ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঘটেই গেল
ছোট চাচা এক দুপুরে বাসায় এসে মীরাকে বললেন, মীরা, আমি সমিতাকে আজ বিয়ে করেছি। তুই খবরটা তোর চাচীকে দিয়ে আয়। সমিতা তিনটার দিকে আসবে।
মীরা পানির গ্লাস নিয়ে যাচ্ছিল। অবিকল সিনেমার দৃশ্যের মতো এই কথা শুনে তার হাত থেকে পানির গ্লাস পড়ে গেল।
ছোট চাচা ইংরেজিতে বললেন, আমাদের একটাই মাত্র জীবন। এই এক জীবনে আমাদের অধিকাংশ সাধই অপূর্ণ থাকে। আমি তা হতে দিতে চাই না। যা পাই হাত পেতে নেব। তুই তোর চাচীকে খবরটা দিয়ে আয়। যাবার আগে ভাঙা গ্লাসের টুকরাগুলো ফেলে দিয়ে যা। পা কাটবে।
মীরা তার কিছুই করল না। দৌড়ে দোতলায় উঠে গেল। তার কিছুক্ষণ পরই কমলা ভাঙা গ্লাসের টুকরায় তার পা কেটে রক্তারক্তি করল।
এইসব খবর আমি অবশ্যি জানলাম অনেক পরে। ঐদিন কী মনে করে যেন ক্লাস করতে গিয়েছিলাম। এ. কে. বদরুদ্দোজা নামের নতুন এক জন স্যার আইনের ভাষ্য বলে খানিকক্ষণ বিজবিজ করে কিছু বলতেই হৈচৈ বেধে গেল। পেছনের এক জন উঁচু গলায় বলল, আইন, গাইন। সারা ক্লাস জুড়ে হাসি। হাসি থামতেই ক্লাসের শেষ প্রান্ত থেকে অন্য আরেকজন বলল, আইন, গাইন, ফে, কাফ, কাফ। নতুন স্যার পুরোপুরি হতভম্ভ। এই অবস্থা তিনি কল্পনাও করেন নি। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, ইউ, ইউ, উঠে দাঁড়াও। কী শুরু করেছ?
আমি উঠে দাঁড়ালাম কিন্তু কিছুই বললাম না। ভদ্রলোক যে পরিমাণ রেগে আছেন—তাঁকে কিছু বলতে যাওয়া অর্থহীন।
কেন তুমি আইন, গাইন করছ? কেন?
আমার পেছন থেকে এক জন বলল, স্যার, ও মাদ্রাসা থেকে পাস করেছে।
আবার চারদিকে হাসাহাসি শুরু হয়ে গেল। গম্ভীর স্বরে অন্য এক জন খুব দরদ দিয়ে শুরু করল, আইন গাইন ফে কাফ কাফ। আলিফ জবর আ, বেজবর বা।
ক্লাস ডিসমিস হয়ে গেল। নতুন স্যার আমাকে বললেন, তুমি আস আমার সঙ্গে। আমি তাঁর সঙ্গে বের হয়ে এলাম। ক্লাস থেকে বের হওয়ামাত্র তিনি বললেন, তোমাকে পঁচিশ টাকা ফাইন করা হল। আমি বললাম, জ্বি আচ্ছা স্যার।
চল আমার সঙ্গে প্রিন্সিপ্যালের ঘরে। ইউ র্যাসকেল। কত ধানে কত চাল তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
আমি আবারো বললাম, জ্বি আচ্ছা স্যার।
প্রিন্সিপ্যাল স্যারের ঘরে আমাকে ঘন্টাখানিক দাঁড়িয়ে থাকতে হল। তিনি বুঝতে চেষ্টা করলেন আমি নিরীহ টাইপ কেউ, না কি কোন ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। যখন নিঃসন্দেহ হলেন আমি নিরীহ ধরনের এক জন, তখন বললেন, তোমাকে আমি এক্সপেল করছি। ক্যান্সার সেল আমি রাখব না। আমি আবারো বিনীত গলায় বললাম, জ্বি আচ্ছা স্যার।
স্যারের কাছে আমার নাম রোল নাম্বার লিখে দিয়ে বাসায় এসে দেখি বিরাট নাটক। ছোট চাচা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন। বিয়ে হয়ে গেছে। একটা সুটকেস হাতে সমিতা উঠে এসেছে বাড়িতে। তার সঙ্গে ছোট্ট মেয়েটি তার আগের পক্ষের স্বামীর। যে স্বামী আট বছর আগে মারা গেছেন।
নাটকের মূল অংশটি হচ্ছে ভেতরের বাড়িতে। বসার ঘরে দুটি সুটকেসের পাশে ছোট মেয়েটি বসে আছে। আমি খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করলাম। কিছুই বোঝা গেল না।
ছোট চাচী ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। দরজা খুলছেন না। মীরাইরা দুজনেই বন্ধ দরজার সামনে কান্নাকাটি করছে এবং বারবার বলছে, দরজা খুলুন চাচী, দরজা খুলুন। প্লিজ, প্লিজ।
দ্বিতীয় মিটিং চলছে ছোট চাচা এবং বড় চাচার মধ্যে। সেখানেও ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। তাদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে ইংরেজিতে।
সমিতা বসে আছে খাবার ঘরের টেবিলে। মা ঠিক তার মুখোমুখি। এই দুজন কোনো কথা বলছেন না। মা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সেই দৃষ্টিতে রাগ বা ঘৃণা খুব নেই, আছে বিস্ময়।
আমি বসার ঘরে বাচ্চা মেয়েটির কাছে চলে এলাম। নরম গলায় বললাম, কেমন আছ খুকি?
সে ঠিক বড়দের মতো আবেগহীন গলায় বলল, ভালো।
নাম কি তোমার?
মিস লরেটা গোমেজ।
মিস?
হ্যাঁ। বিয়ে হয় নি তো, তাই মিস।
বাচ্চা মেয়েটির কথায় চমৎকৃত হলাম। বাচ্চারা বড়দের সহজেই চমকে দিতে পারে। বড়রা তা পারে না। বড়দের কাণ্ডকারখানায় শিশুরা চমকায় না। আমার মনে হল, এই মেয়ে তার মায়ের দ্বিতীয় বিবাহ এবং এই বাড়িতে উঠে আসার পুরো ব্যাপারটাই বেশ সহজে মেনে নিয়েছে।
খুকি, তুমি কি এই বাড়িতে থাকবে?
তা ছাড়া কোথায় থাকবো?
কোন ক্লাসে পড় তুমি?
ক্লাস থ্রি।
বাহ্, তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না, তুমি থ্রিতে পড়। মনে হয় ওয়ান কিংবা টু।
মিস লরেটা গোমেজ গম্ভীর গলায় বলল, জানেন, আমি কিন্তু সব ক্লাসে ফার্স্ট হই।
চমৎকার।
বিড়ালের বাচ্চার ইংরেজি কি আপনি বলতে পারেন?
মানুষের বাচ্চার ইংরেজিই জানি না, আবার বিড়ালের বাছা! তুমি জান না কি?
জানি। কিটেন। হাতির বাচ্চার ইংরেজি কি তুমি জান?
মেয়েটা অনেকক্ষণ চিন্তিত মুখে বসে থেকে বলল, হাতির বাচ্চার কোনো ইংরেজি হয় না।
গভীর মমতায় আমার চোখ ছল ছল করতে লাগল। এই বাড়িতে কত-না দুঃসময় অপেক্ষা করছে তার জন্যে। বড়দের তৈরি করা নাটকে তার অভিনয় করতে হবে। ইচ্ছা না থাকলেও করতে হবে।
মিস লরেটা গোমেজ, আমি তোমার সঙ্গে বসে খানিকক্ষণ গল্প করি?
আপনার ইচ্ছা করলে করতে পারেন।
আমি তার মুখোমুখি বসলাম। এই প্রথম কালো রোগা বড় বড় চোখের মেয়েটি হাসল। তার হাসির একটাই মানে আমি তোমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলাম।
সে পা নাচাতে নাচাতে বলল, আচ্ছা বলুন তো, দুটো স্যুটকেসের মধ্যে কোনটা আমার?
সবচে বড়টা।
সে চমকে উঠে বলল, ঠিক বলেছেন। কী করে বললেন?
আমি সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম, এক কাজ করলে কেমন হয় লরেটা, বাসায় এখন ঝগড়া চলতে থাকবে। বড়দের ঝগড়া করার সুযোগ দিয়ে আমরা দুজন চল আইসক্রিম খেয়ে আসি।
চলুন।
তুমি কি তোমার মাকে বলে যাবে?
না।
সে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরল।
বাড়িতে হৈচৈ চলতেই থাকল।
ছোট চাচীর বাবা গোলাপপ্রেমিক জাজ সাহেব রাত নটার দিকে চলে এলেন। জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। তিনি বসার ঘরে বসে ঘন ঘন অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে লাগলেন। কোত্থেকে সেই সন্ন্যাসী ব্যাটাও জুটেছে। সে গভীর আগ্রহে এই অগ্নিকাণ্ড দেখছে। অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েও ভদ্রলোক বিশেষ সুবিধা করতে পারছেন না, কারণ, দেখার কেউ নেই। শুধু আমি এবং সন্ন্যাসী বসে, আর কেউ নেই।
সন্ন্যাসী এর মধ্যে এক কাণ্ড করল-জাজ সাহেবকে বলল, স্যার, কিছু মনে করবেন না, আপনার কাছে দেয়াশলাই থাকলে একটা কাঠি দিন। কান চুলকাব।
হু আর ইউ?
আমি স্যার কেউ না, সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী।
এইখানে কী চান?
বললাম না, আমি সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, কারো কাছে আমার কিছু চাইবার নেই। আপনি স্যার এইভাবে চিৎকার করবেন না। এরকম রাগারাগিতে অনেক সময় হার্ট এ্যাটাক হয়।
শাট আপ।
জ্বি আচ্ছা স্যার। আপনার কাছে তাহলে দেয়াশলাই নেই?
শাট আপ।
অতি উত্তপ্ত আবহাওয়া রাত এগারটার দিকে হঠাৎ করে খানিকটা পড়ে গেল। বড় চাচা এসে জাজ সাহেবকে কী যেন বললেন, তিনি বাড়ি চলে গেলেন। ছোট চাচী ঘরের গরজা খুলে বের হয়ে এলেন। তাঁকে দেখে মনে হল না খুব আপসেট।
আমার কাছে একমাত্র বাবাকেই অসম্ভব আপসেট মনে হল। তিনি, মনে হল, কান্নাকাটিও করেছেন, তাঁর চোখ লাল। আমাকে এসে বললেন, কেউ তো সারাদিন কিছু খায় নি। টুকু, তুই কোনো হোটেল থেকে কিছু খাবার-দাবার নিয়ে আয়।
এত রাতে কিছু পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। পাওয়া গেলেও কেউ কিছু খাবে বলে মনে হয় না। খিদে লাগলে পাউরুটি-বিসকিট আছে, ঐ খেয়ে শুয়ে পড়বে।
আচ্ছা তাহলে থাক।
আমি সিগারেট প্যাকেট খুলে দেখি পাঁচটা সিগারেট। ঠিক করলাম, আজকের এই বিশেষ রাতটা মনে রাখবার জন্য পর পর পাঁচটা সিগারেট খাব। মাথা যখন ঝিমঝিম করতে থাকবে তখন বিছানায় শুয়ে পড়ব।
সবে দুটা সিগারেট শেষ করেছি, ছোট চাচা লরেটাকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, এই মেয়েটাকে শোয়াবার জায়গা পাচ্ছি না। তোর কাছে রাখবি?
রাখব।
এক্সট্রা বালিশ আছে তোর ঘরে?
লরেটা বলল, আমার বালিশ লাগবে না।
আমি মেয়েটাকে আমার পাশে শুইয়ে দিলাম। এত রাত হয়েছে তব তার চোখে। ঘুম নেই। সে চোখ বড় বড় করে শুয়ে আছে। এক সময় বলল, আমি আপনাকে কী ডাকব?
টুকু ডাকবে। আমার নাম টুকু।
বড়দের বুঝি নাম ধরে ডাকা যায়?
বড় হলেও আমি তোমার বন্ধু। বন্ধুকে নাম ধরে ডাকা যায়। নিয়ম আছে।
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, টুকু, তুমি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। ঘুম আসছে না।
আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। সে নিঃশব্দে কাঁদছে। বাতি নিভিয়ে দিলাম। এই শিশুটির চোখের জল আমি দেখতে চাই না।
পরদিন ভোরে ছোট চাচী জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন।
সন্ধ্যাবেলা উকিল নোটিস চলে এল। সেই নোটসে কী লেখা আমরা জানলাম না, কারণ, উকিল নোটিস ছোট চাচা কাউকে পড়তে দিলেন না।
রাতে বড় চাচা আমেরিকায় টেলিফোন করলেন। টেলিফোনে বড় চাচীকে বলা হল তিনি যেন এক্ষুনি চলে আসেন। জানা গেল চাচী আসছেন। বড় চাচা এমন ভঙ্গি করতে লাগলেন যেন চাচী আসামাত্র সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অথচ বড় চাচী কখনো কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারেন নি। বরং তাঁর দীর্ঘ জীবনে নানান সমস্যা তৈরি করেছেন। এই যে দিনের পর দিন বাইরে পড়ে আছেন এ-ও কি এক সমস্যা নয়?
বিদেশের জলবায়ুতে মেদ বৃদ্ধির কোনো উপাদান আছে। বড় চাচী যতবার বিদেশ থেকে আসেন ততবারই দশ থেকে বারো কেজি বাড়তি মেদ নিয়ে আসেন।
এবার একেবারে গোলআলু হয়ে ফিরলেন। রং আগের চেয়ে অনেক ফর্সা, মাথার চুল কুচকুচে কালো। চুলের রঙে কলপের একটা অবদান বোঝা যাচ্ছে, তবে গায়ের রঙের রহস্যাটা কি, কে জানে।
আমাকে দেখে খুশি খুশি গলায় বললেন, আর লোকজন কোথায়? আর কেউ এয়ারপোর্টে আসে নি?
আমি বললাম, না।
বড় চাচী অবাক হয়ে বললেন, সে কি! তোর বড় চাচাও আসে নি?
না।
এর মানেটা কি? এত দিন পর আসছি আর এয়ারপোর্টে কেউ নেই। আমি কি ফেলনা?
ফেলনা হবেন কেন? আপনার লাগেজপত্র কি এই, না আরো আছে?
বড় চাচী লাগেজের খোঁজে গেলেন। তিনি নাকি মিডিয়াম সাইজের একটা সুটকেস না নিয়েই চলে এসেছেন। কাস্টমস-এর লোকজনদের সঙ্গে ছোটখাট একটা ঝগড়া শুরু করলেন। তারা বড় চাচীকে আবার ভেতরে ঢুকতে দেবে না, বড় চাচীও ঢুকবেনই। আমি শুনছি তিনি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন, কোন আইনে আছে যে, একবার বেরিয়ে পড়লে আবার ঢোকা যাবে না? দেখুন, আমাকে রুলস শেখাবেন না। এসব আমার জানা আছে।
আমি চমৎকৃত হলাম। কারণ বড় চাচী যে সব জিনিস চমৎকার জানেন, তা হচ্ছে কী করে লাউ ফুলের বড়া বানাতে হয়, সাজনা গাছের কচিপাতার তরকারি কী করে রাঁধতে হয়, কৈ মাছের পাতুরিতে পেঁয়াজ কাটা দিতে হয় কি দিতে হয় না। তিনি যে কাস্টমস-এর আইন-কানুনও জানেন, তা জানা ছিল না।
টার্মিনাল থেকে বের হয়ে বললেন, গাড়ি কোথায়? আমি নিরীহ ভঙ্গিতে বললাম, গাড়ি নেই। চলুন বেবিট্যাক্সি নিয়ে নেই। চাচী থমথমে গলায় বললেন, গাড়িও পাঠাল না। এর মানে কি বল তো? এর মানেটা কি?
বাড়িতে নানা ঝামেলা।
ঝামেলার কথা কি আমি জানি না? ঠিকই জানি। আধঘন্টার জন্যে এলে বাড়ি ধ্বংস হয়ে যেত? বল তুই, কী হত আধঘণ্টার জন্যে এলে?
আমি তাঁকে খুশি করবার জন্যে একটা বিকল্প ট্যাক্সি ভাড়া করে ফেললাম। চাচী মুখ কালো করে ট্যাক্সিতে উঠলেন। আমাকে বললেন, তুই ড্ৰাইভারের সঙ্গে গিয়ে বোস। তোর গা দিয়ে সিগারেটের গন্ধ বেরুচ্ছে। অন্য কেউ হলে এ কথায় অপমানিতবোধ করত, আমি করলাম না। বড় চাচী এ ধরনের কথা সব সময় বলেন।
তুই এখন করছিস কী?
কিছু না, ল পড়ছি।
ল একটা পড়ার জিনিস হল? খামাকা এটা পড়ছিস কেন? তোর বুদ্ধি-শুদ্ধি কোন কালে হল না। দাড়িও তো দেখি ঠিকমতো শেভ হয় নি। খোঁচা খোঁচা বের হয়ে আছে।
আমি মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। চাচী খুব যন্ত্রণা করেন। সারাক্ষণ কথা বলেন। এমন সব কথা যা হজম করা বেশ কঠিন। তাঁর মেয়েরা এবং মেয়ের জামাইরা তাকে কী করে সহ্য করেন কে জানে।
ও টুকু।
জ্বি।
তোর জন্যে একটা বাইনোকুলার পছন্দ করেছিলাম। ষাট ডলার দাম। প্যাকেট করে কাউন্টারে গিয়ে দেখি বাইনোকুলারটা কাচে ফাংগাস। আর কেনা হল না।
বাইনোকুলার দিয়ে আমি কী করব? না কিনে ভালোই করেছেন। ঐ সবের আমার দরকার নেই।
দরকার থাকবে না কেন? ক্রিকেট খেলাটেলা হলে দূর থেকে দেখবি। পরের বার আসবার সময় নিয়ে আসব, তখন দেখবি কত চমৎকার।
আচ্ছা নিয়ে আসবেন।
মীরা আর ইরার জন্য দুসেট কসমেটিক কিনেছিলাম, এভন কোম্পানির। তাড়াহুড়ার মধ্যে মেয়ের বাসায় ফেলে এসেছি। এখন এমন খারাপ লাগছে। মেয়েগুলোর জন্যে কখনো কিছু আনা হয় না। আশা করে থাকে।
এসব হচ্ছে তাঁর কথার কথা। আমেরিকা থেকে আসার পর প্রথম কিছুদিন যার সঙ্গেই দেখা হবে, তাকেই তিনি এরকম কিছু বলবেন। তাঁর এই স্বভাব নিয়ে প্রকাশ্যেই হাসাহাসি করা হয়। তিনি তা বুঝতে পারেন না। তাঁর ধারণা, তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। বুদ্ধি দিয়ে তিনি সব ম্যানেজ করতে পারেন।
ও টুকু।
জ্বি।
বাড়ির অবস্থা কি বল।
গেলেই দেখবেন।
সে তো দেখবই। বলতে অসুবিধা আছে? তোর ছোট চাচা কি মেয়েটাকে বাড়িতে এনে তুলেছে?
হ্যাঁ।
বলিস কী।
ছোট চাচী অর্থাৎ এক্স ছোট চাচী কোর্টে কেইস করে দিয়েছেন, মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন, সম্মানহানি এইসব কী যেন। ভালো ভালো উকিলও দেয়া হয়েছে। আমাদের অবস্থা কেরোসিন বলতে পারেন। ক্ৰমাগত কোর্টে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।
চাচী এতবড় খবর শোনার পরও কোন শব্দ করলেন না। পেছনে ফিরে দেখি, তিনি সিটে হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছেন। আমি নিশ্চিন্ত মনে একটা সিগারেট ধরালাম। গাড়ি বড় বড় কয়েকটা ঝাঁকুনি খেল। চাচীর ঘুমের তাতে উনিশ বিশ হল না। মোটা মানুষেরা ঘুমিয়ে পড়লে সহজে জাগে না। শরীরের মতো এদের ঘুমও ভারী হয়।
বড় চাচীকে নিয়ে আমি পৌঁছলাম খুব খারাপ সময়ে। ঐ সন্ন্যাসী ব্যাটা ভোলাবাবু তখনই কী জন্যে যেন এসেছে, বড় চাচা গলা ফুলিয়ে তাকিয়ে তাকে ধমকাচ্ছেন। সন্ন্যাসী তার সন্ন্যাসীসুলভ নিৰ্লিপ্ততায় ঐসব ধমক হাসিমুখে সহ্য করছে। বড় চাচা ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে বলছেন, ইউ আর এ ফ্ৰড নাম্বার ওয়ান। এ থিফ। খবদার, এখানে আর আসবি না।
সন্যাসী বলছে, রাগারাগি করাটা আপনার স্বাস্থ্যের জন্যে মঙ্গলজনক হবে না। তাছাড়া তুই-তোকারি ভালো শুনাচ্ছে না, সবার মুখে তো সবকিছু মানায় না।
বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।
যাচ্ছি, আপনি দয়া করে এত উত্তেজিত হবেন না।
আবার কথা বলে।
আপনি বলেন বলেই বলি। আপনি না বললে বলতাম না। ধ্বনি হলেই প্ৰতিধ্বনি হয়।
খবৰ্দার ব্যাটা, বড় বড় কথা বলবি না। বড় বড় কথা তোরচে আমি বেশি বলতে পারি।
সে তো খুবই আনন্দের কথা। আপনি বলুন, আমি শুনি।
তোকে ধরে একটা আছাড় দেব ব্যাটা ফ্ৰড।
আপনার পক্ষে সেটা সম্ভব হবে না। আমার ওজন অনেক।
চুপ! চুপ।
আপনি চুপ করলেই চুপ করব। আমি আগেই বলেছি ধ্বনি হলেই প্রতিধ্বনি হবে।
চুপ! চুপ।
কথোপকথনের পুরো অংশটি আমরা বসার ঘরে ঢোকার আগে আগে শুনলাম, চাচী হতভম্ব গলায় বললেন, তোর চাচা কার সঙ্গে এরকম চেঁচামেচি করছে? লোকটা কে?
লোকটা এক জন সন্ন্যাসী-নাম ভোলাবাবু।
তোর চাচা সন্ন্যাসী নিয়ে কী করছে? হচ্ছে কী এসব? আমার তো মাথায় কিছু ঢুকছে না।
চাচী চোখে-মুখে হতভম্ব ভাব নিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন এবং বড় চাচাকে বললেন, এই, তুমি চেচা কেন?
বড় চাচা গলা আরো চড়িয়ে বললেন, তুমি ভেতরে যাও। চাচী আরো হকচকিয়ে গেলেন। তিনি আহত গলায় বললেন, তুমি ঝগড়া করছ কেন?
চাচা থমথমে গলায় বললেন, ভূত দেখাবার নাম করে ব্যাটা সারারাত আমাকে জাগিয়ে রেখেছে। এখন বড় বড় কথা বলে। আমি এত সহজে ছাড়ার লোক না। স্ক্র কী ভাবে টাইট দিতে হয়, আমি জানি। আমাকে ব্লাফ দেয়, কত বড় সাহস!
চাচী বললেন, ভূত দেখাবার কথা তুমি কী বলছ? ভূত দেখা মানে? ভূত দেখা যায় না কি?
কি মুশকিল। ভেতরে যেতে বললাম না? কানে শুনতে পাও না!
চাচী আহত এবং অপমানিত হয়ে ভেতরে ঢুকলেন। অন্যবারের মতো এবার আর তাঁকে দেখে কেউ ছুটে এল না। মীরা-ইরা এসে জড়িয়ে ধরল না। চাচী বললেন, বাসায় কেউ নাই নাকি?
আমি বললাম, থাকার তো কথা। সবাই বোধহয় দোতলায় আছে। চলুন দোতলায় চলে যাই।
আমি এখন সিঁড়ি ভাঙতে পারব না। তুই সবাইকে ডেকে আন। আর তোর বড় চাচাকেও আসতে বল….। চাচীর কথা শেষ হবার আগেই সিঁড়ি দিয়ে সমিতাকে নামতে দেখা গেল। তার পিছু পিছু নামলেন ছোট চাচা। তিনি সিঁড়ি থেকে বললেন, ভাবী, ভালো আছেন? খুব একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি, পরে আপনার সাথে কথা বলব।
চাচী অবাক হয়ে সমিতার দিকে তাকিয়ে আছেন। তারা চলে যাবার পর তিনি ক্ষীণ স্বরে বললেন, এই কি সেই মেয়ে?
হ্যাঁ।
কদিন হল এ বাড়িতে আছে?
দিন সাতেক।
লজ্জা-শরম দেখি মেয়েটার একেবারেই নেই। এই বাড়িতে এসে উঠল?
স্বামীর বাড়িতে উঠতে অসুবিধা কি? স্বামীর বাড়িতে উঠতে লজ্জা নেই।
স্বামীর বাড়ি? স্বামীর বাড়ি মানে? বিয়ে হয়েছে নাকি? বিয়ের কথা তো কেউ কিছু লিখে নি।
অনেক কিছুই কেউ আপনাকে জানায় নি। এখন জানবেন।
আমি দোতলায় লোকজনের খোঁজে গেলাম। কাউকে পেলাম না। মীরা গেছে তার কোন ক্লাসফ্লেন্ডের কাছ থেকে নোট আনতে। ইরা গেছে তার সঙ্গে। বড় চাচীর মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গেল। তিনি কাঁদে কাঁদো গলায় বললেন, সবাই জানে আজ আমি আসছি। তারপরও কেউ বাসায় নেই। এ বাড়িতে হচ্ছে কী? আমি সহজ স্বরে বললাম, অনেক দিন আপনি এ বাড়িতে থাকেন না, কাজেই এ বাড়ির নিয়ম-কানুন এখন কী তা জানেন না। জানলে এত অবাক হতেন না। হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম করুন। আমি চা দিতে বলি।
আগে তুই তোর বড় চাচাকে ডেকে আন। এক্ষুনি আন। বলবি খুব জরুরি।
তাঁকে পাওয়া গেল না। জানা গেল সন্ন্যাসী ভোলাবাবুর সঙ্গে বের হয়ে গেছেন। এতদিন পর স্ত্রী বাইরে থেকে ফিরেছে অথচ তিনি একটা মুখের কথা বলার জন্যেও ভেতরে আসেন নি।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সত্যি সত্যি বড় চাচীর চোখে পানি এসে গেল। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, তোরা সব ইচ্ছে করে আমাকে অপমান করছিস, তাই না? কী কী করবি সব আগে থেকে ঠিক করা। যুক্তি করে মীরাইরা বাইরে চলে গেছে। একটা লোককে সন্ন্যাসী সাজিয়ে বসিয়ে রেখেছিস যাতে আমি ঘরে ঢোকামাত্র তোরা একটা ঝগড়া শুরু করতে পারিস। তার চাচাও আমার সঙ্গে কথা না বলে বের হয়ে গেল। আমি বোকা, তবে এটা না বোঝার মতো বোকা আমি নই।
তিনি প্রায় শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। দেশ-বিদেশ ঘুরলেও বাঙালি মেয়েরা ঠিক আধুনিক কখননী হয়ে উঠতে পারে না। কাঁদার সামান্য সুযোগ পেলেও তা গ্রহণ করে। চাচী ৰাইরের কাপড় না বদলেই উপরে গিয়ে শুয়ে রইলেন। মাঝে মাঝে অস্ফুট গলায় বলতে লাগলেন, কী হচ্ছে? এ বাড়িতে এসব কী হচ্ছে?
এ বাড়িতে কী যে হচ্ছে, তা তিনি পুরোপুরি জানলেন সন্ধ্যার পর পারিবারিক বৈঠকে। তিনি জানলেন যে, এ বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্যে ছোট চাচী উকিল নোটিস পাঠিয়েছেন। কারণ বাড়িটা তাঁর নামে দলিলপত্র করা। তিনি আরো জানলেন যে, টেলিফোনে ছট চাচাকে নানান ধরনের হুমকি দেয়া হচ্ছে। ছোট চাচীর বাবা জাজ সাহেব কিছু গুণ্ডাপাণ্ডাও লাগিয়েছেন যারা একদুপুরে ছোট চাচার গাড়ির কাচ ভেঙে দিয়ে গেছে। একদিন সন্ধ্যায় দুজন শুটকো মত লোক ছোট চাচার চেম্বারে ঢুকে বলে গেছে, এই যে চোখের ডাক্তার, চোখ দুটো গেলে দিলে কেমন লাগবে, বলেন দেখি? একদিন এসে দুটো চোখ গেলে দিয়ে যাব।
জাজ সাহেবের মতো গোলাপপ্রেমিক লোক এরকম গুণ্ডা লাগাবেন, তা ভাবা যায় না। তবে তিনি যে লাগিয়েছেন তা বোঝা গেল মঙ্গলবার রাত নটার দিকে। পুরো ব্যাপারটা ঘটল আমার চোখের সামনে। আমি বাড়ির সামনের ফুটপাতে সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছি, হঠাৎ দেখি রোগা একটা ছেলে মোটর বাইক নিয়ে গেটের কাছে এল। এক পলকের জন্যে থেমে ঝড়ের বেগে বাইক নিয়ে চলে গেল, পর মুহূর্তেই বিকট আওয়াজ। তখনো বুঝতে পারে নি যে, এই মোটর বাইকওয়ালা ছেলেটা একটা বোমা ফাটিয়ে গেছে। এই বোমায় আমাদের কারোর কিছু হল না—ছোট চাচার গাড়ির ড্রাইভার কুদ্দুসের বাঁ পা উড়ে গেল। কুদ্দুস এমন অবস্থায়ও জ্ঞান হারাল না। শীতল গলায় বলল, ভাইজান, আমারে হাসপাতালে নেন। হাসপাতালেও কুদ্সের জ্ঞান বজায় রইল। অথচ বড় চাচী সেই যে বোমার শব্দে জ্ঞান হারালেন তা ফিরে পেলেন পরদিন ভোর ছটায়। জ্ঞান পাবার পর জানতে পারলেন কুদ্দুস মারা গেছে।
আমরা বড় সমস্যায় পড়ে গেলাম। কুদ্সের আত্মীয়স্বজনের কারোর কোনো ঠিকানা আমরা জানি না। কুদ্স একবার বলেছিল, তার দেশ চাঁদপুর। সে প্রতি দুমাস পর তিন দিনের ছুটিতে চাঁদপুরে যায়, সঙ্গে ছোট ছোট শার্ট-প্যান্ট থাকে। এই শার্টপ্যান্ট কি তার ছেলেদের জন্যে? কত বড় তারা—আমরা তার কিছুই জানি না।
কুদ্দুস যে ঘরে থাকতো, সেখানে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পাওয়া গেল না। এক জন মানুষ কোনো রকম ঠিকানা না রেখে ঠিকানাবিহীন এক দেশের দিকে রওনা হল।
কুদ্দুসের ডেডবডি নিয়ে আমরা মহাযন্ত্রণায় পড়লাম। সাধারণ মৃত্যুতেই অনেক সমস্যা, অপঘাতে মৃত্যু মানে—অতলান্তিক সমুদ্র। পোস্টমর্টেম হবে, পুলিশী তদন্ত হবে, কেইস ফাইল হবে, পত্রিকার লোকজনও নিশ্চয়ই আসবে। এই জাতীয় মৃত্যুগুলো সম্পর্কে পত্রিকাওয়ালাদের আগ্রহ সীমাহীন। হত্যা, পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ভেতরকার কথা, ঘাতক বোমা, পুলিশ নীরব।
এই রকম কোনো মৃত্যু ঘটা মানে জলের মতো টাকা যাওয়া। সবাইকে টাকা খাওয়াতে হয়। পান খাবার জন্যে সবাই কিছু-না-কিছু পাবে। এখন কথা হচ্ছে কুদ্সের জন্য এত ঝামেলা আমরা করব, কি করব না। তবে টাকাওয়ালা মানুষের জন্যে কোনো ঝামেলাই ঝামেলা না। আমরা নাসিমুদ্দিন নামে আমাদের দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়কে খবর দিলাম। তিনি অফিস ফেলে তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হলেন। মুখভর্তি পান। হাসি হাসি ভাব। যেন এই ঝালেমায় খুব আনন্দ পাচ্ছেন।
এই জাতীয় চরিত্রের সংখ্যা আমাদের সমাজে প্রচুর। এঁরা হচ্ছেন সমস্যা-বিশারদ। বিস্তর লোকজনকে তাঁরা চেনেন। কার কাছে গেলে কোন কাজটা হয়, তা এঁদের নখদর্পণে। পুলিশের লোক, মন্ত্রীর পি. এ.-দের সঙ্গেও তাঁদের মাখামাখি থাকে। চব্বিশ ঘন্টার নোটিসে এরা পাসপোর্ট বের করতে পারেন। কেউ হয়ত বিদেশ থেকে প্রচুর মালামাল নিয়ে আসছে, তাঁকে খবর দিলে তিনি এমন ব্যবস্থা করবেন যে, কাস্টমসের লোকজন ব্যাগ না খুলেই চক দিয়ে ক্রসচিহ্ন দিয়ে দেবে। হাউস বিল্ডিং-এর লোন কী করে পেতে হয় তাও তাঁরা খুব ভালো করে জানেন।
নাসিমুদ্দিন মামা ঘরে পা দিয়েই বললেন, চিন্তার কিছু দেখছি না। আগে চা নিয়ে আস, চা খেয়ে মাথা ঠাণ্ডা করি টেলিফোন ঠিক আছে? গোটাদশেক টেলিফোন করতে হবে।
আমরা সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আর ভয় নেই, এবার ব্যবস্থা হবেই। নাসিমুদ্দিন মামা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, হাজার তিনেক টাকার ব্যবস্থা করেন, ছোট নোট। এর আত্মীয়স্বজনের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?
বাবা বললেন, না। চায়ের দোকানের এক ছেলে বলল, কুমিল্লানবীনগরে বাড়ি। আগে শুনেছিলাম চাঁদপুর।
লোকাল কাউকে খুজে বের করতে হবে। এই লাশ নবীনগরে কে নিয়ে যাবে? দেখি কোনো খোঁজ করতে পারি কি-না। চায়ের দোকান, সিগারেটের দোকান এইসব জায়গায় খোঁজ করতে হবে। আশপাশের লন্ড্রিতে পাত্তা লাগাতে হবে। দেখি কী করা যায়।
নাসিমুদ্দিন মামা অসাধ্য সাধন করলেন। খোঁজ বের করলেন, এসি দাস রোডের এক মেসে কুদ্সের চাচাতো ভাই থাকে। সেও ড্রাইভার। ট্রাক চালায়। ছাই ফেলতে ভাঙাকুলা—আমাকে বলা হল কুদ্দুসের ভাইয়ের সন্ধানে যেতে।
সিনেমাতে ডাকাতদলের গোপন আড়া যে রকম থাকে, সেটা অবিকল সে রকম। পয়সা দিয়ে তাস খেলা হচ্ছে। বিড়ির উৎকট গন্ধে কাছে যাওয়ার উপায় নেই। তারা দুপুরের খাবার শেষ করে তা নিয়ে বসেছে। ময়লা থালাবাসন উঠিয়ে নেওয়া হয় নি। বড় বড় নীল মাছি ভভ করছে। তাস খেলোয়াড়রা আমার দিকে খুবই সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাল। কুদ্দুসের ভাইটির কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল, কী জন্যে দরকার?
দরকারের বিষয়টা ভেঙে বলার পরও সন্দেহ যায় না। একজন জিজ্ঞেস করল, ভাইজান, আফনে কী করেন? ছাত্ৰ শোনার পর তার সন্দেহ আরো বেড়ে গেল। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কুদ্দুসের ভাই এখানে থাকে কী থাকে না, এটা বলতে অসুবিধা আছে?
থাকে। এইখানেই থাকে।
এখন কোথায়?
ট্রিপে গেছে।
কোথায় গেছে? কখন আসবে?
তা তো ভাইজান বলতে পারি না। গেছে বগুড়া। আরিচাঘাটে আটকা পড়লে সাত দিনের মামলা। আর আটকা না পড়লে ধরেন তিনদিন।
আমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে বের হয়ে এলাম। দায়িত্ব পালন করা হয়েছে। এখন আর কেউ বলতে পারবেনা—আমরা খোঁজ-খবর করি নি। কুদ্সের আত্মীয়স্বজন কেউ এলে বলা যাবে যে, চেষ্টার ত্রুটি হয় নি।
বাসায় ফিরে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। ছোট চাচীর বাবা গোলাপপ্রেমিক জাজ সাহেব এসেছেন। তাঁকে খাতির করে চা দেয়া হয়েছে। তাঁর সঙ্গে বড় চাচা এবং বড় চাচী আছেন। কথা বলছেন নিচু গলায়। তাদের চোখ-মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বেশ আন্তরিক আলাপ হচ্ছে। এরকম তো হবার কথা না। রহস্যটা কি?
মাকে গিয়ে বললাম, ব্যাপার কিছু জান মা? মিলমিশ হয়ে গেছে না-কি?
মা বললেন, বুঝতে পারছি না। শুনলাম তোর ছোট চাচা নাকী ঐ বাড়িতে টেলিফোন করেছিল।
কখন?
দুপুরে। জাজ সাহেব টেলিফোন পেয়েই এসেছেন।
ছোট চাচা কোথায়?
জানি না।
আমাদের নার্স চাচী? সেও নেই।
দুজনের কেউ নেই।
দুপুরে বাড়িতে কিছু রান্না হয় নি। মরা-বাড়িতে আগুন ধরাতে নেই, এরকম একটা নিয়ম না-কি আছে। হোটেল থেকে আনা খাবার সবাই খেয়েছে। শুধু বড় চাচী খান নি। চোখের সামনে একটা ডেডবডি নিয়ে তিনি সলিড কিছু খেতে পারবেন না। একটা পেপসি এনে খেয়েছেন। সেই পেপসিও বমি করে ফেলে দিয়েছেন।
ডেডবডি রাখা হয়েছে কুদ্সের ঘরে। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। একটা বড় প্যাকিং বক্সে বরফ দিয়ে রাখা হয়েছে। সেই বরফ গলে পানি চুইয়ে আসছে। বাড়ির সামনে পাড়ার ছেলেপুলেদের ভিড়। পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর বারান্দায় বসে আছেন। তাঁর চোখে সানগ্লাস। এই ভদ্রলোক কথা বলছেন বাবার সঙ্গে। পুলিশের সঙ্গে সবাই মোটামুটি মধুর স্বরে কথা বলে। পুলিশের সঙ্গে কথা বলার সময় অতি বুদ্ধিমান লোকের মুখেও বোকা-বোকা একটা ভাব চলে আসে। আশ্চর্যের ব্যাপার, বাবার মধ্যে তা দেখলাম না, বরং মনে হল তিনি ঝগড়ার সুরে কথা বলছেন।
আপনাদের এইসব নিয়ম-কানুনের মানেটা কী দয়া করে বলুন তো? চাক্ষুষ সাক্ষী-প্রমাণ আছে, বোমা ফেটে লোকটা মারা গেছে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ডাক্তাররা ডেথ সার্টিফিকেটেও এই কথা লিখে দিয়েছেন। এরপর আবার পোস্টমর্টেম কী? এতগুলো মানুষের সাক্ষী-প্রমাণ আপনাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না?
জ্বি না। আপনারা মিথ্যা বলতে পারেন।
নাড়িভুঁড়ি কেটে ডাক্তার যা বলবে, সেটাই সত্যি? ঐ ডাক্তার মিথ্যা বলতে পারে না?
অবশ্যই পারেন। মাঝে মাঝে তাঁরাও মিথ্যা বলেন। তবু নিয়ম বলে একটা কথা।
এইসব নিয়ম তুলে দেন না কেন?
নিয়মগুলো ভালো, মানুষ হচ্ছে খারাপ। মানুষ ভালো হলে এইসব নিয়মকানুনের দরকার ছিল না।
শেষ পর্যন্ত পোস্টমর্টেম করাতে হল না। নাসিমুদ্দিন মামা সমস্ত ঝামেলা চুকিয়ে হাসিমুখে বাড়িতে ঢুকে বললেন, আরো তিনশ কুড়ি টাকা দরকার। নিজের পকেট থেকে চলে গেছে। এখন কবর কোথায় হবে সেটা বলেন, এইখানেও টাকার ব্যাপার আছে।
সমস্ত দিন আমার উপর খুব ধকল গিয়েছে। বিছানায় গিয়ে একটু শুয়েছি, ওমি ঘুমে চোখ জড়িয়ে গেল। শুধু ঘুম না, ঘুমের সঙ্গে স্বও দেখে ফেললাম। স্বপুটা কুদ্দুসকে নিয়ে। স্বপ্নের মধ্যে কুদ্দুস বেঁচে আছে। আমাকে এসে বলল, ছোট মামা এগারটা টাকা দিতে পারবেন? এগারটা টাকা শর্ট পড়েছে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি আমাকে মামা ডাকছ কেন কুদ্দুস? আমাকে না। সব সময়ই ভাই ডাকতে?
কিছু মনে করবেন না ভাইজান, ভুল হয়ে গেছে টাকার অভাবে মাথা ঠিক নেই। কী বলতে কী বলি। শেষ সময়ে এগারটা টাকা শর্ট পড়ল।
আরেকটা কথা কুদ্দুস, তুমি না মারা গেছ। তাহলে কথা বলছ কী করে?
স্বপ্নের এই পর্যায়ে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি মাথার কাছে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। আমার গাঝাঁকাচ্ছেন। বাবাবললেন,তোর একটু নবীনগর যাওয়া লাগে। কুদ্দুসের বৌছেলেমেয়ে আছে, এদের শেষ দেখা দেখানো দরকার।
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, এখন নবীনগর যাব?
হ্যাঁ। তুই একা যাবি না। তোর সঙ্গে ভোলাবাবুও যাবে। ভাগ্য ভালো, হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছে। নিজে থেকেই সঙ্গে যেতে রাজি হল।
যাব কিভাবে?
বিছানায় শুয়ে শুয়ে কথা বলছিস কেন? এটা আবার কোন দেশি ভদ্রতা? আর ঘুমটাই বা তোর এল কীভাবে? এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে, বাড়িতে ডেডবডি।
আমি বাবার সঙ্গে একতলায় নেমে এলাম। কুমিল্লা যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। বেশ আলোব্যবস্থা। কুদ্দুসের ভাই এসেছে। তার বগুড়া যাওয়া হয় নি। আরিচাঘাটে গণ্ডগোল হওয়ায় ফিরে এসেছে। ফিরে এসে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে কোত্থেকে যেন একটা ট্রাক যোগাড় করেছে।
ডেডবডি ট্রাকে তোলা হয়েছে। ভোলাবাবুও ডেডবডির সঙ্গে ট্রাকের পেছনে বসে আছেন। আমাকে হাত ইশারা করে ডাকলেন। কাছে যেতে বললেন, ড্রাইভারের সঙ্গে বসে কী করবেন? পেছনে চলে আসেন, হাওয়া খেতে খেতে যাব। সিনসিনারি দেখব। আমি পেছনেই উঠলাম। ট্রাক ছাড়ল সন্ধ্যার আগে আগে। ভোলাবাবু বললেন, পেছনে উঠার একটাই অসুবিধা, সিগারেট খেয়ে আরাম পাওয়া যায় না।
আমি কিছু বললাম না। ভোলাবাবু বললেন, কিছু চিন্তা করছেন নাকি ভাইজান?
জ্বি না।
মানুষ কখন কোথায় থাকবে বলা খুব মুশকিল। আমি এই বাড়িতে এসেছিলাম কী জন্যে জানেন? বড় সাহেবের কাছ থেকে টাকা ধার করতে। একটা লুঙ্গি কিব। এগারটা টাকা শর্ট পড়ে গেল। ভাবলাম, বড় সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে আসি। এসে দেখি এই ব্যাপার।
কত টাকা শর্ট পড়েছে বললেন?
এগার টাকা।
আমি অবাক হয়ে সন্ন্যাসীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এগার টাকার কথা বলছে কেন? স্বপ্নেও আমি কি ঠিক এই দৃশ্যই দেখি নি? স্বপ্নেও তো কুদ্দুস এ রকম ফতুয়ার মতো একটা পোশাক পরে এসে বলেছিল, ভাইজান, এগারটা টাকা শর্ট পড়ে গেছে। ব্যাপারটা কি সম্পূর্ণ কাকতালীয়? আর কিছুই কি এর মধ্যে নেই?
ভাইজান, কী ভাবেন?
কিছু ভাবি না। ভাবনের কিছু নাই। এই মানুষটা মরে আপনাদের খুব সুবিধা করে দিয়ে গেল। এখন দেখবেন আর কোন চিন্তা নাই।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
এখন মিলমিশ হয়ে যাবে। কুমিল্লার কাজ শেষ করে ঢাকায় যখন ফিরবেন, দেখবেন সব ঠাণ্ডা। আপনার হোট চাচী ফিরে আসছেন। তাঁর অসুখও আর নাই। মাঝখান থেকে এই বেচারা শেষ।
এইগুলো কি আপনার ভবিষ্যদ্বাণী?
জ্বি।
ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক হয়?
জ্বি হয়।
ভাইজানের সঙ্গে কি সিগারেট আছে?
আছে।
আমি সিগারেট বের করে দিলাম। ভোলাবাবু সিগারেট রাতে ধরাতে বললেন, মানুষ যখন বলে হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা, তখন খুব মজা লাগে ভাইজান। মনেমনে হাসি আর বলি, তুমি কী করব? তোমার কি করার কোন ক্ষমতা আছে? ফালাফালি কইরা তো লাভ নাই। কী কন ভাইজান?
তা তো ঠিকই।
একটা শ্যামা সঙ্গীত শুনবেন ভাইজান?
না, থাক।
আচ্ছা থাক।
থাক বলেও গুনগুন করে ভোলাবাবু কী যেন গাইতে লাগলেন। আমার ঘুম পেতে লাগল। কুদ্দুসের বাড়ি পৌঁছলাম গভীর রাতে, আধো-ঘুম ও আধো-জাগরণে।
আকাশে চাঁদ। জ্যোত্সা ঢাকা গ্রাম। অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ। এক জন বুড়োমানুষ লণ্ঠন হাতে বের হয়ে এলেন এবং অবাক হয়ে বললেন, আপনারা কারা বাবাসগল?