Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 3

মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি || Shirshendu Mukhopadhyay

বরদাচরণের পড়ে যাওয়ার শব্দে

বরদাচরণের পড়ে যাওয়ার শব্দে দুঃখবাবু আর গণেশ ঘোষালও ছুটে এসেছিলেন। তেমন কিছু হয়নি দেখে তাঁরা হতাশ হলেন।

নিজেদের ঘরের দিকে যেতে যেতে গণেশবাবুবললেন, “আচ্ছা দুঃখবাবু, মোষের কি গোবর হয়?”

দুঃখহরণবাবু চিন্তিত হয়ে বললেন, “মোষের গোবর? কী জানি, ঠিক বলতে পারছি না। ষাঁড়ের গোবর বলে একটা কথা আছে বটে, কিন্তু মোষের গোবর কখনও শুনিনি। তবু চলুন, ডিকশনারিটা একবার ঘেঁটে দেখি।”

গণেশবাবু বললেন, “ডিকশনারি দেখতে হবে না। আমি আজ জানতে পেরেছি, মোষেরও গোবর হয়।”

“কী করে জানলেন?”

গণেশবাবু বললেন, “আমার বাক্সের চাবি পৈতেয় বাঁধা থাকে। সকাল থেকে সেটা খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় হারাল তা খুঁজতে খুঁজতে শেষে গোয়ালে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। কী দেখলাম জানেন?”

“কী?”

“দেখি কি, গোয়ালঘরে একটা বিশাল চেহারার মোষ বাঁধা। মোষটা এক কাঁড়ি নেদে রেখেছে। আদ্যাশক্তিদেবী তো খুব গোবর ভালবাসেন, দেখলাম তিনি। একটা পেতলের গামলায় সেই নাদি দুহাত ভরে ভরে তুলছেন আর আপনমনে এক গাল হেসে-হেসে খুব আহ্লাদের সঙ্গে বুলছেন–আহা, আজ একেবারে গোবরে-গোবরে ভাসাভাসি কাণ্ড। কত গোবর। জন্মে এত গোবর দেখিনি বাবা! গোবর দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, বুকটা ঠাণ্ডা হয়।”

“বটে?”

“তবে আর বলছি কী! পরিষ্কার দেখলাম মোষ। চোখ কচলে, নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখেছি, আমার দেখার ভুল নয়। হাতির মতো বিশাল, বিটকেল মোষ। আদ্যাশক্তিদেবী তার নাদি তুলতে তুলতে পরিষ্কার বললেন, “গোবর। তাই ভাবছি, মোষের গোবর হয় কি না! এখন মনে হচ্ছে, হয়।”

দুঃখহরণবাবু বললেন, “কিন্তু আমি অন্য কথা ভাবছি। গোয়ালঘরে মোযটা এল কী ভাবে?”

গণেশবাবু বললেন, “আমি কিন্তু তা ভাবছি না। আজ এক আশ্চর্য জ্ঞান লাভ করে আমার মাথাটা ভরে গেছে। মোষেরও যে গোবর হয়, এ একটা নতুন আবিষ্কার। সেই গোবরের চিন্তায় আমার মাথা ভর্তি।”

দুঃখবাবু মাথা নেড়ে বলেন, “তা জানি। কিন্তু অন্য দিকটাও একটু খেয়াল করবেন। মোযটা হঠাৎ এল কোত্থেকে? আর মোযটা গোয়ালে আসার পরেই হঠাৎ গোয়েন্দা বরদাচরণ এসে হাজির হল কেন? বিশেষত, গরু চুরির মামলার তদন্তে বরদাচরণের খুব নামডাক। এখানে যতগুলো গরু চুরির ঘটনা ঘটেছে, তার সব কটাই বরদাচরণ নিষ্পত্তি করেছে। তা হলে

“তা হলে কি আপনি বলতে চান, মোষটা চুরি করে আনা হয়েছে?”

দুঃখহরণবাবু বললেন, “তাই তো মনে হচ্ছে। তবে ওর ভিতর আরও কোনও রহস্য থাকাও অসম্ভব নয়।”

রাখোবাবু গুলতিটা হাতের কাছে টেবিলের ওপর রেখে দিলেন। বদমাশ কাকটা দেওয়ালে বসে সব দিক নজর রাখছে। কখন গুলতিটার আবার দরকার হবে বলা যায় না, তারপর রাখোবাবু বরদাচরণের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিসের ফোটোগ্রাফের কথা বলছিলেন যেন?”

বরদাচরণ গলাটা নিচু করে বললেন, “অত জোরে কথা বলবেন না। চারদিকে শত্রুপক্ষ কান পেতে আছে।”

রাখোবাবু অবাক হয়ে বললেন, “ফোটোগ্রাফ, শত্রুপক্ষ, এসব কী বলছেন বরদাবাবু?”

বরদাচরণ খুব বুদ্ধিমানের মতো একটু রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, “ওই ফোটোগ্রাফটার সন্ধানে বহু গুপ্তচর ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

রাখোবাবু বললেন, “কেন, সেই ফোটোগ্রাফে কী আছে?”

“উঁহু, অত জোরে কথা বলবেন না।” বরদাচরণ সাবধান করে দেন। চারদিকে সতর্ক চোখে চেয়ে দেখে গলা নামিয়ে বলেন, “হরিণগড়ের নাম শুনেছেন তো?”

রাখোবাবু মাথা নেড়ে বলেন, “তা আর শুনিনি। সেখানকার রাজবাড়ি দেখতে গেছি কয়েকবার।”

বরদাচরণ বললেন, “হ্যাঁ, এই ফোটোগ্রাফটার সঙ্গে সেই রাজবাড়ির একটা গভীর যোগাযোগ আছে।”

রাখোবাবু আগ্রহের সঙ্গে বললেন, “কী যোগাযোগ বলুন তো।”

বরদাচরণ আবার সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “আস্তে। সবাই শুনতে পাবে যে! ব্যাপারটা হল, হরিণগড়ের রাজা গোবিন্দনারায়ণের একমাত্র ছেলে কন্দর্পনারায়ণ খুব অল্প বয়সে হারিয়ে যায়। সন্দেহ করা হয়, কন্দর্পনারায়ণকে কোনও দুষ্ট লোক চুরি করে নিয়ে যায়। সে প্রায় দশ বছর আগেকার কথা। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কন্দর্পনারায়ণের খোঁজে হাজারটা লোক লাগানো হয়েছে, পুলিশ থেকে তো প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়েছেই। কিন্তু ছেলেটার খোঁজ পাওয়া একটু কঠিন হয়েছে, কারণ, কন্দর্পনারায়ণের যে-সব ফোটোগ্রাফ ভোলা হয়েছিল সেগুলো রাজবাড়ির কয়েকটা অ্যালবামে লাগানো ছিল। কন্দর্পনারায়ণের সঙ্গে সঙ্গে সেই সব অ্যালবামও উধাও। যারা কন্দর্পনারায়ণকে চুরি করেছে তারা খুবই চালাক লোক। তারা জানে, ছবি না থাকলে কন্দর্পনারায়ণের খোঁজ করা খুবই মুশকিল হবে। কেননা কন্দর্পনারায়ণকে তো আর সবাই দেখেনি। রাজবাড়িতে বা অন্য কোথাও যুবরাজ কন্দর্পনারায়ণের কোনও ছবিই নেই। ফলে যারা হারানো রাজকুমারের খোঁজ করছে তারা যাকে-তাকে রাজকুমার ভেবে ধরে ধরে রাজবাড়িতে নিয়ে এসেছে এতকাল। এ পর্যন্ত প্রায় কয়েক হাজার ছেলেকে এইভাবে রাজবাড়িতে হাজির করা হয়েছে। তাতে খুব গণ্ডগোল হয়। যে সব ছেলেদের ধরে আনা হয়েছিল তাদের বাপ-মাও এই নিয়ে খুব হইচই করে। এদিকে রাজা গোবিন্দনারায়ণ, রানী অম্বিকা এবং রাজার মা মহারানী হেমময়ী রাজকুমারের জন্য পাগলের মতো হয়ে গেছেন। গত দশ বছর ধরে তাঁরা ভাল করে খান না বা ঘুমোন না। কিন্তু একটা ব্যাপার সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিন্ত।”

পুরুতমশাই খুব মনোযোগ দিয়ে পিছনে বসে শুনছিলেন। আর থাকতে না পেরে হঠাৎ বলে উঠলেন, “কী, ব্যাপার সেটা?”

হঠাৎ পিছন থেকে সতীশ ভরদাজের গলা শুনে বরদাচরণ চমকে লাফিয়ে উঠে বললেন, “কে? কে? কে আপনি?”

বলতে বলতে বরদাচরণ অভ্যাসবশে পিস্তলের জন্য কোমরে হাত দিলেন।

রাখোবাবু বললেন, “ভয় পাবেন না বরদাবাবু, উনি আমাদের পুরুতমশাই। এতক্ষণ তো এখানেই বসে ছিলেন। দেখেননি?”

বরদাচরণ অবাক হয়ে বলেন, “না তা! উনি এখানেই ছিলেন?”

সতীশ ভরদ্বাজ রেগে গিয়ে বলেন, “হ্যাঁ বাপু, আগাগোড়া এখানে বসে আছি। তোমাকে পাঁচিলে উঠতে দেখলাম, কাকের তাড়া খেয়ে গাছের ডগা ভেঙে পড়তে দেখলাম। চারদিক লক্ষ করো না, কেমন গোয়েন্দা হে তুমি?”

বরদাচরণ পিস্তলের জন্য কোমরে হাত দিয়ে খুব অবাক। পিস্তলটা নেই। স্তম্ভিত হয়ে তিনি বলে উঠলেন, “এ কী! আমার পিস্তল?”

সতীশ ভরদ্বাজ ভয়ে আঁতকে উঠে বললেন, “পিস্তল খুঁজছ কেন বাপ? না, না, আমি তোমাকে অপমান করার জন্য কিছু বলিনি। তুমি বড় ভাল গোয়েন্দা।”

বরদাচরণ বিরক্ত হয়ে বলেন, “আমি যে ভাল গোয়েন্দা সে আমি জানি। কিন্তু আমার পিস্তলটা কোথায় গেল?”

সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “বন্দুক পিস্তল বড় ভাল জিনিস নয় বাবা। গেছে তো যাক, ও নিয়ে তুমি আর ভেবো না, ওসব কাছে। রাখলেই মানুষের মনে জিঘাংসা আসে।”

রাখোবাবুর আবছা মনে পড়ল, বরদাচরণের হাতে তিনি যেন পিস্তলটা একবার দেখেছিলেন। কিন্তু সে কথা চেপে গিয়ে বললেন, “আজ বোধহয় পিস্তলটা ভুলে এসেছেন।”

বরদাচরণ মাথা নেড়ে বলেন, “বলেন কী, পিস্তল আমার হাতের আঙুলের মতো অচ্ছেদ্য। পিস্তল ছাড়া কখনও বেরোই না। চারদিকে আমার অনেক শত্রু।”

“মানুষ মাত্রেই ভুল হয়,” রাখোবাবু বলেন। বরদাচরণ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে বলেন, “এমন বিরাট ভুল জীবনে কখনও করিনি। যাকগে, কন্দর্পনারায়ণের কথায় আসি, কী যেন বলছিলাম?”

পিছন থেকে সতীশ ভরদ্বাজ বলে উঠলেন, “তুমি বলছিলে, একটা ব্যাপার সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিন্ত।”

বরদাচরণ কটমট করে সতীশ ভরদ্বাজের দিকে তাকিয়ে কঠিনস্বরে বললেন, “আপনি আড়ি পেতে আমার সব কথা শুনেছেন। কিন্তু খুব সাবধান এ-সব কথা যেন পাঁচকান না হয়।”

সতীশ ভরদ্বাজ মাথা নেড়ে বললেন, “ঘুণাক্ষরেও না, ঘুণাক্ষরেও না। গল্পটা বড় ভাল কেঁদেছ। বলো তো শুনি।”

“গল্প নয়।” বলে বরদাচরণ আর-একবার পুরুতমশাইয়ের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে ফের রাখোবাবুকে বললেন, “হ্যাঁ, একটা ব্যাপার সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিন্ত। সেটা হল, কন্দর্পনারায়ণকে চুরি করা হলেও খুন করা হয়নি। কন্দর্পনারায়ণ যেখানেই থাক, সে বেঁচেই আছে। কারণ, সে চুরি যাওয়ার পর থেকে প্রতি বছর গোবিন্দনারায়ণের নামে একটা করে চিঠি আসে। চিঠিগুলো লেখে কন্দর্পনারায়ণ নিজেই। কিংবা ছেলে-চোরেরা তাকে দিয়ে চিঠি লেখায়। তাতে শুধু একটা কথাই লেখা থাকে–বাবা, আমার জন্য চিন্তা কোরো না। আমি ভাল আছি। ব্যস, আর কিছু থাকে না। সাধারণত জানুয়ারি মাসেই চিঠি আসে। আর, চিঠিগুলো আসে কখনও দিল্লি থেকে, কখনও বোম্বে থেকে, কখনও এলাহাবাদ থেকে। চিঠিগুলোতে কন্দর্পনারায়ণের হাতের ছাপ থাকে। কাজেই সন্দেহ নেই যে, সেগুলো তারই লেখা।”

বারান্দায় রেলিঙের ফাঁক দিয়ে তিনটে মুখ ঢুকিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে সরোজ, মনোজ আর পুতুল গল্প শুনছিল। কিন্তু ইস্কুলের সময় হয়ে যাওয়ায় মেজকাকা ভজহরি এসে তাদের ডেকে নিয়ে গেলেন।

বরদাচরণ বললেন, “প্রতি বছর যেসব জায়গা থেকে চিঠি আসে সেসব জায়গায় লোক পাঠানো হয়, পুলিশকেও জানানো হয়। কিন্তু কন্দর্পনারায়ণের চেহারা কেমন সেটা না-জানলে তাকে খুঁজে বের করা তো সম্ভব নয়। তাই এখন কন্দর্পনারায়ণের একটা ছবি খুঁজে বের করার জন্য রাজা গোবিন্দনারায়ণ আমাকে কাজে লাগিয়েছেন। রাজবাড়ির অ্যালবাম ছাড়াও কন্দর্পনারায়ণের আরও দু-একটা ছবি থাকতে পারে কোথাও। সেই আশায় গোবিন্দনারায়ণ আমার সাহায্য চেয়েছেন। তাই আমি বিভিন্ন জায়গায় হানা দিয়ে ছোট ছেলের ছবি খুঁজে বেড়াচ্ছি। যদি কারও কাছে এমন কোনও ছোট ছেলের ছবি থেকে থাকে, যাকে কেউ চিনতে পারছে না তা হলে সেই ছবি রাজবাড়িতে নিয়ে গিয়ে হাজির করার হুকুম রয়েছে।”

রাখোবাবু বলে উঠলেন, “সে তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়।” বলেই ফের মাথা নেড়ে রাখোবাবু বলেন, “না না ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় কথাটা এখানে খাটে না, এটা হল গিয়ে ডোমবনে বাঁশকানা।”

সতীশ ভরদ্বাজ বলে ওঠেন, “ডোমবনে বাঁশকানা আবার কী? বলুন, বাঁশবনে ডোমকানা।”

“ওই হল।” লজ্জা পেয়ে রাখোবাবু বলেন, “সারা তল্লাট জুড়ে বাচ্চা ছেলের ছবি খুঁজে বেড়াননা তো বিরাট ব্যাপার।”

বরদাচরণ বলেন, “ডিউটি ইজ ডিউটি। গোবিন্দনারায়ণ আমাকে এ কাজের জন্য মাসে পাঁচশো টাকা করে দিচ্ছেন। তা ছাড়া, ছবি যার কাছে পাওয়া যাবে তাকে নগদ এক হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। অবশ্য যদি সেটা রাজকুমার কন্দর্পনারায়ণের আসল ছবি হয়।”

রাখোবাবু খুব হেসে বললেন, “হাসালেন বরদাবাবু। হরিণগড়ের রাজাদের আর্থিক অবস্থা আমি জানি। বছর দুই আগেও গিয়ে দেখে এসেছি, রাজমাতা হেমময়ী দরবার-ঘরের বাইরের দেওয়ালে খুঁটে দিচ্ছেন। আরও কী দেখেছি জানেন? দেখেছি, রাজা গোবিন্দনারায়ণ শশা খাচ্ছেন। আর রানী অম্বিকা বাগানের জঙ্গল থেকে কচুর শাক তুলছেন। এক হাজার টাকা পুরস্কার। হুঁ।”

এই বলে রাখোবাবু উঠে যাচ্ছিলেন।

বরদাচরণ বললেন, “সবটা শুনুন রাখোবাবু, তারপর না হয় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন।”

সতীশ ভরদ্বাজও বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, সবটা শোনা উচিত।”

রাখোবাবু মুখটা বিকৃত করে বললেন, “আপনি কী বলতে চান বরদাবাবু যে রাজার মা খুঁটে দেয়, যার রানী কচুর শাক তোলে এবং যে রাজা নিজে শশা খায় সে পাঁচশো টাকায় গোয়েন্দা ভাড়া করবে আর একটা ছবির জন্য হাজার টাকা পুরস্কার দেবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য?”

বরদাচরণ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, “শুনুন রাখোবাবু। রাজার মা যে খুঁটে দেন সেটা অভাবে নয়। সময় কাটানোর জন্যই তিনি খুঁটে দেন। রানী অম্বিকা কচুর শাক তুলছিলেন বটে, কিন্তু তার মানে এ নয় যে তাঁদের অন্য তরকারি জোটে না। আসলে গোবিন্দনারায়ণের কচুর শাকের ওপর খুব রাগ। কিন্তু রানী নিজে কচুর শাক ভালবাসেন বলে চুপি-চুপি নিজেই তুলে নিয়ে গোপনে রান্না করে খান। আর শশা? হাঃ হাঃ। গোবিন্দনারায়ণের ডায়াবেটিস হওয়ার পর থেকে ডাক্তার তাঁকে কেবল শশা খেয়েই থাকতে বলেছেন যে! শশার মধ্যে চিনির ভাগ খুবই কম। আর এ তো সবাই জানে গোবিন্দনারায়ণের রাজত্ব এখন না থাকলেও রাজবাড়ির হাজারটা সুড়ঙ্গ দিয়ে মাটির তলায় যে সব চোর কুঠুরিতে যাওয়া যায় সেখানে লক্ষ লক্ষ টাকার হীরে জহরত আর মোহর রয়েছে! অবিশ্বাস করবেন না রাখোবাবু, আমি এরকম একটা চোর কুঠুরিতে নিজে একবার ঢুকেছিলাম।”

সতীশ ভরদ্বাজ বলে উঠলেন, “সত্যি বলছ বাবা বরদাচরণ?”

“আমি মিথ্যে বলি না,” বরদাচরণ গম্ভীরভাবে বলেন। সতীশ ভরদ্বাজ বলেন, “তা হলে একবার আমার বাড়ি যাও তো। মনে পড়ছে, আমার বাড়ির কুলুঙ্গিতে একটা ছোট্ট ন্যাংটো ছেলের হামা-দেওয়া ছবি আছে। আমার ব্রাহ্মণী আবার সেটাকে গোপালের ছবি ভেবে পুজো-টুজো করেন। একবার দেখো তো সেই-ছবিটাই নাকি?”

ঠাকুরমশাইয়ের কথায় কেউ কান দিল না।

বরদাচরণ বললেন, “রাখোবাবু, গত বছর আপনার বাড়ির সামনের বাগান থেকে সরস্বতী পুজোর আগের দিন রাত্রে অনেক ফুল ও ফল চুরি যায়, খবর পেয়ে এসে আমি তদন্ত করে বের করি যে, সে সব ফুল ও ফল চব্বিশ পল্লীর ছেলেরা তাদের পুজোর জন্য চুরি করেছিল। মনে আছে?”

রাখোবাবু রেগে গিয়ে বলেন, “তাতে মাথা কিনেছিলেন, আর কি! ধরে লাভটা কী হয়েছিল? তারা তো সে সব ফুল-ফল আমার গাছে এসে আবার লাগিয়ে দিয়ে যায়নি!”

বরদাচরণ গম্ভীরভাবেই বললেন, “এবং ওরা চুরি কেন করেছিল তাও আমি বের করেছিলাম। আপনি সেবার ওদের চাঁদা দেননি।”

রাখোবাবু রেগে গিয়ে বলেন, “কেন দেব? চব্বিশ পল্লীর পুজো আপনার পাড়ায় হয়। বেপাড়ার পুজোর চাঁদা দেব কেন? আর এও বলে রাখছি, সে চুরির পেছনে আপনার হতচ্ছাড়া ভাগনে। ওই চাকুও ছিল।”

বরদাচরণ বললেন, “শুনুন রাখোবাবু, উত্তেজিত হবেন না। আমি সেই চুরির ব্যাপার আলোচনা করতে আসিনি।”

“তা হলে কী জন্য এসেছেন?”

“যখন আমি এ বাড়িতে সেই চুরির ব্যাপারে তদন্ত করছিলাম তখন হঠাৎ আমার খুব জলতেষ্টা পায়। আমি পুতুলের কাছে এক গ্লাস জল চাই। পুতুল তখন এই বারান্দায় বসে একটা ছবির অ্যালবাম খুলে তার এক বন্ধুর সঙ্গে বসে ফোটোগুলো দেখছিল। সে অ্যালবাম রেখে জল আনতে গেল, তখন আমি আনমনে অ্যালবামটা তুলে ছবিগুলো দেখছিলাম। তার মধ্যে একটা খুব সুন্দর চেহারার ছেলের ছবি ছিল। ছেলেটা একটা বাংলো বাড়ির সামনের সিঁড়িতে বসে আছে, তার পাশে একটা কাঁচের গ্লাসে দুধ রয়েছে। দুধটা একটা বেড়াল খেয়ে নিচ্ছে…মনে পড়ছে আপনার? পুতুল জল নিয়ে এলে আমি তাকে ওই ছবিটা কার তা জিজ্ঞেস করায় সে বলতে পারল না। আমি তখন মনোজ, সোজ এবং ভজবাবুকেও জিজ্ঞেস করি। তারা কেউ কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু ছেলেটা দেখতে এত সুন্দর এবং ছবিটা এত রহস্যময় যে আমি ব্যাপারটা ভুলতে পারিনি। আজ ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল। কিছু যদি মনে করেন তো আপনাদের ছবির অ্যালবামটা একটু আনুন, আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে ওই ছবিটাই কুমার কন্দর্পনারায়ণের।”

রাখোবাবু একটু হাঁ করে থেকে বলে উঠলেন, “তাই তো বরদাবাবু! তাই তো!” বলেই হঠাৎ উঠে চেঁচাতে লাগলেন–”রামু, রঘু, কিরমিরিয়া জলদি অ্যালবাম আন। জলদি।”

ডাক শুনে কিরমিরিয়া রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ডুকরে কেঁদে উঠল, “ও দাদাবাবু গো, আমি কিছু জানি না গো! আমি কিছু করিনি গো!”

রঘু ‘জলদি’ শুনতে ‘জল’ শুনে এক গ্লাস জল নিয়ে পড়িমরি করে দৌড়ে এল। আর রামু তাড়াতাড়ি বাড়ির পিছনে গিয়ে লুকল।

যাই হোক, অনেক চেঁচামেচি, খোঁজাখুঁজির পর অ্যালবামটা পাওয়া গেল।

হাঁফাতে হাঁফাতে রাখোবাবু অ্যালবাম এনে পাতা খুলে ছবিটা খুঁজতে লাগলেন। খুঁজতে-খুঁজতে একটা পাতায় দেখা গেল ছবিটা যে-চারটে স্টিকারে লাগানো ছিল তা লাগানোই আছে, কিন্তু ছবিটা নেই।

রাখোবাবু হতাশ হয়ে বসে বললেন, “সর্বনাশ!”

বরদাচরণ অ্যালবামটা তুলে নিয়ে দেখলেন। মুখখানা অসম্ভব গম্ভীর হয়ে গেল। হঠাৎ আস্তে করে বললেন, “রাখোবাবু, এখন আমার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নেই যে এ ছবিটাই ছিল কন্দর্পনারায়ণের ছবি।”

সতীশ ভরদ্বাজ বলে ওঠেন, “আমার ঘরে যে বালগোপালের ছবিটা আছে, বুঝলে বাবা বরদা, সেটাও–”

বরদাচরণ সতীশ ভরদ্বাজকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, “অ্যালবাম থেকে ছবিটা চুরি যাওয়াতেই ব্যাপারটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অ্যালবামটা আমি নিয়ে যাচ্ছি রাখোবাবু, ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো দেখতে হবে। আর বাড়ির সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদও করা দরকার।”

রাখোবাবু উদভ্রান্তের মতো চেঁচাতে লাগলেন, “সবাই এসো এদিকে। চলে এসো। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। কড়কড়ে হাজারটা টাকা ফসকে গেল, ইয়ার্কি পেয়েছ নাকি? কোথায় গেল সরোজ, মনোজ, পুতুল?”

রঘু ভয়ে ভয়ে বলে, “খোকাখুকিরা ইস্কুলে গেছে।”

“ডেকে আন ইস্কুল থেকে।”

হারাধন তার ল্যাবরেটরির দরজা খুলে বেরিয়ে এসে গম্ভীরভাবে বলে, “কী হয়েছে বলো তো। ওই বরদা ক্লাউনটা কোনও গোলমাল করছে নাকি?”

বরদাচরণ গম্ভীরভাবে বলেন, “ক্লাউন কে তা আয়না দিয়ে নিজের মুখ দেখলেই টের পাবে হারাধন। আমি জরুরি কাজে এসেছি, ইয়ার্কি কোরো না।”

“হুঁ! জরুরি কাজ! কার বেড়াল চুরি গেল, কার বাগান থেকে কে লাউ নিয়ে গেল, কার গরু হারাল, এ সব খুঁজে বেড়ানোই যার কাজ তার আবার ডাঁট কত!”

বরদাচরণ বলেন, “তবু ভাল, লাউয়ের সঙ্গে কুমড়ো মেশানোর চেষ্টা করে তোক হাসাইনি।”

রাখোবাবু দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, “সবাই চুপ করো। শোনো সবাই, আমি মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি বাড়ির লোককে। এর মধ্যে চুরি-যাওয়া ছবিটা খুঁজে বের করতেই হবে।”

ইস্কুলে ইন্টারক্লাস ক্রিকেট লিগ চলছে। সেই নিয়ে এবার চারদিকে খুব উত্তেজনা। এমনিতে এক ক্লাসের সঙ্গে অন্য ক্লাসের খেলায় আর উত্তেজনার কী থাকবে?

আসলে হয়েছে কি, এবার ক্লাস নাইনে দুটি নতুন ছেলে এসে ভর্তি হয়েছে। তারা যমজ ভাই, হুবহু একরকম দেখতে। তারা পোশাক করে একইরকম, টেরি কাটে মাথার একই ধারে, এমন কি দুজনেরই বাঁ গালে তিল। তফাত শুধু নামে, একজনের নাম সমীর, অন্যজনের নাম তিমির। দুই ভাই-ই দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলোয়াড়। তবে খেলাতে দুই ভাইয়ের কিছু তফাত আছে। সমীর সাঙ্ঘাতিক জোরে বল করে, তার বল চোখে ভাল করে ঠাহর হয় না। অন্যজন তিমির বেদম ব্যাট করে, প্রায় ম্যাচেই সেঞ্চুরি করেও নট আউট থেকে যায়।

দুই যমজ ভাইয়ের দৌলতে ক্লাস নাইন এবার দুরন্ত টিম। স্কুলের চ্যাম্পিয়ন তো তারা হবেই জানা কথা। শোনা যাচ্ছে এবার সমীর আর তিমিরকে জেলা একাদশেও নেওয়া হবে। যেদিন ক্লাস নাইনের খেলা থাকে সেদিন মাঠের চারধারে বহু লোক জমে যায় সমীর-তিমিরের বলের হলকা আর ব্যাটের ভেলকি দেখতে।

নাম-ডাক হওয়াতে দুই ভাইয়েরই কিছু ডাঁট হয়েছে। এমনিতেই তারা বড়লোকের ছেলে। তাদের বাবা সিভিল সার্জেন। দুটো সবুজ রঙের রেসিং সাইকেলে চেপে তারা ইস্কুলে আসে। টকাটক ইংরিজিতে নিজেদের মধ্যে কথা বলে। কাউকে বড় একটা গ্রাহ্য করে না। ইস্কুলের মাস্টারমশাইরা পর্যন্ত তাদের একটু সমঝে চলেন।

ওদিকে ক্লাস এইটও বেশ ভাল টিম। যদিও তাদের সমীর বা তিমিরের মতো বোলার বা ব্যাটসম্যান নেই তবু গেম টিচার তারক গুহ বলেন, “আমার মনে হয়, ক্লাস এইট একটা আপসেট করতে পারে।”

এইট-এর ক্যাপটেন মনোজ। বলতে কি, ক্লাস সেভেন-এ পড়ার সময়ে সে প্রথম ক্রিকেটের হাতে-খড়ি করে। ব্যাট খারাপ করে না, বলও খুব জোরে করতে পারে। এইট-এ উঠে ইন্টারক্লাস লিগে এ পর্যন্ত সব কটা ম্যাচ তারা জিতেছে। প্রত্যেকটাতেই মনোজের রান ভাল, উইকেটও খারাপ নেয়নি।

তারক গুহ প্রবীণ লোক। একসময়ে নাকি কলকাতায় ভাল টিমে ক্রিকেট খেলতেন। কোচ হিসেবে তাঁর তুলনা নেই, সবাই বলে। মফস্বলের স্কুলে সামান্য বেতনের গেম টিচারের চাকরি করেন বলে তেমন পাত্তা দেয় না কেউ। রোগা কোলকুঁজো, বুড়ো শকুনের মতো চেহারা তারকবাবুর। গায়ের রঙ ব্ল্যাকবোর্ডের মতো কালো। পান খেয়ে খেয়ে দাঁতগুলো সব খয়েরি হয়ে গেছে। গায়ে সব সময়ে বেঢপ বড় সাইজের সাদা ফুলহাতা জামা, পরনে সাদা জিনের প্যান্ট, কোমরে কখনও দড়ি কখনও মোটা চামড়ার বেল্ট বাঁধা, পায়ে কেডস। এ ছাড়া তারকবাবুকে অন্য পোশাকে দেখা যায় না। জামাকাপড় সব সময়ে ময়লা। নাকে নস্যি দেন বলে খোনা সর্দির গলায় কথা বলেন। তাঁর ল্যাকপ্যাকে হাত পা, চেহারা আর পোশাক দেখে কিছুতেই ভাবা যায় না যে এ লোক খেলার কিছু জানে।

তারকবাবুকে সমীর-তিমিরও পাত্তা দেয় না। বরং তারকবাবুই সেধে যেচে ওদের কাছে গিয়ে নেট প্র্যাকটিসের সময় নানারকম উপদেশ দেন। ওরা হাসে। সমীর একদিন মুখের ওপরেই বলে দিল, “আপনি তো স্যার কখনও ফাস্ট বল চোখেই দেখেননি ভাল করে, ইনসুইং-এর গ্রিপ আপনার কাছে কী শিখব! আমি কলকাতায় ফাঁদকারের কাছে বোলিং শিখেছি।”

সেই থেকে তারকবাবুর ওদের ওপর খুব রাগ। ভাল খেলো সে তো ঠিক আছে, তা বলে প্রশিক্ষককে সম্মান দেবে না?”

সেই থেকে তারকবাবু হন্যে হয়ে অন্য ক্লাশের ছেলেদের মধ্যে সত্যিকারের ক্রিকেট-প্রতিভা খুঁজে বেড়িয়েছেন।

এইভাবেই একদিন মনোজকে তাঁর নজরে পড়ে। এইট-এর সঙ্গে টেন-এর খেলা ছিল। মনোজ বারো রানের মাথায় একটা হুক মারতে গিয়ে ক্যাচ তোলে। আউট হয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসবার সময়ে তারকবাবু ধরলেন। বললেন, “ছোঁকরা, তোমার বয়সী কোনও ছেলে যে লেট কাট মারতে পারে তা আমার ধারণা। ছিল না। কোত্থেকে শিখলে?”

মনোজ আমতা-আমতা করে বলল, “ক্রিকেটের বইয়ের ছবি দেখে স্যার।”

“বাঃ! বাঃ!”

ভারী খুশি হলেন তারকবাবু, তাঁর কোটরগত চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল। বললেন, “সত্যিকারের প্লেয়ার হতে চাও? তবে আমি তোমাকে প্লেয়ার বানাব, কিন্তু একটু কষ্ট করতে হবে বাবা।”

মনোজ রাজি হয়ে গেল।

সেই থেকে তারকবাবু গোপনে মনোজকে তালিম দেন। মাঝে মাঝে বলেন, “তোমার বডি তো খুব ফিট। দমও অনেক। ফাস্ট বোলিং তোমার হবেই।”

সারা স্কুলে মোট পাঁচটা টিম। ফাঁইভ, সিক্স, সেভেন মিলিয়ে একটা টিম, আর চারটে উঁচু ক্লাশের।

ক্লাশ নাইন ক্লাশ এইট ছাড়া বাকি সবাইকে হারিয়ে দিল। ক্লাশ এইট ও নাইন ছাড়া বাকি সবাইকে হারাল; দু ক্লাশের পয়েন্ট সমান। এই দুই ক্লাশের খেলায় যে জিতবে সে-ই চ্যাম্পিয়ন।

সবাই জানে নাইন জিতবে। ইলেভেন-এর বড় ছেলেদের সঙ্গে খেলাতেও নাইন নয় উইকেটে জিতেছিল। সমীর নটা উইকেট পায় মাত্র নয় রানে। তিমির নিরানব্বই করেছিল একা। কাজেই বোঝা যাচ্ছে ক্লাস নাইন কী সাঙ্ঘাতিক টিম।

আজ ফাঁইনাল খেলা। ফাস্ট পিরিয়ডের পর স্কুল ছুটি হয়ে গেল। খেলার মাঠের চারিদিকে দারুণ ভিড় আর ধাক্কাধাক্তি। মাঝের মাঝখানে তিনটে করে ছটা স্টাম্প গাড়া হয়ে গেছে। স্বয়ং সিভিল সার্জেন, ডি এস পি আর মুনসেফ খেলা দেখতে এসেছেন। তাঁদের জন্য আলাদা চেয়ারের ওপর ছোট ত্রিপল টাঙানো হয়েছে। ক্রেট বোঝাই লেমোনেড এসেছে মাঠে। চানাচুর, ঝালমুড়ি, ফুচকা আর আইসক্রিমের গাড়ি জড়ো হয়েছে। বেশ মেলা-মেলা ভাব।

তারকবাবু প্রচণ্ড উত্তেজনায় ছোটাছুটি করছেন।

এইট-এর ক্যাপটেন মনোজ আর নাইন-এর ক্যাপটেন সমীর মাঠে নেমে টস করল।

টসে জিতে গেল মনোজ। বিনা দ্বিধায় বলল, “ব্যাট।”

সমীর একটু কাঁধ ঝাঁকাল মাত্র।

ওয়ান ডাউনে মনোজ নামবে। ওপেনিং ব্যাটসম্যান দুজন মাঠে রওনা হয়ে যেতেই তারক স্যার এসে বললেন, “মনোজ প্যাড-আপ করো। এক্ষুনি উইকেট পড়বে।”

মনোজ প্যাড বাঁধতে বাঁধতে বলল, “একঘণ্টা টিকতে পারলে হয়।”

তারক স্যার নিজে প্রচণ্ড উত্তেজিত। তবু বললেন, “উত্তেজিত হয়ো না মনোজ। আমি জানি সমীরের সুইং নেই। কিন্তু অসম্ভব জোরে বল আসে বলে আনাড়িরা খেলতে পারে না, লাগার ভয়ে আউট হয়ে চলে আসে। তুমি ঘাবড়াবে না।”

স্যারের কথাই ঠিক। মাঠে নামতে না নামতে ওপেনিং ব্যাট গদাইচরণ সমীরের দ্বিতীয় বলে বোলড হয়ে ফিরে এল।

মনোজ যখন নামছে তখন ক্লাশ এইট-এর ছেলেরা খুব হাততালি দিল। সমীর দূর থেকে বলটা লোফালুফি করতে করতে একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। তারকবাবু মনোজের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মাঠের মধ্যে খানিকদূর এলেন, বার বার বললেন, “সোজা বল, খেলতে অসুবিধা নেই। প্রথম থেকেই একটু মেরে খেললে দেখবে ও কাবু হয়ে গেছে।”

যদিও মনোজ খুব সাহসী ছেলে তবু এখন তার হাত-পা একটু ঝিম ঝিম করছিল! হাঁটুর জোরটা যেন কমে গেছে, হাতে ব্যাটটা বেশ ভারী-ভারী লাগছে।

গার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে চারদিকে ফিলডারদের অবস্থান দেখতে একটু সময় নিল মনোজ। ভয় করছে। বেশ কয়েকবার বুকটা দুরদুর করে ওঠে।

সমীর ওভারের তৃতীয় বলটা দিতে প্রায় স্ক্রিনের কাছাকাছি চলে গেছে। অত দূর থেকে দৌড়ে এসে বল করলে সে বল যে কী মারাত্মক জোরের বল হবে তা ভাবতেই মনোজের পেটটা গুলিয়ে উঠল।

চারদিকের মাঠ স্তব্ধ। সমীর জেট প্লেনের মতো দৌড়ে আসছে। এসে বাঁই করে হাত ঘোরাল।

বলটা একবার দেখতেও পেল না মনোজ। একটা আবছা লাল ফিতের মতো কী যেন সড়াক করে পিচের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। বেকুবের মতো মনোজ দাঁড়িয়ে থাকে। স্লিপের ফিলডাররা হাসছে।

আবার সমীর দৌড়ে আসে। বল করে। আবার সেই লাল ফিতের মতো লম্বাটে একটা ছায়া দেখতে পায় মনোজ। কিন্তু এমন সাঙ্ঘাতিক তার গতি যে ব্যাটটা তুলবারও সময় হয় না।

মনোজের ভাগ্য ভাল যে, দুটো বলই ছিল বাইরের।

সে আবার ব্যাট আঁকড়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু হাত পা ঝিম ঝিম করে, চোখে অন্ধকার-অন্ধকার লাগে। স্ক্রিনের কাছ থেকে সমীর ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো দৌড়ে আসছে।

মনোজের একবার দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হল। অনেক কষ্টে সে ইচ্ছে দমন করে প্রাণপণে চোখ দুটো বিস্ফারিত করে সমীরের বল করার কায়দাটা দেখতে লাগল।

সমীরের হাত যখন ঘঘারে তখন ঠিক সিলিং ফ্যানের মতো ঘূর্ণমান চক্রের মতো দেখায়।

এবার লাল ফিতেটা বাইরে দিয়ে গেল না। সোজা চলে এল মনোজের দিকে। গুড লেংথে পড়ে মিডলস্টাম্পে।

মনোজ ব্যাট তোলেনি, হাঁকড়ায়নি, কিচ্ছু করেনি। বলটা এসে আপনা থেকেই ব্যাটটাকে একটা ঘুষি মেরে অফ-এর দিকে গড়িয়ে গেল।

একটা বল আটকেছে মনোজ, তাইতেই হাততালি পড়ল চারদিকে।

সমীর শেষ বলটা করতে আসছে। একইরকম গতিবেগ। তবে এখন মনোজের অতটা ভয় করছে না।

এ বলটাও সোজা এল। একটু শর্ট পিচ পড়ে কোমর সমান উঁচু হয়ে লেগ-এর দিকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মনোজ ব্যাটটা দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ভেগে-যাওয়া বলটা জোর চাপড়ে দেয়। সেই চাপড়ানিতে বলটা আরো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে একলাফে বাউন্ডারি ডিঙিয়ে আরও পঞ্চাশ গজ দূরে গিয়ে পড়ল। ছক্কা।

হাততালির তুমুল শব্দে কানে তালা লাগবার জোগাড়।

পরের ওভারে বল করল সোজ। এইট-এর ওপেনিং ব্যাট ষষ্ঠীব্ৰত সে ওভারটা খুটখাট করে কাটিয়ে দিল। রান হল না।

পরের ওভারে আবার সমীর বল করতে আসে, মনোজ ব্যাট করবে।

চারিদিক থেকে চিৎকার ওঠে, “মনোজ আর একটা ছক্কা চাই।”

আগের ওভারে একটা ছক্কার মার খেয়ে সমীরের শরীরে আগুন লেগে গেছে। সে তিনগুণ জোরে দৌড়ে এসে যে বলখানা দিল তা অ্যাটম বোমের মতো। কিন্তু মনোজের বুকের দুরদুরুনিটা এখন নেই। হাত-পাও বেশ বশে এসে গেছে। চোখেও কিছু খারাপ দেখছে না।

অফ স্টাম্পের ওপর বলটা ছিল। মনোজ পা বাড়িয়ে ব্যাটখানা পিছনে তুলে বলটার ঠিক ব্ৰহ্মতালুতে ব্যাটখানা দিয়ে চাপড়াল। বলটা মাটিতে একটা ঠোকর খেয়ে স্লিপের মাঝখান দিয়ে সে কি পড়ি মরি দৌড়, যেন পালাতে পারলে বাঁচে।

বাউন্ডারি। হাততালি। চিৎকার। পরের বল মিডল স্টাম্পে, গুড লেংথ। সাধারণত ব্যাটসম্যান এ বল আটকায়। মনোজের এখন আর আটকানোর কথা মাথায় আসছে না। মার না পড়লে সমীরের ধার ভোঁতা হবে না। পিচে পড়ে বলটা ওঠার মুখে, মনোজ এগিয়ে সেটাকে অন ড্রাইভ করল। সমীরের জোরালো বল সে মার সইতে পারল না,

বন্দুকের গুলির মতো মাঠের বাইরে বেরিয়ে গেল।

লাইনের ধারে লোকেরা ভীষণ চেঁচাচ্ছে, ছেলেরা লাফাচ্ছে, স্বয়ং তারকবাবু নিয়ম ভেঙে দু-দুবার মাঠের মধ্যে ছুটে এসেছিলেন, তাঁকে হেডস্যার এসে ধরে নিয়ে গেলেন।

মনোজ এখন আর অন্য কিছু দেখছেও না, শুনছেও না। তার সমস্ত মন চোখ এখন বলের দিকে। একের পর এক বল আসে আর মনোজ এগিয়ে পিছিয়ে, শরীর বাঁকিয়ে নানা কায়দায় কেবল পেটায়। তার মারমূর্তি দেখে সমীরের বল একদম ঝুল হয়ে গেল। দশ ওভারের পর হাঁফাতে হাঁফাতে তার জিভ বেরিয়ে গেছে, মনোজ তখন আশি ছাড়িয়ে গেছে। টোটাল বিরানব্বই। এর মধ্যে শুধু ষষ্ঠীব্রত আউট হয়েছে। আর কোনও ঘটনা ঘটেনি।

মফস্বলের স্কুলের খেলায় লাঞ্চ বা টি হয় না। একনাগাড়ে খেলা চলে। এক ইনিংসের খেলা একদিনেই শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংস বলে কিছু নেই।

কিন্তু ব্যাপার-স্যাপার দেখে মনে হচ্ছিল, ক্লাশ এইট-এর ব্যাটের দাপট আজকে কমবে না। এক ইনিংসও আজ শেষ হবে না।

মনোজ সমীরকে তিন-তিনটে চার মেরে নব্বইয়ের কোঠায় ঢুকে গেল। স্কোরাররা তাল রাখতে পারছে না রানের গতির সঙ্গে।

ওদিকে দর্শকদের মধ্যে একজন কালো চশমা পরা গম্ভীর মানুষ এসে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর গলায় দূরবীন, কাঁধে ক্যামেরা ঝুলছে। কোমরে পিস্তরের খাপ আছে বটে কিন্তু তাতে পিস্তল নেই। বরদাচরণ মনোজ আর সরোজকে জেরা করতে এসেছেন।

কিন্তু খেলা ভাঙার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বলে তিনি খুবই বিরক্ত, বার বার ঘড়ি দেখছেন। একবার ধৈর্য হারিয়ে বলেই ফেললেন, “দূর ছাই, ছেলেটা কি আউট হবে না নাকি?”

পাশেই তারকবাবু ঘাসের ওপর বসে জুলজুলে চোখে মনোজের খেলা দেখছেন। বরদাচরণের কথা শুনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, “কী! কী বললেন মশাই?”

ল্যাকপ্যাকে রোগা হলেও তারকাবুকে তখন হুবহু খুনির মতো দেখাচ্ছিল।

তারকবাবু খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “ইয়ার্কি পেয়েছেন মশাই? ক্রিকেটের মতো সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে ইয়ার্কি? কোন আক্কেলে আপনি ওই অলক্ষুণে কথা বললেন?”

চেঁচামেচিতে মুহূর্তের মধ্যে বরদাচরণের চারধারে ভিড় জমে গেল। স্বয়ং ডি এস পি এগিয়ে এসে বললেন, “আরে! এ যে দেখছি সেই কমিক্যাল গোয়েন্দা ভ ভদ্রলোক! কী করেছেন উনি?”

তারকবাবু আগুন হয়ে বললেন, “ইনি চাইছেন মনোজ আউট হয়ে যাক।” বরদাচরণের কাঁদো কাঁদো অবস্থা। লোকজন চারদিক থেকে আওয়াজ দিচ্ছে। একজন সিটি দিল, অন্যজন বলে উঠল, “ওরে দ্যাখ গোয়েন্দাচরণের পিস্তলের খাপ ফাঁকা!”

বরদাচরণের দূরবীনটা তুলে দূরের জিনিস দেখতে লাগল। সানগ্লাসটা খুলে নিল একজন।

চাকু মামার দুরবস্থা দেখছিল দূর থেকে। সে আরও একটা জিনিস লক্ষ করে রেখেছে। সে লক্ষ করেছে ক্রিকেট মাঠের বাইরে ঘাসজমিতে মনোজদের কুখ্যাত দুষ্ট গরু হারিকেন চরে বেড়াচ্ছে।

চাকু কাউকে কিছু না বলে নিঃশব্দে হারিকেনের দিকে এগিয়ে গেল।

এদিকে মনোজের নিরানব্বই। সমীর সরে গেছে অনেক আগে। একটা আনাড়ি ছেলে বল করতে আসছে। একটা রান অনায়াসে হবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে চারদিক থেকে তুমুল চিৎকার উঠল। বোলার ছেলেটা তার দৌড়ের মাঝপথে হঠাৎ বাঁ দিকে ঘুরে প্রাণপণে মাঠের বাইরে ছুট লাগাল। আম্পায়ার অঙ্ক স্যার একটা স্টাম্প উপড়ে বাগিয়ে ধরে তারপর কী ভেবে স্টাম্পটা হাতে করেই দৌড়তে থাকেন।

হতভম্ব মনোজ প্রথমটায় কিছু বুঝতে পারেনি। তারপরই দেখতে পেল, তাদের গরু হারিকেন বাঁ ধারে লাইনের পাশে প্রায় আট-দশজনকে গুঁতিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে, তারপর মাঠে ঢুকে দুজন ফিল্ডারকে ধরাশায়ী করে এখন পিচের দিকে ছুটে আসছে। তার মুখে ফেনা, চোখ লাল, ফোঁস ফোঁস শ্বাস ছেড়ে বাঘের গলায় ‘হাম্বা’ ডাক ছাড়ছে।

তার সেই মূর্তি দেখে মুহূর্তে মাঠ ফাঁকা। ডি এস পি, সিভিল সার্জেন, হেডস্যার কে কোথায় গেলেন কে জানে! চারদিকে জড়ামড়ি করে কিছু ছেলে আর লোক পড়ে গেছে মাঠে। হারিকেন মনোজকে চেনে, কাজেই সে মনোজের দিকে দৃকপাত করে সোজা মাঠের লাইনের ধারে দর্শকদের দিকে ছুটে গেল।

বরদাচরণ পিস্তলের খাপে হাত বাড়িয়ে বড় হতাশ হলেন।

তাই তো! হারিকেন আর কাউকে না ধরে কী করে যেন বরদাচরণকেই টারগেট বানিয়ে তেড়ে গেল।

অসমসাহসী বরদাচরণ পালানোর চেষ্টা করেও পারলেন না। দেওয়াল থেকে পড়ে হাঁটুতে চোট। সুতরাং তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। হারিকেন তেড়ে এসে টু মারতেই বরদাচরণ বাঁ পাশে সরে গেলেন। আবার টু। বরদা আবার ডানপাশে সরলেন। ৬৮

দারুণ জমে গেল খেলা। বরদাচরণ ভারসাস হারিকেন। ক্রিকেটের কথা ভুলে লোকজন বুলফাইট দেখতে আবার ভিড় জমিয়ে ফেলল।

ভিড়ের ভিতর থেকে একটা লোক তার গায়ের লাল ব্যাপারটা খুলে বরদাচরণের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “বরদাবাবু, আমাদের আসল বুল ফাঁইট দেখিয়ে দিন।”

হারিকেনের তৃতীয় ঢুটা এড়াতে গিয়ে বরদাচরণ মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। হারিকেন আবার ফিরে আসছে। বরদাচরণ করেন কী? তাড়াতাড়ি লাল র‍্যাপারটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বুল ফাঁইটারের মতোই হারিকেনকে দেখিয়ে সেটা নাড়তে লাগলেন। হারিকেন দৌড়ে এল। বরদাচরণ খুব দক্ষতার সঙ্গে সরে গেলেন। কিন্তু হারিকেন বোকা ষাঁড় নয়, সে হল ত্যাঁদড়া গরু। বরদাচরণের ওপর তার রাগ কেন তা অবশ্য বোঝা গেল না। কিন্তু লাল র‍্যাপার নিয়ে বরদাচরণকে ইয়ার্কি করতে দেখে, তার রাগ চড়ে গেল কয়েক ডিগ্রি। চারদিকে লোকজন শাবাশ! বাহবা! হুররে। লেগে যা, ঘুরে ফিরে।’ বলে চেঁচাচ্ছে। তাই শুনে আরও খেপে গেল হারিকেন। কিন্তু এবার আর সে তাড়াহুড়ো করল না। খুব ভাল করে বরদাচরণকে লক্ষ করে দেখে নিল। তারপর হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে এগিয়ে এসে আচমকা ধেয়ে এসে তার চার নম্বর হুঁ লাগাল।

সেই ছুঁতে হাতি পর্যন্ত টলে যায় তো মানুষ কোন ছার! বরদাচরণ সেই গুতো এড়াতে পারলেন না, তিন হাত শুন্যে ছিটকে উঠে চার হাত দূরে গিয়ে পড়ে চেঁচাতে লাগলেন, “পুলিশ, দমকল, বাবারে!”

হারিকেন অবশ্য আর বরদাচরণের দিকে দৃকপাত করল না। সে চমৎকার লাল আলোয়ানটা দেখে মুগ্ধ হয়ে খুব হাসি-হাসি মুখ করে সেটা মুখে নিয়ে চিবোতে লাগল। যার আলোয়ান, সে ডুকরে উঠে বলতে লাগল, “গেল বার ষাট টাকায় কিনেছিলাম গো! গরুর পেটে আস্ত ষাটটা টাকা ওই চলে গেল।”

কারও সাহস হল না হারিকেনের মুখ থেকে আলোয়ানটা কেড়ে আনবে।

অসম সাহসী গোয়েন্দা বরদাচরণ অনেকটা পথ হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে গিয়ে ইস্কুলের বারান্দায় উঠে বসে কোঁকাতে লাগলেন। আজকের দিনটা তাঁর ভাল যাচ্ছে না। একটা ভুতুড়ে কাকের তাড়া খেয়ে দেওয়াল থেকে পড়েছেন। পিস্তল হারিয়েছেন। ত্যাঁদড় গরুর পাল্লায় পড়ে একেবারে বেহাল হয়েছেন। কিন্তু গুরুতর আহত হয়েও তিনি তাঁর কর্তব্যকর্ম বিস্মৃত হননি। সামান্য একটু দম নিয়েই তিনি হামাগুড়ি দিয়ে চারদিকে ঘুরে সরোজ আর মনোজকে খুঁজতে লাগলেন। তার দৃঢ় ধারণা, কুমার কন্দর্পনারায়ণের দুর্লভ ছবিটার হদিশ ওদের কাছে পাওয়া যাবে।

কিন্তু সরোজ আর মনোজ তখন ইস্কুলের ত্রিসীমানায় নেই। তাদের গরু হারিকেন আজকের ম্যাচ খেলা নষ্ট করেছে, একজনের আস্ত লাল আলোয়ান চিবিয়ে খেয়েছে, বরদাচরণের ক-খানা হাড় ভেঙেছে তা কে জানে! হারিকেন ছাড়া পেলে শহরে তুলকালাম সব কাণ্ড হয়। আর লোকে এসে তাদের গালমন্দ করে, ক্ষতিপূরণ চায়, কয়েকবার পুলিশের কাছেও নালিশ হয়েছে। তাই আজ হারিকেনের কাণ্ড দেখে দুই ভাই কোন ফাঁকে সটকে পড়েছে।

এদিকে বরদাচরণকে হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে আবার লোকে ভিড় করে এল। হেড স্যার, ডি এস পি, সিভিল সার্জেন, ছাত্র আর মাস্টারমশাইরা তাঁকে ঘিরে ধরে বোঝাতে লাগলেন, আপনি আহত হয়েছেন বরদাবাবু, এবার একটু বিশ্রাম নিন। ফার্স্ট এইড দেওয়া হবে।

বরদাচরণ বললেন, “ডিউটি ইজ ডিউটি। আমি সরোজ আর মনোজকে এক্ষুনি জেরা করতে চাই। খুব জরুরি দরকার।”

ছেলেরা খবর দিল, ওদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হারিকেন ওদেরই গরু কিনা। তাই ওরা লজ্জায় চলে গেছে।

ইতিমধ্যে ডি এস পি থানায় খবর পাঠিয়েছেন, যেন সশস্ত্র পুলিশবাহিনী এসে বদমাশ গরুটাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আলোয়ানওয়ালা লোকটা এসে ক্ষতিপূরণের জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর করছে। সমীর আর তিমির বলে বেড়াচ্ছে, হেরে যাওয়ার ভয়ে ক্লাশ এইট গরুটাকে মাঠের মধ্যে তাড়া করে এনেছিল। তাই শুনে তারকবাবু খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “ওই গরুটার জন্যই তোমরা এ যাত্রা বেঁচে গেলে। ক্রিকেট খেলার অ-আ-ক-খ-ই এখনও তোমাদের রপ্ত হয়নি।”

ইস্কুলে যখন এইসব কাণ্ড চলছে তখন মনোজদের বাড়ির অবস্থা খুব থমথমে। রাখোবাবু সবাইকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন, তার মধ্যে হারানো ছবিটা খুঁজে বের করতেই হবে। রাখোবাবু এই কথা ঘোষণা করেই হাতঘড়িটা হাতে পরে নিয়ে মাঝেমাঝে সময় দেখছেন আর বলছেন, “এই তিন ঘণ্টা হয়ে গেল…এই চার ঘণ্টা দশ মিনিট..প্রায় পাঁচ ঘণ্টা…আর মাত্র উনিশ ঘন্টা আছে কিন্তু।”

বাড়িসুদ্ধ লোক ঘরদোর তোলপাড় করে ছবি খুঁজতে লেগেছে। সতীশ ভরদ্বাজ দুপুরবেলা বাড়ি যাওয়ার সময় বলে গেছেন, “আমার হাঁদু-উঁদু থাকলে একলহমায় ছবি-কে-ছবি এমনকি কন্দর্পনারায়ণকেও খুঁজে বের করে কাঁধে বয়ে এনে ফেলত। কিন্তু কী করব, তারা দু মাসের ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। নইলে কোনও হাঙ্গামা ছিল না।”

হাঁদু-ভুঁদু হল সতীশ ভরদ্বাজের পোষা ভূত। সবাই তাদের কথা জানে। কেউ অবশ্য তাদের কখনও দেখেনি, কিন্তু সবাই ভয় খায় তাদের।

বৈজ্ঞানিক হারাধন আকাশ থেকে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের একটা নতুন গবেষণায় খুব ব্যস্ত। তামার তার দিয়ে গোটা কুড়ি ঢাউস গ্যাস-বেলুন আধ মাইল উঁচুতে তুলে দেওয়া হবে। সেখানে কোনও একটা স্তরে প্রচুর বিদ্যুতের একটা বলয় রয়েছে। তামার তার বেয়ে সেই বিদ্যুৎ ধরে এনে নানা কাজে লাগানো যাবে বলে হারাধন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। কিন্তু আধ মাইল লম্বা কুড়িটা তামার তার জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা নয়। তার ওপর তারগুলো এমন জট পাকিয়ে যায় যে, জট ছাড়াতে গলদঘর্ম।

হারাধন বিরক্ত হয়ে উঠোনে পায়চারি করছিল। সতীশ ভরদ্বাজের কথা শুনে বলল, “হাঁদু-উঁদুর ছুটি ক্যানসেল করে একটা টেলিগ্রাম করে দিন না ঠাকুরমশাই।”

সতীশ ভরদ্বাজ হারাধনকে দেখতে পারেন না। দু পাতা বিজ্ঞান পড়ে এরা ঘোর নাস্তিক হয়ে গেছে। কিছু মানে না। ভরদ্বাজ ঠাকুরমশাই রেগে গিয়ে বললেন,”টেলিগ্রাম করব, ইয়ার্কি পেয়েছ নাকি? তাদের দেশ তো আর শহর গঞ্জে নয় যে, টেলিগ্রাম যাবে। তারা থাকে প্রেতলোকের গহীন রাজ্যে। সেখানে আলো নেই, অন্ধকার নেই, কেবল ঘোর সন্ধেবেলার মতো আবছা এক জায়গা। চারদিকে ছমছম করছে অদ্ভুত গাছপালা, পাহাড় হ্রদ। মড়ার মাথা চারদিকে ছড়ানো, হ্রদে জলের বদলে রক্ত, পাহাড় হচ্ছে হাড়গোড় দিয়ে তৈরি। বাদুড়, শকুন আর পেঁচা ছাড়া কোনও পাখি নেই। সেখানকার গাছে ফুল ফুটলে পচা নর্দমার গন্ধ ছাড়ে। সেখানে আকাশের রঙ ঘোর কালো, চাঁদ তারা সূর্য কিছু নেই। সেখানকার রাজার প্রাসাদ তৈরি হয়েছে মাথার খুলি দিয়ে। গায়ে গায়ে পিশাচ, শাঁকচুন্নি, মামদো, ব্রহ্মদৈত্য, খোস সব সেখানে বসবাস করে। আমি কতবার গিয়েছি।”

হারাধন হেসে ফেলে বলে, “জায়গাটা বেশ ভাল মনে হচ্ছে ঠাকুরমশাই। একবার আমাকে নিয়ে চলুন না।”

সতীশ ভরদ্বাজ সেকথার জবাব দেননি। শুধু বলেছেন, “আসুক হাঁদু-ভুঁদু, বিশ্বাস না হয় তাদের মুখেই শুনে নিয়ো।”

এই বলে ঠাকুরমশাই চলে গেলেন।

বিকেলের দিকে গরু দোয়াতে গিয়ে রামু মহাবিপদে পড়ল। চোখে ভাল ঠাহর হয় না তার, কিন্তু তা বলে একেবারে কানাও তো সে নয়। হাতিয়ে-টাতিয়ে, নিরীখ-পরখ করে সব জিনিসেরই একটা আন্দাজ পায়। আজ যেন সে গোয়ালে ঢুকে হারিকেনের গায়ে হাত দিয়েই বুঝতে পারল, গরুটা আর আগের মতো নেই। দিব্যি বড়সড় হয়ে উঠেছে, গায়ে খোঁচা-খোঁচা লোম, আর ভারী ঠাণ্ডা স্বভাব, দুধ দোয়ানোর সময় রোজ যেমন দাপাদাপি করে, বালতি উল্টে ফেলে দেয় বা পায়ের চাঁট ছোড়ে, আজ তেমন কিছু করল না। দুধও দিল এক কাঁড়ি। বালতি ভরে প্রায় উপচে পড়ে আর কী! খুব আনন্দ হল রামুর। কিন্তু বালতি-ভরা দুধ নিয়ে সে যখন হাসি-হাসি মুখ করে গোয়াল থেকে বেরোতে যাচ্ছে তখন দোরগোড়ায় একটা মুশকো মতো লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেল।

“কৌন হ্যাঁয় রে?” বলে রামু চোখ পাকিয়ে তাকায়।

মুশকো লোকটা দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছে। এমন ব্যাদড়া লোক যে, রামুর পথও ছাড়ছে না।

ভয় পেয়ে রামু চেঁচাল, “কৌন চোট্টা হ্যাঁয় রে! এখনও সন্ঝা হয়নি, এরই মধ্যে গরু চোরাতে এসেছিস?”

এই বলে রামু বালতিটা রেখে হঠাৎ দুহাতে লোকটাকে জাপটে ধরে চেঁচাতে থাকে, “এ মিশিরজি, এ রঘু, জলদি আও। গরু চোর ধরেছি।”

মুশকো লোকটা পেল্লায় জোয়ান। এক ঝটকায় রামুর হাত ছাড়িয়ে উল্টে তার ঘাড়টা চেপে ধরে বলল, “চোর আমি না তুই? আমার ভঁইসটাকে সারা দু পহর ছুঁড়ে বেড়াচ্ছি, আর তুই চোট্টা আমার দুধেল ভঁইস ধরে এনে গোহালে বেঁধে রেখেছিস!”

রামু তখন বুঝতে পারল, এ লোকটা হল হরশঙ্কর গয়লা। এ-তল্লাটে হরশঙ্কর হচ্ছে সবচেয়ে বড় পালোয়ান। বজরঙ্গবলী মন্দিরের সামনের আখড়ায় একটা কুস্তির দঙ্গল আছে। সেখানে ফি বছর কুস্তির প্রতিযোগিতায় হরশঙ্কর অন্য সব জোয়ানদের ধরে ধরে ধোবিপাট প্যাঁচ মেরে আছাড় দেয়। ধোপা কাপড় কাঁচবার সময় যেমন করে আছাড় মারে, তাই হল ধোবিপাট, হরশঙ্করকে সবাই খুব সমঝে চলে।

রামুর চেঁচানি শুনে মিশির আর রঘু দুই লাঠি নিয়ে ধেয়ে এসেছিল, কিন্তু হরশঙ্করকে দেখে লাঠি ফেলে দিয়ে হাতজোড় করে রাম রাম’ বলে খুব খাতির দেখাতে লাগল।

হরশঙ্কর কাউকে গ্রাহ্য করল না, রামুকে কাঁধে ফেলে আর মোষটাকে খোঁটা থেকে দড়িসুদ্ধ খুলে এক হাতে দড়ি ধরে রওনা দিল। যাওয়ার সময় বলে গেল, “রামু চোট্টাকে আজ পুলিশে দেব।”

রামু হরশঙ্করের কাঁধে ঝুলতে ঝুলতে কেঁদে-কেঁদে বলতে লাগল, “এ রঘু, এ মিশিরজি, আমার যদি ফাঁসি হয় তো আমার মুলুকমে একটা খত লিখে দিয়ে, পুলিশলোগ কি আমাকে পেটাবে নাকি রে বাপ? আমি কখুনো মারধোর খাইনি, কীরকম লাগবে কে জানে? ও হরশঙ্করভাই, অত জোরসে হাঁটছ কেন, আমার যে ঝাঁকুনি লাগছে!”

হরশঙ্কর কী করত বলা মুশকিল। কিন্তু গোয়াল থেকে বেরিয়ে যেই সে পাছদুয়ার দিয়ে বারমুখো রওনা দিয়েছিল–

সন্ধে হলেই ভজবাবু টর্চ নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ান। বাড়িটা বেশ বড়ই বলতে হবে। উঠোনের চারদিক ঘিরে অনেকগুলো ঘর। তা ছাড়া বাইরের দিকে বাগানের দুধারে পড়া, গান শেখা এবং বৈঠকখানার জন্য আলাদা-আলাদা ঘর আছে। এত বড় বাড়ির আনাচকানাচও তো কিছু কম নেই। সন্ধের অন্ধকারে কোন চোর ছাঁচোড় বাড়ি ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে কে জানে! তারপর মাঝরাতে সবাই ঘুমোলে মালপত্র নিয়ে ভাগারাম দেবে। সেই ভয়ে ভজবাবু সন্ধে হলেই টর্চ হাতে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখেন কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা, ছাদ, সিঁড়ি, খাটের তলা, পাটাতন সব জায়গা।

আজও ভজবাবু ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে পিছনের দিকে একটা বাজে জিনিস রাখবার কুঠুরির সামনে এসেই শুনতে পেলেন ঘরটার ভিতরে খুটুর-মুটুর শব্দ হচ্ছে।

ভজবাবু খুব সাহসী লোক নন। শব্দ শুনেই ভড়কে গিয়ে কাঁপাগলায় জিজ্ঞেস করলেন, “ভিতরে কে-এ-এ?”

কোনও জবাব নেই। খুটুর-মুটুর শব্দ হতেই লাগল। ভজবাবুর ঘরের ভিতরে ঢুকতে তেমন সাহস হল না। যদি চোর হয়ে থাকে তো বেশ সাহসী চোরই হবে। ভজবাবুর সাড়া পেয়েও ঘাবড়ায়নি। এ-সব চোর বড় সাংঘাতিক হয়।

ভজবাবু ভিতর-বাড়িতে চলে এলেন। দেখেন কিরমিরিয়া উঠোনে চাল ছড়াচ্ছে, আর সেই ভুতুড়ে কাকটা মহানন্দে নেচে নেচে চাল খাচ্ছে।

ভজবাবু বললেন, “কিরমিরিয়া, একটু সঙ্গে আয় তো! চোর-কুঠুরিতে একটা চোর ঢুকে বসে আছে বলে মনে হচ্ছে।”

শুনেই কিরমিরিয়ার হাত থেকে চালের বাটিটা পড়ে গেল ঠুং করে। সে পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগল, “ও বাবাগো, বাড়িতে চোর ঢুকল গো! এখন চোরকে কে ধরবে গো! চোর যে আমাদের মেরে ফেলবে গো!”

“চোপরও!” ভজবাবু এক পেল্লায় ধমক দিলেন।

সেই ধমকে কিরমিরিয়ার দাঁতকপাটি লাগবার জোগাড়। সে উঠোনে উবু হয়ে বসে মুখ বন্ধ করে গোঁগোঁ শব্দ করতে থাকে।

ভজবাবু রেগে গিয়ে বললেন, “যা, আজই তোকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলাম।”

সেই শুনে কিরমিরিয়া চোখ মুছতে মুছতে উঠল। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “আজ আমাকে চোর মারবে গো। মেরে ফেললে আর কী করে বেঁচে থাকব গো! ও ভজবাবু গো, আমি মরে গেলে কে তোমাদের বাসন মাজবে, কাপড় কাঁচবে, ঘর মুছবে, খুঁটে দেবে গো!”

কিরমিরিয়াকে সঙ্গে নিয়ে আর একটা দা হাতে করে ভজবাবু চোরকুঠুরির সামনে এসে বন্ধ দরজায় কান পেতে শুনলেন, ভিতরে এখনও সেই শব্দ।

ভজবাবু বাইরে থেকে হুঙ্কার ছাড়লেন, “কে আছিস ভেতরে? শোন ব্যাটা, ভাল চাস তো এক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে চলে যা। তা হলে কিছু বলব না। আর যদি বেশি ট্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করিস তো রক্ষে নেই কিন্তু।”

কিরমিরিয়া কেঁদে উঠে বলল, “ও চোর-দাদাবাবু গো, ভজদাদাবাবুকে আর আমাকে মেরো না গো। ভালয় ভালয় চলে যাও গো।”

কিন্তু কুঠুরির ভিতরে চোরের তেমন গা নেই। শব্দটা হতেই লাগল।

ভজবাবু আর কী করেন! যদি চোর তাড়া করে, তবে দৌড়তে হবে বলে কাছাটা এঁটে নিয়ে এক হাতে টর্চ অন্য হাতে দাটা বাগিয়ে ধরে দড়াম করে দরজাটা খুলে ফেলেই তিন হাত পিছিয়ে সরে দাঁড়ালেন। না, তাতেও চোরটা বেরলো না। ভজবাবু শাসালেন, “বেরিয়ে আয় বলছি। বেরোলি?”

কোনও জবাব নেই।

ভজবাবু তখন পা টিপে টিপে ঘরের চৌকাঠে গিয়ে ভিতরে টর্চের আলো ফেলেই বললেন, “দূর! এ যে দেখছি বেড়ালটা। যাঃ যাঃ।”

খুব সাহসের সঙ্গে ভজবাবু ভিতরে ঢুকলেন। বেড়ালটা তাড়া খেয়ে পালাল। ভজবাবু চারদিকে টর্চ ফেলে ফেলে দেখলেন, হতচ্ছাড়া বেড়াল ঘরটাকে যাচ্ছেতাই রকমের বেগোছ করেছে। একধারে পুতুলের পুতুল খেলার বাক্সটাক্স সব হাঁটকে মাটকে একশেষ। ভজবাবু নিচু হয়ে পুতুলের বাক্সটা গুছিয়ে রাখতে যাচ্ছিলেন। তারপরই হঠাৎ ‘বাবা গো’ বলে চেঁচালেন।

সেই চিৎকারে বাইরে কিরমিরিয়া আরও জোরে চেঁচাল।

ভজবাবু স্তম্ভিতমুখে একটা পিস্তল হাতে করে নিয়ে বেরিয়ে এসে বললেন, “কিরমিরিয়া, চুপ কর। ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস। এ-সব চোর-টোরের কাণ্ড নয়। কোনও ডাকাত বাড়িতে ঢুকেছে। এই দ্যাখ ডাকাতের পিস্তল। অস্ত্রটা এই ঘরে লুকিয়ে রেখে ডাকাতটা নিশ্চয়ই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। লোকজন সব ডাক এক্ষুনি।”

“বাবা গো, ডাকাত গো,” বলতে বলতে কিরমিরিয়া দৌড়াল। ভজবাবু টর্চ আর পিস্তল হাতে পাছ-দুয়ারের দিকে তফাতে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঘন ঘন গায়ত্ৰীমন্ত্র জপ করছেন আর চারদিকে নজর রাখছেন।

ঠিক এই সময়ে কাঁধে রামু আর হাতে মোষের দড়ি ধরে হরশঙ্কর গোয়ালা গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে পাছ-দুয়ারের দিকে আসছিল। রামু দু হাত জড় করে ঝুলতে ঝুলতে বলছে, “জয় বাবা রামজি, আমার তো কাল ফাঁসি হয়ে যাবে।”

দৃশ্যটা দেখে ভজবাবু হাঁ। আজকাল চোর ডাকাতের যে কী পরিমাণ সাহস বেড়েছে। এই ভর সন্ধেবেলা গেরস্তর ঘুরে ঢুকে গরু মানুষ সব ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ডাকাতটার চেহারা যেমন পেল্লায়, তেমনি হাবভাবও রাজা জমিদারের মতো। দৌড়ে পালাবি, তা নয়, কেমন গদাই লস্করের মতো চলছে দেখ।

ডাকাতটার এই সাহস দেখে ভজবাবু খুব রেগে গেলেন। বেয়াদপির একটা শেষ থাকা দরকার। তিনি একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুখে টর্চ ফেলে পিস্তলটা বাগিয়ে ধরে বললেন, “তুই কে রে পাজি? ভর সন্ধেবেলা মানুষ গরু চুরি করছিস, তোর আক্কেলটা কীরকম? চুরি করবার এই নাকি সময় তোদের? চক্ষুলজ্জা বলে জিনিস নেই?”

হরশঙ্কর মস্ত বড় পালোয়ান বটে, কিন্তু পিস্তল দেখে তার রক্ত জল হয়ে গেল। সে রামুকে ধমাস করে মাটিতে ফেলে দিল, মোষের দড়িও ছেড়ে দিল। দু হাত জোড় করে বলল, “গোড় লাগি ভজবাবু, এই রামু বদমাশটা আমার ভঁইসটাকে চুরি করেছিল, তাই ভাবলাম, যাই গিয়ে ভঁইসটাকে নিয়ে আসি।”

ভজবাবু উত্তেজনায় হরশঙ্করকে প্রথমে চিনতে পারেননি, এখন চিনতে পেরে পিস্তলটা আরও ভালভাবে বাগিয়ে ধরে বললেন, “ও, তুই সেই পাজি হরশঙ্কর, না? দুধে জল মেশাস!”

হরশঙ্কর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “আর কখনও মিশাব না। হুজুর, মাফি মাঙে।”

হুম! ভজবাবু একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, “সবই তো বুঝলাম। কিন্তু পিস্তলটা এল কোত্থেকে! আর ডাকাতটাই বা গেল কোথায়?”

পিস্তলের গুণ দেখে ভজবাবু অবাক। এত বড় পালোয়ান হরশঙ্কর গোয়ালা পিস্তলের সামনে কেমন নেতিয়ে পড়ল। হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে বলল, “বড়বাবু, জান বাঁচিয়ে দিন। কান পাকড়াচ্ছি, আর দুধে জল দিব না। আপনাদের কোঠিতেও কখনও ঘুষব না।”

ভজবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “ঠিক আছে, মোষ নিয়ে চলে যা। আর যদি কখনও..”

“রাম, রাম। আউর কখনো হোবে না।” বলে হরশঙ্কর তার মোষ নিয়ে চলে গেল।

ভজবাবু পিস্তলের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর মুখে অদ্ভুত একটা হাসি। সত্যিই পিস্তলের মতো জিনিস হয় না। এই পিস্তল নিয়ে বাজারে গেলে দোকানিরা একঝটকায় দাম কমিয়ে প্রায় জিরোতে নামিয়ে ফেলবে। পিস্তলটাকে এক হাতে ধরে অন্য হাতে সেটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে ভজবাবু আপনমনে বললেন, “তাই তো বলি, একটা পিস্তল ছিল না বলেই এতকাল কেউ আমাকে গ্রাহ্য করছিল না।”

ভাবতে ভাবতে ভজবাবুর রক্ত গরম হয়ে গেল। তাঁর মনে হতে লাগল, এই পিস্তলের জোরে তিনি যা খুশি করতে পারেন। যত বড় বদমাশ বা গুণ্ডা হোক সবাই পিস্তলের সামনে হরশঙ্করের মতোই ভেজানো ন্যাতা হয়ে নেতিয়ে পড়বে।

ভজবাবুর খুব ইচ্ছে হল, পিস্তলের শক্তিটা একটু ভাল করে পরখ করেন। তাই কাউকে কিছু না বলে র‍্যাপারের তলায় পিস্তলটা লুকিয়ে নিয়ে ভজবাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

এবার সবাইকে তিনি বুঝিয়ে দেবেন কত ধানে কত চাল।

কিরমিরিয়ার চেঁচামেচি শুনে বাড়ির লোকজন দৌড়ে এসেছিল। কিন্তু তারা এসে ভজবাবুকে খুঁজে পেল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress