মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতি : ০২
গত সভায় আমাদের মাননীয় বক্তা অনেক আবোল-তাবোল বকেছেন।
বাঙালির স্বভাবই হল, যারা একটু বলতে কইতে পারেন তারা আর মাইক ছাড়তে চান। যদিও এ সভা অ-মাইক। এটাও কিন্তু মনুষ্য ক্লেশের মধ্যে পড়ে। আমরা শুনব না, শুনতে চাইছি না তবু জোর করে শোনাবার চেষ্টা। দেখো আমি কত বড় পণ্ডিত। কত কি জেনে বসে আছি। বক্তারা চিরকালই শ্রোতাদের ক্লেশের কারণ। এর নাম দেওয়া যাক বকর-বকর ক্লেশ।
যিনি নোট নিচ্ছিলেন, সভাপতি নীচু গলায় তাকে বললেন, বাঁদিকে ওপরে লিখুন, বকর বকর ক্লেশ, বড় করে লিখুন, হ্যাঁ, আন্ডার লাইন করুন।
এই বকরমবাজদের মধ্যে পুংলিঙ্গও আছে স্ত্রীলিঙ্গও আছে, সুতরাং বকরমবাজরা হলেন উভলিঙ্গ জীব। ইংরেজিতে এদের বলে–হারমাফ্রোডাইট। এঁরা অফিসে সহকর্মী, যানবাহনে সহযাত্রী, মঞ্চে নেতা, সভাপতি কিংবা প্রধান অতিথি, বেতারে বক্তা, গৃহে শয্যাসঙ্গিনী! একবার দম দিয়ে ছেড়ে দিলেই হল। দম মারো দঅঅম।
সভাপতি ফিসফিস করে বললেন, শেষ লাইনটা বাদ দিন। ও দমটা গ্রামোফোনের দম নয়, যদুর জানি গাঁজার দম।
কথা কম, কাজ বেশি, এদেশে তা সম্ভব হল না। চৈত্র মাসে, গাজনের সন্ন্যাসীরা চড়কের দিন জিভে বাণ ফোঁড়েন, এর নাম হল বাণ-ফেঁড়। উদ্দেশ্যটা কি? বাক্যের উৎসস্থলে বাণ মেরে বাক্যবাণ বন্ধ করা। যে কুকুর বেশি ঘেউঘেউ করে তার মুখে মাজল বেঁধে দেওয়া হয়। যে বাছুর সবসময় বাঁটের দুধ খাওয়ার জন্যে বেশি ছোঁকছোঁক করে তার মুখে জাল বেঁধে দেওয়া হয়। আমি স্বীকার করছি, মানুষের মুখের গঠনটাই বেয়াড়া। থ্যাবড়া। শেয়াল বা কুকুরের মতো ছুঁচোলো নয়। মাজল পরাবার কোনও উপায়ই ঈশ্বর করে রাখেননি। ঠোঁট দুটো গুণছুঁচ দিয়ে সেলাই করে দিলেই বকরম-বকরম বন্ধ হতে পারে! কিন্তু সে তো আর সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, কঁদুনে খোকার মুখে যেমন চুষি বা সাকার ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সেইরকম একটা কিছু যদি চালু করা সম্ভব হতো তাহলে মন্দ হতো না। চুষলেই চাটনি, বেশ নেশা ধরানো চাটনি। এত বড়-বড় চুষি, সি এস পি সি এম ছাপ মারা। যেই মনে হবে লোকটা বড় বিপজ্জনক, ক্লেশদায়ক, সুযোগ পেলেই বকতে আরম্ভ করবে, দাও মুখে চুষি রে।
যেমন ধরুন কোনও মহিলা এসে বললেন, কত্তার জ্বালায় বাড়িতে আর টিকতে পারছি না, চব্বিশ ঘণ্টা বকর-বকর করে পাগল করে দিচ্ছে। সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের এই সংস্থার তৈরি স্পেশ্যাল একটা নিপলস্ তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হল। সঙ্গে এক শিশি চাটনি।
সভাপতি প্রশ্ন করলেন, কীসের চাটনি? আমের না আমড়ার?
মিষ্টি-মিষ্টি চাটনি। এমন চাটনি যার মধ্যে কিছু নেশার উপাদান থাকবে। বকবক করার নেশার চেয়েও জোরালো নেশা। ফরমূলাটা ধরুন এইরকম হবে, কাঁচা আম এক কেজি, চিনি ৫০০ গ্রাম, এক ভরি আফিমের জল, অভাবে পোস্তর খোলাসেদ্ধ জল, বেলশুট চূর্ণ ২০০ গ্রাম। বেল দেওয়ার কারণ, আফিমে একটু কনস্টিপেশন হতে পারে, বেলে সেটা কেটে যাবে। কনস্টিপেশনে বায়ু বেড়ে যায়, বায়ু উর্ধমুখী হলে বকবকানি আরও বেড়ে যেতে পারে।
এখন আম সেদ্ধ করে কাত করে বের করে মিহি মোলায়েম করে হেঁকে ফেলুন। চিনি রস করে মিশিয়ে দিন। সামান্য জিরে গুঁড়ো, অল্প একটু লঙ্কা, আফিমের জল, বেলচূর্ণ দিয়ে বেশ করে ফুটিয়ে নিন। ঠান্ডা হলে শিশিতে ভরে ফেলুন। গায়ে লেবেল মেরে দিন নাম ফরমূলা ১, মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতির মোক্ষম দাওয়াই। বয়স্কদের বকম-বকম, কানের কাছে অনবরত হাঁচি অথবা কাশির মতোই বিরক্তিকর। ফাঁপা চুষিতে এক চামচে ফরমূলা ১ ভরে কত্তাকে চুষতে দিন, গিন্নির মুখে গুঁজে দিন, শ্বশুরের মুখে ঠুসে দিন, শাশুড়ির ঠোঁটে পুরে দিন। অব্যর্থ দাওয়াই! অভ্যাস হয়ে গেলে চুষি একবার ধরে গেলে, কেউ আর বক্তা থাকবেন না, সবাই তখন শ্রোতা।
সভাপতি একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, আফিম পাবেন কোথায়? ইট ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট টু প্রোকিউর। এই তো আমার পা ফুলছে বলে কবরেজ বিধান দিয়েছেন, একগুলি করিয়া সরষের অহফিম দুধসহ সেব্য। তার জন্যে কার্ড চাই, আবগারি বিভাগের পারমিট চাই। তা ছাড়া ওই বস্তুটি যৌবন ধরে রাখে, খিদে বাড়ায়, গালে গোলাপি আভা আনে, মানুষকে মৌতাতে রাখে। কিশোর ন্যাচারাল প্রসেসে যুবক হবে। সংসারে প্রবেশ করবে। ধাক্কা আর মার খেতে-খেতে অকালে বুড়িয়ে ঝরাপাতার মতো চেহারা হয়ে যাবে। ডিসপেপসিয়া, ন্যাবা, বুক ধড়ফড়, কন্যাদায়, পুত্রদায়, পিতৃঋণ সব নিয়ে একদিন অকালে বল হরি হরিবোল। ফিনিশ। সেখানে আফিম ইনট্রোডিউস করে জীবনকে মধুর করে তোলা অপরাধ। আমরা তো আর কনস্টিটিউশনের অ্যাগেনস্টে যেতে পারি না। জীবনবিরোধী কার্যকলাপ পরিহার করিয়া চলাই বাঞ্ছনীয়।
কোন কনস্টিটিউশন? ভারতীয় সংবিধানের কথা বলছেন, যে সংবিধানের দুশো বার অ্যামেন্ডমেন্ট হয়েছে, যে সংবিধানে বলেছে, ইকোয়াল অপরচুনিটিস ফর অল, ফ্রিডম অফ স্পিচ, ফ্রিডাম ফ্রম পভার্টি, স্লেভারি, এট অল?
ও নো নো। সে সংবিধান অতি পবিত্র বস্তু, পার্লামেন্ট ছাড়া তাতে হাত দেওয়ার অধিকার কারুর নেই। আমি মিন করেছি আমাদের কনস্টিটিউসান, হিউম্যান সামথিং দেবভোগ্য বস্তু, আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে। আমি একটা বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবছি।
হোয়াট ইজ দ্যাট।
আমরা কালা হয়ে যাওয়ার সাধনা করি। কথায় আছে, ধরো আর মারো আমি পিঠে বেঁধেছি। কুলো, বকো অরে ঝকো আমি কানে দিয়েছি তুলল।
তার মানে আপনি ফাংশানাল ডিজঅর্ডার চাইছেন?
অফকোর্স। ইতিহাসে দেখুন এক-একটা যুগ এসেছে, ডার্ক এজ, গোল্ডেন এজ, রেনেসাঁস, রিভাইভ্যাল অফ রেনেসাঁস, এইভাবে আমরা এসে পড়েছি–এজ অফ ব্রেকডাউনে! রাস্তায় গাড়ি ব্রেকডাউন, পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্রেকডাউন, পেট্রল আর ডিজেল সাপ্লাই ব্রেকডাউন, রেলে ব্রেকডাউন, মর্যাল ব্রেকডাউন, পারিবারিক শান্তি ব্রেকডাউন, সব সার্ভিস ব্রেকডাউন, হেলথ ব্রেকডাউন, সামাজিক কাঠামো, মানুষ মানুষের সম্পর্ক সব ব্রেকডাউন। ডাউন ডাউন, নিলডাউন। হাম হাম গুঁড়িগুড়ি।
সুর করে বলি, ম্যায় চলি, ম্যায় চলি, হাম হাম হামাগুড়ি।
কিন্তু সভাপতি স্যার, কালা হব বললেই কি হওয়া যায়! শুনেছি বিল্বমঙ্গলবাবু কাম জয় করার জন্যে প্রেমিকার খোঁপা থেকে কাটা খুলে নিয়ে চোখে খোঁচা মেরে অন্ধ হয়ে বলেছিলেন, প্রাণপ্রিয়ে দিলুম বারোটা বাজিয়ে, তুমি কে, কে তোমার, অন্ধের কিবা রাত্রি কিবা দিন, পেঁচিও যা পরিও তাই। তাহলে আমরাও কি স্ব-স্ব পত্নীর বড়ি-খোঁপা থেকে ইস্টিলের কাঁটা খুলে কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট করে এককালে সব বধির হয়ে যাব?
না তার প্রয়োজন নেই, বিল্বমঙ্গলের পরিবর্তে কর্ণমঙ্গল কাব্য আর তেমন মার্কেটে চলবে না। শ্রবণশক্তি ইতিমধ্যেই নয়েজ পলিউশানে কমে আসছে। নেতারা চোঙা ফুঁকে প্রায় আধকালা করেই দিয়েছেন। আর একটু ধৈর্য ধরতে পারলেই ফুল-কালা হয়ে যাব। এর মাঝে আর একপথ আছে–অভ্যাসযোগ। শুনেও শুনব না, দেখেও দেখব না।
রাইট। রকে বসে ছেলে আমার স্যাঙাতদের নিয়ে খুব গুরু-গুরু করে যাচ্ছে। ভীষণ ইরিটেশান হচ্ছে ভেতরে, ক্লেশ, ভীষণ ক্লেশ…।
গুরুর নাম শুনে ক্লেশ?
আজ্ঞে এ গুরু সে গুরু নয়। এই জেনারেশানের কথার ধরন। একদিন কি একটা কথা বললুম, উত্তর দিলে, কি যে বলো, গুরু। অবশ্য তক্ষুনি সামলে নিয়ে সরি বলেছিল, গর্ভধারিণী মাকে একদিন বলে বসল, হায় সখি।
ও, এই ব্যাপার। হ্যাঁ, এখানে অভ্যাসযোগ চলবে। শুনেও শুনবেন না।
যেমন ধরুন মাসের শেষে। সকাল থেকেই স্ত্রী বলছেন, শুনছ, বড় জামাই আসছে কানপুর থেকে, শুনছ বড় জামাই। সকালের চায়ের সময় বড় জামাই, বাথরুমে ঢোকার মুখে বড় জামাই, অফিসে বেরোবার সময় বড় জামাই, লাস্ট বিছানায় শুয়ে মাঝরাতেও বড় জামাই! শেষে তেরিয়া হয়ে বলতেই হল, মানে মুখ ফসে, সরি ফকসে নয় ফসকে বেরিয়ে পড়ল–বিগজামাই আসছে তো আমার বাপের কি! সঙ্গে-সঙ্গে আবিষ্কার করলুম, আমি আর খাটে নেই। মশারি ঝুলে লাল মেঝেতে।
ভুল করেছেন। সকাল থেকে যেমন বধির ছিলেন, তেমনি বধির থাকাই উচিত ছিল। একটা টোটকা শিখে রাখুন, যখনই কোনও ক্লেশদায়ক কথা শুনতে থাকবেন, তখনই মনে গুনগুন করতে থাকবেন, আমি বনফুল গো, আমি বনফুল গো, ছন্দে-ছন্দে দুলি আনন্দে, আমি বন…