হরিণগড়ের রাজা গোবিন্দনারায়ণ
হরিণগড়ের রাজা গোবিন্দনারায়ণ সন্ধেবেলা আহ্নিক সেরে জলযোগ করছেন। মস্ত বড় এক শ্বেতপাথরের টেবিলের ওপর রুপোর থালায় ডাঁই করে কাটা শশা দেওয়া হয়েছে। গোবিন্দনারায়ণ সোনার চামচ দিয়ে শশা মুখে তুলে কচমচ করে চিবোচ্ছেন। মুখে একটা তৃপ্তির ভাব।
টেবিলের অন্য ধারে গোবিন্দনারায়ণের ভাগনে কৌস্তভনারায়ণ বসে মামার শশা খাওয়া দেখছে। গোবিন্দনারায়ণের মতো শশাখোর লোক কৌস্তভ আর দেখেনি। একটা মানুষ একা যে কত শশা খেতে পারে, তা হরিণগড়ে এসে রাজা গোবিন্দনারায়ণকে
দেখলে বোঝা যায় না। কৌস্তভ অবশ্য মামার শশা খাওয়া দেখতেই যে এসে বসে থাকে তা নয়। তার অন্য মতলব আছে। মামার নিরুদ্দেশ ছেলে কন্দর্পনারায়ণ যদি আর ফিরে না আসে, তবে মামার বিষয়সম্পত্তি সব সেই পাবে। সেই আশায় কৌস্তভ প্রায়ই আনাগোনা করে। চারদিকে ঘুরঘুর করে মামার বিষয়সম্পত্তি কত তা বুঝবার চেষ্টা করে।
পঁয়তাল্লিশটা শশার টুকরো খাওয়ার পর গোবিন্দনারায়ণ একটা পেল্লায় ঢেকুর তুলে একটু দম নেওয়ার জন্য চামচটা রাখলেন। পেটের মধ্যে জায়গা করার জন্য উঠে একটু পায়চারি করতে লাগলেন।
কৌস্তভ সুযোগ বুঝে খুব সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করল, “মামাবাবু, কন্দর্পর কোনও খবর পেলেন?”
গোবিন্দনারায়ণ তাঁর ভাগনেটিকে বিশেষ পছন্দ করেন না। ভাগনে কৌস্তভ বলে নয়, আসলে তিনি কোনও আত্মীয়স্বজনকেই ভাল চোখে দেখেন না। তার কারণ, আত্মীয়স্বজন এলেই তাদের সঙ্গে নানারকম লৌকিকতা করতে হয়। ভাল-মন্দ খাওয়াও রে, ধারকর্জ দাও রে, গরিব বলে সাহায্য করো রে, পালা-পার্বণে জামাকাপড় দাও রে।
রাজা গোবিন্দনারায়ণ বড় কৃপণ মানুষ। তিনি নিজে কখনও প্রাণে ধরে ভাল-মন্দ খান না, কাউকে খাওয়াতে ভালবাসেন না। রাজা হয়েও তিনি ছেঁড়া জামাকাপড় সেলাই করে পরেন। বাবুগিরি তিনি দু চক্ষে দেখতে পারেন না। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শখ হল অবসর সময়ে আপনমনে টাকা গোনা। রাজবাড়ির গুপ্ত কুঠুরিতে লোহার সিন্দুক থেকে টাকা বের করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোনেন। শোনা যায়, এক টাকার নোটে আর খুচরো পয়সায় দশ বিশ হাজার টাকা কয়েক ঘণ্টায় গুনে ফেলতে পারেন। কিন্তু সে সব টাকা কেবল গোনার জন্যই।
ভাগনে কৌস্তভের দোষ হল সে সবসময়ে এক পেট খিদে নিয়ে মামাবাড়িতে আসে। এসেই মামি বা দিদিমার কাছে গিয়ে বলে, “ওঃ, যা একখানা খিদে পেয়েছে না, দশটা চাষার ভাত একাই খেতে পারি এখন।”
তা পারেও কৌস্তভ। চেহারাটা রোগা-রোগা হলেও খেতে বসলে তাজ্জব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। একবার আশিটা কৈ মাছ খেয়েছিল, অন্যবার বাহাত্তরটা রাজভোগ। সেসব ভাবলে। কৌস্তভকে দেখে গোবিন্দনারায়ণের খুশি হওয়ার কথা নয়।
প্রশ্ন শুনে গোবিন্দনারায়ণ বললেন, “না। অন্ধকার হয়ে এল কস্তু, বাড়ি যাবি না?”
কৌস্তভ ঘড়ি দেখে বলল, “রাত আর কই হল! শীতের বেলা বলে আলো চলে গেছে। এই তো পৌনে ছটা মাত্র। তা মামাবাবু, কন্দর্পকে খোঁজার জন্য আপনি নাকি গোয়েন্দা লাগিয়েছেন?”
“সে আমি লাগাইনি। গুচ্ছের টাকার শ্রাদ্ধ। গোয়েন্দা লাগিয়েছে তোর মামি। মর্কট গোয়েন্দাটা নাকি পাঁচশো টাকা করে নেবে ফি মাসে। শুনে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। আমি স্রেফ বলে দিয়েছি, আগে খুঁজে বের করো, তারপর টাকাপয়সার কথা হবে। কস্তু, আজ বড় ঠাণ্ডা পড়বে রে, এই বেলা না হয়। দুগা-দুগা বলে বেরিয়ে পড়।”
কৌস্তভ বিরক্ত হয়ে বলে, “বেরোতে বললেই কি বেরোনো যায়! আজ মামিকে বলেছি গাওয়া ঘিয়ের লুচি খাব। মামি রাজি হয়েছে।”
গোবিন্দনারায়ণ আঁতকে উঠে বললেন, “ও বাবা রে!”
কৌস্তভ তাড়াতাড়ি উঠে বলল, “কী হল মামাবাবু, কিছু কামড়াল নাকি?”
“না বাবা, কামড়ায়নি। গাওয়া ঘি কত করে দর যাচ্ছে বল তো?”
“ওঃ। কত আর হবে! বেশি নয়।”
“তোদের আর কী! যার যাচ্ছে তার যাচ্ছে। তা যা, বরং তোর মামির কাছেই গিয়ে বোস গে।”
এই বলে গোবিন্দনারায়ণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার শশার থালার সামনে বসলেন। কৌস্তভ বিরক্ত হয়ে উঠে গেল। কিন্তু রাজা গোবিন্দনারায়ণের আর শশা খেতে ইচ্ছে করল না। ‘গাওয়া ঘিয়ের লুচি’ বাক্যটা তার মনের মধ্যে মশার মতো পন্ন্ পন্ করে উড়তে থাকে, আর মাঝে-মাঝে কুটুস করে কামড়ায়। বড্ড অস্বস্তি।
মন খারাপ হলে গোবিন্দনারায়ণ সোজা মাটির নীচের চোর কুঠুরিতে গিয়ে সিন্দুক খুলে টাকা গুনতে বসে যান। মন যদি অল্প খারাপ হয় তবে হাজার পাঁচ-সাত নোট গুনলেই আস্তে আস্তে মনটা ভাল হয়ে ওঠে। বেশি মন খারাপ হলে কখনও দশ বিশ ত্রিশ হাজারও গুনতে হয়। আজকে ‘গাওয়া ঘিয়ের লুচি’ কথাটা ভুলবার জন্য কত হাজার গুনতে হবে তা গোবিন্দনারায়ণ বুঝতে পারছিলেন না।
মনে হচ্ছে, আজ পঞ্চাশ-ষাট হাজার নোট গুনতে হবে। সেই সঙ্গে ফাউ হিসেবে হাজার দুই টাকার খুচরো পয়সাও গুনলে কেমন হয়? পঞ্চাশ হাজার নোটে ‘গাওয়া ঘি’ কথাটা ভুলতে পারলেও ‘লুচি’ কথাটা মন থেকে তুলতে ওই দু হাজার টাকার খুচরো দরকার হতে পারে।
সে যাই হোক, রাজা গোবিন্দনারায়ণ চাবির থোলো হাতে অন্দরমহলের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। তারপর মেহগিনির পালঙ্কের নীচে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে মেঝের একটা জায়গা থেকে চৌকো একটা কাঠের পাটাতন সরালেন। গর্ত নেমে গেছে। সরু সিঁড়ি। একটা টর্চ নিয়ে গোবিন্দনারায়ণ সিঁড়ি বেয়ে সুড়ঙ্গপথে নামতে লাগলেন। হাত দশেক নামলে একটা সরু গলি। গলির গায়ে দুধারে মোট চারটে ঘর। বড় বড় মজবুত তালা ঝুলছে ঘরগুলোর লোহার দরজায়। প্রথম বাঁ হাতি ঘরটার তালা খুলে গোবিন্দনারায়ণ ঢুকে পড়ে আলো জ্বাললেন।
ছোট্ট ঘরটায় গোটা চারেক সিন্দুক রয়েছে। একটাতে একশো টাকার নোট, অন্যগুলোয় কোনওটাতে পাঁচ কোনওটাতে এক আর কোনওটায় কেবল খুচরো পয়সা।
রাজা গোবিন্দনারায়ণ আজ সব কটা সিন্দুকই খুলে ফেললেন। বাণ্ডিল বাণ্ডিল নোট হাসতে লাগল।
লোকে কাশ্মীর যায়, দার্জিলিং যায়, কন্যাকুমারিকায় গিয়ে বেড়ায়। কোথাও সূর্যোদয় দেখে, কোথাও সমুদ্র বা পাহাড় দেখে মুগ্ধ হয়, বা তীর্থে গিয়ে পুণ্য করে আসে। তেমনি এই চোর-কুঠুরিতে এলে গোবিন্দনারায়ণেরও কাশ্মীর, কুলুভ্যালি, দার্জিলিং বা কন্যাকুমারিকা দেখা হয়ে যায়। চোর কুঠুরির মতো এমন সুন্দর জায়গা দুনিয়ায় দ্বিতীয়টা নেই।
গোবিন্দনারায়ণ তাড়াহুড়ো করলেন না। মেঝেয় একটা কাঁঠাল কাঠের সিঁড়ি পেতে বসে ধীরেসুস্থে সব সিন্দুক থেকেই বাণ্ডিল বাণ্ডিল টাকা নামিয়ে মেঝেতে সাজালেন। গাওয়া ঘি থেকে শুরু করে লুচি পর্যন্ত পুরো বাক্যটা মন থেকে তুলে ফেলতে কত টাকা লাগবে তা আগেভাগে বলা মুশকিল।
দীর্ঘ দিন ধরে বার বার গোনবার ফলে নোটগুলো ভারী নেতিয়ে পড়েছে। ময়লাও হয়েছে বড় কম নয়। তা ছাড়া অনেক নোট এত পাতলা হয়ে গেছে যে একটু নাড়াচাড়া করলেই ছিঁড়ে যাবে। খুচরো পয়সাগুলোও আঙুলের ঘষা খেয়ে তেলতেলে হয়ে পড়েছে। এখন আর তাদের গায়ে লেখা অক্ষর ভাল করে বোঝাই যায় না।
গোবিন্দনারায়ণ খুব সাবধানে একটা বাণ্ডিল খুলে খুব আলতো আঙুলে টাকা গুনতে শুরু করলেন–এক…দুই…তিন…চার…
গুনতে গুনতে পাঁচশো ছশো পেরিয়ে হাজার ধরোধরা হয়ে গেল। গোবিন্দনারায়ণ চোর-কুঠুরির বন্ধ বাতাসে ঘেমে উঠছেন। একটু শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। তবু বুঝতে পারছেন তার মন থেকে ‘গাওয়া’ কথাটা প্রায় লোপাট হয়ে গেছে। এত তাড়াতাড়ি ফল পেয়ে তিনি আরও তাড়াতাড়ি টাকা গুনতে লাগলেন। বাহ্যজ্ঞান প্রায় নেই।
ঠিক এক হাজার তিনশো ছাপ্পান্নটা নোটের সময়ে একটা গলার স্বর খুব কাছ থেকে বলে উঠল, “ইস! টাকাগুলো যে একদম অচল!”
রাজা গোবিন্দনারায়ণ বীরপুরুষের বংশধর। তাঁর ঊর্ধ্বতন চতুর্থ পুরুষ মহারাজ দর্পনারায়ণ ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করেছেন। তাঁর ছেলে সম্পদনারায়ণ মস্ত শিকারি ছিলেন। গোবিন্দনারায়ণের দাদু চন্দ্রনারায়ণ ঠ্যাঙাড়েদের ঠেঙিয়ে বিলেত থেকে কী একটা খেতাব পান। আর বাবা হংসনারায়ণ তেমন। কিছু না করলেও একবার একটা চোরকে জাপটে ধরে ফেলেছিলেন বলে কথিত আছে। এই সব বীরের রক্ত গায়ে না থাকলে চোর-কুঠুরিতে দ্বিতীয় মানুষের স্বর শুনে গোবিন্দনারায়ণ ঠিক মূছ যেতেন। গেলেন না। তবে হঠাৎ ডুকরে উঠে বললেন, “ওরে বাবা রে, মেরে ফেললে রে! কে কোথায় আছিস! এসে আমাকে ধরে তোল।”
ভয়ে গোবিন্দনারায়ণ ঘাড় ঘোরাতে পারছেন না। না, আসলে তিনি তেমন ভয় পাননি, ঘাড়টাই ভয় পেয়ে শক্ত হয়ে গেছে। চোখদুটোও ভয় পেয়ে ঢাকনা ফেলে বসে আছে, খুলতে চাইছে। আর হাত পাগুলো বেয়াদপের মতো থরথর করে কাঁপছে।
গলার স্বরটা একটু কাছে এগিয়ে এসে বলল, “মহারাজ, ভয় পেলেন নাকি? ভয়ের কিছু নেই। আমি গোয়েন্দা বরদাচরণ।”
মুহূর্তে ঘাড় ঢিলে হয়ে গেল, চোখের পাতা খুলে গেল, আর গোবিন্দনারায়ণের বীরের রক্ত টগবগ করে উঠল। তিনি ধমক দিয়ে বললেন, “তুমি এখানে এলে কেমন করে, হ্যাঁ?”
বরদাচরণ খুবই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “এ আর কী দেখলেন? একবার একটা আঙুলের ছাপ খুঁজতে আলিপুরের টাঁকশালে ঢুকে গিয়েছিলাম সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। গোয়েন্দাদের সব বিদ্যে থাকা চাই।”
স্তম্ভিত গোবিন্দনারায়ণ বরদাচরণের দিকে চেয়ে বললেন, “শোনো বাপু, এই চোর-কুঠুরিতে তুমি ঢুকেছ, তার মানে তুমি রাস্তা জানো। এরপর যদি আমার এখান থেকে একটা টাকাও হারায়, তবে তোমাকে পুলিশে দেব। মনে থাকে যেন।”
“সে আর বলতে!” বলে বরদাচরণ একটু অমায়িক হেসে বললেন, “কিন্তু আপনার অত সতর্কতার প্রয়োজন কী মহারাজ? ও টাকাগুলো তো সবই মান্ধাতার আমলের। ওর তো কোনও দামই নেই।”
গোবিন্দনারায়ণ একটা শশার ঢেকুর তুলে বললেন, “বলো কি? চলবে না মানে? টাকা চলে না, এ কখনও হয়?”
বরদাচরণ গম্ভীর হয়ে বললেন, “ও-সব মান্ধাতার আমলের টাকা কবে তামাদি হয়ে গেছে। মহারাজ, আপনি কি কোনও খবর রাখেন না? সময় থাকতে যদি ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিতেন তা হলে সুদও পেতেন, টাকাটাও নষ্ট হত না।”
গোবিন্দনারায়ণ হাঁ করে খানিকক্ষণ চোর কুঠুরির দেওয়ালের দিকে চেয়ে থেকে কী যেন ভাবলেন। হঠাৎ মনে হল, তাই তো! এতকাল ধরে টাকা গুনে আসছেন গোনার নেশায়, কিন্তু কখনও তো মনে পড়েনি যে, দিন কাল পালটে গেছে, টাকাও পালটেছে।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এতক্ষণ ধরে টাকা গুনে যে জিনিসটা ভুলে গিয়েছিলেন সেই জিনিসটা মাথার মধ্যে ফিরে এল। গাওয়া ঘিয়ের লুচি। গোবিন্দনারায়ণ নিজের মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে ডুকরে উঠলেন–গাওয়া ঘিয়ের লুচি! গাওয়া ঘিয়ের লুচি!
বরদাচরণ কিছু বুঝতে পারলেন না। কিন্তু ভাবলেন, টাকার শোকে রাজামশাই নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছেন। আর একথা কে না জানে যে, পাগলরা অনেক সময় লোককে ধরে কামড়ায়। এই ভেবে বরদাচরণ দুই লাফে চোর কুঠুরির চৌকাঠের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন।
সন্ধেবেলা মনোজ চুপিসারে রামায়ণ বইটা খুলে ছবিটা বের করল। ভারী চমৎকার ছবি। যখনই মনোজ ছবিটার দিকে তাকায় তখনই মনে হয় ছবির ছেলেটা যেন এক্ষুনি বলে উঠবেবন্ধু, কেমন আছ?
ছবিটা আজ মনোজ অনেকক্ষণ দেখল। এই কুমার কন্দর্পনারায়ণ? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। মনোজ শুনেছে, রাজা গোবিন্দনারায়ণ অসম্ভব কিপটে লোক। রাজবাড়ির বুড়ো দারোয়ানের সঙ্গে ইস্কুলের বেয়ারা সুখলালের খাতির আছে। দুজনের বাড়ি এক গাঁয়ে। বুড়ো দারোয়ান নাকি সুখলালকে একবার বলেছিল, রাজা ভীষণ কৃপণ বলে রানী অম্বিকা নিজেই তাঁর এক ভাইয়ের কাছে কুমার কন্দর্পকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাপের কাছে থাকলে নাকি কন্দর্প মানুষ হত না। কন্দর্পর মামা মস্ত বড় চাকরি করে, নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। সেই মামার আবার ছেলেপুলে নেই। কন্দর্প সেই মামার কাছে মহাসুখে আছে। কিন্তু মনোজের কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে, কৃপণ গোবিন্দনারায়ণের এত সুন্দর একটা ছেলে থাকতে পারে। ছবিটা যারই হোক মনোজ এই ছবিটা কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারবে না। তার যত ছেলে বন্ধু আছে তাদের চেয়েও এই ছবির বন্ধুটা তার বেশি প্রিয়।
মনোজ রামায়ণ বইটা অন্য সব বইয়ের পিছনে সাবধানে লুকিয়ে রেখে দিল।
তাদের বাড়ির অবস্থাটা এই ভর সন্ধেবেলা খুবই থমথমে। রাখোবাবু ঘড়ি হাতে দিয়ে উঠোনে পায়চারি করতে করতে ঘন-ঘন টাইম দেখছেন আর মাঝে মাঝে হাঁক ছেড়ে সবাইকে সময় জানাচ্ছেন। বাড়ির লোকেরা সবাই ছবি খুঁজে খুঁজে হয়রান। এখন আর কেউ রাখোবাবুর হাঁকডাকে গ্রাহ্য করছে না।
মনোজের ছোট ভাইবোন দুটো কিরমিরিয়ার কাছে বসে গল্প শুনছে। গণেশ ঘোষালের কাছে বসে গলা সাধছে পুতুল। ঠাকুমা আর ঠাকুরঝি ঠাকুরঘরে বসে জপের মালা টপকাচ্ছে। মা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বাবাকে উদ্দেশ করে বলছে, “ওই একজনের চেঁচামেচিতে বাড়ি অতিষ্ঠ হয়ে গেল। হাতে ঘড়ি বেঁধে ঘড়িবাবু হয়ে চৌকিদারের মতো চেঁচাচ্ছেন তখন থেকে।” ইত্যাদি। রঘু আর রামু হ্যারিকেন হাতে হারিকেনকে খুঁজতে বেরিয়েছে। ভজবাবুকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। পাড়ার থিয়েটারে ভজবাবুই মধ্যমণি, তাঁর খোঁজে ছেলেরা বার বার আসছে। কিন্তু ভজবাবু ফিরছেন না। সবাই কিছু চিন্তিত।
কিন্তু ভজবাবুর এখন আর ফেরার উপায় নেই। ব্যাপারের তলায় পিস্তল নিয়ে সেই যে বেরিয়েছিলেন, তারপর সাঙ্ঘাতিক-সাঙ্ঘাতিক সব কাণ্ড হয়ে গেছে শহরে।
উত্তর দিকের শহরতলিটা একটু নির্জন, গা-ছমছম করা জায়গা। এদিকে অনেক গাছ-গাছালি, মাঠঘাট আর ডোবা আছে। ঠ্যাঙাড়ে ডাকাতদের আস্তানা ছিল এক সময়। এখনও গুণ্ডা বদমাস-ডাকাতরা এই অঞ্চলটাতেই রাজত্ব করে। শহরের ভদ্রলোকেরা সন্ধের পর বড় একটা এদিকে আসে না।
কানাই মাছওলার বাড়িও এই উত্তর দিকের শহরতলিতেই, বড় রাস্তা থেকে একটা হাঁটা পথ ঘন বাঁশঝোঁপের ভিতর দিয়ে নেমে গেছে। সেই রাস্তার দুধারে কচুবন, ভাঁটবন আর বেঁটে কুলগাছের ঝোপে ভরা। খানিক এগোলে একটা মান্ধাতার আমলের ভাঙা কালীমন্দির চোখে পড়বে। দ্বাদশ শিবের মন্দিরও আছে বটে, তবে তার বেশির ভাগই তক্ষক, চামচিকে আর সাপখোপের বাসা, গোটা চারেক মন্দির ভেঙে স্তূপ হয়ে আছে। তবে কালীমন্দিরের কালী খুব জাগ্রত। লোকে বলে ডাকাতে কালীবাড়ি।
কথাটা মিথ্যে নয়। কানাই মাছওলা আর তার জনা বিশেক সাঙাৎ রোজ সন্ধেবেলা মন্দিরের চাতালে বসে গাঁজা কিংবা কারণবারি খেয়ে নেশা করে। শুটকোমতো এক পুরুতমশাই সন্ধেবেলা এসে ধূপধুনো দিয়ে আরতি করেন ভয়ে-ভয়ে, আর বাইরে কানাই আর সাঙাত্রা ‘জয় মা জয় মা’ বলে বিকট সুরে হাল্লা-চিল্লা করে।
কানাই বৈকালী বাজারে গিয়ে মাছ বেচতে বসবার আগে কালী-প্রণাম সেরে যায়। লোকে বলে, কানাই রাত-দুপুরে ডাকাতি করতে বেরোয়। তা কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। তবে কিনা, কানাইকে এখনও কেউ হাতে-নাতে ধরে ফেলতে পারেনি।
আজকের আরতি খুব জমে উঠেছে। রোগা পুরুতমশাই নেচে-নেচে আরতি করে ঘেমে উঠেছেন। কিন্তু বাইরে ষণ্ডারা প্রচণ্ড হুমকি দিয়ে বলছে, “ঘুরে ফিরে। আবার হোক। চালিয়ে ৯০
যাও।”
পুরুতমশাই আর করেন কী! ওরা থামতে না বললে তো আর থামতে পারেন না। বেয়াদপি করলে খাঁড়ার কোপে গলা নামিয়ে দেয় যদি! এদের খপ্পরে পড়ে যাওয়ার পর থেকে পুরুতমশাইয়ের জীবনে আর শান্তি নেই। শহরের উত্তর দিকটা নিরিবিলি দেখে কী কুক্ষণে এদিকে একখানা কুঁড়েঘর তুলে থাকতে এলেন। তারপর একদিন মাঝরাতে ডাকাতরা তাঁর গলায় সড়কি ধরল এসে, বলল, “ভাল চাও তো আমাদের কালীর পুজো করবে চলো।”
সেই থেকে আজ পাঁচ বছর একটানা কালীপুজো করতে হচ্ছে। পয়সা কড়ি পান না যে, তা নয়। ডাকাতরা মতলব হলে দেয় থোয় ভালই। কিন্তু তার বদলে অনেক নাচন-কোঁদন দেখাতে হয়। ঝাড়া ঘণ্টা দুই আরতি না করলে ডাকাতদের মন ওঠে না। পায়ে বাত হোক, জ্বর জ্বারি, আমাশা, বায়ু, পিত্ত, কফ কিছু মানে না ব্যাটারা। কেবল বলে–ঘুরে ফিরে। জোরসে চালাও। আবার হোক।
পুরুতমশাইয়ের জীবনটাই অন্ধকার হয়ে গেছে। তার ওপর ডাকাতদের সংস্পর্শ দোষে কবে যে পুলিশ ধরে নিয়ে হাজতবাস করায়। নানা দুশ্চিন্তায় পুরুতমশাই আজকাল খেতে পারেন না, ঘুমোতে পারেন না। দিন-দিন রোগা হয়ে যাচ্ছেন। মনে-মনে কেবল মা কালীর কাছে মানত করেন–জোড়া পাঁঠা দেব মা, এদের হাত থেকে উদ্ধার করো।
আজকের পুজোর আয়োজনটা খুব জাঁকালো রকমের। যেদিন এরকম পুজো হয়, সেদিনই পুরুতঠাকুর বুঝতে পারেন যে, আজ কোথাও কোনও গেরস্তর কপাল পুড়েছে। সাধারণত ডাকাতি করার রাতেই বড় করে পুজো দেওয়া হয়।
একজোড়া পাঁঠা আজ বলি হয়েছে। বলির পর পাঁঠার রক্ত আঁজলা করে নিয়ে ডাকাতরা কপালে আর গায়ে মেখেছে মহা উল্লাসে। মুড়ো দুটি মায়ের ভোগে উৎসর্গ করে এখন একটা মুশকো-মতো লোক পাঁঠা দুটোকে একটা আম গাছের ডালে ঠ্যাং বেঁধে ছাল ছাড়িয়ে নাড়িভুড়ি বের করছে পেট থেকে।
মন্দিরের চাতালে বসে কানাই একটার-পর-একটা হেঁসো বালি দিয়ে ঘষে ধার তুলছে। তার চোখ দুটো টকটকে লাল। পানের রসে ঠোঁট দুটোও রক্ত-শোষার মতো দেখাচ্ছিল।
অন্য সব ডাকাতরা মদ-গাঁজা খেয়ে পেল্লায় হাঁকডাক ছাড়ছে। এইসব দেখে পুরুতমশাইয়ের ঠ্যাং দুটো থরথর করে কাঁপে। বুকে ধড়াস ধড়াস শব্দ। গলা শুকিয়ে কাঠ।
এই ডাকাতের দলে একটা ছেলে আছে যে একটু অন্য রকমের। তাকে দেখতে ডাকাতের মতো নয় মোটেই। ভারী সুন্দর ফুটফুটে চেহারা তার। লম্বা হলেও খুব কেটা জোয়ান নয় সে। মুখখানা মিষ্টি, চোখ দুটো ঢুলুঢুলু। গায়ের রঙ এক সময়ে টকটকে ফসা ছিল, কিন্তু এখন অযত্নে রঙটা জ্বলে গেছে। দেখে মনে হয়, এ বোধহয় ভদ্র ঘরের ছেলে।
কিন্তু পুরুতমশাই শুনেছেন, ডাকাত দলের বুড়ো সর্দারকে হটিয়ে একদিন নাকি একেই নতুন সর্দার বানানো হবে। ছেলেটা মদ গাঁজা খায় না, চেঁচামেচিও করে না। বেশির ভাগ সময়ে চুপচাপ বসে থাকে। তবে ছোঁকরা নাকি ভারী এলেমদার। বন্দুক পিস্তলের হাত খুব পরিষ্কার, বশার টিপ একেবারে অব্যর্থ, তা ছাড়া দুর্জয় তার সাহস।
পুরুতমশাই ঘণ্টা নেড়ে আরতি করতে করতেই শুনতে পেলেন, একজন ডাকাত বলছে, “ওরে, আজ রাজবাড়ি লুট হবে, তোরা বেশি মদ গাঁজা খাসনি। খেলে মাথা ঠিক রাখতে পারবি না।”
শুনে পুরুতমশাইয়ের হাত থেকে ঘণ্টাটা টঙাস করে পড়ে গেল।
ওদিকে একটা বাঁশঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ডাকাতদের দৃশ্যটা লক্ষ করছিলেন আর-একজনও। তাঁর গায়ে ব্যাপার, পরনে ধুতি। দেখলে খুব নিরীহ মানুষ বলে মনে হয়। আসলে মানুষটা নিরীহই। কিন্তু আজ তাঁর ডান হাতে একটা পিস্তল। আর চোখ দুটোও অসম্ভব জ্বলজ্বল করছে।
এ লোকটা আর কেউ নয়, স্বয়ং ভজহরি বাজাড়।
ভজবাবুকে যাঁরা রোজ বাজারে হাটে দেখেন, তাঁরা এই ভজবাবুকে দেখলে কিন্তু চিনতেই পারবেন না। তার মানে এ নয় যে, বেঁটেখাটো ভজবাবু হঠাৎ ছ ফুট লম্বা হয়ে গেছেন, কিংবা তাঁর থলথলে চেহারাটা হঠাৎ মাসকুলার হয়ে গেছে। সে সব না হলেও, ভজবাবুর চেহারায় এখন এমন একটা বেপরোয়া ভাব, এমন হিংস্র আর কঠিন মুখচোখ যে, লোকে দেখলেই তিন হাত পিছিয়ে পালানোর পথ খুঁজবে।
আজ বিকেলে পিস্তলটা হাতে পাওয়ার পর থেকেই ভজবাবুর এই পরিবর্তন। আপনমনে মাঝে মাঝে হাসছেন আর বিড়বিড় করে বলছেন, “এতদিন পিস্তল ছিল না বলেই কেউ আমাকে পাত্তা দিত না তেমন! আজ সব ব্যাটাকে ঢিট করে ছাড়ব। আজ আর কারও রক্ষে নেই।”
ভজবাবু ছেলেবেলায় যে ইস্কুলে পড়তেন তার হেড স্যার ছিলেন গোলোকবিহারী চক্রবর্তী। অমন কড়া ধাতের মানুষ হয় না। এক-একখানা থাবড়া খেলে মনে হত, বুঝি গাছ থেকে পিঠে তাল পড়ল। তাঁর ভয়ে ছেলেরা ছবি হয়ে থাকত, কারও খাস পর্যন্ত জোরে বইত না। ভজবাবুর ছেলেবেলাটা এই হেড স্যারের শাসনে কেটেছে। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, ইস্কুল ছাড়বার পরেও ভজবাবু গোলোকবিহারীর ভয় আজও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। গোলোকবিহারীর বয়স এখন অষ্টাশি, কিন্তু পেল্লায় সটান চেহারা তাঁর। চোখে ঈগল পাখির মতো দৃষ্টি, গলায় বাঘের আওয়াজ, হাতির মতো মাটি কাঁপিয়ে রাস্তায় হাঁটেন, দেখা হলেই পিলে চমকে দিয়ে গাঁক করে বলেন, “এই যে ভজু, বল তো সাইকোলজি বানান কী?”
বলতে না পারলে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, “তোকে গাধা বললে গাধাদের অপমান করা হয়।”
গোলোকবাবুর এই অসহ্য মাস্টারি ভজবাবু বহুকাল সহ্য করেছেন। এই বুড়ো বয়সেও ভজবাবুকে রাস্তায়-ঘাটে বাজারে সর্বত্র ওই গোলোকবাবু এইভাবে অপমান করে বেড়ান। তাই পারতপক্ষে গোলোকবাবুর মুখোমুখি পড়ে যেতে চান না ভজবাবু।
আজ পিস্তল হাতে পেয়েই প্রথম তাঁর গোলোকবাবুর কথা মনে পড়ল। ওই লোকটাকে টিট করতে না পারলে জীবনে শান্তি, সুখ, স্বাস্থ্য কিচ্ছু নেই।
র্যাপারের মধ্যে পিস্তল লুকিয়ে নিয়ে ভজবাবু তাই সোজা আজ বিকেলে গিয়েছিলেন গোলোকবাবুর কদমতলার বাড়িতে।
গোলোক স্যার তাঁর বাইরের ঘরে বিশাল চৌকির ওপর কম্বলমুড়ি দিয়ে বসা। সামনে খোলা একখানা পাঁচসেরী এনসাইক্লোপিডিয়া। বিনা চশমায় খুদে-খুদে অক্ষর দিব্যি পড়ে যাচ্ছেন এই অষ্টাশি বছর বয়সেও।
ভজবাবু দরজার চৌকাঠে দাঁড়াতেই তিনি মুখ তুলে দেখে বললেন, “ভজু নাকি রে?”
সেই কণ্ঠস্বরে হাতে পিস্তল থাকা সত্ত্বেও ভজবাবুর বুকটা কেঁপে গেল। বললেন, “আজ্ঞে।”
অভ্যাসবশে কম্বলের ভিতর থেকে হেড স্যার একজোড়া পা বার করে দিয়ে বললেন, “পেন্নাম তাড়াতাড়ি সেরে নে, ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি।”
শহর ভরে গোলোকবাবুর ছাত্র। বুড়ো ধুড়ো, ছেলে, ছোঁকরা মিলে বিশাল ছাত্রের ব্যাটেলিয়ান। সারাদিন তাদের সঙ্গে গোলোকবাবুর দেখা হচ্ছে আর টপাটপ প্রণাম পাচ্ছেন। প্রণাম পাওয়ার এই অভ্যাসবশেই পা বের করে ফেলেছেন তিনি।
কিন্তু আজ প্রণাম করতে আসেননি ভজবাবু। তাঁর উদ্দেশ্য গোলোকবাবুর যেখানে-সেখানে মাস্টারি করার অভ্যাসটাকে বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু ব্যাপারের তলায় পিস্তলটা হাতের চেটোয় ঘেমে উঠল ভয়ে। গোলোকবাবু তাকিয়ে আছেন চোখে-চোখে।
ডান হাত থেকে পিস্তলটা বাঁ হাতে চালান করে প্রণামটা সেরে নেবেন বলে ভেবেছিলেন ভজবাবু। কিন্তু একটা মুশকিল হল র্যাপারের তলায় হাত-চালাচালি করতে গিয়ে দেখেন মাঝখানে র্যাপারের একটা পল্লা এসে যাচ্ছে। পিস্তলটা হাত বদল করা যাচ্ছে না। অথচ প্রণামে দেরি করাও চলে না। গোলোকবাবুর পায়ে ঠাণ্ডা লাগছে।
অগত্যা ভজবাবু ডান হাতেই পিস্তলটা ধরে রেখে বাঁ হাতে গোলোকবাবুর পায়ের ধুলো নিলেন।
গোলোকবাবু একগাল হেসে বললেন, “আমি বরাবর লোককে বলি ভজু গর্দভটার ডান বাঁ জ্ঞান নেই, তা এখন দেখছি বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সব কটা ফোরকাস্ট তোর জীবনে মিলে যাচ্ছে। বলি, তুই সব্যসাচী হলি কবে থেকে যে, বাঁ হাতে পায়ের ধুলো নিচ্ছিস?”
ভজুবাবু মাথা চুলকে বললেন, “ডান হাতে ব্যথা স্যার।”
“ব্যথা? কেন, ঢিল ছুঁড়তে গিয়েছিলি নাকি?”
“আজ্ঞে না।”
“বল দেখি, সব্যসাচী মানে কী?”
“যার দুই হাত সমানে চলে।” টপ করে বলে দিলেন ভজবাবু। আর বলে তাঁর খুব আনন্দ হল। গোলোকবাবুর বিদখুটে সব প্রশ্নের মধ্যে খুব অল্পেরই ঠিক জবাব দিতে পেরেছেন তিনি।
“বটে?” গোলোকবাবু খুব মিষ্টি করে হেসে বললেন, “এবার তা হলে বল, সব্যসাচীর ইংরাজিটা কী হবে?”
ভজবাবুর একগালে মাছি। হাতের পিস্তলটার কথা আর মনেও পড়ল না। ভয়ে পেটের ভিতরে গোঁতলান দিচ্ছে।
“স্টুপিড।” বলে গর্জন করে উঠলেন গোলোকবাবু। ধপাস করে বইটা বন্ধ করে বললেন, “বুড়ো হতে চললি, এখনও এই সব রপ্ত হল না? গোলোক মাস্টারের ছাত্র বলে সমাজে কী করে পরিচয় দিস তোরা, অ্যাাঁ? কত জুয়েল ছেলে এই হাত দিয়ে বেরিয়েছে জানিস? ওঠবোস কর। কর ওঠবোস।”
ভজবাবুর হাঁ আরও দু ইঞ্চি বেড়ে আলজিভ দেখা যেতে লাগল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গোলোক স্যার তাকে ওঠবোস করতে বলছেন। অ্যাঁ।
“ওঠবোস করব স্যার?” অতিকষ্টে জিজ্ঞেস করেন ভজবাবু।
“তা নয় তো কি ডন-বৈঠক করতে বলেছি। দশবার ওঠবোস করে তারপর ছুটি পাবি। শুরু করে দে।”
“হাঁটুতে বাত যে স্যার।”
“বাত সেরে যাবে।”
“হাড়ে মটমট শব্দ হয়।”
“হোক শব্দ, তাতে তোর শব্দরূপ ধাতস্থ হবে।”
“আমার যে পঞ্চান্ন বছর প্রায় বয়স হল স্যার।”
“শিক্ষার আবার বয়স কী রে উল্লুক? কর ওঠবোস। বাঁ হাতে পেন্নাম করা তোমার বের করছি। কর ওঠবোস!” গোলোকবাবু একটা হুঙ্কার ছাড়লেন।
সেই হুঙ্কারে ভজবাবু কুঁকড়ে যেন ক্লাশ সিক্স-এর ভজু হয়ে গেলেন। তারপর বাতব্যাধি ভুলে, বয়স উপেক্ষা করে, হাড়ের মটমট শব্দ তুচ্ছ করে দশবার তাঁকে ওঠবোস করতে হয়েছে।
শাস্তির দৃশ্যটা খুব আয়েস করে দেখলেন গোলোকবাবু। শুধু তিনিই নন, ভজবাবু ওঠবোস শুরু করার মুখে গোলোক স্যারের দুই নাতি আর এক নাতনিও এসে দরজায় দাঁড়াল। তাদের সে কী মুখচাপা দিয়ে হাসি!
দশবার ওঠবোস করার পর ভজবাবু যখন হ্যাঁ-হত্যা করে হাঁফাচ্ছেন তখন গোলোকবাবু বললেন, “যা। আর কক্ষনো যেন ডানবাঁ ভুল না হয় দেখিস।”
সেই অপমানের পর বেরিয়ে এসেই ভজবাবুর চেহারাটা একদম পাল্টে গেল। ভরসন্ধেবেলা দশবার ওঠবোস! হাতে পিস্তল থাকতেও!
ভাবতে-ভাবতে ভজবাবুর চেহারা হয়ে গেল খ্যাপা খুনীর মতো। সারা দুনিয়াকে তখন তাঁর দাঁতে-নখে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। মাথাটা এত তেতে গেছে যে, মনে হচ্ছিল এক্ষুনি মাথার ব্রহ্মতালুতে আগ্নেয়গিরির গহ্বরের মতো ছাঁদা হয়ে মাথার ঘিলু তপ্ত লাভার মতো ছিটকে বেরিয়ে পড়বে।
রাস্তার কল থেকে খানিক ঠাণ্ডা জল মাথায় দিয়ে ভজবাবু আবার রওনা দিলেন। সব পাজি বদমাশকে আজ ঠাণ্ডা করতে হবে।
চৌরাস্তার মোড়ে একজন কনস্টেবল একজন রিকশাওলার কাছ থেকে পয়সা নিচ্ছিল। প্রায়ই নেয়। রিকশাওলার গাড়িতে বাতি ছিল না, তাই ধরা পড়ে কাঁচুমাচু মুখে একটা সিকি ঘুষ দিচ্ছিল।
ঠিক এই সময়ে ভজবাবু পিস্তল বাগিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির।
বিকট একটা হুঙ্কার দিয়ে কনস্টেবলটাকে বললেন, “সিকি ফিরিয়ে দে।”
পিস্তল দেখে সিপাইটার চোখ লুচির মতো গোল হয়ে গেল, আর রিকশাওলাটা বাবারে’ বলে গাড়ি ফেলে দৌড়।
“দে বলছি ফিরিয়ে।” ভজবাবু ধমকালেন।
কিন্তু সিপাই সিকিটা ফিরিয়ে দেবে কাকে! রিকশাওলাটা হাওয়া দিয়েছে যে। অগত্যা সে ভয়ে-ভয়ে ভজবাবুর দিকেই সিকিটা ছুঁড়ে দিয়ে জোড়হাতে বলল, “জান বাঁচিয়ে দিন ভজবাবু। আর কখনও–”
ভজবাবু নির্দয়। খুনীর গলায় বললেন, “ওঠবোস কর। দশবার।”
লোকটা খানিক গাঁইগুঁই করল বটে, কিন্তু শেষে রাজি হয়ে চৌরাস্তার ধারে সরে এসে একটু অন্ধকারে দশবার বৈঠকী দিল।
সিপাইটাকে ওঠবোস করিয়ে গায়ের ঝাল খানিকটা মিটল ভজবাবুর। ভারী খুশি হয়ে উঠলেন পিস্তলের গুণ প্রত্যক্ষ করে।
আবার ব্যাপারের তলায় অস্ত্রটা লুকিয়ে নিয়ে সোজা চলে এলেন ইউরোপীয়ান ক্লাবে।
ক্লাবে অবশ্য এখন ইউরোপিয়ান আর কেউ নেই। বিলিয়ার্ড টেবিলের ওপরকার দামি কাপড়টা কে বা কারা ব্লেড দিয়ে কেটে তুলে নিয়েছে। টেবিল টেনিসের টেবিলের ওপর এখন দারোয়ানের মেয়ে আর জামাই শোয়। আর বল নাচের ঘরে টেবিল-চেয়ার পেতে কয়েকজন অফিসারগোছের লোক পয়সা দিয়ে তাস-টাস খেলে।
জুয়াখেলা দুচক্ষে দেখতে পারেন না ভজবাবু। বহুকাল ধরে তাঁর ইচ্ছে, এই জুয়ার চক্রটা ভাঙতে হবে।
ঘরে ঢুকেই ভজবাবু পিস্তলটা বাগিয়ে ধরে বললেন, “হাতটাত তুলে ফেল হে। দেরি কোরো না।”
জুয়াড়িরা খেলায় মজে আছে। ভাল করে শুনতেও পেল না, কিংবা শুনলেও গ্রাহ্য করল না।
“কই হে!” বলে ভজবাবু এবার যে হুমকি ছাড়লেন তা অবিকল গোলোকবাবুর গলার মতো শোনাল।
এইবার চার-পাঁচজন জুয়াড়ি মুখ তুলে তাকিয়ে থ।
“এই যে ভজ বাজাড়!”
“হাতে পিস্তল যে! ও ভজবাবু, হল কী আপনার?…
ভজবাবু সেসব কথায় কান দিলেন না। তবে লোকগুলো যাতে ব্যাপারটাকে হালকাভাবে না নেয় তার জন্য হঠাৎ পিস্তলের নলটা ছাদের দিকে তাক করে গুড়ম করে একটা গুলি ছুঁড়লেন।
সেই শব্দে, নাকি গুলি লেগে কে জানে, ঘরের আলোর ডুমটা ফটাস করে ভেঙে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। আর সেই অন্ধকারে চার-পাঁচটা জুয়াড়ি প্রাণপণে চেঁচাতে লাগল, “গুলি! গুলি! গেলাম! মলাম!”
ভজবাবু অন্ধকারে আপনমনে একটু হেসে বেরিয়ে এলেন। পিস্তলের মজা এখনও শেষ হয়নি। এই তো সবে শুরু। ভাবলেন ভজবাবু। তারপর জোর কদমে আর-এক দিকে হাঁটতে লাগলেন।
চোট্টা গোবিন্দ ভাল লোক নয়। সে সুদে টাকা খাটায় লোকের গয়না জমি বন্ধক রেখে টাকা ধার দেয়। এইসব করে সে এখন বিশাল বড়লোক। আসল নাম গোবিন্দচন্দ্র বণিক। কিন্তু সুদখোর আর অর্থলোভী বলে তার নামই হয়ে গেছে চোট্টা গোবিন্দ।
যারা টাকা ধার দিয়ে সুদ খায় বা বন্ধকী কারবার করে, তাদের বড় একটা ভাল হয় না। এই যেমন চোট্টা গোবিন্দরও ভাল কিছু হয়নি। তার ছেলেপুলেরা কেউ মানুষ হয়নি। দুটো ছেলেই বখে গিয়ে বাড়ি থেকে চুরি করে পালায়। তারপর একজন খুন করে জেলে গেছে, অন্যজন পাগল হয়ে পাগলাগারদে আছে। একটিই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল সাধ করে। কিন্তু সে-মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে বলে দিয়েছে, ওরকম সুদখোর বাপের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা চলবে না। তাই মেয়েও বাপের কাছে আসে না।
পুলিশ চৌকির কাছেই চোট্টা গোবিন্দর বাড়ি। ছোট আর পুরনো হলেও বাড়িটা খুব মজবুত। জানালায় মোটা মোটা গরাদ, লোহার পাত মারা পুরু কাঠের দরজা আর তাতে আবার সব সময়ে তালা লাগানো থাকে। ঘরে বিশাল বিশাল কয়েকটা সিন্দুকে কয়েকশো ভরি বন্ধকী গয়না আর জমিজমার দলিল, কোম্পানির কাগজপত্র রাখা থাকে।
কৃপণ চোট্টা গোবিন্দর পয়সা থাকলে কী হয়, কখনও ভাল খাবে পরবে না। বুড়ো শকুনের মতো বাজারে ঘুরে ঘুরে যত সব শস্তার পচা বাসী তরিতরকারি কিনবে। বাজারের ভাল জিনিসটার প্রতি যার চোখ নেই, তাকে ভজবাবু মোটেই ভাল চোখে দেখেন না। তার ওপর আবার লোকটা সুদখোর।
চোট্টা গোবিন্দর একটা স্বভাব হচ্ছে সব কাজ করার আগে পাঁজি দেখে নেবে। তিথি-নক্ষত্রের যোগ না দেখে সে কখনও কোনও কাজ করে না। এমনকী, দিন খারাপ থাকলে বন্ধক নেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখে।
হঠাৎ চোট্টা গোবিন্দর কথা মনে পড়তেই ভজবাবুর শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে লাগল। হ্যাঁ, এ লোকটা মানুষের সমাজে এক বিদঘুঁটে কলঙ্ক, পৃথিবীর এক কুটিল শত্রু। এই নরাধমকে কিছু উত্তম শিক্ষা দেওয়া দরকার।
ভজবাবু এসে চোট্টা গোবিন্দর দরজায় কড়া নাড়লেন।
চোট্টা গোবিন্দ সাবধানী লোক। সন্ধের পর হুট বলতে সদর দরজা খোলে না। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে সন্তুষ্ট হলে দরজা খোলে, নয়তো পরদিন আসতে বলে বিদায় দেয় লোককে। নিতান্ত কেউ দায়ে ঠেকলে জানালা দিয়ে গয়না টাকার লেনদেন হয়। তাও আবার তিথি-নক্ষত্র ভাল থাকলে।
কিন্তু ভজবাবুর কপালটা আজ নিতান্তই ভাল। যে সময়টায় তিনি কড়া নাড়ছিলেন, ঠিক সে সময়েই দরজার ভিতর থেকে হুড়কো খোলার শব্দ হল। কপাটের পাল্লা খুলে শার্দুল চৌধুরী বেরিয়ে আসছিল।
শার্দুল নামকরা শিকারি। তার যে কত বন্দুক পিস্তল ছিল তার লেখাজোখা নেই। সাতটা তেজী ঘোড়া ছিল, পাঁচটা গ্রে-হাউন্ড ব্লাড-হাউন্ড কুকুর, বাড়িতে বাগান, পুকুর, দারোয়ান ছিল। তা ছাড়া শার্দুলের চেহারাটাও ছিল পাহাড়ের মতো বিশাল; আর মনটা ছিল আকাশের মতো উদার। মুঠো মুঠো টাকা যেমন ওড়াত তেমনি বিলিয়ে দিত।
তবে একটা কারণে শার্দুলকেও ভজবাবু দেখতে পারেন না। শার্দুল বাজারে গিয়ে কখনও দরদাম করে না। দোকানদাররা যা দাম চায় তাই হাসিমুখে দিয়ে দেয় আর রাশি রাশি তরিতরকারি, মাছ, ডিম, মাংস কিনে ফেলে। শার্দুল যেদিন বাজারে যায় সেদিন দোকানদারদের পোয়াবারো, আর ভজবাবুর কপালে দুঃখ। সেদিন ভজবাবু যে-দোকানদারের কাছেই গিয়ে বাবা, বাছা বলে দু পয়সা কমানোর চেষ্টা করেন সেই দোকানদারই তাঁকে না-চেনার ভান করে, পাত্তাই দিতে চায় না। কানাই মাছওলা একবার তো বলেই ১০২
ফেলল, “বাজাড়দের মধ্যে ভ ভদ্রলোক দেখলাম একমাত্র ওই শার্দুলবাবুকেই। আর তো সব ছ্যাঁচড়া।”
সেই থেকে ভজবাবুর রাগ। শার্দুল চৌধুরীর অবশ্য আর সেই বাঘ-সিংহী মারার দিন নেই। অমিতব্যয়ের ফলে তার পয়সাকড়ি সব চলে গেছে, বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। বন্দুক, ঘোড়া, কুকুর সবই বেহাত। শার্দুলের সে চেহারাও আর নেই। রোগাটে লম্বা মানুষটাকে দেখলে মনে হয় বুঝি শার্দুলের বাবা। অত বুড়ো দেখায়।
শার্দুল ভজবাবুকে দেখে চোখ নাচিয়ে বলল, “কী খবর হে ভজু শিকারি?”
ভজবাবু জন্মেও কিছু শিকার করেননি। তবে কিনা ভাল বাজার করেন বলে শাল তাঁকে মুনাফা-শিকারি বলে ডাকে। সংক্ষেপে শিকারি।
ভজবাবুর ব্যাপারের তলায় তৈরি পিস্তল। কিন্তু যখন-তখন সেটা ব্যবহার করতে তো আর পারেন না। সতর্কতার একান্ত প্রয়োজন। তাই ভালমানুষের মতো বললেন, “ভিতরে চলুন শার্দুলবাবু, আপনার সঙ্গে কথা আছে।”
শার্দুল ব্যস্ত হয়ে বলে, “কথা বলার সময় নেই। বাড়িতে আজ জলসা বসিয়েছি, লখনউ থেকে এক বড় ওস্তাদ এসেছে। তাকে মুজররা দিতে হবে বলে একটা সোনার পকেটঘড়ি বাঁধা দিয়ে গেলাম। জোর খানাপিনাও হবে।”
ভজবাবু দাঁত কিড়মিড় করলেন। অমিতব্যয়ী আর কাকে বলে। এই লোকটার এই দেদার টাকা খরচ করে ফুর্তি করা আর বাজারের দোকানদারদের আশকারা দেওয়া আজ বের করতে হবে। ভজবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “কথাটা একান্তই জরুরি। বেশি সময়ও লাগবে না।”
এই বলে শালকে একরকম ঠেলে দরজার ভিতরে এনে ভজবাবু দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে পিস্তল বের করে বললেন, “হ্যান্ডস আপ।”
শার্দুল বলে উঠল, “উ-হুঁ-হুঁ, আজ থিয়েটার দেখার সময় নেই। ওস্তাদজি বসে আছেন। তোমাদের পূর্বপল্লী কি এবার গোয়েন্দা-নাটক করছে নাকি?”
ভজবাবু হাসলেন, তারপর বিনাবাক্যে পিস্তলের মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ঘোড়া টিপে দিলেন।
প্রচণ্ড শব্দ, আগুনের ঝলক আর ধোঁয়ার ভিতরে দাঁড়িয়ে ভজবাবুর নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বীর বলে মনে হল।
পিস্তলের শব্দে শার্দূল তিন হাত ছিটকে গেল। চোট্টা গোবিন্দ সিন্দুকের চাবি ট্যাকে খুঁজতে যাচ্ছিল, ঝনাত করে চাবির গোছাটা পড়ে গেল মেঝেয়।
ভজবাবু বললেন, “হ্যান্ডস আপ।”
এবার আর শার্দুলও চোট্টা গোবিন্দর হাত ওপরে তুলতে বেশি দেরি হল না। তবে কিনা চোট্টা গোবিন্দ ইংরিজি জানে না, ‘হ্যান্ডস আপ’ কথাটার মানে বুঝতে পারেনি বলে তার কিছু দেরি হয়েছিল। শার্দুল চৌধুরী কথাটার মানে বলে দিল তাকে; তখন সে তড়িঘড়ি হাত তুলে বলল, “বাবা ভজু, দোহাই তোমার। পাঁজিটা একটু দেখতে দাও।”
ভজবাবু হেসে বললেন, “পাঁজি দেখবেন? না পাঁজি দেখতে চান? পাঁজি দেখতে চাইলে একটা আয়না নিয়ে নিজের মুখখানা দেখুন, সবচেয়ে বড় পাজিকে দেখতে পাবেন।”
চোট্টা গোবিন্দ কাকুতি-মিনতি করে বলতে থাকে, “লক্ষ্মী ছেলে ভজু, অমন করে না, ছিঃ! আটটা কত মিনিটে যেন অমৃতযোগ আছে। যদি মারতেই হয় তবে সময়টা একটু দেখে মেয়েরা বাপ। নইলে কোন নরকে গিয়ে পচব।”
“হাঃ হাঃ,” হাসলেন ভজবাবু, তারপর ডাকলেন, “শার্দুল চৌধুরী।”
ভজবাবুর গলায় ডাকটা বাঘের ডাকের মতো শোনাল। শব্দে কেঁপে ওঠে শার্দুল। আর ভজবাবু অবাক হয়ে নিজের গলায় হাত রেখে ভাবেন, “এও কি পিস্তলের গুণ? নইলে এরকম বাঘের আওয়াজ আমার গলায় এল কোত্থেকে?”
ভজবাবু পিস্তলটার গায়ে আদরে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “শুনুন শার্দুলবাবু আর গোবিন্দবাবু, আপনাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। গোবিন্দবাবু, আপনি সুদখোর, বন্ধকী মহাজন, মানবতার শত্রু, পৃথিবীর পঙ্কিলতম জঘন্যতম কী যেন! কী যেন! থাকগে। আর শার্দুলবাবু, আপনি আড্ডাবাজ, ফুর্তিবাজ, বেহিসাবি। দরিদ্রের রক্ত শোষণ করে, পৃথিবীর সম্পদ লুণ্ঠন করে, বাজারে গিয়ে নিজের ধনসম্পদের অপপ্রয়োগের দ্বারা মূল্যমানকে জঘন্যতম উর্ধ্বে তুলে দিয়ে যে অহমিকার ধ্বজা–এত কথারই বা কাজ কী! ওঠবোস করুন। দশবার।”
শার্দুল খুব মন দিয়ে ভজবাবুর কথা শুনছিল, ভজবাবু, থেমে যেতেই চোট্টা গোবিন্দর দিকে চেয়ে বলে উঠল, “পার্ট ভুলে গেছে?”
ভজবাবু ভয়ঙ্কর রেগে গিয়েগ বললেন, “ভুলিনি। আরো শুনতে চান? আপনাদের লজ্জা হয় না শুনতে? ওঠবোস করুন, ওঠবোস করতে থাকে।
চোট্টা গোবিন্দ প্রায় কেঁদে ফেলে বলে উঠল, “আটটা পনেরো মিনিট উনচল্লিশ সেকেন্ড গতে অমৃতযোগ লাগবে। বাবা ভজু, ততক্ষণ বসে না হয় বিশ্রাম করো। বসেবসে গালাগাল করো। খানিক শুনি। বেশ বলছিলে বাবা।”
ভজবাবু রেগে গিয়ে বললেন, “কথা কানে যাচ্ছে না নাকি? ওঠবোস করতে বলছি যে!”
“ওঠবোস!” চোট্টা গোবিন্দ ভারী বিমর্ষ গলায় বলে, “ওঠবোস করব সেই ভাগ্য কি আমার আছে বাপ! দু হাঁটুতে বাত। একবার বসলে আর উঠতে পারি না, ধরে তুলতে হয়। দশবার ওঠবোস করতে একটা বেলা চলে যাবে। তাও যদি তোমরা ধরাধরি করে করাও।”
ওদিকে শার্দুল শেষবার ওঠবোস করে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, “দশ। এবার ছুটি তো ভজু?”
ভজবাবু মাথা নেড়ে বলেন, “ছুটির দেরি আছে। গোবিন্দবাবু, আপনার কাছে তামা-তুলসী-গঙ্গাজল থাকে বলে শুনেছি। সেসব বের করুন।”
চোট্টা গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলে, “থাকে বাবা। যারা ধারকর্জ করতে আসে তাদের তামা-তুলসী-গঙ্গাজল ছুঁইয়ে শপথ করিয়ে নিই যাতে সুদ ঠিকমতো দেয়, মামলা-মোকদ্দমা না করে শাপশাপান্ত না দেয়।”
পিস্তল নাচিয়ে ভজবাবু বললেন, “সেসব বের করুন। আজ আপনাদের শপথ করিয়ে নেব।”
কাঠের আলমারি খুলে চোট্টা গোবিন্দ তাপাত্রে গঙ্গাজল আর তুলসীপাতা বের করে হাতে নিয়ে দাঁড়াল। ভজবাবুর পিস্তলের ইশারায় শার্দুল চৌধুরীও তাম্রপাত্রটি ছুঁয়ে দাঁড়াল।
ভজবাবু বললেন, “এবার বলুন, আর কখনও টাকা ধার দিয়া সুদ লইব না, বন্ধকের কারবার করিব না, মানুষের সর্বনাশ করিয়া ধনী হইব না—”
চোট্টা গোবিন্দ বলতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে শার্দুলও বলে, “আর কখনও টাকা ধার দিয়া সুদ লইব না, বন্ধকের কারবার–”
ভজবাবু বিরক্ত হয়ে শার্দূলকে বলেন, “আহা, ও কথা আপনার বলবার নয়। আপনার শপথবাক্য আলাদা।”
এরপর ভজবাবু শার্দুলকে দিয়ে শপথ করাতে থাকেন, “আর কখনও বেহিসাবি খরচ করিব না, ফুর্তি করিয়া টাকা উড়াইব না, আর বাজার করিতে গিয়া দরাদরি না করিয়া জিনিস কিনিব না–”
এবার শার্দুলের সঙ্গে সেসব কথা চোট্টা গোবিন্দও বলতে থাকে, “আর কখনও বেহিসাবি খরচ করিব না, ফুর্তি করিয়া টাকা উড়াইব না, আর বাজার করিতে গিয়া”।
ভজবাবু চোট্টা গোবিন্দকে ধমক দিলেন, “ওসব আপনাকে কে বলতে বলেছে? আপনি বরং সুদের কারবার ছেড়ে এবার থেকে ফুর্তি করেই টাকা ওড়াবেন। আপনার সেইটেই দরকার।”
“তাই করব বাবা। তবে বুড়ো বয়সে কিছু মনে থাকে না। যা সব শপথ করালে তা মনে থাকলে হয়।”
ভজবাবু একটু তৃপ্তির হাসি হেসে বেরিয়ে এলেন। এবার যাবেন বাজারে। কানাই মাছওলাকে ঢিট করতে না পারলে সুখ নেই।
কিন্তু বৈকালী বাজারে আজ কানাই বসেনি। মেছুনী অনঙ্গবালা ভজবাবুকে চুপি চুপি বলল, “আসবে কী করে বাবু, আজ যে কানাইয়ের কালীপুজো।”
“কালীপুজো! কালীপুজো তো কবে হয়ে গেছে।”
অনঙ্গবালা পান-খাওয়া মুখে একটু হেসে বলে, “সে পুজো নয় বাবু। আপনাকে বলেই বলছি, আজকের পুজো হচ্ছে ডাকাতি করার পুজো।”
“বটে!” ভজবাবুর মুখখানা অসুরের মুখের মতো হয়ে গেল। বাজার থেকে বেরিয়ে তিনি সোজা শহরের উত্তরদিকে যাওয়ার রাস্তায় পড়লেন। বেগে হাঁটছেন আর আপনমনে মাঝে মাঝে বলছেন, “বটে! বটে! বটে! বটে!”
বাঁশঝোঁপের আড়াল থেকে ভজ বাজাড় সবই দেখলেন, শুনলেন। তারপর আপনমনে বলে উঠলেন “বটে।”
আলোয়ানের তলা থেকে পিস্তলটা বের করে একটু আদর করলেন অস্ত্রটাকে। পিস্তল থাকলে আর কোনও ভয় নেই। পিস্তলের সামনে সব ডাকাত, বদমাশ, চোর, গুণ্ডা ঠাণ্ডা।
ওদিকে ডাকতরা খুব চিল্লামিল্লি করছে। তাদের আনন্দ আর ধরে না। পুজো হয়ে গেছে। বলির পাঁঠা কাটাকুটি করে মস্ত কড়াইতে কাঠের জ্বালে রান্না চেপে গেছে। গোটা পঁচিশ মশাল জ্বলছে চারধারে। চারদিকটা আলোয় আলো।
এদিকে মাংসের গন্ধে ভজবাবুর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আজ সেই দুপুরের পর এ পর্যন্ত তাঁর কিছুই খাওয়া হয়নি। বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। তার ওপর বাঁশঝাড় থেকে হাজার হাজার মশা পিন্ পিন্ করে উড়ে এসে ঘেঁকে ধরেছে তাঁকে।
ইচ্ছে ছিল ডাকাতদের ওপর আরো কিছুক্ষণ নজর রাখবেন। ওরা যখন ডাকাতিতে বেরোবে ঠিক তখন গিয়ে যমের মত পিস্তল হাতে মুখোমুখি হবেন। কিন্তু খিদে আর মশার জ্বালায় ভজবাবু বসে থাকতে পারলেন না। আহাম্মক মশাগুলো তো পিস্তলের মর্ম বোঝে না যে ভয় পাবে। তাই ভজবাবু ভাবলেন তাড়াতাড়ি ডাকাতগুলোকে শিক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে পেট ভরে ভাত খাবেন। সারাদিন ভারী ধকল গেছে।
এই ভেবে ভজবাবু ব্যাপারটা ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে পিস্তল বাগিয়ে ধরে বাঘের গলায় ‘খবরদার! খবরদার!’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে চার-পাঁচ লাফ দিয়ে কালীবাড়ির চাতালে পড়লেন। তারপরই গুড়ম করে একটা গুলি আকাশে ছুঁড়ে বললেন, “হ্যান্ডস আপ। সবাই হাত তোলো।”
ভজবাবুর সেই চেঁচানি আর গুলির শব্দে ডাকাতদের মধ্যে প্রথমটায় এক প্রচণ্ড আতঙ্ক দেখা দিল। ভড়কে গিয়ে সবাই এদিকে সেদিক পাঁই-পাঁই করে পালাতে লাগল। একটা মোটা ডাকাত মাংসের ঝোল হাতায় তুলে নুনঝাল পরীক্ষা করছিল সে তাড়াহুড়োয় পালাতে গিয়ে সেই ফুটন্ত ঝোল হাতা থেকে মুখে ঢেলে গরমে মাংসের কড়াইয়ের জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়তে গিয়ে ফুটন্ত মাংসের কড়াইয়ের মধ্যে একটা পা ডুবিয়ে দিল। তারপর ‘বাবা রে গেছি রে’ বলে লেংচে লেংচে খানিক দূরে গিয়ে পড়ল।
কানাই দায়ে ধার দিচ্ছিল, আচমকা ভজবাবুর মূর্তি আর পিস্তলের শব্দে সে মনে করল, পুলিশ এসেছে। সে হাঁটু গেড়ে বসে খুব অভিমানের সুরে হাতজোড় করে বলতে লাগল, “এসব কি ঠিক হচ্ছে পুলিশ সাহেবদের? আজ সকালেই দু সের বড় বড় কই মাছ দারোগাবাবুদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছি, তবু এই মন্দিরে এসে জুলুম কেন? নিরালায় বসে কয়েকজন ভক্ত মায়ের পুজো করছে, তার মধ্যে এসে এই হুজ্জতের কোনও মানে হয়?”
কিন্তু ভজবাবুর কানে সেসব কথা যাচ্ছে না। ডাকাতদের পালাতে দেখে তাঁর সাহস দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সোল্লাসে লাফাতে লাফাতে বলতে লাগলেন, “সব ব্যাটাকে মেরে ফেলব। খুন করব। তারপর ফাঁসিতে ঝোলাব। আজ তোদেরই একদিন কি আমারই একদিন।”
তারপর হঠাৎ কানাইকে দেখতে পেয়ে ভজবাবু এক লাফে তার সামনে এসে নাকের ডগায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে বললেন, “কানাই!”
ভজবাবুকে দেখে কানাই অবাক। পিস্তল দেখে আরো অবাক। কাঁপা গলায় বললেন, “আজ্ঞে!”
“এবার?” ভজবাবু একগাল হেসে বললেন।
কানাই কাঁপা গলায় বলে, “রোজ তো আপনাকে নিজের ক্ষতি করে কম দামে মাছ দিই ভজবাবু!”
“আজ সকালে যে বড় কৈ মাছগুলো লুকিয়েছিলি।”
“পরে তো বের করে দিচ্ছিলাম ভজবাবু, কেবল গোয়েন্দাচরণ
এসে–”
“চোপ,” বলে ভজবাবু এক ধমক দিয়ে বললেন, “বেশি কথা বলতে হবে না। দশবার ওঠবোস কর। তাড়াতাড়ি।”
কানাই খুব বাধ্য ছেলের মতো ওঠবোস করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আর দরকার হল না। কোথা থেকে একটা মাছ ধরার জাল উড়ে এসে ভজবাবুকে আপাদমস্তক মুড়ে ফেলল। হ্যাঁচকা টান খেয়ে ভজবাবু চাতালে গড়াগড়ি।
মাছের জালের দড়িটা হাতে নিয়ে ডাকাতের মেজ সর্দার সেই সুন্দরপানা ছেলেটা চেঁচিয়ে বলল, “ওরে, তোরা সবাই আয় রে। লোকটাকে ধরেছি। আজ বড় করে পুজো হবে ফের। আর সেই পুজোতে নরবলি হবে।”
সেই শুনে ভজবাবু মূর্ছা গেলেন। যতক্ষণ হাতে পিস্তল ছিল ততক্ষণ ভজবাবু আর ভজবাবু ছিলেন না, মহাবীর হয়ে গিয়েছিলেন। যেই পিস্তলটা হাত থেকে ছিটকে গেল অমনি তিনি রোজকার ভিতু, নিরীহ, গোবেচারা ভজহরি হয়ে গেছেন।
মুর্ছা যখন ভাঙল তখন দৃশ্য ভজবাবুর আবার মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। দেখেন ডাকাতরা আবার সব জমায়েত হয়েছে। চারদিকে মহা উল্লাস চলছে। তিনি টের পেলেন তাঁর হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, গলাটা হাড়িকাঠে আটকানো। ঢাক আর কাঁসিতে কারা যেন বলির বাজনা বাজাচ্ছে। কানাই মাছওলা বলছে, ‘এই ছ্যাঁচড়া বাজাড়টার জন্য আর মাছ বেচে সুখ ছিল না। আজ এটাকে নিকেশ করতেই হবে।’
রোগা পুরুতমশাই এসে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভজবাবুর কপালে একটা সিঁদুরের তিলক এঁকে দিলেন। ডাকাতরা চেঁচাল, ‘জয় মা জয় মা!’