Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

এদিকের গ্রামগুলিতে জনবসতি বেশি নয়

এদিকের গ্রামগুলিতে জনবসতি বেশি নয়। মাঝে মাঝেই বিস্তীর্ণ বিল, হাওর, দহ নামে জলাভূমি। এবং পতিত জমি, ঝোপ-জঙ্গল। কোথাও কোথাও অরণ্য বেশ গভীর। সুদূর অতীতে এইসব অঞ্চলই সম্ভবত সুন্দরবনের অন্তর্গত ছিল। বর্তমানের ভয়াল সুন্দরবন অংশে মানুষ সহজে যেতে চায় না। সেখানে ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির আর গাছের ডগাতেও দোল খায়। বিষধর সাপ।

সেই সব হিংস্র প্রাণীরা মাঝে মাঝে অনেক দূরেও চলে আসে। হঠাৎ কোনও গৃহস্থের গোয়ালঘরে একটা বাঘকে বসে থাকতে দেখা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রতি বছরই বাঘের গ্রাসে আর সাপের বিষে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হয়। নদী থেকেও কুমির ডাঙায় উঠে এসে গরু-ছাগল টেনে নিয়ে যায়। মানুষের শিশুরাও তাদের নজরে পড়লে নিস্তার পায় না। আর শিয়ালের উৎপাত তো আছেই। অতি ধুরন্ধর শিয়ালের মুখ থেকে হাঁস-মুরগি রক্ষা করাই মুশকিল।

আর একরকম প্রাণীও আছে, এ-অঞ্চলে তাদের নাম বাঘডাসা, বন বিড়ালের চেয়ে আকারে বড়, বাঘের চেয়ে কিছুটা ছোট। মূ-উ-ল, মূ-উল শব্দে ডাকে। এরাও হিংস্র কম নয়, নিকটবর্তী জঙ্গলে এদের সংখ্যাই বেশি।

ছেঁউড়িয়া গ্রামের অদূরে যে-জঙ্গল, গৃহত্যাগী লালু ক্ষোভে-অভিমানে সেই জঙ্গলেরই অনেকটা গভীরে ঢুকে বসে রইল একটা গাছতলায়। বন্য জন্তুদের জাত-ধর্ম নেই। কিন্তু তারা যে মানুষকে অনেক বেশি হিংস্র প্রাণী মনে করে এবং সুযোগ পেলে মানুষকে আক্রমণও করে, তা লালুর মনে। রইল না।

পেটে খিদের আগুন, মাথার মধ্যে উত্তাপ, তাই ঘুম আসে না। রাত বাড়ে, বনের মধ্যে শুকনো পাতায় কিছু কিছু জন্তুর চলাচলের আওয়াজ পাওয়া যায়, হঠাৎ কোনও রাতপাখি ডেকে ওঠে। আকাশ এখন অনেকটা মেঘমুক্ত।

অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় লালুর বুক ঠেলে কান্না আসে।

কঠিন রোগের যন্ত্রণার সময়ও লালু কাঁদেনি, কোনও মানুষের সামনেই সে কাঁদে না। এখন কেউ নেই, সে বুক উজাড় করে, হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদতে লাগল। সে যেন অনুভব করল, তার অনেক বন্ধন ছিঁড়ে যাচ্ছে, অনেক কিছুর সঙ্গেই তার চিরকালের বিচ্ছেদ ঘটে যাচ্ছে।

রাত্রিবেলা জঙ্গলে কোনও একলা মানুষ যখন বসে বসে কাঁদে, তখন তার মধ্যে যে-তীব্র নিঃসঙ্গতার ধ্বনি বেজে ওঠে, তা শ্রবণ করার অভিজ্ঞতা আর কোনও মানুষের থাকে না।

ভোরের দিকে লালু ঘুমিয়ে পড়ল।

তার গায়ে খসে পড়ছে গাছের পাতা। সদ্য জেগে ওঠা পাখিরা অবাক চোখে দেখতে লাগল তাকে। কয়েকটা শেয়াল তার দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল। কাছাকাছি দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল কয়েকটা খরগোশ।

বেলা বাড়ে, রৌদ্র প্রখর হয়। গাছতলার ভিজে মাটিতে শুয়ে আছে। একজন মানুষ।

কুমিরের বাচ্চার মতন একটা গোসাপ কাছাকাছি এসে চিড়িক চিড়িক করে জিভ বার করছে। ও ডিম পেড়েছে ওই গাছতলায়, মানুষ দেখে ভয় পেয়ে কাছে এগোতে পারছে না।

লালুর ঘুম ভাঙল খিদের জ্বালায়। কাছাকাছি একটা ডোবায় হাত-মুখ ধুয়ে সে প্রাতঃকৃত্য সেরে নিল। কিন্তু খাবে কী?

আগেকার দিনে মুনি-ঋষিরা নাকি বনের ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণ করতেন। কিন্তু সেরকম ফল তো এখনকার জঙ্গলে ফলে না। এখন বর্ষাকাল, এখন ঠিক ফলের সময়ও নয়। কিছু কিছু তালগাছ আছে, তাতে ছোট ছোট ফল ধরেছে বটে, কিন্তু ও ফল খাওয়া যাবে না। তাল পাকে ভাদ্রমাসে। অন্যান্য গাছের অচেনা ফল হয়তো কাক-শালিকে ঠোকরায়, মানুষের আস্বাদের উপযুক্ত নয়।

এক জায়গায় রয়েছে অনেক কচু গাছ। কচুর শাকও তো মানুষ খায়। কিন্তু। রান্না করতে হয়। লালু জানে, কচুর শাক দুরকম হয়, সবুজ আর লোহা লোহা রঙের। সবুজগুলোতে গলা চুলকায়, যতই রান্না করা হোক, তবু চুলকানি শোধরায় না। অন্য কচুর শাকের স্বাদ ভালো, ইশা মাছের মুড়া দিয়ে রাঁধলে তো কথাই নাই!

এইগুলো সবই সবুজ।

মাটির ওপর উঁচু উঁচু হয়ে আছে একপ্রকার কচু, অনেকটা গাঠির মতন, কিন্তু গাঠির চেয়েও বড় বড়। এগুলির নাম আনমেল কচু। লালু দেখেছে, বাড়িতে কখনও চাল বাড়ন্ত হলে তার মা এই আনমেল সেদ্ধ করে খাইয়েছে। কিন্তু কাঁচা খাওয়া কি সম্ভব? চেষ্টা করে দেখতে হবে, যদি গলা চুলকায়, তা হলে একটা তেঁতুলগাছ খুঁজতে হবে, সব জঙ্গলেই তেঁতুল গাছ থাকে। টক খেলে গলা চুলকানির শান্তি হয়।

কচুবন থেকে বেরিয়ে এল একটা সাপ। লালুকে দেখে ফণা তুলল। অল্প বয়েস থেকেই লালু অনেক সাপ দেখেছে, তাই একেবারে আঁতকে উঠল না। সে নিশ্বাস বন্ধ করে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইল। একেবারে নড়াচড়া না করলে সাপ কামড়ায় না, এমনকী পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেলেও কামড়ায় না। লালু তা জানে।

সাপটা আর একটা ঝোপে ঢুকে যাবার পর লালু নিশ্বাস ছাড়ল। তখনই সে বুঝল যে, মারুক বা না-মারুক, অন্য জন্তু-জানোয়ারদের ঠেকাতে তার হাতে একটা কিছু থাকা দরকার। এদিক-ওদিক খুঁজে সে একটা গাছের শুকনো ডাল ভেঙে নিল। তারপর তার প্রশাখাগুলো ছেটে ফেলার পর সেটা বেশ একটা লাঠির আকার নিল। এবং হাতে একটা লাঠি থাকলেই কী। করে যেন আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।

যতই ক্ষুধা বাভুক, লালু আগে কচুর শাকে মুখ দিল না। খানিক খুঁজে সে একটা তেঁতুলগাছ পেয়েও গেল, গাছটি বিশাল, অনেক উঁচুতে তেঁতুল ফলে আছে, হাত যাবে না। লুঙ্গিটা গুটিয়ে নিয়ে সে গাছে উঠতে লাগল, তেঁতুলের কচি কচি পাতাও বেশ খাওয়া যায়।

বাঁদররা যেমন গাছের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়, সেইভাবেই একটা উঁচু ডালে বসে তেঁতুলপাতা খেতে লাগল অনেকগুলো। কিছু তেঁতুলও ঝুলছে। সেগুলো একেবারেই কাঁচা, এতই চুকা যে, দাঁত অবশ হয়ে যায়। কিছুটা লবণ জোগাড় করতে পারলে তবু খাওয়া যেত।

গাছ থেকে নেমে আসার একটু পরেই সে হড়হড় করে বমি করতে লাগল। এতখানি কাঁচা টক পাতা কি হজম করা সহজ? বাঁদররা যা পারে, মানুষ কি তা সব পারে?

মুখ-টুখ ধুয়ে আবার কিছুক্ষণ মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে রইল লালু। গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশ। যখনই সে আকাশের দিকে তাকায়, গভীর বিস্ময়ে মন ভরে যায়। এ আকাশ কত বড়? কী আছে ওখানে? সত্যিই ওখানে স্বর্গ কিংবা বেহেস্ত আছে? কেউ কি তা দেখে ফিরে এসে বলেছে? ঠাকুর-দেবতারা ওখানে শহর-বাজার সাজিয়ে বসবাস করছেন? আল্লা থাকেন কোনদিকে? তার উরস কোথায় পাতা? আবার খ্রিস্টানদেরও স্বর্গ আছে। কুমারখালিতে এক পাদরি ধর্মপ্রচার করছিল, তখন শুনেছিল লালু। তিনি বলছিলেন, ঈশ্বরের পুত্র যিশু। তাইলে যিশুর বাবাই আসল ভগবান? তার নাম তো কেউ বলে না!

লালু ঠিক করল, যতই খিদে থাক, সে আর অখাদ্য-কুখাদ্য খাবে না। দেখা যাক না কতদিন না-খেয়ে থাকা যায়। অসহ্য হলে জঙ্গল থেকে লোকালয়ে চলে গেলেই হবে। এখানে কেউ তার সঙ্গে কথা বলছে না, এটাই বেশি ভালো লাগছে।

লালু আবার গাছতলায় এসে বসল। গোসাপটা ছুটে পালাল সঙ্গে সঙ্গে। লালু এবার ওর অসুবিধেটা বুঝতে পারল। গোসাপকে দেখলে একটু একটু ভয় লাগে বটে, কিন্তু ওরা কখনও কোনও পূর্ণবয়স্ক মানুষকে আক্রমণ করার সাহস পায় না।

লালু বলল, ঠিক আছে, আমি সরে যাচ্ছি।

সে এবার একটা শিমুলগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসল, আর নড়ল চড়ল না।

এটা কিন্তু ধ্যানে বসা নয়। সে ধ্যানের কী জানে? লেখাপড়া শেখেনি, শাস্ত্রমন্ত্র জানে না, তার কোনও মুক্তি বাঞ্ছা নেই, জীবনদর্শন সম্পর্কেও কোনও বোধ নেই। সে এখন আর হিন্দু নয়, হিন্দু দেব-দেবীদের সম্পর্কে সে আগেও যেমন কিছু কৌতূহলবোধ করেনি, মুসলমানদের ধর্ম বিষয়েও সে বিশেষ কিছু জানে না। নামাজ পড়ার সময় মুসলমানরা কী চিন্তা করে, তা-ও। সে কখনও জিজ্ঞেস করেনি। পরলোক সম্পর্কেও তার কোনও অনুসন্ধিৎসা নেই।

সুতরাং তার চুপ করে বসা থাকাটাকে কোনওক্রমেই ধ্যান বলা চলে না। তবে জাগ্রত অবস্থায় কোনও মানুষই একেবারে চিন্তাবর্জিত হতে পারে না। কিছু না কিছু মনে আসেই।

সে বাল্যকাল থেকে যত মানুষজনদের দেখেছে, তাদের কথা ভাবতে লাগল। কতরকম কথা শুনেছে, তার অনেক কিছুই যেন ভুলে গিয়েছিল। এখন জলের মধ্যে ভুরভুরি কাটার মতন অনেক কথাই ফিরে এল। সেই সব কথার নির্যাস থেকে তৈরি হল তার বিন্দু বিন্দু আত্ম উপলব্ধি।

কোনও পাঠশালা, টোলে সে যায়নি, কেউ তাকে লেখাপড়া শেখাবার কথা চিন্তাই করেনি। সে একটা ছাড়া গোরুর মতন আপনমনে ঘুরেছে। যাত্রাদলের মহড়ার সময় বসে থেকেছে এক কোণে, এ-অঞ্চলে প্রচুর বাউল, ফকিরের আখড়া, কীর্তনের দলও আছে। সে তাদের কাছাকাছি ঘুরঘুর করেছে, তখন যা কানে এসেছে শুনেছে। এখন নানান গানের ছত্র, মুরুব্বিদের মুখের কথা ফিরে আসছে তার কাছে। সেগুলো দানা বাঁধছে।

এইভাবে স্মৃতির রোমন্থনে সে যেন একজন অন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছে।

খিদের জ্বালাটা দেড়দিন পর্যন্ত বেশ তীব্র থাকে। তারপর শরীরটা যেন আস্তে আস্তে হালকা হয়ে যায়। আর কোনও খাদ্যের কথা মনে পড়ে না। এরকম সময়ে অনুভূতিও অনেক সুক্ষ্ম হয়ে ওঠে। অনেক আপাত সাধারণ কথায় নতুন অর্থও ঝিলিক মারে। তার জাত গেছে, এই কথাটা সে যতবারই ভাবে ততবারই মনে প্রশ্ন জাগে। জাত আসলে কী? ধর্ম কাকে বলে? মানুষের জন্য ধর্ম, না ধর্মের জন্য মানুষ? ধর্ম না-থাকলে কি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নেই?

গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে থাকে লালু, এক-এক সময় শিরদাঁড়ায় একরকম শিরশিরে অনুভব হয়। গাছেদের কোনও ভাষা নেই, তবু গাছও কি কোনও বার্তা পাঠাতে পারে? কিছু একটা টের পায় লালু, তার অর্থ বোঝে না। মাঝে মাঝে গাছের পাতায় বাতাসের শব্দ হয়, এক-এক বার এক-এক রকম শব্দ, যেন তারও কোনও মর্ম আছে। শুনতে শুনতে ঘুম এসে যায়।

কদিন কাটল, তিনদিন না পাঁচদিন? লালু হিসেব রাখেনি। আস্তে আস্তে তার শরীর থেকে সব রাগ মুছে গেছে। কারুর প্রতি কোনও অভিমানও নেই। সত্যিই যেন সে একটা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল নতুন মানুষ হয়ে। তা হলে আর তার মা ও স্ত্রী সম্পর্কে কোনও দায়িত্বই রইল না।

এই কদিন লালু খাদ্য খুঁজতেও যায়নি, কোনও জন্তু-জানোয়ারও তাকে বিরক্ত করেনি। আর কোনও মানুষের মুখও দেখেনি সে।

তারপর একদিন জঙ্গলে হুটোপাটির আওয়াজ শুনতে পেল। একদল মানুষ যেন মার মার শব্দে কারুকে তাড়া করছে। কোনও মানুষকে অন্য মানুষরা মারতে আসছে নাকি?

লালু চক্ষু বুজল। মানুষের মৃত্যু সে দেখতে চায় না।

অন্যরকম একটা শব্দ শুনে সে আবার চোখ খুলল। মানুষ নয়, একটা জন্তু। ছুটে আসছে, তার পেছনে লাঠি-সোটা নিয়ে চার-পাঁচজন মানুষ।

পেছনের মানুষগুলো লালুকে দেখে চেঁচিয়ে বলল, ভাইডি, ভাইডি আটকাইন অরে, মারেন।

বাঘডাসাটা লালুর দিকেই ছুটে আসছে। এর আগে সে বেশ মার খেয়েছে বোঝা যায়, সারা গা রক্তাক্ত। গর্জন করতে করতে সে ছুটছে, লালুরই দিকে।

লালু উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল, তার হাতে মোটা লাঠি। জোরে একবার মাথায় মারলে জন্তুটা আর উঠতে পারবে না। লালু তুললও লাঠিটা, সে দেখতে পেল জন্তুটার অসম্ভব ভয়ার্ত চোখ, ও দেখতে পেয়েছে মৃত্যু?

লাঠিটা নামিয়ে নিল লালু। সে জন্তুটাকে বলল, যাঃ যাঃ!

জন্তুটা এবার কয়েক লাফে ঢুকে গেল একটা ঝোপের মধ্যে।

লালু কেন করল এরকম? এর আগে সে তো অন্যদের সঙ্গে মিলে দু তিনটে বাঘডাসা, শেয়াল আর পাগলা কুকুর পিটিয়ে মেরেছে। জন্তুরা এসে জ্বালাতন করলে মানুষ তো তাদের মারবেই।

তবে আজ কেন যে লাঠিটা সরিয়ে নিল, তা সে নিজেই বুঝল না।

এই জঙ্গলটা তো মানুষের নয়, জন্তু-জানোয়ারদেরই। এখানে সে কয়েকদিন রয়েছে, কেউ তাকে বিরক্ত করেনি, তার জন্যই কি এই কৃতজ্ঞতা?

লোকগুলো কাছে আসার পর লম্বা মতন একজন জিজ্ঞেস করল, এই তুই ওইডারে মারলি না ক্যান?

একটু বোকার মতন হেসে লালু বলল, জানি না!

কী কথার কী উত্তর। এরকম কেউ কখনও শোনেনি।

লোকটি ধমক দিয়ে বলল, জানি না কী রে বেওকুফ! বল যে পারলি না! লাঠিখান তো উঠাইছিলি।

লালু আবার বলল, ও খুব ভয় পাইছিল।

এবারে দু-একজন হেসে উঠল। একজন বলল, শোনো কথা, ভয় পাবে। তো কি ও হাসবে? আর একটু হইলেই আমরা অরে ধইরা ফেলাইতাম।

অন্য একজন বলল, আমাগো গেরামের একটা ছাগল মারছে।

কয়েকদিনের অনশনেই সম্ভবত লালুর চিন্তার প্রবাহ কিছুটা ঘোলাটে হয়ে গেছে। কথার সূত্রও খুঁজে পাচ্ছে না।

সে আপনমনে বলল, মানুষে কি বাঘডাসা মাইরা খায়? হরিণ খায়, খরগোশ খায়, শিয়াল খায় না ক্যান?

লম্বা লোকটি বলল, এডা কয় কী? পাগল-ছাগল নাকি? আইলো কোথা থিকা?

একজন জিজ্ঞেস করল, এই, তুই কে? লালুর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, সিরাজ সাঁইয়ের কথা! সব খোঁজার মধ্যে বড় হল নিজেকে খোঁজা। আমি কে? তা তো এখনও জানা হয়নি।

লালু উত্তর দিল না।

সে আবার জিজ্ঞেস করল, তোর বাড়ি কোথায়? কোথা থিকা আইছোস?

লালু বলল, বাড়ি নাই।

সবাই এখন লালুকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। সারা গায়ে ধুলো-কাদা মাখা, চুলেও ধুলো, কয়েকদিনের অরণ্যবাসের পর লালুকে পথের পাগলের মতনই দেখায়।

একজন তাকে একটা খোঁচা মেরে বলল, তুই আইছোস কোথা থিকা? তোর বাপ মায় কী করে?

লালু দুদিকে মাথা নাড়ল।

অন্য একজন বলল, পুরা পাগল। কোনও আশা নাই। চল, চল।

আর একজন বলল, আহা রে, কোন মায়ের যেন বুক ভাঙছে। জন্ম দিছে, লালন পালন করছে, খাওয়াইছে-পরাইছে, এতখানি বড় তো করছে, তারপর সংসারে কোনও কাজেই লাগল না। এই জঙ্গলে থাকলে কতদিন আর বাঁচবে।

লোকগুলি চলে যাবার পর দুটি কথা লালুর মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল। তুমি কোথা থেকে এসেছ, তুমি কে?

এ-প্রশ্নের উত্তর তো দাসপাড়ার লালু নয়। আরও গভীর। মানুষ কোথা থেকে আসে? কী মানুষের প্রকৃত পরিচয়?

প্রহ্লাদ পালায় আর একটি বচনও তার মনে পড়ে গেল। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুকে এক ব্রাহ্মণ বলেছিল, লালয়েৎ পঞ্চবর্ষাণি, দ্বাদশ বর্ষানি পালয়েৎ। প্রাপ্তেতু যোড়ষবর্ষে পুত্রমিত্রবদাচরেৎ। এর অর্থও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সম্ভানকে জন্মের পর প্রথম পাঁচ বছর পালন করবে, নইলে সে নিজে থেকে কিছু খেতে শিখবে না, কথা কইতে শিখবে না। অনেক জন্তু জানোয়ারের শাবক দু-চারদিন পরেই খেতে শিখে যায়, নিজে নিজেই হাঁটতে বা উড়তে শেখে। গোরুর বাছুর তো জন্মের কিছুক্ষণ পরেই লাফাতে শুরু করে। শুধু মানুষের বাচ্চা জন্মের পর একেবারে অসহায়, কান্না ছাড়া আর কিছুই জানে না। অন্তত পাঁচ বছর তাকে লালন না করলে বাঁচানো যায় না। তারপর তাকে পালন করতে হয়। তাকে শিক্ষা দিতে হয় অনেক কিছু, শুধু তো খাওয়া নয়, সে ভাষা শেখে, মানুষ চেনে, আগুনে হাত দেওয়া যায় না বোঝে। সাঁতার না-শিখে জলে নামা যায় না, বাপ-পিতামহর ধর্ম শেখে। আসল কথা পৃথিবীটাকে চিনতে শেখে। সেটাকেই পালন করা বলে। বারো বছর বয়স পর্যন্ত অন্তত পালন করতে হয়। তারপর যোলো বছর বয়সে সে লায়েক হয়ে যায়, তখন পুত্রের সঙ্গে মিত্রের মতন আচরণ করতে হয়।

পণ্ডিত মশাই আরও বলেছিলেন, বাবা-মায়ে মিলে কত পুত্র-কন্যার জন্ম দেয়। কিন্তু প্রকৃতভাবে লালন-পালন করে কয়জন? ধনীরাও ঠিক মতন মন দেয় না, আর গরিব ঘরের তো কথাই নাই।

কোনওমতে চার-পাঁচ বছর বুকের দুধ দেয়, খাওয়ায়, শিশু কিছুর অভাবে কান্নাকাটি করলে চাপড় মেরে মেরে ঘুম পাড়ায়, তারপর তাদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেয়। রাস্তার কাঙালিরা যেমন গৈরস্ত বাড়ির অপোগন্ড ছেলে ছোকরাগুলোর সাথেই বা তাদের কী তফাত! তাদের দ্বারা সমাজের কোনওই উপকার হয় না, বরং অশান্তি লেগেই থাকে।

প্রায় ছবছর আগে এই কথাগুলো শুনেছিল লালু। তখন বিশেষ মন দেয়নি। এসব জ্ঞানের কথা শোনার ধৈর্য ছিল না। এখন আশ্চর্যভাবে প্রতিটি শব্দ ফিরে এল তার স্মৃতিতে। আর বারবার মনে হতে লাগল, সে এই পৃথিবীতে জন্মেছে বটে, কিন্তু তার তো লালনপালন কিছু হয়নি। তার জন্মদাতা তার কোনও দায়িত্ব নেয়নি, অতি অল্প বয়সেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে, তার মুখও লালুর মনে নেই।

তার অসহায় বিধবা মা আর কীভাবে তাকে পালন করবেন? মামার বাড়িতে এসে তার মাকে যে কতরকম লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে, তা কি সে শিশু বয়সেও অনুভব করেনি? দুবেলা দুটি অন্নের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে তার মাকে, ছেলের দিকে তিনি মনোযোগও দিতে পারেননি। মামাবাড়ির ছেলেরা পাঠশালায় পড়তে যেত, লালুকে তারা সে ধারেও ঘেঁষতে দেয়নি। লালুর অবশ্য তখন মনে হত, তাকে যেন সুবিধেই দেওয়া হচ্ছে, গুরুমশাইয়ের বেতের সামনে বসে থাকতে হবে না ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কত মজা। সে তখন ঘুরে বেড়াত বনে-বাদাড়ে, কোথায় না কোথায়, শুধু মাঠে মাঠে চুরি-করা ঘোড়ায় চাপলেই তার মনে হত, সে বহুদূরে অচেনা দেশে চলে গেছে।

এখন কোনও মানুষকে বইয়ের পাতা থেকে কিছু পড়তে দেখলে তার। যেমন অবাক লাগে, তেমন হিংসেও হয়। অত খুদে খুদে কালো অক্ষরে। কী করে মানুষের ভাষা, কত জ্ঞানের কথা লেখা থাকে? এসব আর লালুর জানা হবে না?

মৃত্যু থেকে ফিরে এসেছে সে। ধর্মও চলে গেছে। সে এখন নতুন মানুষ। যেন আবার জন্ম হয়েছে তারা এখন থেকে তার লালনপালনের ভার নিজেকেই নিতে হবে।

লালুর একসময় ভয় হয়েছিল, লোকগুলো বুঝি তাকে মারবে। রাস্তায় পাগল দেখলে অনেকেই ঢিল ছোড়ে, কঞ্চি দিয়ে পেটায়। এতে কেন তারা আনন্দ পায় কে জানে।

বাঘডাসাটাকে কেনই বা সে লাঠি তুলেও মারল না? আহত পশুটার ভয়ার্ত চোখ দুটি দেখে কেমন যেন হয়ে গেল মনটা। অথচ এই জন্তুগুলো একটু সুযোগ পেলেই যে গৃহস্থের ক্ষতি করে, তাও তো ঠিক। লালু ওই তাড়া করে আসা মানুষগুলোর প্রশ্নের ঠিক মতন জবাব দিতে পারেনি, তখন। কিছুক্ষণের জন্য তার মনটা অবশ হয়ে গিয়েছিল।

সে রাতটাও কেটে গেল, আবার দিনমণির উদয় হল আকাশে। এখানে অরণ্য বেশ ঘন, তাই দিনের বেলাতেও আলো-আঁধারি হয়ে থাকে। একটু দূরে কিছুই দেখা যায় না। সেখানে শুকনো পাতায় খচর-মচর শব্দ হলেই সচকিত হয়ে উঠতে হয়।

লালু শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করে যায়। খিদের জ্বালাটা একেবারেই কমে গেছে। প্রায় মনেই পড়ে না। ভবিষ্যৎ নিয়ে সে কী করবে? একটা মনুষ্যজন্ম পেয়েছে, এটা তো শুধু শুধু নষ্ট করা যায় না। এই জঙ্গলে সে মোটেই কাটাতে চায় না বাকি জীবন। সে মানুষের সঙ্গ চায়। কাল মানুষগুলোকে দেখে প্রথমে উৎফুল্ল বোধ করেছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে মানসিক সংযোগ ঘটল না, হয়তো তার নিজেরই দোষে।

জঙ্গলের এই একাকিত্বের মধ্যে সে এক-একসময় নারী-সঙ্গ পাওয়ার জন্যও আকুতি বোধ করল। দীর্ঘ অসুস্থতার সময় তার এই বোধ একেবারেই ছিল না। এখন মাঝে মাঝেই সে তার পুরুষাঙ্গের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে।

আরও একটা ব্যাপারে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে লালু। যখন তখন তার মনে আসছে দু-একটা গানের পদ। এ গান কার রচনা সে জানে না, কোথায় শুনেছে তাও মনে পড়ে না।

সে গাইতে লাগল:

এমন মানব-জনম আর কি হবে
যা কর মন ত্বরায় কর
এই ভবে…

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *