মনোবল
মেয়েটির নাম আলো।এখন ওর বয়স ঊনত্রিশ। একটা ফুটফুটে ছয় বছরের সন্তানের মা। আলো আজ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে একা ছেলে সুমনকে মানুষ করছে। বি.বি. সি চ্যানেলে আংক্যারিন করছে। নামকরা চিত্রশিল্পী।নানান বিজ্ঞাপনে আলো আলোকিত করছে।
আলোর বিছানা ,শোয়া ,বসা,কর্মক্ষেত্র, স্থানান্তর ,সব একমাত্র সাথী তার হুইল চেয়ার।
আলোর জন্ম থেকে হুইল চেয়ার সাথী নয়।আলোর আলো পুরোপুরি নিভে গিয়েও আজ ও নানা সংগ্রাম করে বহাল তবিয়তে আলো জ্বালিয়ে জ্বলজ্বল করছে।
আলোর রক্ষনশীল পরিবারে জন্ম।ঠাকুমা,দাদু আলোর বাবাকে বলে মেয়ের তো আঠার বছর হল,এবার বিয়ে দাও। মা আলোকে বলে শোনো মা,ভাল ছেলে মেয়েরা বড়দের অবাধ্য হয় না।বিয়ে করার কথা দাদু বলছেন ,তুমি রাজী নিশ্চয়।ঐ যে ভাল মেয়ে তাই আলো রাজী হয়ে যায়।ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে বিয়ে হয়। কলেজে ভর্তিও হয়েছিল। সময় ভালই কাটছিল বরের সাথে। শ্বশুরবাড়ি তে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। বরঞ্চ বাপের বাড়িতে অনেক নিষেধ ছিল।
কুড়ি বছরের জন্মদিনে , আলো বরের সাথে গাড়ি নিয়ে অনেক দূর রেস্তোরাঁয় খেয়ে বাড়ি ফিরছিল, তখন গাড়িটা একটা খাদে পড়ে যায়।সম্ভবত আলোর স্বামী গাড়ি চালানোর সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল।পড়বার মূহূর্তে ওর স্বামী গাড়ির দরজা খুলে ঝাঁপ দেয়।তাই মলয় বেঁচে গিয়েছিল।তারপর লোকজন এসে গাড়ি থেকে উদ্ধার করে আলোকে।হাসপাতালে নেয়ে যাওয়া হয়।মৃত্যুর সাথে আড়াই বছর যুদ্ধ করে।প্রথম দিন যখন ডাঃ দেখেন আলোকে ,ডঃ জানান মেরুদন্ড, গলা,বামহাতের রেডিয়াস, ,আলনা ,কবজি সব ভেঙে গেছে,আলো কোনদিন হয়ত হাঁটতে পারবে না। আলো ঘাড় নাড়ে,মেনে নেয়।
দ্বিতীয় দিন ডাঃ বলেন আলো কোন বাড়ির গৃহবধূ র যা কর্তব্য ,তা পালন করতে পারবে না।আলো আঁকতে চাইলেও ,সারাক্ষণ বসে থেকে আঁকতে পারবেনা। আলো সেটাও মন দিয়ে শোনে। বুঝে যায়,তাকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হবে।
তৃতীয় দিন আলোকে ডাঃ জানায় যেটা ,আলো মা হতে পারবে না। ঐ দিন আলো ভেঙে পরে। তাহলে কি নিয়ে বাঁচবে।
প্রায় আড়াই বছর ধরে হাসপাতালে থাকতে থাকতে,হাসপাতালের সাদা দেওয়াল দেখে অসহ্য লাগছিল আলোর। ভাইকে রঙ তুলি এনে দিতে বলে। তারপর আলো যে ছবিটা এঁকেছিল, সবাই রঙিন ছবি দেখে বাহবা দিয়েছিল। কিন্তু ছবিটার মধ্যে আলোর কষ্ট বেদনা পরিস্ফূটিত হয়েছিল।
হাসপাতালে অনেক ছবি আঁকে। তখন শুয়ে শুয়ে চিন্তা করেছিল ,প্রথমে বরকে ডির্ভোস করাতে রাজী করতে পারবে কিনা।বরের বিয়েতে প্রথম শুভেচ্ছা ওই পাঠাবে।অবশ্য
বাড়ি ফিরে তাই করেছিল। বাচ্চা তো দত্তক নেওয়া যায়। মাসদুয়েক বাদে দুই বছরের ছেলে পায়। ঐ শিশুটির ছোঁয়ায় প্রথম মাতৃত্বের স্পর্শ পায়। তারপর ছবি আঁকা, নানা টি.ভি চ্যানেলে কাজ করে। সব কিন্তু ঐ হুইল চেয়ারে। আলো আজ ও একা ছয় বছরে ছেলেকে নিয়ে জ্বলছে। আজ বিশ্ব আলোকে খুঁজে নিয়েছে।
তার এই লড়ে যাবার ঘটনা পৃথিবীর সব হেরে যাওয়া মানুষকে আশা রাখি অনুপ্রাণিত করবে।
আলোর মত শক্ত মনোবল মেয়েরা নানান দুর্ঘটনায় সব হারিয়েও, দত্তক ছেলের ছয়বছরের জন্মদিনে চিৎকার করে গান করে বাড়ি মাতিয়ে রাখে…
আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা……শুভ জন্মদিন সুমন….বেলুন ওড়ায়,কেক কাটে..কত কত বন্ধু নিয়ে হইচই করতে পারে।মনোবল আনুন,কেউ ফুরিয়ে যাবেন না,বাঁচতে শিখুন,হাসুন ,আনন্দ করুন।(পাকিস্তানের এক মহিলার জীবন কাহেনী অবলম্বনে)