট চাচা বললেন, লরেটার এক দূরসম্পর্কের খালার সন্ধান পাওয়া গেছে। উনি এসেছিলেন। মেয়েটাকে নিতে রাজি হয়েছেন। তুই কাল ভোরে তাকে দিয়ে আসবি।
আমি যথারীতি বললাম, আচ্ছা।