Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মদন তপাদারের বাক্স || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 7

মদন তপাদারের বাক্স || Shirshendu Mukhopadhyay

জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ

বলতে গেলে এটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ। এত সোনা সে জীবনে দ্যাখেনি। তার উপর মদন তপাদারের বাক্সখানা। এটা থেকেও কিছু আয় হবে। সে এখন কত লাখ টাকার মালিক তা বুঝে উঠতে পারছিল না সুধীর গায়েন। এত টাকা নিয়ে কী করতে হয়, তাও সে জানে না। তবে টাকা হলে শিখে নিতে দেরি হবে না। তার ইচ্ছে গরিব-দুঃখীকেও কিছু দেবে। তবে একটা আহাম্মকির কাজ হয়েছে। মন্টুরামের বাড়িতে ধরা পড়ে সে কবুল করে ফেলেছিল যে, মদন তপাদারের বাক্স চুরি করতেই সে ও বাড়িতে ঢুকেছে। সুতরাং এখন পুলিশ হন্যে হয়ে তাকে খুঁজবে। অতএব আজ রাতেই তাকে এই গাঁয়ের সীমানা পেরিয়ে অনেকটা তফাত হতে হবে।

সুধীর একটু তাড়াতাড়িই হাঁটছিল। মনে আনন্দ, শিহরন, উত্তেজনা। চারদিকটা সে যেন ভাল করে খেয়াল করতে পারছে না।

চৌপথীর ঠিক মাঝখানে মন্টুরামের দাদু স্বাধীনতা সংগ্রামী জয়রাম সিংহের একটা প্রমাণ সাইজের ব্রোঞ্জমূর্তি। শ্বেতপাথরের বেদির উপর দাঁড় করানো। সেই মূর্তিটা যখন পেরিয়ে যাচ্ছিল সুধীর, সেই সময়ে একটা খুব সূক্ষ্ম নড়াচড়া টের পেল সে। কিন্তু সতর্ক হওয়ার আগেই কালো মূর্তিটাই যেন লাফিয়ে নেমে এল তার সামনে। কালো কাপড়ে ঢাকা মুখ, লম্বা আর চওড়া মূর্তিটা

ভাল করে ঠাহর করার আগেই তার মাথায় কঠিন একটা জিনিস এসে লাগল। কিছু বুঝে ওঠার সময় পেল না সে। চোখ অন্ধকার হয়ে গেল, মাথাটা ভোঁ হয়ে গেল, সে অজ্ঞান হয়ে গড়িয়ে পড়ল রাস্তায়।

যখন জ্ঞান ফিরল, তখনও আলো ফোটেনি। সুধীর মাথাটা চেপে ধরে উঠে বসে খানিকক্ষণ তার কী হয়েছে বুঝবার চেষ্টা করল। কপালের ডান দিকে একটা টিপলি আঙুলে টের পেল সে, আর অসহ্য যন্ত্রণা। একটু-একটু করে ঘটনাটা মনে পড়ল তার। ব্রোঞ্জমূর্তি তার উপর যে লাফিয়ে পড়েনি, তাও বুঝতে পারল সে। মূর্তির সঙ্গে মিশ খেয়ে যে গা ঢাকা দিয়েছিল, তাকেও সে বোধহয় বিলক্ষণ চেনে। কালোবাবু যে ভয়ংকর লোক, তাও তার অজানা ছিল না। কিন্তু লোকটা যে এত ধুরন্ধর তা আন্দাজ করতে পারেনি।

সুধীর বুঝতে পারল, চুরির মাল হাতছাড়া, সুটকেস হাওয়া, সে এখন পুনর্মুষিক। তার উপর ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তেড়ে আসবে। সুতরাং সে উঠে পড়ল এবং জোর কদমে হেঁটে এবং খানিকটা ছুটে চৈতন্যপুরের সীমানা ডিঙিয়ে গেল।

ভোরের বাস ধরে ঘণ্টা দুয়েক বাদে একেবারে পাথরপোতায় বাঁকাবাবার ঠেকে পৌঁছে হাঁফ ছাড়ল সে। ভোরের আলো ফুটে গিয়েছে। পাখিপক্ষী ডাকাডাকি করছে। বাঁকাবাবার ঠেকে আজ কোনও লোজন নেই। বড্ড ফাঁকা। বাবা বোধহয় যোগনিদ্রা থেকে এখনও ওঠেননি।

সুধীরের কোনও তাড়া নেই। মনটা বড্ড খারাপ। সে একটা পরিষ্কার গাছতলা বেছে নিয়ে তার তলায় গামছাটা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।

ঘুম ভাঙল ঠিক দুপুরবেলায়। শরীরে জ্বরভাব। পেটে খিদে, কণ্ঠায় তেষ্টা। ধীরে ধীরে চোখ মেলে চারদিকটা চেয়ে দেখতে গিয়েই নজরে পড়ল, শিয়রে সেই বুড়ো লোকটা বসে আছে। তাকে চোখ মেলতে দেখেই বলল, “আহাম্মকির গুনোগার দিতে হল তো?”

একটা শ্বাস ফেলে উঠে গাছে ঠেস দিয়ে বসে সুধীর বলল, “এখন আপনার বিশ্বাস হল তো যে, আমি মোটেই ভাল চোর নই!”

“চুরি পর্যন্ত তো সব ঠিকঠাকই ছিল হে। গণ্ডগোল তো করলে পালানোর সময়।”

মাথা নেড়ে সুধীর বলে, “চুরিটাও ঠিকঠাক হল কোথায়? গোবিন্দবাবুই তো সুলুকসন্ধান বাতলে দিলেন। আমার কেরানি আর কতটুকু?”

“যারা বড় চোর হয় ভাগ্যও তাদের সঙ্গে থাকে কিনা। গোবিন্দ ঘোষ তো নিমিত্ত মাত্র।”

“দুর মশাই, ও কথায় আর ভবি ভুলবার নয়। তবে আপনি যে আমাকে দেড় হাজার টাকা দিয়েছিলেন, তাতে আমার মেলা উপকার হয়েছে। খেটেপিটে টাকাটা একদিন শোধ দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।”

“আর চোরের উপর যে বাটপাড়ি করল তাকে কি ছেড়ে দেবে?”

সুধীর একটা খাস ফেলে বলল, “কালোবাবুকে আপনি চেনেন না। চিনলে ওকথা বলতেন না। সাত-আটটা খুন ছাড়া অনেক ডাকাতির কেসও আছে ওঁর নামে। তাগড়াই চেহারা, কোমরে দুটো-তিনটে পিস্তল, ছোরা, এইসব থাকে সব সময়ে। বাড়িঘর কোথায়, কেউ জানে না। হঠাৎ উদয় হন। তারপর কোথায় হাওয়া হয়ে যান। ওরকম লোকের সঙ্গে আমাদের কি পাল্লা দেওয়া চলে?”

“তুমি যে বড্ড লাতন হয়ে পড়েছ হে!”

“হওয়ারই কথা কিনা। মাথা টনটন করছে, অত সোনাদানা হাতছাড়া, পিছনে পুলিশ তাড়া করে আসছে। আমার অবস্থায় যদি আপনি পড়তেন, তবে বুঝতেন।”

বুড়ো লোকটা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, “তা বটে। তোমার অবস্থাটা এখন অত সুবিধের নয়।”

সুধীর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল, “একটা কথা বলবেন মশাই? আমি যে এখানে আছি, সেই সন্ধান আপনাকে কে দিল?”

“সন্ধান? সন্ধান আর কে দেবে! প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে হঠাৎ দেখি, তুমি গাছতলায় শুয়ে আছ।”

“মশাই, এখন কম করেও বেলা বারোটা বাজে। এ সময়ে কেউ কি প্রাতর্ভমণে বেরোয়?”

“ওঃ, তাও তো বটে! বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে দেখছি! তা হলে চলো, ওঠা যাক।”

“আমার যাওয়ার যে কোনও জায়গা নেই মশাই! কিছুদিন এখন গা ঢাকা দিয়ে এই বাঁকাবাবার ঠেকেই পড়ে থাকতে হবে।”

“বাঁকাবাবার আশ্রম! সেটা কোথায় বলো তো?”

“কেন, ওই যে কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে, বাবা ওখানেই থাকেন। সামনে যে মাটির বেদি দেখছেন ওখানে বসেই ভক্তদের দেখা দেন।”

“ওইটে বাঁকা মহারাজের ঠেক বুঝি! বাঃ! বেশ ভাল ব্যবস্থা তো! কানাই দারোগাও সেদিন বলছিলেন বটে যে, পাথরপোতায় বাঁকা মহারাজের আশ্রমে গেলে ভারী শান্তি পাওয়া যায়। আর মন্টুরাম তো তাঁর মেয়ের হাঁপানির ওষুধ নিতে প্রায়ই চলে আসেন গাড়ি চালিয়ে।”

সুধীর টপ করে উঠে পড়ে বলল, “জানি আপনি মিছে কথা কইছেন, তবু আপনার মিথ্যে কথাটাকে সত্যি বলে না ধরে আমার উপায় নেই। চলুন, কোথায় যেতে হবে।”

বুড়ো মানুষটা হাত তুলে বলে, “রোসো বাপু, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। লক্ষ করেছ কি যে, তোমার বাঁকা মহারাজের আশ্রমে

কোনও লোকজন দেখা যাচ্ছে না।”

সুধীর একটু অবাক হয়ে বলে, “তাই তো! কাল সকালেও মেলা লোকজন ছিল! গতকালই তো এসে বাবার আশীর্বাদ নিয়ে তবে মন্টুরামের বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছি।”

“চলো, ব্যাপারটা দেখা যাক।”

দেখা গেল, বাঁকা মহারাজের ঠেক একেবারে ফাঁকা। কুঁড়েঘরখানায় কোনও তৈজসপত্র, লোটাকম্বল বা আর কিছুই নেই।

“তোমার বাঁকা মহারাজ কি যোগবলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন নাকি হে সুধীর?”

“আজ্ঞে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।”

চারদিকটা ঘুরে দেখতে দেখতে বুড়ো মানুষটা বলল, “যোগবলে অদৃশ্য হওয়ার চেয়ে মোটরবাইকে অদৃশ্য হওয়া ঢের সোজা। মাটির উপর এই মোটরবাইকের চাকার দাগ দেখতে পাচ্ছ তো!”

চারদিকটা দেখতে দেখতে বুড়ো মানুষটা খুব আনমনে বলল, “বাপু হে, পাথরপোতা নামটা শুনলে তোমার কিছু মনে পড়ে না?”

“না। শুধু জানি এ হল বাঁকাবাবার ঠেক।”

“চোরেদের স্মৃতিশক্তি তো খুব ভাল হওয়ার কথা! একবার যা দ্যাখে, একবার যা শোনে, তা সহজে ভোলে না। কী বলো হে?”

হঠাৎ সুধীর থমকে দাঁড়াল। তারপর বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, পাথরপোঁতা তো মদন তপাদারের গ্রাম! মনে পড়েছে”

“ঠিক ধরেছ।”

“কিন্তু তাতে আর কী যায়-আসে বলুন।”

“তা তো ঠিকই। কী আর যায়-আসে। তবে কী জানো, মদন তপাদারের একটা ছোট্ট ছেলে ছিল। হিরু তপাদার।”

সুধীর মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, মাঝে মাঝে ছেলের কথা বলে খুব দুঃখ করতেন। মা-মরা ছেলে।”

“সেই ছেলেটার খোঁজখবর করতে তোমার ইচ্ছে যায়নি?”

মাথা নেড়ে সুধীর বলল, “আজ্ঞে না। খোঁজ নিয়ে কী করব বলুন। আমার নিজেরই পেট চলে না, সেই ছেলের কোন উপকারে আসতে পারতাম? তবে মাঝে মাঝে মনে যে পড়ত না, তা নয়। মদনবাবুর মৃত্যুর জন্য আমিও তো খানিকটা দায়ী।”

“বাপু সুধীর, যা মনে হচ্ছে তোমার বাঁকা মহারাজ আর সহজে এখানে উদয় হবেন না। তিনি অস্তেই গিয়েছেন। চলো যাওয়া যাক।”

.

আজ মধ্যরাতে হরিশ্চন্দ্রের পিসিমাগণের আবির্ভাব ঘটল একটু অন্য স্টাইলে। কানা পিসি ছাদের দিক থেকে বাতাসের অদৃশ্য সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে নামলেন। খোঁড়া পিসি যেন বাতাসের দরজা ঠেলে ঢুকলেন। কুঁজো পিসি যেন সুড়ঙ্গপথ ধরে পাতাল থেকে উঠে এলেন। হরিশ্চন্দ্র একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। তাড়াতাড়ি উঠে বসে বললেন, “পিসিমাগণ, আজ সব ভেন্ন ভেন্ন হয়ে উদয় কেন?”

কানা পিসি বলে, “আর বলিস না বাছা, প্রাণের ভয় কার নেই বল! ওই মুখপোড়া নাদু মালাকার গতকাল সন্ধেবেলা তিনতলার চিলেকোঠায় আমরা যখন চুল আঁচড়াচ্ছি, তখন হাঁড়ি নিয়ে হামলে পড়েছিল। ধরে ফেলে আর কী। কী আস্পর্ধা বল তো! আমরা তো আর হ্যাতা-ন্যাতা মানুষ নই রে বাপু, স্বয়ং রাজাধিরাজের পিসি! শিঙ্গি-মাগুর মাছ তো নই যে, হাঁড়িতে পুরে জিইয়ে রাখবে!”

হরিশ্চন্দ্র উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তা আপনারা কী করলেন পিসিমাগণ?”

খোঁড়া পিসি বলে, “সেই তো বাছা, কী বিপদেই যে পড়েছি। তিনজন বুদ্ধি করে আয়নায় ঢুকে পড়েছিলুম বলে বাঁচোয়া।”

হরিশ্চন্দ্র ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আয়না! আয়নায় কি ঢোকা যায়?”

কুঁজো পিসি বলে, “আয়নায় যে ঢোকা যায়, তা কি আর আমাদেরই জানা ছিল বাপ। কিন্তু দিব্যি ঢুকে গেলুম যে। নাদু কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে চলে গেল।”

“আর আয়নাটা?”

“সে আছে।”

“কীরকম আয়না পিসিমাগণ? আমি যতদূর শুনেছি, আয়নায় ভূত-প্রেতের ছায়া পড়ে না।”

কানা পিসি বলে, “তা ঠিকই শুনেছিস বাপু, এই অবস্থা হওয়ার পর থেকে চেহারার কী ছিরি হয়েছে, তা দেখার জন্য মনটা বড় আঁকুপাঁকু করত। কিন্তু এমনই পোড়া কপাল যে, রাজবাড়ির কোনও আয়নাতেই আমাদের ছায়া পড়ত না। তাই মনে বড় দুঃখ ছিল। তারপর একদিন তোষাখানার তাকে এই আয়নাটা পেলুম। দিব্যি আয়না। দেখলুম, তাতে আমাদের বেশ ছায়া পড়ছে। তা বাপু মুখের ছিরি যাই হোক, দেখতে কার না ইচ্ছে করে বল! এই আয়নাটা হয়ে পর্যন্ত আমাদের একটা দুঃখ তো ঘুচেছে! এখন ওই বজ্জাত নাদু মালাকারের একটা ব্যবস্থা কর বাবা। কবে ধরে তিনজনকেই হাঁড়িতে পোরে, সেই ভয়ে আমরা এখন ভেন্ন ভেন্ন থাকছি।”

হরিশ্চন্দ্র ভাবিত হয়ে বললেন, “হু, খুবই দুশ্চিন্তার কথা পিসিমাগণ। আমি এখন বুড়ো হয়েছি। দৌড়ঝাঁপ করতে পারি না। ঢাল-তলোয়ার তুলতে পারি না। চারদিকে চোখ রাখতে পারি না।”

কুঁজো পিসি ঝংকার দিয়ে বলে, “আ মোলোলা, রাজার ছেলে আবার ওসব কবে করেছে। তোর পাইক-বরকন্দাজ দিয়ে মুখপোড়াটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ঘা কতক দে না। এই নে বাবা, আরও দশখানা গিনি রেখে যাচ্ছি। ভাল-মন্দ খাস।”

সকালে উঠে বিছানায় দশখানা গিনি পেলেন হরিশ্চন্দ্র। পিসিমাদের হাত ক্রমেই দরাজ হচ্ছে। বলতেই হবে যে, নাদু মালাকার বেশ উপকারী লোক। তার কারণেই পিসিমাগণ কৃপণের ধন একটু-একটু করে ছাড়ছেন। বেঁচে থাকো বাবা নাদু মালাকার।

দোতলা থেকে তিনতলার ছাদে ওঠার সিঁড়ি বছর দশেক আগে অনেকটা ভেঙে পড়ে গিয়েছিল। কয়েক ধাপ আছে, আবার কয়েক ধাপ নেই, আবার কয়েক ধাপ আছে, এইরকম আর কী। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার চেষ্টা অতীব বিপজ্জনক। তাই হরিশ্চন্দ্র সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে কী করে তিনতলায় ওঠা যায়, তার উপায় ভাবছিলেন।

এমন সময় পিছন থেকে খুব বিনয়ের সঙ্গে কেউ বলল, “ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সিঁড়ি ভাঙা কি উচিত কাজ হবে মহারাজ?”

গলাটা খুবই চেনা-চেনা লাগল হরিশ্চন্দ্রের। কিন্তু পিছন ফিরে যাকে দেখলেন, তিনি সাদা দাড়ি-গোঁফওলা একজন বুড়ো মানুষ। হরিশ্চন্দ্র চিন্তিত ভাবে লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, “সিঁড়ি ভাঙতে যখন ভাঙা সিঁড়ি ছাড়া অন্য উপায় নেই, তখন সিঁড়ি না ভেঙে আর কী করা যাবে।”

“সেক্ষেত্রে ভাঙা সিঁড়ি যদি আরও ভেঙে পড়ে, তা হলে যে উদ্দেশ্যে সিঁড়ি ভাঙা, তা যে ব্যর্থ হয়ে যাবে রাজামশাই! সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে চাইলেই তো হবে না। সিঁড়ি ভেঙে পড়লে যে উপরে ওঠার বদলে নীচে নেমে আসতে হবে। আর সিঁড়ি ভাঙার সঙ্গে হাত-পা ভাঙাও বিচিত্র নয়।”

হরিশ্চন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সিঁড়ি ভাঙা বেশ বিপজ্জনক কাজ।”

বুড়ো লোকটা বলল, “চিন্তা করবেন না মহারাজ, ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সিঁড়ি ভাঙার লোক হাতেই রয়েছে। সে সিঁড়ি না ভেঙেই সিঁড়ি ভাঙতে পারে।”

“তার মানে কী, সে সিঁড়ি ভাঙবে, কিন্তু সিঁড়িও ভেঙে পড়বে?”

“যে আজ্ঞে। ভাঙা ভাঙা সিঁড়ি দিয়েও সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ওঠা-নামা যায়। তবে তার জন্য ওস্তাদ সিঁড়ি-ভাঙিয়ে চাই। কিন্তু তাকে দিয়ে এই সিঁড়ি ভাঙানোর উদ্দেশ্য কী মহারাজ?”

হরিশ্চন্দ্র আমতা আমতা করে বললেন, “উদ্দেশ্যটা তেমন কিছু নয়। তিনতলার চিলেকোঠায় একটা হাত-আয়না পড়ে আছে, সেটা নামিয়ে আনতে হবে।”

এ কথায় বুড়ো মানুষটার চোখদুটো যেন পটাং করে গোল হয়ে গেল। লোকটা ভারী উত্তেজিত হয়ে বলল, “আয়না মহারাজ। আয়না? ঠিক শুনছি তো?”

“হ্যাঁ মশাই, সামান্য একটা আয়না।”

“সামান্য আয়না মহারাজ? পৃথিবীর কোনও আয়নাকেই আমাদের সামান্য বলে মনে করা উচিত নয় মহারাজ। আয়না খুবই গুরুতর জিনিস।”

হরিশ্চন্দ্র লোকটার দিকে খুব ঠাহর করে চেয়ে বললেন, “মশাই, গলাটা চেনা-চেনা ঠেকছে, কিন্তু মুখটা চেনা লাগছে না তো?”

বুড়ো মানুষটা বলল, “গলা যখন ধরা পড়েছে, মুখও পড়বে মহারাজ।”

এই বলে লোকটা পিছু ফিরে ডাকল, “এসো হে সুধীর।”

থামের আড়াল থেকে একটা বেঁটেখাটো লোক বেরিয়ে এসে হরিশ্চন্দ্রকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। হরিশ্চন্দ্র একটু অবাক হয়ে বললেন, “এ লোকটি কে?”

বুড়ো মানুষটি বলল, “এ একজন চোর, মহারাজ। এর নাম সুধীর গায়েন।”

হরিশ্চন্দ্রের একগাল মাছি। থতমত খেয়ে বললেন, “চোর! ঠিক শুনলাম তো! চোর বললেন নাকি?”

“ঠিকই শুনেছেন। সুধীর একজন বেশ পাকা চোর। চোরদের আপনি খুব একটা অপছন্দ করেন না তো!”

হরিশ্চন্দ্র একটু ভাবিত হয়ে বললেন, “তা চোরই বা খারাপ কী? ঠিকমতো ভেবে দেখলে আগেকার রাজা-জমিদাররাও তো আসলে চোর-ডাকাতই ছিলেন। অন্যের রাজ্য লুঠপাঠ করতেন, রাজকন্যাদের হরণ করতেন। না বাপু, আমি চোরদের তেমন অপছন্দ করি না। আমার ঠাকুরদার তো একজন মাইনে করা চোর ছিল। তার নাম গোপাল গায়েন।”

সুধীর আর একবার হরিশ্চন্দ্রকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলল, “আজ্ঞে, তিনি আমার বাবার শ্রদ্ধেয় ঠাকুরদা।”

হরিশ্চন্দ্র খুশি হয়ে বললেন, “তা হলে তো তুমি বংশানুক্রমিক চোর। চুরি তো তোমার রক্তে হে।”

মলিন মুখে মাথা নেড়ে সুধীর গায়েন বলে, “না মহারাজ, আমাকে কুলাঙ্গার বললেও অত্যুক্তি হয় না, কোনও কাজেই শেষরক্ষা করতে পারি না। এই তো কাল রাতেই মন্টুরাম সিংহের বাড়ি থেকে অনেক কসরত করে মদন তপাদারের বাক্সটা বের করে আনলাম, কিন্তু শেষরক্ষে হল কই? চৌপথীর মোড়ে একটা ষণ্ডা মাথায় ডান্ডা মেরে নিয়ে গেল।”

হরিশ্চন্দ্র একটু আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! সেই লকেটখানাও হাতছাড়া হয়েছে নাকি?”

বুড়ো মানুষটি বলে, “যে আজ্ঞে। তবে কিনা শুধু লকেটে কোনও কাজ হবে না। সঙ্গে আয়নাখানাও চাই। লকেট আর আয়নার সম্পর্ক কেমন জানেন? এই যেমন সজনে ডাঁটার সঙ্গে কুমড়ো, নিমের সঙ্গে বেগুন, পোস্তর সঙ্গে আলু। সুতরাং লকেটওলা আয়নার খোঁজে এল বলে।”

হরিশ্চন্দ্র একটু শঙ্কিত হয়ে বললেন, “সেটা কি ভাল হবে বাপু? সে তো আর লোক ভাল নয়।”

বুড়ো মানুষটি দুঃখের সঙ্গে বলে, “ভাল লোক বড় কমে যাচ্ছে মহারাজ।”

“তা হলে উপায়?”

“উপায় আপনার হাতে মহারাজ। আপনার গুজগুজ আর ফিসফাসদের সঙ্গে একটু কথা কয়ে দেখুন।”

হরিশ্চন্দ্র একটু অবাক হয়ে বলেন, “গুজগুজ আর ফিসফাস! ওহে, দাড়িগোঁফের আড়ালে ওটা কি হিরু তপাদার নাকি তুমি?”

“যে আজ্ঞে।”

হিরু তার দাড়ি-গোঁফ, পরচুলা খুলে ফেলে হরিশ্চন্দ্রকে একটা প্রণাম করে বলল, “মহারাজ, সত্যিই কি আয়নার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে?”

হরিশ্চন্দ্র চিন্তিত মুখে বললেন, “গুজগুজ আর ফিসফাস শুনে তাই তো মনে হয়। দেখাই যাক।”

সুধীর ভাঙা সিঁড়িটা একবার দেখে নিয়ে টক করে কয়েকটা ধাপ তড়তড় করে উঠে মস্ত ফাঁকটার কাছে পৌঁছে রেলিং-এর উপর উঠে দিব্যি প্রথম চাতালটায় পৌঁছে গেল। তারপর পরের ধাপগুলো উঠবার মুখেই হঠাৎ ছাদের দিক থেকে শাঁই করে একটা আধলা ইট নেমে এল তার দিকে। ‘বাপ রে’ বলে দু পা পিছিয়ে এল সুধীর।

“মহারাজ, ছাদ থেকে কে যেন ঢিল ছুড়ছে!” মহারাজ উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “বটে!”

সুধীর ডিঙি মেরে ছাদের দিকটা দেখবার চেষ্টা করছিল। অমনি আরও চার-পাঁচটা বড় বড় ঢিল দমাদম এসে পড়তে লাগল সুধীরের আশপাশে। একটা ঢিল তার হাঁটুতেও লাগল।

সুধীর পট করে রেলিং বেয়ে নেমে এসে হাঁটু চেপে বসে পড়ে বলল, “মহারাজ, দেখলেন তো, আমি শেষরক্ষা করতে পারি না। আমার ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার তা আমি জানি। শেষ পর্যন্ত বটতলায় তেলেভাজার দোকান দেওয়া ছাড়া আমার আর গতি নেই।”

হিরু অবাক হয়ে বলে, “কিন্তু ছাদ থেকে ঢিলটা ছুড়ছে কে মহারাজ? ছাদে তো কেউ থাকে না!”

হরিশ্চন্দ্র সখেদে বললেন, “এ বাড়িতে যে কে থাকে আর কে থাকে না, তা আমি আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারলাম না বাপু। তবে আজকের মত রণে ভঙ্গ দাও তোমরা। গুজগুজ আর ফিসফাসকে একটু ঠান্ডা করে না নিলে কাজ আদায় করা শক্ত হবে। তাঁরা বড় রেগে আছেন।”

“যে আজ্ঞে, মহারাজ।” মাঝরাতে ঘুম ভাঙা আর তারপর নানা কিম্ভুত ব্যাপার দেখা হরিশ্চন্দ্রের একরকম অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। সুতরাং তিনি মনে মনে একরকম তৈরিই থাকেন।

কিন্তু আজ রাত দেড়টার সময় যা ঘটল, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। বেশ ফুরফুরে ঘুম হচ্ছিল তাঁর। হঠাৎ মাথায় একটা ঠান্ডা আর শক্ত জিনিস এসে ঠেকল। চটকাটা ভেঙে দ্যাখেন, সামনে কালো কাপড়ে মুখ-মাথা ঢাকা একটা লোক তাঁর মাথায় একটা পিস্তল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

হরিশ্চন্দ্রও তো কেঁপে-কেঁপে অস্থির। কোনওক্রমে বললেন, “কে তুমি? কী চাও বাপু?”

“আয়নাটা।”

“আয়না! তা এ বাড়িতে আয়নার অভাব কী? নিয়ে গেলেই হয়।”

“চালাকি করবেন না, ঠুকে দেব। কথা না বাড়িয়ে আয়নাটা দিয়ে দিন। আমি জানি, মদন তপাদারের আয়না আপনার কাছে আছে।”

ঠিক এই সময় কানা, খোঁড়া আর কুঁজো পিসি বেশ হেলেদুলে হাসি হাসি মুখ করে ঢুকে দিব্যি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেল।

কানা পিসি আহ্লাদের গলায়ই বলে, “দেখলি তো হরি, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে কি না! একটা নিঘিন্নে চোরকে আমাদের সাধের আয়নাটা চুরি করতে লাগালি! তোর পাপের ভয় নেই?

কি শাপশাপান্ত গেরাহ্যি করিস না? এখন এই মিনসে যদি তোর বুকে গুলি ঠুসে দেয়, তা হলে তো তোর পাপেরই শাস্তি হবে নাকি?”

খোঁড়া পিসি বলে, “ওরে, তোর পিসিরা কি ভেসে এসেছে? তাদের একটু সাধআহ্লাদ থাকতে নেই? রুজ পাউডার মাখছি না, পমেটম ঘষছি না, শুধু মাঝেমধ্যে আয়নায় একটু মুখ দেখা! বলি, তাও তোর সইল না?”

কুঁজো পিসি ফঁৎ করে একটা শাস ছেড়ে বলে, “এই যে তোকে সোনাদানা বের করে দিচ্ছি, ভালমন্দ খেতে বলছি, তোর খোঁজখবর রাখছি, বাবা-বাছা বলছি, এর কি কোনও দাম নেই রে হরি? বলি রক্তের সম্পর্কটাও কি মানতে নেই? এই মড়াখেকো গুন্ডাটার হাতে যদি মরিস, তা হলে তোর গতি কী হবে বল তো?”

লোকটা তার কপালে পিস্তলের নলের একটা জোর খোঁচা দিয়ে বলল, “এই যে রাজামশাই, শুনতে পাচ্ছেন?”

হরিশ্চন্দ্ৰ ককিয়ে উঠে বললেন, “শুনেছি বাপু, শুনেছি। একটু রোসো। বুড়ো বয়সে নড়াচড়া করতেও তো সময় লাগে বাপু। হাড়ের জোড়ে জোড়ে ব্যথা, আধিব্যাধিরও কি শেষ আছে?”

“আমার হাতে বেশি সময় নেই। তাড়াতাড়ি করুন।”

কানা পিসি বলল, “দে না বন্দুকের ঘোড়াটা টিপে। বুঝুক মজা।”

খোঁড়া পিসি বলে, “মিনসেটা যেন কী! ম্যাদামারা।”

কুঁজো পিসি বলল, “আজকালকার গুন্ডাগুলোও তেমনি। হাঁদাগঙ্গারাম।”

হরিশ্চন্দ্ৰ কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠতে গিয়েই অম্বুরি তামাকের গন্ধটা পেলেন। দেখলেন মহিমচন্দ্র চেয়ারে বসা। রক্তচক্ষুতে লোকটার দিকে চেয়ে বাঘা গর্জনে বললেন, “বেয়াদবটা কে রে হরি?”

হরিশ্চন্দ্র মিনমিন করে বলেন, “তা কি আর চিনি?”

“ধরে দুটো রদ্দা দে না। তোকে যে ছেলেবেলায় মাইনে করা কুস্তিগির রেখে কুস্তি শিখিয়েছিলুম, তা কি ভুলে গেলি?”

ঠিক এই সময় আরও এক লম্বা চওড়া রাজকীয় পুরুষ ঘরে ঢুকে ভ্রু কুঁচকে বললেন, “এত আস্পর্ধা! আমার বংশধরের গায়ে হাত! ওরে ও হরি, ওটা তিনশো বছরের পুরনো খাট। ওর বাজুতে অস্ত্র লুকোনো আছে। উপরের পিতলের লোহার বলটা এক প্যাঁচ ঘুরিয়ে টেনে তুললেই অস্ত্র বেরোবে।”

হরিশ্চন্দ্র চিনলেন। ইনি তাঁর এক পূর্বপুরুষ প্রতাপচন্দ্র, এঁর ছবি দরবারে ঝোলানো আছে।

হরিশ্চন্দ্র বাজুর পিতলের বলটা আঁকড়ে ধরে উঠলেন এবং উঠবার সময় সেটাতে পাঁচটাও মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে বলটা খট শব্দ করে একটু আলগা হয়ে গেল বলে টের পেলেন হরিশ্চন্দ্র। দাঁড়িয়েই লহমাও দেরি না করে টান দিতেই একটা লম্বা দোধার তরোয়াল লকলক করে উঠে এল হাতে।

এখনও যে তাঁর এত তৎপরতা আছে, তা জানাই ছিল না হরিশ্চন্দ্রের, আর লোকটাও বোধহয় হঠাৎ একটা তরোয়ালের আবির্ভাব দেখে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল। সে নড়বারও সময় পেল না, হরিশ্চন্দ্রের চালানো তরোয়াল বিদ্যুতের মতো ৯৮

বেগে গিয়ে লোকটার কবজিতে বসে গেল। পিস্তলটা ছিটকে গেল হাত থেকে, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। লোকটা ‘বাপ রে’ বলে একটা আর্তনাদ করে কবজি চেপে ধরে মেঝেয় বসে পড়ল।

প্রতাপচন্দ্র হুকুম দিলেন, “গলাটা কেটে ফেল! ফেল কেটে!”

হরিশ্চন্দ্র ততটা করলেন না। তবে ঘরের কোণ থেকে তাঁর মোটা লাঠিটা এনে লোকটার মাথায় জোর এক ঘা বসিয়ে দিলেন। লোকটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

হরিশ্চন্দ্র এবার তাঁর পিসিমাদের দিকে চেয়ে রোষকষায়িত লোচনে বললেন, “পিসি হয়ে ভাইপোর সঙ্গে এরকম ব্যবহার! দাঁড়াও, কালই নাদু মালাকারকে ডাকিয়ে আনাচ্ছি।”

তিন পিসি ভারী জড়সড় হয়ে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। কানা পিসি শুকনো মুখে বলল, “তা আর করতে হবে

বাছা, তোর জিনিস দিয়ে দিচ্ছি।” বলেই পিসিরা উধাও হল বটে, কিন্তু একটু পরেই হরিশ্চন্দ্রের বিছানার উপর আয়নাটা এসে ঠুক করে পড়ল।

ডাকাডাকিতে রাখহরি এল, মোক্ষদা এল, নগেন এল। তার পিছু পিছু এল হিরু তপাদার আর সুধীর গায়েন। সকলেরই চক্ষু চড়কগাছ, “মহারাজ, করেছেন কী? একা হাতে এরকম একটা গুন্ডাকে ঘায়েল করেছেন?”

হরিশ্চন্দ্র বললেন, “ওরে বাপু, রাজার রক্তটা তো এখনও শরীরে আছে, না কি?”

কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা লোকটার দিকে চেয়েই সুধীর চেঁচিয়ে উঠল, “এ তো কালোবাবু!”

হিরু বলল, “শুধু কালোবাবুই নন, এঁর আরও একটা পরিচয় আছে। সেটা ঘোমটা সরালেই বোঝা যাবে।”

ঘোমটা সরাতেই কালো দাড়ি-গোঁফে আচ্ছন্ন একটা মুখ বেরিয়ে পড়ল। আর তাই দেখে সুধীর ডুকরে উঠল, “এ যে বাঁকা মহারাজ!”

হিরু বলে, “এঁর তিন নম্বর পরিচয় হল, নাম খগেন নন্দী, আমার বাবার কাছে ছোঁকরা বয়সে ম্যাজিক শিখতে আসত। সম্ভবত তখনই আয়নার কথাটা জেনে যায়। মহারাজ, বলেছিলুম কি না আয়নার খোঁজে এ লোক আসবেই এখানে। ওই দেখুন ওর গলায় ধুকধুকিটাও রয়েছে। কিন্তু আপনার পিসিমারা তো আয়নাটা হাতছাড়া করতে রাজি নয় মহারাজ! তা হলে কী হবে?”

হরিশ্চন্দ্র বিছানা থেকে আয়নাটা তুলে হিরুর হাতে দিয়ে বললেন, “এসব বিপজ্জনক জিনিস। সাবধানে রেখো বাপু। বেশি নাড়াঘাটা করতে যেয়ো না যেন।”

হিরু বলল, “পায়ের ধুলো দিন রাজামশাই। আপনার মতো মানুষ আমি জীবনে আর একটাও দেখিনি।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress