Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মন্দ্রসপ্তক (১৯৯৩) || Humayun Ahmed » Page 6

মন্দ্রসপ্তক (১৯৯৩) || Humayun Ahmed

আমরা ভয়াবহ যন্ত্রণায় ছিলাম

আমাদের দেখে কে বলবে চার দিন আগেই আমরা ভয়াবহ যন্ত্রণায় ছিলাম?

কেউ বলবে না।

বলার কথাও নয়।

এখন সব স্বাভাবিক। বড় চাচা ব্যাগ বোঝই করে বাজার করছেন। শীতের নতন আনাজ উঠেছে-অবিশ্বাস্য দামে তিনি সেসব কিনে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন এবং সবাইকে ধাঁধা ধরার মতো করে বলছেন, বল তো, টমেটো কত করে আনলাম?

কি, বলতে পারলি না? একজেক্ট ফিগার বলতে পারলে দশ টাকা দেব।

মীরা সম্ভবত আবার কোনো ছেলের প্রেমে পড়েছে। একটি বিরহের গান দিনে পঞ্চাশ বার বাজাচ্ছে। গানের ভাব হচ্ছে—তুমি আর আমি দুই পথের যাত্রী। এই জীবনে দুই পথ এক হবে না ইত্যাদি। শুটকো মতো একটা ছেলেকে ঘাড় কুঁজো করে প্রায়ই আমাদের বাসার সামনের রাস্তায় ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই ছোকরাই মীরার সাম্প্রতিক প্রেমিক। রূপবতী মেয়েরা প্রেমিক হিসেবে কুৎসিত ছেলেদের বেশি পছন্দ করে কেন কে জানে।

ছোট চাচা ফিরে এসেছেন। রোগী দেখা শুরু করেছেন। রোগী আসছে স্রোতের মতো।

ছোট চাচীও ফিরে এসেছেন। তাঁর ঘন ঘন অসুখ হবার ঝামেলাটা এই শীতে একটু কম বলে মনে হচ্ছে। গতকাল আমার সঙ্গে হাসিমুখে অনেকক্ষণ আলাপ করলেন। আলাপের বিষয়বস্তু হচ্ছে—তিনি শিগগিরই বাচ্চা নেবার কথা ভাবছেন। যদিও বাচ্চা নেয়া মানে ফিগারের দফারফা, তবু নেবেন। ব্রেস্ট ফিডিং না করালেই হল। আলাপের এক পর্যায়ে বললেন, মেয়েদের বুকের সেইপ নষ্ট হয়ে গেলে তো সবই নষ্ট। তাই না টুকু?

আমি উত্তর না দিয়ে ঢোঁক গিললাম। তিনি হাসিমুখে বললেন, তুমি দেখি লজ্জায় একেবারে বেগুনি হয়ে যাচ্ছ। লজ্জা পাবার মতো কী বললাম? যা বলেছি সবই সত্যি। হার্ড ফেক্ট। তোমাদের রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :

পত্র পুটে রয়েছে যেন ঢাকা
অনাঘ্ৰাতা পূজার কুসুম দুটি।

রবীন্দ্রনাথের মতো মহামানবেরই যদি এই ভাব হয় তাহলে সাধারণ পুরুষদের অবস্থাটা কী হবে ভেবে দেখ….

আলোচনা বেশিদূর এগুতে না দিয়ে আমি চলে এলাম। এ বাড়ির সবাই সুখে আছে। এটাই আমার সুখ। তবে কুসুমে কাঁটার মতো একটা কাঁটা এখনো আছে। সমিতা তার মেয়েটিকে নিয়ে যায় নি। বাড়ির কেউ তা নিয়ে চিন্তিতও না। মেয়েটি কান্নাকাটি করছে না, হৈচৈ করছে না, এতেই সবাই খুশি। আমি তাকে রোজ স্কুলে দিয়ে আসছি, স্কুল থেকে নিয়ে আসছি। সে একবারও তার মার কথা জিজ্ঞেস করছে না। আমিও নিজ থেকে কিছু বলছি না। রাতে ঘুমুবার আগে দুজন বয়স্ক মানুষের মতো খানিকক্ষণ গল্প-গুজব করি। আমার জন্মদিনে রিমি যে কাণ্ডটা করল আমি তা বেশ সহজভাবেই তাকে বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, রিমির এই কাজটা কি উচিত হয়েছে?

লরেটা আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বলল, উনি তোমাকে খুব পছন্দ করে তো, তাই তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে। পছন্দের মানুষকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে।

কে বলল তোমাকে?

মা বলেছে। এই যে মা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, নিয়ে যাচ্ছে না; তার কারণ মা আমাকে পছন্দ করে।

তুমি ঘুমাও।

আচ্ছা।

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। আমার মনটা এতই খারাপ হল যে, ঘুম এল না। ছাদে অনেকক্ষণ পায়চারি করলাম। বড় বড় নিঃশ্বাস নিলাম। প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন শরীরে নিলে না-কি ঘুম পায়। ঘুম পেল না। তৃষ্ণা পেয়ে গেল।

আজ ঘরে পানির জগ রাখতে ভুলে গেছি। নামতে হল একতলায়। পর পর তিন গ্লাস পানি খাবার পরও তৃষ্ণা মিল না। তৃষ্ণা ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। মাঝে মাঝে কিছুতেই তৃষ্ণা মেটে না। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রে সত্যি, না সার ক্ষেত্রে তা জানি না। কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

বসার ঘর থেকে নাক ডাকার অদ্ভুত শব্দ আসছে। সন্ন্যাসী ভোলাবাবু নাক ডাকাচ্ছে। কিছুদিন ধরে এই সন্ন্যাসী রোজ আসছে। বড় চাচার সঙ্গে গুজ গুজ, ফিস ফিস করছে। রাতে বসার ঘরের কার্পেটে কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। দারোয়ান বা মালীর ঘরে সে ঘুমুবে না, ঘুমুবে বসার ঘরে। আমার মার ধারণা, এই ব্যাটা একরাতে আমাদের খুন-টুন করে জিনিসপত্র নিয়ে পালাবে। মা তার এই আশংকার কথা অনেককেই বলেছেন, কেউ আমল দেয় নি।

সবার ঘরে উঁকি দেবার আমার কোনোই প্ৰয়োজন ছিল না—সম্ভবত নাক ডাকার শব্দে আকৃষ্ট হয়েই উঁকি দিলাম। ঘর অন্ধকার, সন্ন্যাসী নাক ডাকাচ্ছে অথচ আমি পা দেয়ামাত্র সে ভারী গলায় বলল, ভাইজানের কাছে সিগারেট আছে? আমি হকচকিয়ে গেলাম।

আছে ভাইজান সিগ্রেট?

আপনি কি জেগে ছিলেন না-কি?

জ্বি না, ঘুমাচ্ছিলাম।

আমি ঘরে পা দেয়ামাত্র ঘুম ভেঙে গেল?

জ্বি।

এবং অন্ধকারেও বুঝতে পারলেন আমি কে?

জ্বি।

কিভাবে বুঝলেন? আপনি কি অন্ধকারে দেখতে পান?

জ্বি না। অন্ধকারের দেখব কিভাবে? আমি তো আর বিড়াল না।

তাহলে বুঝলেন কী করে যে এটা আমি।

গন্ধ থেকে বুঝলাম।

গন্ধ থেকে বুঝে গেলেন?

জ্বি। সব মানুষের শরীরের গন্ধ আছে। মানুষের সঙ্গে যেমন মানুষের মিল নাই, এক মানুষের গন্ধের সঙ্গেও আরেক মানুষের গন্ধের কোনো মিল নাই।

আপনি কি সবার গন্ধ আলাদা করে চেনেন?

জ্বি না। যাদের সাথে কয়েকবার দেখা হয়, তাদেরটা চিনি। সিগ্রেট আছে ভাইজান?

সঙ্গে নেই, তবে ঘরে আছে।

থাক, বাদ দেন। তিনতলায় যাবেন আবার নামবেন। দরকার নাই।

দরকার নাহলে তো ভালোই। যাবার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করি তৃষ্ণা প্রসঙ্গে। আপনার কি কখনো এমন হয়েছে যে খুব পানির তৃষ্ণা হয়েছে, পানি খেয়েই যাচ্ছেন কিন্তু তৃষ্ণা মিটছে না?

না। শরীরের তৃষ্ণা তো সহজেই মেটার কথা। মনের তৃষ্ণা নিয়েই সমস্যা। ঐ তৃষ্ণাটা কখনো মিটে না।

এইসব কথাবার্তা আপনি কি ভেবেচিন্তে বলেন, না যা মনে আসে বলে। ফেলেন?

যা মনে আসে বলি না। টুকু সাহেব?

জ্বি।

আপনাদের সমস্যা তো মিটে গেল।

তাই তো দেখছি।

ট্রাকে করে কুদ্দুসের ডেডবডি নিয়ে যাবার সময় আপনাকে বলেছিলাম না, এই মৃত্যুর পর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?

তা বলেছিলেন।

ছোট্ট একটা সমস্যা অবশ্যি থেকেই গেল।

কোন সমস্যার কথা বলছেন?

বাচ্চা মেয়েটার কথা বলছি। লরেটা বোধহয় নাম।

ওর কী সমস্যা?

আমার তো মনে হয় ওর মা তাকে নিতে আসবে না।

আপনি কি ভবিষ্যদ্বাণী করছেন?

জ্বি না। অনুমানে বলছি। পাঁচ দিন হয়ে গেল, এখনো আসছে না ভয়ংকর কিছু নাহলে তো এক জন মা কখনো এই কাজ করবে না। আচ্ছা, এখন যান ঘুমান গিয়ে।

আমি বুঝলাম, সন্ন্যাসী পাশ ফিরল এবং সঙ্গে সঙ্গে নাক ডাকা শুরু হল। সত্যি সত্যি কি সে ঘুমিয়ে পড়েছে, না-কি আমাকে অভিভূত করবার জন্যে ভান করছে? সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রচুর ভান করতে হয়। তাদের প্রধান দায়িত্ব এবং কর্তব্যের একটি হচ্ছে ইমেজ রক্ষা। ব্যাটা সম্ভবত সারাক্ষণই জেগেছিল। নাক ডাকাটা তার কোনো এক কৌশল। কৌশল হলেও মজার কৌশল। গন্ধের ব্যাপারটাও চমৎকার, তবে হকচকিয়ে যাবার মতো কিছু নয়। কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তি কিছু মানুষের মধ্যে অবশ্যই থাকতে পারে। পশুদের স্বভাব-চরিত্রের অনেক কিছুই তো মানুষের মধ্যে দেখা যায়।

আমি দোতলায় উঠে এলাম, তবে সন্ন্যাসীকে মন থেকে পুরোপুরি তাড়াতে পারলাম না। একটা সিগারেট নিয়ে আবার কি ফিরে আসব? খানিকক্ষণ গল্প করব? মন্দ কী?

নিজের ঘরে ঢুকে নামতে ইচ্ছা করল না। ঘুম পেতে লাগল। প্ৰচণ্ড ঘুম পাওয়ার। লক্ষণটা ভালো না। এই জাতীয় ঘুম বিছানায় যাবার আগ পর্যন্ত থাকে। বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়। আমার বেলায়ও তাই হল। বালিশে মাথা রাখামাত্র ঘুম চলে গেল। ঘরে শুয়ে অনেক রকম পরিকল্পনা করলাম। তার একটি হল বাচ্চা মেয়েটির মাকে খুঁজে বের করা।

আশ্চর্যের ব্যাপার, ভদ্রমহিলাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। রাত এগারোটার দিকে যে বাড়ির সামনে নামিয়ে রেখে এসেছিলাম। সে বাড়িতে সমিতা ছিল মাত্র এক রাত। ভোরবেলাতেই সুটকেস নিয়ে চলে যায়। কোথায় যায় তাও বাড়ির কেউ জানে না। জানার আগ্রহও নেই। যেখানে ইচ্ছা যাক সবারই এরকম একটা মনোভাব।

আমি সারাদিনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খুজতে লাগলাম। এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে অন্য আত্মীয়ের বাড়ি। কেউই কিছু জানে না। গ্রামের বাড়িতে খোঁজ করব সেই উপায়ও নেই, কারণ ভদ্রমহিলার গ্রামের বাড়ি নেই। কোলকাতার মেয়ে। উনিশ শ ষাট সনে ঢাকায় এসেছে।

রাত এগারোটায় খোঁজার পর্ব বন্ধ করলাম। জায়গাটা খারাপ। যে কোনো মুহুর্তে ঘড়ি, মানিব্যাগ, শার্ট, স্যুয়েটার খুলে নেবে। কপাল মন্দ হলে পেটে ক্ষুর ঢুকিয়ে দু একটা পপাঁচ দেবে। আগে এসব ক্ষেত্রে চিৎকার-চেঁচামেচি করলে লোকজন ছুটে আসত, এখন দৌড়ে উল্টো দিকে পালিয়ে যায়। বিটের পুলিশ হঠাৎ করে বধির হয়ে যায়, তাদের চলৎশক্তি থাকে না। তারা উদাস দৃষ্টিতে পুরো ব্যাপারটা দেখে।

আমি ঠিক করলাম, রিমিদের বাসায় চলে যাব। রিমিদের বাসা কাছেই। সে গাড়ি করে নিশ্চয়ই আমাকে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করবে। রিমিদের বসার ঘরে আলো জ্বলছে। ঢুকে দেখি, খালা সেজেগুজে বসে আছেন। তাঁর সামনে কালো জ্যাকেট পরা এক ভদ্রলোক। দুজনের সামনেই কফির কাপ। খালা কুঁচকে বললেন, তুই কী মনে করে?

যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে, ভাবলাম…

কোনো খবর আছে, না এম্নি এসেছিস?

খবর নেই, এম্নি।

খালা বিরক্ত গলায় বললেন, দুপুররাতে মানুষের বাসায় আসার মানে কি? তোদর কি কাণ্ডজ্ঞান কখনো হবে না?

আমি অপমান হজম করে হাসিমুখে বললাম, রিমি বাসায় আছে?

বাসায় থাকবে না তো যাবে কোথায়? ও ঘুমুচ্ছে। তুই বোস এখানে, নাকি চলে যাবি?

বসি খানিকক্ষণ।

আমি বসামাত্রই ভদ্রলোক গল্প শুরু করলেন। ভদ্রলোক মনে হল। হিমালয়বিশারদ। হিমালয় ভ্রমণের কাহিনী খুব বিতং করে বলছেন।

হরিদ্বার হচ্ছে হিমালয়ের সিংহ-দরজা। কোলকাতা থেকে হরিদ্বার যাবার দুটো ট্রেন আছে। একটা হচ্ছে দুন এক্সপ্রেস। রাত নটা দশ মিনিটে ছাড়ে। অন্যটা হচ্ছে। জনতা এক্সপ্রেস। হাওড়া থেকে হরিদ্বারের দূরত্ব হচ্ছে পনের শ কিলোমিটার।

খালা বললেন, পনের শ কিলোমিটার সমান কত মাইল?

ওয়ান পয়েন্ট সিক্স কিলোমিটার হচ্ছে এক মাইল, কাজেই এবাউট…

ভদ্রলোককে হিসেব শেষ করতে না দিয়েই খালা কিশোরীদের গলায় বললেন, আপনি এত কিছু জানেন।

ভদ্রলোক এর উত্তরে হাসিমুখে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগে দরজার পর্দা সরিয়ে রিমি ঢুকে বরফের মতো গলায় বলল, টুকু, তুই ভেতরে আয়।

আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলাম। রিমি আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেল। চাপা গলায় বলল, ঐ লোক কখন থেকে বক্‌ বক্‌ করছে জানিস?

সন্ধ্যা থেকে?

না। দুপুর থেকে। দুপুরে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করেছে। তারপর থেকে বকবকানি চলছে।

যেতে চাচ্ছে না?

চাচ্ছে হয়ত, মা যেতে দিচ্ছে না। আমার অসহ্য লাগছে। তুই এসেছিস ভালো হয়েছে। এখন আমি মাকে একটা ভয় দেখাব। তোকে ভেতরে রেখে দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দেব।

তাতে লাভ কী?

তোর কোন লাভ নেই, মা ভয়ে ছটফট করবে, এটাই লাভ।

বলতে বলতে রিমি দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দিল।

আমার গা ছম ছম করতে লাগল। রিমি বলল, খবৰ্দার, গায়ে হাত দেবার চেষ্টা। করবি না। গায়ে হাত দিলে মেরে তক্তা বানিয়ে দেব।

আমি ফিস ফিস করে বললাম, তুই এত পাগল হলি কিভাবে?

রিমি বিরক্ত স্বরে বলল, পাগলের তুই কি দেখলি? আমি যা করছি খুব ভেবেচিন্তে করছি। মাকে আজ আমি একটা শিক্ষা দেব।

খালা উঠে এসেছেন। বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে আতংকিত স্বরে ডাকছে, রিমি, এই রিমি।

রিমি বলল, কী চাও মা?

দরজা বন্ধ কেন?

আমরা গল্প করছি, এই জন্যে দরজা বন্ধ। গোপন গল্প তো। আমরা চাই না সবাই শুনুক।

খালা ভাঙা গলায় বললেন, দরজা খোল মা।

বিরক্ত করো না মা। এখন যাও।

ঐ ভদ্রলোক উঠে এসে বললেন, কী হয়েছে?

খালা বললেন, কিছু হয় নি। রিমি না খেয়ে শুয়ে পড়েছে, তাই ডাকছি। আপনি রসার ঘরে গিয়ে বসুন।

ঐ ছেলেটা গেল কোথায়? আমি নাহয় ঐ ছেলেটার সঙ্গে গল্প করতাম।

খালা বললেন, ও চলে গেছে। পেছনের দরজা দিয়ে চলে গেছে। বিচিত্র স্বভাব এই ছেলের। কাউকে কিছু না বলে চলে যায়।

খালার কথা শেষ হবার আগেই রিমি উঁচু গলায় বলল, টুকু তো কোথাও যায় নি। এখানেই আছে। আমরা গল্প করছি।

হুড়মুড় শব্দ শুনলাম।

খুব সম্ভব খালা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছেন।

আমি দরজা খোলার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি, রিমি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, চুপ করে থাক, নড়বি না।

আমি অন্ধকারে অদ্ভুত মেয়েটার সঙ্গে বসে রইলাম।

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারোটার মতো বাজল। বিরাট নাটক করে বের হলাম। খালার কান্না, দরজার ধাক্কাধাক্কি–কুৎসিত ব্যাপার। ঘর থেকে বের হওয়ামাত্র খালা বললেন, আর কোনো দিন যদি তোক এ বাড়ির ত্রিসীমানাতে দেখি তাহলে জুতা দিয়ে পিটিয়ে লাশ বানাব। হারামজাদা কোথাকার!

রিমি বলল, মা, একে আমার সামনে ধমকা ধমকি করবে না। আমরা বিয়ে করে ফেলেছি।

কী বললি?

মুসলমানদের বিয়ে তো খুব সিম্পল—আমি তিনবার বলেছি, তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? সে বলেছে কবুল। Now we are husband and wife.

খালা মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। আমি পালিয়ে এলাম।

রাতে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখলাম। এই দুঃস্বপুটা আগেও কয়েকবার দেখেছি। আজ আবার দেখলাম, স্বপ্নে একটা পাগল আমাকে তাড়া করছে। পাগলের হাতে চকচকে একটা ক্ষুর। সে মৃদুস্বরে বলছে—ভয়ের কিছুনাই। ব্যথা দিমুনা। ক্ষুর খুব ধার। সে পেছনে পেছনে ছুটছে, তার মুখ দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু স্বপ্নে সবই সম্ভব। আমি পাগলটার মুখ দেখতে পাচ্ছি। খুব চেনা মুখ অথচ চিনতে পারছি না। পাগলটার মুখে শিশুসুলভ সারল্য, চোখ দুটি মায়া মায়া, গলার স্বরও অতি মধুর। সে খানিকক্ষণ পর পরই বলছে, ভয়ের কিছু নাই। ক্ষুর খুব ধার। পোঁচ কইরা বসামু, টেরও পাবেন না।

জেগে উঠে দেখি, ঘামে সারা শরীর ভেজা। হৃৎপিণ্ড ধক্ ধ করছে। যেন সত্যি সত্যি এতক্ষণ ছুটছিলাম। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। আমার ঘরে পানি থাকে না। একতলায় যেতে হবে পানির খোঁজে, অথচ যেতে ইচ্ছে করছে না, ভয় ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে, দরজা খুললেই পাগলটার দেখা পাব। স্বপ্নের ঘোর কাটার জন্যে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। ঘোর পুরোপুরি কাটল না।

এ রকম একটা স্বপ্ন বার বার দেখার মানে কি ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতেই দেখিছোট চাচা। আমার চিলেকোঠার ঘর। দরজা খুললেই পুরো ছাদটা চোখে পড়ে। ছোট চাচা সিগারেট হাতে ছাদে পায়চারি করছেন। আমাকে দেখেই বললেন, দুঃস্বপ্ন। দেখেছিস নাকি?

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম—হ্যাঁ, বুঝলেন কী করে?

গোঁ গোঁ শব্দ করছিলি।

খুব খারাপ স্বপ্ন। একটা পাগল ক্ষুর হাতে আমাকে তাড়া করছিল। পাগলটাকে চিনি; আবার চিনি না।

ছোট চাচা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, রাতে কী খেয়েছিলি? গুরুপাক কিছু খেয়েছিস, বদহজম হয়েছে। আমাদের অধিকাংশ দুঃস্বপ্নের কারণ হচ্ছে বদহজম।

তাই নাকি? আমিতো শুনেছি সাব-কনসাস মাইন্ড…

দূর! দূর! স্বপ্নের মূল কারণ হচ্ছে স্টমাক। পেটরোগা মানুষ সব সময় দুঃস্বপ্ন দেখে।

বাজে কটা ছোট চাচা?

ঘড়ি নেই। দুটা থেকে আড়াইটা হবে। আমি একটার সময় ছাদে এসেছি।

ইনসমনিয়া?

হুঁ। আচ্ছা টুকু, ঐ মেয়েটার ব্যাপারে কিছু ভাবছিস? লরেটার কথা বলছি।

না।

ভাবা দরকার তো। আমার মনে হয় সমিতার কোনো আত্মীয়-বাড়িতে রেখে আসা দরকার।

আচ্ছা।

আচ্ছা নয়। কাজটা জরুরি।

জরুরি হলে তো করতেই হবে।

বাচ্চাটা তোর ছোট চাচীর মনে চাপ ফেলেছে। ও এখানে বেবি এক্সপেক্ট করছে। এই সময় মনে চাপ পড়লে বেবির গ্রোথ ভালো হয় না। বুঝতে পারছিস কী বলছি?

পারছি।

হুট করে একটা বাজে ঝামেলায় জড়িয়ে…

এখন তো ঝামেলা শেষ। আনন্দের শুরু।

ঠাট্টা করছিস না-কি?

না। ঠাট্টা করছি না। ঠাট্টা করব কেন? ছাদে বেশিক্ষণ একা থাকা ঠিক না। ভূতের উপদ্ৰব।

ভূতের উপদ্রব মানে।

কমলা প্রায়ই ভূত দেখে।

তুই কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছি নাকি? রাস্কেল।

আমি সহজ মুখে নিচে নেমে এলাম।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress