মাঝরাতে হরিশ্চন্দ্র চোখ চেয়েই
মাঝরাতে হরিশ্চন্দ্র চোখ চেয়েই আঁতকে উঠে চেঁচালেন, “ওরে করিস কী? করিস কী? ও যে সব্বোনেশে কাণ্ড! হাত ফসকে যদি আমার গায়ে এসে পড়িস, তা হলে যে আমার বুড়ো হাড় একটাও আস্ত থাকবে না!”
কিন্তু কে শোনে কার কথা! লোকটা সেঁতো একটা হাসি হেসে দিব্যি ফের এক ঝাড়বাতি থেকে ঝুল খেয়ে শূন্যে দুটো ডিগবাজি দিয়ে অন্য ঝাড়বাতিটায় গিয়ে দোল খেতে লাগল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন হরিশ্চন্দ্র। কিন্তু তাতেও কি শান্তি আছে! ফের চোখ খুলতেই সেই একই দৃশ্য। লোকটা এবার ওই ঝাড়বাতি থেকে লাফ মেরে শূন্যে চরকির মতো কয়েকটা পাক খেতে লাগল। হরিশ্চন্দ্র আর্তস্বরে বললেন, “ওরে বাপু, ট্রাপিজের খেলা দেখাতে চাস তো বাগানে মেলা গাছপালা রয়েছে, সেখানে যা না! এই বুড়ো মানুষটার বুকের উপর কেন?”
লোকটা অবশ্য পড়ল না। দিব্যি অন্য ঝাড়বাতিটায় গিয়ে ঝুলে এক গাল হেসে বলল, “কেমন খেলা রাজামশাই?”
হরিশ্চন্দ্র কাতরস্বরে বললেন, “এ কি তোর সার্কাসের তাঁবু পেয়েছিস বাপু? ঝাড়বাতি যে বড্ড পলকা জিনিস। লাফঝাঁপের ধাক্কা কি সইতে পারবে? ভেঙে পড়লে রক্তারক্তি কাণ্ড হবে যে!”
হরিশ্চন্দ্রের খাটের উপর, উঁচুতে একটা সিলিং পাখা ঝুলে
আছে। সারানো হয়নি বলে এখন আর চলে না। লোকটা ঝাড়বাতি ছেড়ে এক লাফে গিয়ে পাখাটার উপর পা ঝুলিয়ে বসল। আতঙ্কিত হরিশ্চন্দ্র ইষ্টনাম জপ করতে করতে বললেন, “নাঃ, দেখছি অপঘাতেই আমার প্রাণটা যাবে।”
লোকটা ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে বলে, “বুঝলেন রাজামশাই, আমি একসময় নামকরা ট্রাপিজের খেলোয়াড় ছিলুম। একবার অসাবধানে পড়ে গিয়ে বাঁ হাতটা ভেঙে গিয়েছিল বলে ছেড়ে দিতে হল।”
“তা বাপু, ওসব হুড়যুদ্ধের খেলায় যাওয়ার দরকারটাই বা কী তোমার? দুনিয়ায় কি আর কোনও খেলা নেই? ফুটবল-টুটবল খেলো, ব্যাট-বল খেলো, তাস বা পাশা না হয় লুডু খেললেও তো হয় রে বাপু।”
“ট্রাপিজের খেলায় ভারী মজা রাজামশাই, ও আপনি বুঝবেন। খেলাটা ছেড়ে দিতে হল বলেই শেষে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতাম।”
“ভাল রে বাপু, খুব ভাল। ম্যাজিকও কিছু খারাপ নয়।”
“দেখবেন নাকি রাজামশাই?” বলেই লোকটা ওই উঁচু থেকে সোজা হরিশ্চন্দ্রের খাটের উপর লাফ দিয়ে নামল। হরিশ্চন্দ্র “বাবা রে, গেছি রে!” বলে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। লোকটার অবশ্য ভ্রুক্ষেপ নেই।
হরিশ্চন্দ্রের দু’ধারে দু’পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠিক তার বুকের উপর ছ’-সাতটা লোহার বল লোফালুফি করতে লাগল।
হরিশ্চন্দ্র হাউমাউ করে উঠলেন, “সামলে বাপু, সামলে! এ যে প্রাণঘাতী খেলা রে বাবা! কেমন বেআক্কেলে লোক হে তুমি! রাজা-গজাদের বিছানায় পা দিয়ে দাঁড়িয়েছ যে বড়! রাজার কি সম্মান নেই?”
লোকটা বলগুলো লোফালুফি করতে করতেই বলল, “আপনি আর কীসের রাজা? রাজত্ব নেই, মন্ত্রীসান্ত্রি নেই, হাতি-ঘোড়া নেই। কেউ মানেও না আপনাকে।”
হরিশ্চন্দ্ৰ ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “রাজা না হোক, বুড়ো মানুষ বলেও তো একটু মায়া করতে হয় রে বাপু। ওই লোহার বল একটাও যদি হাত ফসকে পড়ে, তবে কি আমি বাঁচব?”
লোকটা নির্বিকার ভাবে বল লুফতে লুফতে বলে, “ভয় নেই রাজামশাই, আমার হাত থেকে বল ফসকায় না। এই দেখুন, বলগুলো সব উপরে ছুঁড়ে ছেড়ে দিচ্ছি, সব অদৃশ্য হয়ে যাবে।”
বলতে বলতেই লোকটা একের পর-এক বল উপরে ছুঁড়ে দিয়ে খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে গেল। হরিশ্চন্দ্র সভয়ে দেখলেন, বলগুলো সোজা তাঁর উপর নেমে আসছে। একটা বল এসে পড়ল কপালে, দ্বিতীয়টা নাকে, তিন নম্বরটা বুকে, চার নম্বরটা পেটে, আর দুটো কোথায় পড়ল কে জানে। হরিশ্চন্দ্র বললেন, “ওরে বাবা রে! মাথাটা গেল! নাকটা আর নেই রে! বুকটা তো ভেঙে চুরমার, পেটটা ফুটো হয়ে গিয়েছে রে!”
হরিশ্চন্দ্র চোখে অন্ধকার দেখলেন। তারপর গায়ে হাত দিয়ে দেখলেন গা বরফের মতো ঠান্ডা, নাকে হাত দিয়ে দেখলেন, উঁহু, খাস বইছে না। নাড়ি টিপে দেখলেন, নাড়ি থেমে গিয়েছে, বুকে হাত দিলেন, না, ধুকপুকুনি নেই।
হরিশ্চন্দ্র হাউরে মাউরে করে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওরে তোরা কে কোথায় আছিস, শিগগির আয়। আমি যে মরে কাঠ হয়ে গিয়েছি। মড়া বাসি হওয়া কি ভাল রে! তাড়াতাড়ি আয়। এটা কি ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোনোর সময়! একটা লোক মরে গেল আর তোদের হুঁশ নেই? মুখাগ্নি করার জন্য একটা দেশলাই দে বাপ, কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলি, দেরি হলে অনৰ্থ হবে যে!”
চেঁচামেচি শুনে বুড়ো রাখহরি, মোদা, নগেন সব কাজের লোকেরা হাজির।
“কী হল বুড়োকর্তা, চেঁচাচ্ছেন কেন?”
“তোদের আক্কেলটা কী বল তো! শ্মশানবন্ধুদের সব ডেকে আন, মড়ার খাট কিনতে লোক পাঠিয়ে দে।”
“বালাই ষাট! আপনার হয়েছে কী?”
“মরে গিয়েছি তো! এই দ্যাখ নাড়ি বন্ধ, শ্বাস নেই, গা ঠান্ডা, ধুকপুকুনি হচ্ছে না।”
রাখহরি বলল, “গা তো দিব্যি গরম, খাসও চলছে, নাড়িও ঠিক আছে। কিছু হয়নি আপনার।”
“হয়নি! নাকটা ভেঙে গিয়েছে না?” মোক্ষদা ঝংকার দিয়ে বলল, “নাক ভাঙুক আপনার শরদের।”
হরিশ্চন্দ্র চারদিকে ভাল করে তাকিয়ে বললেন, “তবে লোহার বলগুলো কোথায় পড়ল বল তো?”
“কীসের লোহার বল?”
“ওই যে লোকটা লোহার বল লোফালুফি করতে করতে হঠাৎ ছেড়ে দিল!”
“আপনি স্বপ্ন দেখছিলেন। এখন ঘুমোন তো৷” সকালবেলা হরিশ্চন্দ্র তাঁর জরির পোশাকটা পরে বাগানে পায়চারি করছিলেন। পোশাকের জরি অবশ্য প্রায় সবই খসে গিয়েছে, কাপড়টাও ঝ্যালঝালে হয়ে এসেছে। পুরনো ঠাটবাট আর কিছুই বজায় রাখা যাচ্ছে না। তবু বড্ড মায়া। এই পোশাকটা তাঁর ঠাকুরদা পরেছেন, বাবা পরেছেন, তাই তিনিও পরেন। বাগানটাও আর বাগানের মতো নেই। আগাছা, চোরকাঁটায় ভরতি। পাথরের ফোয়ারাটা কেতরে পড়ে আছে। তবু তো বাগান।
একটু অন্যমনস্ক ছিলেন, আচমকা একটা লোক তাঁর পথ আটকে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বলল, “প্রাতঃপ্রণাম বুড়োকর্তা।”
হরিশ্চন্দ্র একটু অবাক হয়ে বলেন, “তুমি কে হে বাপু? কী চাও?”
“আজ্ঞে, বলছিলুম কী, আপনার বাড়িতে একটা ছোটখাটো কাজ হয়?”
হরিশ্চন্দ্র বিলক্ষণ জানেন যে, আজকাল তিনি ভুল দেখেন, ভুল শোনেন, ভুল বোঝেন এবং ভুল বলেও ফেলেন। তাই খুব সতর্ক হয়ে তিনি লোকটাকে দেখে নিয়ে বললেন, “বাপু হে, আগে এ বাড়িতে জুতো পরিয়ে দেওয়ার লোক ছিল, ঘামাচি গেলে দেওয়ার লোক ছিল, চুল আঁচড়ে দেওয়ার লোক ছিল, এমনকী, গোঁফে তা দিয়ে দেওয়ার জন্যও লোক ছিল। কিন্তু সেই দিন আর নেই হে।”
লোকটা ভারী খুশি হয়ে বলে, “আজ্ঞে, আমি ওসব কাজ খুব ভালই করতে পারি কর্তা।”
হরিশ্চন্দ্র বিরস মুখে বললেন, “ওরে বাপু, জুতো পরাবে কাকে? আমার তো মোটে এই এক জোড়া হাওয়াই চপ্পল সম্বল। বয়স হওয়ার পর শীত-গ্রীষ্ম সব সময়েই কেমন শীত শীত করে বলে আমার ঘামও হয় না, ঘামাচিও নেই। আর চুল আঁচড়াতে চাইলেই তো হবে না, চুল কোথায়? দেখছ না, মাথাজোড়া টাক? আর গোঁফে উকুন হয়েছিল বলে বছর চারেক আগেই হারাধন হাজাম আমার গোঁফ কামিয়ে সাফ করে দিয়ে গিয়েছে। তা দেবে কোথায়?”
“রাজামশাই, আমি যে অনেক দূর থেকে বড় আশা করে এসেছিলুম।”
হরিশ্চন্দ্র ফের পায়চারি শুরু করে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “না হে ভালমানুষের ছেলে, আমি তো আশা-ভরসা কিছুই দেখছি না।”
“তা রাজামশাই, আপনার রসুইকর লাগে না? আমি রোগন জুস, দম পুক্ত, মুর্গ মসল্লম, কাবাব, বিরিয়ানি, চাইনিজ, মোগলাই সব রাঁধতে পারি।”
হরিশ্চন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “আহা, কতকাল ওসব শব্দ শুনিইনি! কী যেন বললে বাপু? রোগন জুস, কাবাব, বিরিয়ানি?”
“যে আজ্ঞে।”
হরিশ্চন্দ্র হাতটা উলটে মাথাটা নাড়া দিয়ে বললেন, “স্বাদ সোয়াদ ভুলেই গিয়েছি।”
“একবার ট্রাই দিয়ে দেখুন কর্তা, ফাটিয়ে দেব।”
“ওরে ভালোমানুষের পো, পেটে যে কিছুই সয় না বাপ। মোক্ষদা দু’বেলা গাদাল পাতা দিয়ে কাঁচকলার ঝোল বেঁধে দেয়। সেই আমার পথ্যি। একদিন এক টুকরো পাঁঠার মাংস খেয়ে ফেলে সে কী আইঢাই! না হে বাপু, ও লাইনে সুবিধে নেই তোমার।”
লোকটা হরিশ্চন্দ্রের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তা হলে তো বড় মুশকিলে পড়া গেল মশাই। আমি যেন শুনেছিলুম, রাজা গজাদের মেলাই লোকলশকর লাগে! আর এই চৈতন্যপুরের রাজবাড়িতে নাকি মোটে পাঁচজন কাজের লোক। তারাও সব বুড়োধুড়ো হয়ে পড়েছেন। তাই ভাবলুম, আপনার একজন কমবয়সি কাজের লোক হলে বোধহয় ভালই হয়।”
হরিশ্চন্দ্র ঠোঁট উলটে বললেন, “কাজের আছেটাই বা কী বলো তো! আমি তো বাপু, সারাদিন শুয়ে-বসে থাকা ছাড়া কোনও কাজই খুঁজে পাই না। তুমিই কি পাবে?”
লোকটা সোৎসাহে বলল, “কাজ মেলাই জানি বুড়োকর্তা, গাছ বাইতে পারি, জল তুলতে পারি, মাটি কোপাতে পারি, কাপড় কেচে ইস্তিরি করতে পারি, পাঞ্জাবি গিলে করতে পারি, তারপর বাজার-হাট বলুন, ফাঁইফরমাশ বলুন, সব কাজে পাকা। দরকার হলে লাঠি চালাতে পারি, বন্দুক ফোঁটাতে পারি।”
হরিশ্চন্দ্র থমকে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখ করে লোকটাকে দেখে নিয়ে বললেন, “ওরে বাবা, তোমার তো অনেক বিদ্যে হে! কিন্তু এত গুণের কদর করতে পারি, আমার কি আর সেই সঙ্গতি আছে? আমার কাজের লোকেরা কত বেতন পায় জানো? গত পঞ্চাশ বছর ধরে তারা ত্রিশ টাকা করে মাইনে পায়। তাও সব মাসে হাতে পায় না। মাঝেমধ্যেই বাকি পড়ে যায়।”
লোকটা ভারী অবাক হয়ে বলে, “ত্রিশ টাকা! ত্রিশ টাকা কি কম হল মশাই? ঠিক মতো দরাদরি করে কিনলে যে ত্রিশ টাকায় জাহাজ কেনা যায় রাজামশাই।”
হরিশ্চন্দ্র বুঝতে পারছেন, তিনি ভুল শুনছেন। প্রায়ই শোনেন। তবু ভ্রু কুঁচকে বললেন, “জাহাজ বললে নাকি বাপু?”
“যে আজ্ঞে। আমাদের গাঁয়ের গৌর গড়গড়ি তত তিন টাকায় হাতি কিনে ফেলেছিল।”
হরিশ্চন্দ্র ডান কানে আঙুল দিয়ে খোঁচাখুঁচি করে হতাশ মাথা নেড়ে বললেন, “নাহ, কানটাই গিয়েছে দেখছি!”
লোকটা সোৎসাহে বলল, “গৌর গড়গড়ি এমন দরাদরি করেছিল যে, হাতিওয়ালা দরাদরির চোটে মূৰ্ছা যায়। মূৰ্ছা ভাঙার পর তার মাথা এমন ভ্যাবলা হয়ে গিয়েছিল যে, তিন টাকায়ই হাতিটা বেচে দিয়ে মনের দুঃখে নিরুদ্দেশে চলে যায়। বুঝলেন তো রাজামশাই, ত্রিশ টাকায় হিসেব মতো দশটা হাতি কিনে ফেলাও বিচিত্র নয়। ত্রিশ টাকা যদি বেশি বলে মনে হয়, তা হলে আমাকে না হয় আপনি কুড়ি টাকাই দেবেন।”
হরিশ্চন্দ্র বললেন, “কুড়ি টাকা! ঠিক শুনছি তো!”
“ঠিকই শুনছেন। আমার একটু টানাটানি হবে বটে, কিন্তু
আপনার দিকটাও তো দেখতে হবে। রাজবাড়ির যা অবস্থা দেখছি, তাতে ওর বেশি চাইলে ধর্মে সইবে না।”
হরিশ্চন্দ্র খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বললেন, “আরও কথা আছে। বাপু, এ বাড়ির খাওয়াদাওয়া তেমন সুবিধের নয়। কচু-ঘেঁচু দিয়ে একটা ঝোল আর মোটা চালের ভাত।”
লোকটা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে বলে, “ভাতের সঙ্গে ঝোল! বলেন কী রাজামশাই! সে তো রাজভোগ! আমার তো ভাত-পাতে একটু নুন-লঙ্কা হলেই চলে।”
হরিশ্চন্দ্ৰ হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “বুঝেছি বাপু, তোমার একটা মতলব আছে।”
ছোঁকরা ভারী লাজুক হেসে মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলল, “এ বয়সেও কর্তামশাইয়ের চোখের নজর আছে বটে! ঠিকই ধরেছেন কর্তা, একটু বিষয়কর্মেই চৈতন্যপুরে আসা। শুনেছিলুম, চৈতন্যপুরের রাজবাড়ি হল অবারিত দ্বার।”
হরিশ্চন্দ্র আর একটা শ্বাস মোচন করে বললেন, “ঠিকই শুনেছ বাপু, অবারিত দ্বারই বটে। সিংহদরজার লোহার ফটক কবেই ভেঙে পড়ে গিয়েছে। বাড়ির বেশিরভাগ দরজারই খিল নেই। জানলার কপাট উধাও। গোরু-ছাগল, কুকুর-বেড়াল, চোর-ছ্যাঁচড় সবই ঢুকে পড়ছে। এমন অবারিত দ্বার আর কোথায় পাবে। তবে কিনা গা ঢাকা দেওয়ার পক্ষে জায়গাটা মন্দ নয়। তোমার বোধ হয় সুবিধেই হবে।”
ছোঁকরা তাড়াতাড়ি হরিশ্চন্দ্রের পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, ওই ভরসাতেই আসা কিনা। আমার নাম হীরেন গণপতি। হিরু বলেই সবাই ডাকে।”
ছোঁকরা চোর বা ডাকাত, ফেরারি আসামি বা উগ্রবাদী, খুনি বা গুন্ডা কি না তা কে জানে! কিন্তু হলেই বা, হরিশ্চন্দ্রের কী-ই বা
যায় আসে। এই বাড়িতে স্বদেশি আমলেও ছেলে-ছোঁকরা ঢুকে বোমা বাঁধত। অন্তত দু’বার দুটো জেল-পালানো ডাকাত কাজের লোক সেজে ঢুকেছিল, পরে খুঁজে খুঁজে পুলিশ এসে তাদের ধরে নিয়ে যায়। এত বড় একটা বাড়ি সামাল দেওয়ার মতো লোকবল তাঁর কই? তাই তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাত্র।
কিন্তু মাঝরাতে এক বিপত্তি। খ্যানখ্যানে গলায় কে যেন ডাকছিল, “ও হরি! বলি হরিশ্চন্দ্র কি শুনছিস! কী কুম্ভকর্ণের ঘুম রে বাবা তোর! বলি ওদিকে যে সব্বোনাশ হয়ে গেল, সে হুশ আছে?”
হরিশ্চন্দ্র ধড়মড় করে উঠে দ্যাখেন, তিন ডাইনি বুড়ি খাটের তিন দিকে দাঁড়িয়ে কটমট করে তাঁকে দেখছে। হরিশ্চন্দ্র অবশ্য ঘাবড়ালেন না। এই তিনজনকে তিনি বিলক্ষণ চেনেন। ছেলেবেলা থেকেই। তিনজনেই দেড়শো বছর আগে গত হয়েছে। কিন্তু এ বাড়ির মায়া কাটাতে পারেনি। মাঝে মাঝেই উদয় হয়ে নানা বায়নাক্কা তোলে। হরিশ্চন্দ্র শশব্যস্তে বললেন, “কী হয়েছে। পিসিমাগণ?”
কানা পিসির একটা চোখ কানা বটে, কিন্তু আর-এক চোখের নজর এমনই সাংঘাতিক যে, অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। কানা পিসি ঝংকার দিয়ে বলল, “বলি, তুই এই সসাগরা পৃথিবীর রাজা, চারদিকে তোর এত ধন্যি ধন্যি, সেই তুই কিনা যাকে-তাকে রাজবাড়িতে সেঁধুতে দিচ্ছিস বাবা! চৈতন্যপুরের রাজবাড়ি কি শেষে ধর্মশালা হয়ে উঠবে নাকি?”
কুঁজো পিসির পিঠের কুঁজ যত বড়ই হোক, তেজ কিছু কম নয়। চোখ পাকিয়ে বলে উঠল, “চৈতন্যপুর হল গিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রাজ্য। আর তুই হলি রাজচক্রবর্তী। সেই তোরই শেষে মতিচ্ছন্ন হল! ছোঁড়াটা যদি আমাদের গয়নাগাঁটির খোঁজে এসে থাকে, তা হলে কী হবে বল তো?”
খোঁড়া পিসির এক ঠ্যাং খোঁড়া বটে, কিন্তু মেরুদণ্ড খাড়া আর গলার জোর সবচেয়ে বেশি। ঝংকার দিয়ে বলল, “লোকে বলে মহারাজাধিরাজ হরিশ্চন্দ্র হল গে একটা রাজার মতো রাজা। যেমন বুদ্ধি, তেমন বিবেচনা। তা কোথায় কী? এরপর তো রাজবাড়িতে হাট-বাজার বসে যাবে।”
কানা পিসি এবার গলাটা একটু নরম করে বলে, “হ্যাঁ রে হরি, বলি আমাদের তিন-চার হাজার ভরির গয়না, তিন কলসি হিরে জহরত, সাতশো আকবরি মোহর কার জন্য আগলে রেখেছি বল তো! তুই ছাড়া আমাদের আছেটা কে? তোকেই সব দিয়ে থুয়ে যাব বলেই না সব সময় ভয়ে-ভয়ে থাকি, অন্য কেউ এসে না লুটেপুটে নিয়ে যায়। তা বাছা, এইসব অজ্ঞাতকুলশীলকে কি প্রাসাদে ঢোকাতে আছে?”
সোনাদানার গল্প সেই ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছেন হরিশ্চন্দ্র। পিসিমারা নাকি তাঁকেই সব দিয়ে যাবে, কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি পয়সাও উপুড়হস্ত করেনি। এতকাল খুব আশায়-আশায় ছিলেন, কিন্তু এখন আশা ক্ষীণ হতে হতে উবে যেতে বসেছে। তবে এদের তিনি চটাতেও সাহস পান না। কী জানি যদি সত্যিই একদিন লুকোনো সোনাদানা বের করে দেয়! তা হলে কী হবে? অনেক ভেবে দেখেছেন হরিশ্চন্দ্র। সোনাদানা পেলে এই বয়সে তিনি এক জোড়া নরম দেখে বিদ্যাসাগরী চটি কিনবেন, একটা ঝলমলে দেখে জরির জোব্বা, দাঁতগুলো বাঁধিয়ে নেবেন, আর দু’বেলা ভাতের পাতে একটু আমসত্ত্ব খাবেন। এর বেশি ভাবতে তাঁর ভরসা হয় না।
হরিশ্চন্দ্ৰ হাতজোড় করে বললেন, “পিসিমাগণ, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনাদের সোনাদানা খুঁজে বের করার মতো মনিষ্যি এখনও জন্মায়নি। সেই গাঁড়া সর্দারের কথা মনে নেই? সে আমাদের সবাইকে বেঁধে রেখে দক্ষিণের ঘরের মেঝে খুঁড়ে গর্ত করেছিল! তা আপনারা তো মাটিচাপা দিয়ে তাদের মেরেই ফেলেছিলেন প্রায়। বাড়িতে একটা অপঘাত হতে যাচ্ছে দেখে রাখহরি তাদের উদ্ধার করে।”
কুঁজো পিসি ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলে, “তবু বাপু, সাবধানের মার নেই। ছোঁড়াটা বড্ড চালাক-চতুর। চোখ দুটো যেন চারদিকে চরকির মতো ঘুরছে। মতলব মোটেই ভাল বুঝছি না।”
খোঁড়া পিসি ঝংকার দিয়ে বলে, “কার মতলবই বা ভাল দেখছিস লা? দুনিয়াতে কি আর ভাল লোক আছে? নাদু মালাকার তো এখনও মেটে হাঁড়ি নিয়ে এ বাড়ির আড়ায়-আড়ায় আমাদের ধরবার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। কালও দেখেছি, পিছনের ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে আসশ্যাওড়ার আড়াল থেকে নজর দিচ্ছে। হ্যাঁ রে হরি, সত্যি করে বল তো, আমাদের ধরার জন্য নাদু তোকে কত টাকা দিতে চেয়েছে?”
হরিশ্চন্দ্র আমতা আমতা করে বলেন, “বেশি নয় পিসিমাগণ, নাদু মাত্র তিন হাজার টাকা কবুল করেছিল।”
কানা পিসি তার এক চোখ কপালে তুলে বলে, “মাত্র তিন হাজার! কী ঘেন্নার কথা! বাব্বাঃ, আমাদের দাম নাকি তিন হাজার! গলায় দড়ি।”
কুঁজো পিসি ফুঁসে উঠে বলে, “ড্যাকরার মুখোনা ভেঙে দিতে পারলি না রে হরি! আমরা হলুম গে চৈতন্যপুরের মহারাজাধিরাজের পিসি! সোজা পাত্তর তো নই রে বাপু!”
হরিশ্চন্দ্র কাতর কণ্ঠে বলেন, “রাগ করবেন না পিসিমাগণ। নাদুর ধারণা আপনারা ডাইনি৷ আর ডাইনির আত্মা দিয়ে নাকি অনেক কাজ হয়।”
কানা পিসি বলে, “আঁ! তার এত আম্পদ্দা!”
কুঁজো পিসি বলে, “ছোট মুখে এত বড় কথা!”
খোঁড়া পিসি বলে, “ওরে পিঁপড়ের পাখা গজিয়েছে।”
হরিশ্চন্দ্র কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “না না, সে কথা আমি তাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছি। বলেছি, ওঁরা মোটেই ডাইনি ছিলেন না। ছয় পুরুষ আগেকার লতায়-পাতায় সম্পর্ক বটে, কিন্তু হিসেব করে দেখা গিয়েছে যে, আমরা পিসি আর ভাইপোই বটে। সে একটু গাঁইগুই করছিল বটে, বলছিল, মরার পর আর কীসের পিসি, কীসের ভাইপো! তা আমি তাকে বলে দিয়েছি, আমার পূজনীয়া পিসিমাদের দিকে যেন সে আর নজর না দেয়।”
কানা পিসি বলে, “ওরে, আমাদের হিসেব একেবারে পাকা। শুধু ভাইপোই নোস, আমাদের একমাত্র ওয়ারিশান।”
কুঁজো পিসি বলে, “আহা, শুধু ওয়ারিশান কেন, ও তো আমাদের নয়নের মণি!”
খোঁড়া পিসি বলে, “তা তো বটেই, এখনও যেন সেই ফুটফুটে খোকাটি।”
তিন পিসি ফুস করে বাতাসে উধাও হয়ে গেলে হরিশ্চন্দ্র একটু জল খেলেন। তিনি জানেন যে, তিনি ভুল দেখেন, ভুল শোনেন, ভুল বোঝেন এবং ভুল বলেও ফেলেন। কিন্তু এই ভুলভুলাইয়ার মধ্যেই তাঁকে ঘুরপাক খেতে হবে। ব্যাপারটা তাঁর তেমন খারাপও লাগে না। তবে কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক, তা নিয়ে একটু গণ্ডগোল হয় বটে।
এই যেমন কিছুদিন আগে নাদু ওঝা এক সকালবেলায় এসে তাঁর সামনে একটা মেটে হাঁড়ি রেখে পেন্নাম করে বলল, “কর্তামশাই,
হাঁড়ির মধ্যে বটের আঠা আর বন্ধনমন্ত্র মাখিয়ে দেওয়া আছে। তিনটি হাজার টাকা দিচ্ছি, ওই তিন ডাইনিকে ভুলিয়েভালিয়ে হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিন, আমি সরা চাপা দিয়ে নিয়ে যাব।”
হরিশ্চন্দ্র একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তারপর কী হবে?”
নাদু বলল, “তারপর অনেক প্রক্রিয়া আছে। তিনজনকে ওই হাঁড়ির মধ্যে মজিয়ে শোধন করে যখন বের করব, তখন একেবারে মাটির মানুষ। যাই বলব, তাই লক্ষ্মী ছেলের মতো করবে।”
হরিশ্চন্দ্রের একবার ইচ্ছে হয়েছিল, তিন খিটকেলে বুড়িকে বেচেই দেন। এই বাজারে তিন হাজার টাকা কিছু কম নয়। দোকানে ধার বাকি আছে, কাজের লোকের বেতন বকেয়া পড়ে আছে, গয়লা তাগাদা দিচ্ছে। তারপর ভেবে দেখলেন, পিসিমাগণ তাকে দীর্ঘদিন ধরে গয়নাগাটি, হিরে-জহরত আর মোহরের লোভ দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু উপুড়হস্ত করছে না। তবু একটা ক্ষীণ আশাও তো আছে। নাদু মালাকারের খপ্পরে গিয়ে পড়লে আশাটুকুও থাকবে না। গয়নাগাটিও ওই গাপ করবে।
হরিশ্চন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, “না হে বাপু, পিসি বিক্রি করা আমার কর্ম নয়। ওতে মহাপাপ।”
নাদু হাঁ হাঁ করে উঠে বলে, “আহা, সে তো জ্যান্ত পিসি কর্তামশাই। মরা পিসি, তাও লতায়-পাতায় সম্পর্ক, বেচতে দোষ কী?”
“মাত্র তিন হাজার টাকায় পিসিদের বিক্রি করে দেব, আমি কি সেরকম পাষণ্ড নাকি?”
নাদু দুঃখের সঙ্গে বলল, “দরটা কি কম মনে হল কর্তামশাই? বাজার ঘুরে দেখে আসুন গে, পিসির দর কত করে যাচ্ছে। পিসি প্রতি হাজার টাকায় আপনার মোটেই ঠকা হচ্ছে না।”
হরিশ্চন্দ্র দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, “না হে বাপু, পিসি বেচলে মহাপাতক। নরকবাস। পরকালের কথাটাও তো খেয়াল রাখতে হবে কিনা? তুমি বাপু, এসো গিয়ে।”
“দরটা না হয় আর একটু বাড়িয়ে দিচ্ছি কর্তা। তাতে আমার লোকসান যাবে অবশ্য, তা যায় যাবে।”
কিন্তু হরিশ্চন্দ্র রাজি হননি। নাদু মালাকার মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে চলে গেল বটে, কিন্তু সে হাল ছাড়েনি। হরিশ্চন্দ্র মাঝেমধ্যেই খবর পান, নাদু একটা মেটে হাঁড়ি নিয়ে প্রাসাদের আদাড়ে-পাদাড়ে ঘুরঘুর করে বেড়ায়।
হরিশ্চন্দ্র সকালের পায়চারি সেরে সামনের চওড়া বারান্দায় একটা কেঠো চেয়ারে রোদে পা মেলে দিয়ে বসে আছেন। শরৎকাল। মোলায়েম হাওয়া দিচ্ছে। চারদিকে মৌমাছির গুনগুন শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিচিত্র সব পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। আকাশে মেঘ আর রোদের খেলা। হরিশ্চন্দ্রের একটু ঢুলুনি মতো এসে গেল।
ঠিক এই সময়ে হিরু গণপতি একটা বন্দুক নিয়ে এসে হরিশ্চন্দ্রকে প্রণাম করে পায়ের কাছে বসল। হরিশ্চন্দ্র সভয়ে চেয়ে বললেন, “বন্দুক কীসের হে?”
একগাল হেসে হিরু বলে, “আজ্ঞে, লোহালক্কড়ের ঘরে একটা টিনের বড় বাক্সে পুরনো জিনিসপত্রের মধ্যে পড়েছিল রাজামশাই। মরচে পড়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু খাঁটি বিলিতি জিনিস। মেহনত করে ঘষে-মেজে নিলে এতে এখনও কাজ হয়। এসব জিনিস কি অযত্নে ফেলে রাখতে হয় কর্তা?”
হরিশ্চন্দ্র দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে বললেন, “ওই বন্দুক আমার বাপ ঠাকুরদা চালাতেন বটে, আজকাল আর দরকার হয় না বলে পড়ে আছে।”
হিরু বন্দুকটার গায়ে আদর করে একটু হাত বুলিয়ে বলল, “যা দিনকাল পড়েছে কর্তামশাই, তাতে কোথা দিয়ে কোন বিপদ আসে তার ঠিক কী? একটা অস্ত্র থাকা তো ভালই।”
হরিশ্চন্দ্র প্রমাদ গুনে বললেন, “ওরে বাপু, ওইসব বিপজ্জনক জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করা মোটেই ভাল কথা নয়। ওতে আমাদের কাজ কী?”
“তা হলে খুলেই বলি রাজামশাই, এই হিরু গণপতির পিছনে পিছনেই বিপদ ঘোরে। এই তো দু মাস আগে মনসাপোতার জঙ্গলে কালোবাবুর দল আমাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল। তারপর ফুটু সর্দারও আমার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুনেছি।”
আতঙ্কিত হরিশ্চন্দ্র বললেন, “কেন বাপু, তুমি করেছটা কী?”
“সে অনেক কথা রাজামশাই। তবে আমি যখন এসে পড়েছি, তখন বিপদের অভাব হবে না।”