Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

নৌকোটা একেবারে পাশে এসে লাগল

নৌকোটা একেবারে পাশে এসে লাগল। দেশলাইয়ের জন্য যে-হাত বাড়িয়ে আছে, সে ধূর্জটি।

ধূর্জটি যে শুধু সুপ্রিয়াকেই চেনে তা নয়, সে অমলকেও চেনে। নিজের বন্ধু না-হলেও বন্ধুর বন্ধু। ধূর্জটি জানতই না যে, সুপ্রিয়ার সঙ্গে অমলের কোনো সম্পর্ক আছে। অমল ছিল সত্যিকারের গোপন।

ধূর্জটির বন্ধুদের মধ্যে যে-ছেলেটি কর্কশ গলায় চিৎকার করছিল, সেও চেনে অমলকে। সে নাটকীয়ভাবে জিভ কেটে বলেছিল, আরে, অমলবাবু না? সরি, সরি, ভেরি সরি! সেম সাইড হয়ে গেছে। আমরা এক্ষুনি যাচ্ছি।

নৌকোটা আবার দূরে সরে যেতে যেতে সুপ্রিয়া স্পষ্ট শুনল, সেই লোকটা ধূর্জটিকে জিজ্ঞেস করছে, এই ওই ভদ্রমহিলা অমলবাবুর কে রে? বউ? কবে বিয়ে করল?

ধূর্জটির উত্তরটা শুনতে পায়নি। কী উত্তর দিয়েছিল ধূর্জটি?

তারপর আর ধূর্জটির সঙ্গে দেখা হয়নি সুপ্রিয়ার। দেখা হয়নি বলা ঠিক নয়, দূর থেকে দেখলেও ধূর্জটির সামনে যেতে ভয় পেয়েছে সে। গতবছর ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচের সময় মাঠে তার খুব কাছেই বসেছিল ধূর্জটি। তাকে সুপ্রিয়াই আগে দেখতে পেয়ে চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। সে দিন খেলা না দেখেই চলে এসেছিল। সেদিন সিনেমা হলেও তো ধূর্জটিকে আগে দেখেই সুপ্রিয়া অন্য দিকে ফিরে চলে যেতে চেয়েছিল। কেন যে দীপংকর তাকে দেখে ফেলল?

আজও সুপ্রিয়া জানে না, ধূর্জটি ওর বন্ধুকে তার প্রশ্নের কী উত্তর দিয়েছিল? ধূর্জটি ব্যর্থ প্রেমিক, তার সাংঘাতিক রাগ থাকাই স্বাভাবিক। আজও চোখে ভাসে সেই দৃশ্যটা। আবছা জ্যোৎস্নায় গঙ্গার ওপর একটা নৌকোর পাশে আর একটা নৌকো ভিড়ল। একটা দেশলাই এর জন্য হাত বাড়িয়েছে ধূর্জটি। ধূর্জটি প্রথমে দেখেছিল সুপ্রিয়াকেই। তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকা অমলকে দেখেছে তারপরে। অদ্ভুতরকম মুখখানা হয়ে গিয়েছিল ধূর্জটির। তাতে অনেক ব্যথা, বেদনা, অনেক অপমান মেশানো। নিশ্চয়ই প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিল, কারণ তারপর আর একটাও কথা বলেনি সে। সে সুপ্রিয়া বা অমলকে চেনার ভানও করেনি। পাশ থেকে তার অসভ্য বন্ধুটাই গলা বাড়িয়ে–।

ধূর্জটি তার জীবনের সবচেয়ে গোপন কথাটা জানে। কিন্তু ধূর্জটি একটা কথা জানে না যে তারপর থেকে সুপ্রিয়ার যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে। আর সে কোনোদিন অমলের সঙ্গে কোনো নির্জন জায়গাতেও দেখা করবে না। অমল আর কোনোদিন তার কোলে মাথা দিয়ে শোবে না। কিন্তু ধূর্জটি কি একথা বিশ্বাস করবে? সে একবার চোখে যা দেখেছে, সেটাই তার কাছে সত্যি হয়ে আছে। ইচ্ছে করলে ধূর্জটি এখন তার নামে চারিদিকে বিষ ছড়াতে পারে। ধূর্জটির কথা সবাই বিশ্বাসও করবে। কারণ তার সাক্ষীও আছে।

কেন দীপংকর ধূর্জটিকে ডেকে আনল? সুপ্রিয়া, কিছুতেই আর ধূর্জটির চোখের দিকে তাকাতে পারবে না। সেই ঘটনার পর সুপ্রিয়ার এমন লজ্জা আর আত্মগ্লানি হয়েছিল যে, এক-একবার মরে যেতেই চেয়েছিল। কিন্তু তখন বুলান মাত্র এক বছরের শিশু।

ধূর্জটি কি আবার আসবে? যেন না আসে! যেন না আসে!

পরদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সুপ্রিয়া দাঁড়িয়েছিল রাস্তার দিকের বারান্দায়। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, তাই দূরের সজল দৃশ্য দেখতে ভালো লাগে।

সুপ্রিয়াদের বাড়ির সামনের রাস্তাটায় একটু একটু জল জমেছে। তারমধ্যেই সুপ্রিয়া দেখল, প্যান্ট উঁচু করে, পা টিপে টিপে আসছে ধূর্জটি। এই দুপুরেই!

সুপ্রিয়ার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। কেন আসছে ধূর্জটি? প্রতিশোধ নিতে? তার ভালোবাসাকে সুপ্রিয়া লঘু করে দেখেছিল। পাত্তাই দেয়নি। তারপরেও যদিও সে বিয়ে করত অন্য একজনকে, ত দুঃখের কারণ থাকলেও অভিযোগের কারণ থাকত না। অনেক সময় বাবা-মায়ের চাপে পড়ে মেয়েদের এ-রকম মেনে নিতেই হয়। কিন্তু আবার আর একজনের সঙ্গে প্রেম? তার মানে ধূর্জটি কেউ-ই না!

কী প্রতিশোধ নিতে চায় ধূর্জটি? সুপ্রিয়ার মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বারান্দা থেকে সরে এসে তাড়াতাড়ি সে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। যাতে চোখাচোখি না হয়। ধূর্জটি বাড়ির একেবারে কাছে এসে গেছে। এবার সে নিশ্চয়ই গেট দিয়ে ঢুকছে। দোতলায় উঠতে আর কতক্ষণই-বা লাগবে? এক্ষুনি বেজে উঠবে কলিং বেল।

যেন ঘাতক আসছে মৃত্যুদন্ড দিতে, সুপ্রিয়া ঠিক সেইভাবে অপেক্ষা করতে লাগল। সে দিনই বাঁকাভাবে অমলের কথা উচ্চারণ করে ধূর্জটি বুঝিয়ে দিয়ে গেছে যে, অমলের কথা তার ঠিকই মনে আছে। ভুলবেই-বা কেন, ওইটাই তো তার তুরুপের তাস। আজ নির্জন দুপুরে সে আসছে বোঝাপড়া করতে। এখন সে ইচ্ছে করলে যা খুশি ব্ল্যাকমেল করতে পারে। সুপ্রিয়া তার যথাসর্বস্ব দিয়ে দিতেও রাজি কিংবা বাধ্য। কী মূল্য চাইবে ধূর্জটি? সে কবি, সে কি আর টাকাপয়সা চাইবে।

এতক্ষণে ধূর্জটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসছে। ওপরে। এবার দরজার সামনে এসে কলিং বেলে হাত।

সুপ্রিয়া উৎকর্ণ হয়ে রইল। তার শরীরটা কাঁপছে। ধূর্জটির কাছ থেকে বাঁচবার কি কোনো উপায়ই নেই? যদি সে দরজা না খোলে? তাহলেও ধূর্জটি কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? চাকরকে বলে রাখবে সুপ্রিয়া যে, দুপুর বেলা যে-ই আসুক, দরজা যেন না খোলে!

কিন্তু কলিং বেল বাজল না। দোতলায় উঠতে তো এর চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারে না। তাহলে ধূর্জটি কোথায় গেল?

সুপ্রিয়া আবার আস্তে আস্তে উঁকি মারল বারান্দা দিয়ে। ধূর্জটি রাস্তাতেও নেই। সে কি বাড়ি ভুল করবে? একদিন মাত্র রাত্তির বেলা এসেছিল। না, তা হতে পারে না, বাড়িটার সামনে একটা পাম গাছ-ওটা দেখলে আর কারুর ভুল হওয়ার কথা নয়।

তাহলে কি সুপ্রিয়াই ভুল দেখেছে? ধূর্জটি নয়, অন্য কোনো লোক? কিন্তু স্পষ্ট দেখল, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, রোগা, লম্বা—অবশ্য মুখটা নীচের দিকে ছিল।

সারা দুপুর তবু সুপ্রিয়া উৎকণ্ঠার মধ্যে রইল। দরজায় সামান্য শব্দ হলেই উঠে বসে। কিন্তু ধূর্জটি এল না।

না এসে আরও বেশি কষ্ট দিল ধূর্জটি। তিল তিল মৃত্যুযন্ত্রণা দেওয়ার মতন। প্রতিটি মুহূর্ত অসহ্য। কখন আসবে, কখন আসবে? কেন আসছে না? এটাও কি তার কায়দা? সুপ্রিয়াকে বেশি কষ্ট দেওয়ার জন্য সে এই কায়দাটা বার করেছে? বাড়ির সামনে এসেও কোথাও লুকিয়ে আছে?

যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে সুপ্রিয়া একসময় বিছানা থেকে ঘুমন্ত বুলানকে বুকে তুলে নিল। মেয়েই তার একমাত্র আশ্রয়। মেয়ের জন্যই তাকে বাঁচতে হবে। যদি সে আগে কিছু অন্যায় করেই থাকে, তবু কি ক্ষমা পেতে পারে না? তার কোলে বুলানকে দেখেও কি ধূর্জটির দয়া হবে না?

বুলানকে কোলে নিয়ে দরজাটা খুলে রাখল সুপ্রিয়া। ধূর্জটি তবু আসে না। বারান্দায় গিয়ে কতবার উঁকিঝুঁকি দিল। না, ধূর্জটি কোথাও নেই।

তখন সুপ্রিয়ার মনে হল, আসলে বোধ হয় ধূর্জটিই ভয় পেয়েছে। বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করলেও শেষপর্যন্ত ভেতরে ঢোকার সাহস পায়নি। ধূর্জটি তো ভীতুই! আগে যখন ও প্রেমের কথা বলত, তখন মুখ-চোখ একেবারে কাঁচুমাচু হয়ে যেত। ধূর্জটি হয়তো এখনও তাকে সেইরকম ভালোবাসে, তাই ভয়টা এখনও যায়নি।

প্রত্যেকদিন সুপ্রিয়া ধূর্জটির প্রতীক্ষা করে। সে চায় না ধূর্জটি আসুক। অথচ প্রতিটি দুপুরেই মনে হয়, যেকোনো সময় ধূর্জটি এসে দরজাতে বেল বাজাবে। সে কী শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারবে না?

এর ফলে হল কী, অমলের কথা আবার নতুন করে মনে পড়তে লাগল। নৌকার সেই ঘটনার পর অমলের সঙ্গে আর দেখা করতে সাহস পায়নি। অমল মাঝে মাঝে ফোন করে। অমলকে সে চিঠি লিখতে বারণ করেছে। অবশ্য তাও দু-বার খুব কম সময়ের জন্য অমলের সঙ্গে দেখা করতেই হয়েছে। তার মধ্যে একদিন ছিল অমলের জন্মদিন। ওই দিনটা সুপ্রিয়া কখনো ভোলে না। ছেলেবেলা থেকেই ওই দিনটায় সে অমলকে ফুল দিয়েছে। এবার অবশ্য ফুল দিতে পারেনি। তবে, সেই সময় হর্টিকালচারাল গার্ডেনে একটা ফুলের প্রদর্শনী ছিল। সেইখানে গিয়ে দেখা করেছিল অমলের সঙ্গে। সেখানে কেউ দেখে ফেললেও ক্ষতি নেই। ফুলের প্রদর্শনীতে তো যে-কেউই আসতে পারে। একবার শুধু সেখানে সুপ্রিয়া চুপিচুপি অমলকে বলেছিল, এই বাগানের সব ফুল আমি তোমাকে দিলাম।

রাত্রে শুয়ে শুয়ে অমলের কথা দারুণ মনে পড়েছে। এক-এক সময় এ-রকম হয়। মনে হয়, ভুল, ভুল, সারাজীবনটাই এইরকম ভুলের ওপর দিয়ে চলবে? তখন অসহ্য লাগে, আর শুয়ে থাকাও যায় না।

মাঝে মাঝে দু-একটা অসম্ভব কথাও তার মাথায় আসে। এমন হয় না যে ধূর্জটি এলে সুপ্রিয়া তাকে সব কথা খুলে বলে তার কাছে দয়া ভিক্ষে করবে। ধূর্জটির কাছে হাতজোড় করে অনুনয় করে বলবে, অমলকে ভালো না বেসে আমার উপায় নেই। ধূর্জটিদা, তুমি আমাকে সেই সুযোগ দাও।

যেন পৃথিবীতে এখন একমাত্র ধূর্জটিই পারে তার সঙ্গে অমলকে মিলিয়ে দিতে। আর কোনো বাধা নেই। সে তো বেশি কিছু চায় না, তার স্বামী-সংসার সবই ঠিক থাকবে, শুধু অমলের সঙ্গে মাঝে মাঝে একটু দেখা করা। শুধু চোখের দেখা। অমলের নারীসঙ্গহীন রুক্ষজীবনে সামান্য একটু সান্ত্বনা।

কিন্তু না, ধূর্জটি দয়া করবে না। অন্য যে-কেউ হলে হয়তো দয়া করত, কিন্তু ধূর্জটি যে নিজেই সুপ্রিয়ার প্রেমিক। সে কী করে সুপ্রিয়াকে অপরের হাতে তুলে দেবে? তার বদলে প্রতিশোধ নেবে সে।

সুপ্রিয়া উঠে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। মধ্যরাত্রের টাটকা হাওয়ায় জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। একসময় সে টের পেল, তার স্বামী এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে।

সুপ্রিয়ার কান্না আসছে। কী করে কান্না চাপবে? যদি মনের সব কথা বেরিয়ে আসে? না, না, দীপংকরকে সে দুঃখ দিতে চায় না। দীপংকরের তত কোনো দোষ নেই। সে তো সাধ্যমতন সুপ্রিয়াকে সুখেই রাখতে চেয়েছে।

সুপ্রিয়া কান্নায় ভেঙে পড়ে দীপংকরের বুকে মাথা রেখে বলল, তুমি আর আমায় ভালোবাসো না! আমাকে একটুই ভালোবাসো না!

দীপংকর তার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল, যাঃ তোমাকে কি ভালো না বেসে পারি? তোমাকেই তো শুধু ভালোবাসি। তুমিই তো আমার সব।

সুপ্রিয়া নিশ্চিন্ত হল। দীপংকর ভালোবাসা কথাটা বারবার উচ্চারণ করতেই ভালোবাসে। এতে তৃপ্তি পায়। তাকে এই তৃপ্তিটুকু দিতে চায় সুপ্রিয়া এবং অতিরিক্ত হিসেবে সে দীপংকরের ঠোঁটে একটি চুমু দিল।

এরপরের দু-তিনদিন মনে হল সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। মুছে গেছে অতীতের যা-কিছু। ধূর্জটি আর আসবে না। এখন সুপ্রিয়া সন্ধ্যে বেলা স্বামীর জন্যই উতলা হয়ে অপেক্ষা করছে। দীপংকর ফিরলে সুপ্রিয়া আদর করে নিজেই তার গলার টাই খুলে দেয়। দীপংকর যা খেতে ভালোবাসে, সেরকম কিছু-না-কিছু একটা সে নিজেই রান্না করে, দীপংকর বাড়ি ফেরার পর। মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে নাইট শোতে কোনো একটা সিনেমা দেখবার জন্য আবদার করল একদিন স্বামীর কাছে। স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে ছোট্টসংসার, এর নামই তো সুখ।

ধূর্জটিকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য যে-পাগলামি চেপেছিল দীপংকরের, সেটা কেটে গেছে। আর সে ধূর্জটির কথা বলে না। বাংলা পত্রিকার পাতা উলটে ধূর্জটির কবিতাও খোঁজে না।

ভীতু, কাপুরুষ ধূর্জটি এবাড়ির দরজা পর্যন্ত এসেও পালিয়ে গেছে। আর কোনোদিন

আসবার সাহস হবে না তার।

দীপংকরের গাড়ি রং হচ্ছে, তাই নাইট শো দেখে ফেরার সময় ওরা ট্যাক্সি নিল। ট্যাক্সিটাও টালিগঞ্জ মোড়ে এসে খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। বাড়ি আর বেশিদূর নয়, হেঁটেই যাওয়া যায়। তবু দীপংকর জিজ্ঞেস করল, রিকশা নেবে? এর আগে সুপ্রিয়া কোনোদিন দীপংকরের সঙ্গে রিক্সা চাপেনি। অল্প শীতের হাওয়ায় বেশ ভালোই লাগল। সুপ্রিয়ার মনে হল, দীপংকরের ওপর সত্যি নির্ভর করা যায়। এখন তাদের মাঝখানে অমল নেই। সুপ্রিয়া নেই—এখন শুধু দীপংকরের স্ত্রী। আঃ কী শান্তি!

পরদিনই ধূর্জটি এল। ঠিক দুপুরে নয় অবশ্য, একটু বিকেলের দিকে। চাকর ছুটি নিয়েছে। সেইদিনই, একটু আগে রাঁধুনি বুলানকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে গেছে। আশ্চর্য, ধূর্জটি কী করে এতসব খবর রাখল? বাড়িতে সুপ্রিয়া একদম একা।

দরজা খুলেই সুপ্রিয়া বিবর্ণ মুখে তাকিয়ে রইল। আজ বুলানও নেই যে তাকে বুকে চেপে ধরে আত্মরক্ষা করবে সুপ্রিয়া। আজ সে সম্পূর্ণ একা। ধূর্জটি কি লুকিয়ে এতদিন লক্ষ রেখেছে, কখন বাড়িটা সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যায়।

ধূর্জটি হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। তবু ওর আড়ালে সুপ্রিয়া দেখতে পাচ্ছে প্রতিহিংসার আগুন। আর কোনো উপায় নেই, আর কোনো উপায় নেই। ধূর্জটি ভেতরে এসে কৌতুকের সুরে বলল, বকা খেতে এলাম।

সিনেমা হলে ঢোকার সময়ই ধূর্জটি ওদের দেখতে পেয়েছিল। সুপ্রিয়া আর তার স্বামী। কী যেন নাম ভদ্রলোকের? সুধাময়, না অনিরুদ্ধ? না, মনে পড়েছে, দীপংকর। সরলাদের অফিসে চাকরি করে। সরলার বস।

দেখতে পেয়েও ধূর্জটি মুখটা ঘুরিয়ে নিল চট করে। কারণ, তার সঙ্গে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব রয়েছে, তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে প্রতুল। প্রতুল বড় মুখ খিস্তি করে, সে যদি একবার দেখে যে ধূর্জটি কোনো সুন্দরী মহিলার সঙ্গে কথা বলছে, তাহলেই তা নিয়ে এমন জ্বালাবে পরে! প্রতুল মেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারে না। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা নেই, তাই আড়ালে তাদের নিয়ে খিস্তিখাস্তা পছন্দ করে।

ওরই মধ্যে তবু একবার সুপ্রিয়ার সঙ্গে ধূর্জটির চোখাচোখি হয়ে গেল। কেউই চেনার ভাব করল না। সুপ্রিয়া যেন মুখটা ফিরিয়েই নিল মনে হয়। সেইরকম আগের মতনই অহংকারী ভাবটা এখনও আছে। সুপ্রিয়া তার স্বামীর গা-ঘেঁষে চলে গেল ভেতরে। ধূর্জটি বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট শেষ করল, তারপর ভেতরে ঢুকল অন্ধকার হবার পর।

অন্ধকারেও সে দেখতে পেল সুপ্রিয়া আর তার স্বামী কোথায় বসেছে। তাদের সিটের চেয়ে কয়েক রো পেছনে। সুপ্রিয়ার স্বামী বোধ হয় দেখতে পায়নি ধুর্জটিকে। দেখলেও চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ।

কিন্তু সিনেমা ভাঙার পর ধূর্জটি দেখল, সুপ্রিয়ার স্বামী গেটের কাছেই গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই রে, কী করে এড়ানো যায়? এদিক দিয়ে তো বেরোতেই হবে। প্রতুলটা আবার এরই মধ্যে একটা পাঞ্জাবি মেয়েকে দেখে নানারকম মন্তব্য শুরু করে দিয়েছে। ওরা আবার শুনতে না পায়!

এই যে, কেমন আছেন?

দীপংকরের কথা শুনে ধুর্জটিকে দাঁড়াতেই হল। নমস্কার করে বলতেই হল দুটো-একটা কথাবার্তা। সুপ্রিয়া অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে।

সুপ্রিয়ার বর আবার তাকে বাড়িতে চায়ের নেমন্তন্ন করে ফেলল! শুধু তাকে একা নয়, বন্ধুদেরও। প্রতুলকে নিয়েই তো যত ভয়, তাই ধূর্জটি কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল খুব! যাক বন্ধুরা কেউ রাজি হল না। প্রতুলটা শুধু পার্ক স্ট্রিটে মদ খেতে যাবে বলে ওদের গাড়িতে লিফট নিল। এটুকু সময়েই প্রতুলটা লোভীর মতন তাকিয়ে রইল সুপ্রিয়ার দিকে। নাঃ, এ ছেলেটাকে নিয়ে আর রাস্তাঘাটে চলা যায় না। পার্ক স্ট্রিটে প্রতুল নেমে যাবার পর ধূর্জটি একটু নিশ্চিন্ত হল।

দীপংকরই বেশি কথা বলছে ধূর্জটির সঙ্গে। সুপ্রিয়া চুপচাপ। সুপ্রিয়া অবশ্য এত গম্ভীর আগে কখনো ছিল না! স্বামীর কাছাকাছি বসে ধূর্জটির সঙ্গে কী কথা বলবে তা ভেবেই পাচ্ছে না।

এ কী, ওরা গলফ ক্লাব রোডে থাকে? এ পাড়াটা তো ধূর্জটির খুব চেনা। অনেকবার আসতে হয় এই রাস্তায়। এই বাড়িটার পাশ দিয়েও কতবার গেছে, তখনও ধূর্জটি জানত না, সুপ্রিয়া এখানেই রয়েছে এতদিন। ফ্ল্যাটটা বেশ সুন্দর সাজিয়েছে। মন্দ-না।

এ ধরনের ফ্ল্যাট দেখলেই তার মালিকের চরিত্রটা বোঝা যায়। প্রাইভেট ফার্মের চাকরি। যারা মাইনে খুব বেশি না দিয়ে ইনকাম ট্যাক্স বাঁচাবার জন্য, অন্য অ্যালাউয়েন্স দেয় হাজাররকম। ফ্ল্যাটটার ভাড়া হাজার-বারো-শো হবেই, কোম্পানি দেয়। নিশ্চয়ই দীপংকর সকাল সাড়ে আটটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত চাকরের মতন অফিসে খাটে! এ ছাড়া মাঝে মাঝে পার্টি আর সিনেমা দেখা—এই তো এদের জীবন। এদের সকলের বাড়িই একইরকম দেখতে হয়। সকলেই শৌখিন তামার অ্যাশট্রে রাখে। উঃ, এই তামার অ্যাশট্রে দেখলেই ধূর্জটির গা জ্বলে যায়।

সুপ্রিয়া সেই যে ভেতরের ঘরে চলে গেল, আর আসার নাম নেই। তার স্বামীই একা বকবক করছে।

অবশ্য একটা ব্যাপারে ধূর্জটি একটু খুশি হল। সুপ্রিয়ার স্বামী দীপংকর কবিতা পড়ে এবং বোঝে। এইসব লোকের সঙ্গে তবু দু-একটা কথা বলা যায়। সুপ্রিয়া তো কবিতার কিছুই বোঝে না।

সুপ্রিয়াকে অনেকদিন থেকে চেনে ধূর্জটি। রণজয়ের কীরকম যেন বোন হয়। রণজয়ের সঙ্গে ওদের বাড়িতে গেছে অনেকবার। এক সময় ধূর্জটি সুপ্রিয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। তখন ওকে দেখতে আরও অনেক বেশি সুন্দর ছিল। বিশেষত চোখ দুটি একেবারে অপূর্ব। স্নান করবার পর মুখটা যখন ভিজে ভিজে থাকত, তখন অপ্সরী বলে মনে হত এক-এক সময়। এখন অবশ্য সে চেহারার কিছুই নেই। কীরকম একটা মা-মা ভাব এসে গেছে।

সুপ্রিয়ার বিয়ের আগেই ধূর্জটি বুঝে নিয়েছিল, সুপ্রিয়া শুধুই সুন্দরী, তার মনের কোনো গভীরতা নেই। যে-নারীর মনটাও আকর্ষণীয় নয়, তার যতই সৌন্দর্য থাক, শেষপর্যন্ত তাকে পুতুল পুতুল দেখায়।

তবু, যে-রকম মেঘলা আকাশ, বর্ষাকালের নদী বা জঙ্গলে শালগাছের ফুল। সেইরকম নারীর রূপেরও একটা আলাদা আকষর্ণ আছে। ধূর্জটি সেই রূপ দেখে ভুলেছিল। সুপ্রিয়া সেইটাকেই ভেবেছিল ভালোবাসা। সুপ্রিয়ার মধ্যে একটা আমায় ভালোবাসো, আমায় ভালোবাসো ভাব আছে। অনেক মেয়ে যেমন বিয়ের আগে একটু ভালোবাসার ট্রেনিং নিয়ে নিতে চায়, রাতে স্বামীর সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয়ে যেন কোনো ভুল না হয়।

রণজয়ের অনেক বন্ধুই যদিও সুপ্রিয়ার প্রতি বেশ খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তবু সুপ্রিয়া বেশি প্রশ্রয় দিত ধূর্জটিকেই। ধূর্জটিও বাড়িতে গেলেই সুপ্রিয়া ওপর থেকে তরতর করে নেমে আসত। জোর করে ধূর্জটির কাছে কবিতা শুনতে চাইত। যেকোনো কবিতা শুনেই ভাবত, সেটা ওকে নিয়ে লেখা। ও সুন্দরী বলেই ওর ধারণা ছিল পৃথিবীর সব কবিতা ওকে নিয়ে লেখা হবে। ধূর্জটি অবশ্য আপত্তি করত না। সুপ্রিয়া যখন ধূর্জটির পিঠে হাত রেখে বলত, ধূর্জটিদা, আর একটা পড়ো। তখন ধূর্জটির শরীরে একটা শিরশিরানি ভাব এসে যেত। কৃত্রিম দুঃখের ভাব দেখিয়ে ধূর্জটি বলত, তোমার মতন মেয়েকে বিয়ে করতে পারলে আমি ধন্য হয়ে যেতাম। কিন্তু জানি, তা তো হবে না—তুমি রাজেন্দ্রাণী হওয়ার যোগ্য, আমি একজন সামান্য কবি।

তাতেই সুপ্রিয়া ভাবত, ধূর্জটি বুঝি তার প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছে। সুপ্রিয়া তক্ষুনি রাজি হলেও ধূর্জটি তাকে কিছুতেই বিয়ে করত না। সুন্দরী বউকে সাজাতে-গোছাতেই ধূর্জটিকে সর্বস্বান্ত হতে হত। সুপ্রিয়ার কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা নেই। এইসব মেয়েকে বিয়ে করা যায় না, দূর থেকে দেখতেই ভালো লাগে।

সকলের মুখে সুন্দরী সুন্দরী শুনে সুপ্রিয়ার একসময় একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল যেন পৃথিবীতে তার চেয়ে সুন্দরী আর নেই। ধূর্জটি এই ব্যাপারটাতে বেশ মজা পেত। সেইজন্যই ধূর্জটি ইচ্ছে করেই আরও বেশি উচ্ছাসের সঙ্গে রূপের প্রশংসা করত সুপ্রিয়ার। সুপ্রিয়া তার প্রত্যেকটি কথা বিশ্বাস করত। ধূর্জটির পাশে এসে বসত সবসময়, ধূর্জটির হাত ছুঁয়ে কথা বলত। যেন সে ধূর্জটিকে দয়া করছে। ধূর্জটি যে, সেই সময়েই আরও দুটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে, তা আর সুপ্রিয়া জানবে কী করে।

সুপ্রিয়া অবশ্য বেছে বেছে সবচেয়ে সুযোগ্য পাত্রটিকেই বিয়ে করেছিল। দীপংকরের চেহারা সুন্দর, ভালো ফ্যামিলি, চাকরিও পেয়েছে জব্বর। স্বামী হিসেবে আদর্শ। দীপংকরের এইরকম স্ত্রী দরকার ছিল, বড়ো অফিসারদের সুন্দরী স্ত্রী না থাকলে চলে না। নানান পার্টিতে বউকে নিয়ে যেতে হয় তো।

দীপংকর ধূর্জটিকে হুইস্কি খেতে অনুরোধ করল। ইস, স্কচ। দীপংকর কি ধূর্জটির কাছে চাল মারতে চাইছে নাকি? বোতলটিতে অর্ধেকেরও কম আছে। ওটুকু তো ধূর্জটি একাই এক চুমুকে শেষ করে দিতে পারে। কিন্তু যাক দরকার নেই, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই টিপে টিপে খরচ করেন।

সুপ্রিয়া বাইরের দামি শাড়িটা পালটে একটা সাধারণ আটপৌরে শাড়ি পরে এসেছে। স্বামীর সামনে দেখাতে চায়, আমায় বিশেষ কোনো আলাদা মূল্য নেই ওর কাছে। আমার জন্য সেজে থাকারও দরকার নেই। আমার দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারছে না। চোখে একটা ঘুম ঘুম ভাব—যেন আমি চলে গেলেই ভালো হয়! চলেই তো যাবে ধূর্জটি, সে কি থাকতে এসেছে নাকি!

সুপ্রিয়ার স্বামী হঠাৎ ভালোমানুষি দেখাবার জন্য, ওদের আলাদা রেখে বাথরুমে চলে গেল কেন? ভাবল বুঝি, এই সুযোগে ধূর্জটি কিছু গোপন কথা বলে নেবে? পাগল! কোনো প্রেমিকই কোনো বিবাহিতা মহিলার স্বামীর উদারতার সুযোগ নেয় না! স্বামীকে ঠকিয়েই বেশি সুখ।

ধূর্জটি আর সুপ্রিয়া মুখোমুখি বসে আছে। দু-জনেই চুপ। কী কথা বলবে, ধূর্জটি ভেবেই পাচ্ছে না। এক সময় সুপ্রিয়ার সামনে কতরকম প্রগলভতাই করেছে। এখন কথাই খুঁজে পাচ্ছে না সে। মাত্র দু-তিন বছর আগে হলেও, সে নানারকম ঠাট্টা-ইয়ার্কি কিংবা সুপ্রিয়ার রূপের প্রশংসা করে তার অহংকার উসকে দিত। কিন্তু এখন আর সে তা পারবে না। এখন তার জীবনে অনেক বদল এসেছে।

সুপ্রিয়ার মুখে একটু দুঃখী দুঃখী, ভীতু ভীতু ভাব। ও কি অসুখী? কিন্তু অসুখী হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের মেয়ে তো এইরকম স্বামী আর সংসারই চায়। কোনো কিছুরই তো অভাব নেই, এমনকী স্বামীর ভালোবাসারও।

অবশ্য অনেকে ইচ্ছে করে দুঃখী সাজতে ভালোবাসে। আসল কোনো দুঃখ না থাকলেও মনগড়া দুঃখ নিয়ে মেতে থাকে। তা ছাড়া, সুপ্রিয়ার একসময় অভ্যেস ছিল বহুপুরুষের স্তুতি শোনার, এখন কি সে শুধু তার স্বামীর প্রেম নিয়েই তৃপ্ত থাকতে পারবে?

সেইজন্যেই কি অমল গুপ্তের সঙ্গে—

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *