মজদুরের মজদুরি
মালিকের কাছে —-গায়ের ঘাম শোকাবার আগে মজদুরি নিয়ে নেবেন।
দিচ্ছি করে পাওনা টাকা পেতে জীবনের অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে যাবেন।একটার পর একটা কাজ করিয়ে যখন মুক্তি মিলবে—-তখন জীবনের বহু মূল্যবান সময় চলে গেছে।
গল্পের সূত্রপাত:
ওই শুনতে পাচ্ছেন— আমার শাশুড়ীর শাশুড়ী কি বলছেন—
ও পুতি বৌমা এক কাপ গরম জল দাও তোমার দাদুকে।
কেন কি হবে গো ঠাকুমা ??
তোমার তো বেটি বড্ড চোপা।তোমায় গরম জলের হিসাব দিতে হবে।
ঠাকুমা ভাল হচ্ছে না কিন্তু…তোমার কাছে কোথায় হিসাব চাইলাম??
শুধু বললাম গরম জল কি হবে??
ঠাকুমা ঠিক আছে হাতের কাজ টা সেরে একটু পড়ে করে দিচ্ছি।
তারপর কি কান্ড !!
কালা ঠাকুমা কি শুনলেন
আচমকা ওঠে চেলাকাঠ দিয়ে মারে পুতি বৌমাকে।
নিজেই গজগজ করতে করতে শুকনোপাতা জ্বালিয়ে বুড়ো বরকে গরমজল করে দেন।কারণ বুড়োর গলাটা বসা বসা লাগছে।যদি মরে যায় বুড়ো।
পুতিবৌমা রাগে বলে আর কতকাল বাঁচিয়ে রাখবে——বয়স তো একশ পাঁচ—–তুমিও কেটে পড়ো বুড়ি—-একশ ছুঁইছুঁই তো।
এই অভাগীর বেটি তোর কি রে?তোর বাপের টা খাচ্ছি!!!হা….
দেখো ঠাকুমা গাল দেবে না কিন্তু।তখন ভালো কথা বলি তুমি শুনতে পাও না।এটা কি করে শুনলে গো বু..
আর শোনো বুড়ি ঠাকুমা আর কোনোদিন গায়ে হাত দাও—হাতখানা মুচকে দেব।
শাশুড়ীর শাশুড়ী বলতে শুরু করে জানিস হতভাগী ——আমার দাদাশ্বশুরের ঠাকুরদা তাজমহল বানাতে গেছিল।
ষোলো বছর পর বাড়ি এসেছিল।
তোর বর তো সবে পাঁচবছর কাজে গেছে—–তারজন্য এত চোপা—-কাড়ি কাড়ি টাকা আনবে—-মা বেটায় গবগব করে খাবি।
সাড়ে চারবছরের ছেলে মলিনাকে বলে ও মা আমার বাবা কবে আসবে??
সবার বাবা আছে—-দাদুর বাবা আছে—।আমার বাবা কবে আসবে?
কি জানি ??তোর বাবাকে মজদুরের কাজ করতে এক বাবু নিয়ে গেছে দুবাই।
তুই যে জন্মেছিস তোর বাবা সেটাও জানে না।
আমরা তো গরিব,ফোন নম্বর কোথায় পাব?
মলিনার শাশুড়ী ও শ্বশুর মাছ ধরতে গেছিল।
বৌমা কটা লাটা মাছ,বাণ মাছ পেলাম।এটা কেটে রান্না করে ফেল।ঝাল দিস কম।
মলিনা চোখ ছলছল করে বলে —
“ও মা বাবুলের বাবা কবে আসবে”?
শাশুড়ি বলে আসবে রে ——ঠিক আসবে—–
রোজ মোটা করে সিঁদুর পড়বি ঠিক আমার বেটা লাফাতে লাফাতে চলে আসবে।
শাশুড়ীর শাশুড়ী কিছু নালিশ করতে আসছিল—মলিনার শাশুড়ী বলে—- বাচ্চা বৌ—সারাদিন সংসারে খাঁটে।—আপনি জানেন সব জায়গায়—আট ঘন্টা কাজ করলে ছুটি পাওয়া যায়।
বৌমা তো সারাদিন খাঁটে—ও মজদুরের চেয়ে বেশী কাজ করে—-আমার দুঃখী বৌ বটে!–
বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে আমার ছেলেটা কাজ করতে গিয়ে নিরুদ্দেশ।
কিন্তু মা আমার বৌমার মজদুরির পারিশ্রমিক জোটে সব সময় গালাগালি আর আপনাদের মার।
এককালে আমাকে যেমন জ্বালিয়েছেন আর এখন আমার বৌমাকে।
বৌমার বাপের বাড়ির অবস্থা খুব ভালো।আমাদের ছেড়ে চলে যায় নি তো।আমার ছেলে যা করে নি সেটা আমার বৌমা করছে। আমাদের চারজন বুড়ো বুড়ি কে সামলাচ্ছেন।
হঠাৎ পাড়ার ঘন্টাদা এসে বলে মাসীমা আপনার ছেলে ফিরবে।ওর সাথে দেখা হয়েছিল।এই ফোন নম্বরে ফোন করতে বলেছে।
ঘন্টাদার ফোন থেকে ফোন করে।সবাই কত গল্প করছেন।মলিনা ভাবেএকবার ও আমায় দিচ্ছেন না।
ঘন্টাদা মলিনার করুণ মুখ দেখে ফোন মলিনাকে দেন। মলিনা বলে তোমার ছেলের সাথে দেখা করবে না।বর বলে জানো মলিনা পাঁচ বছরে অনেক টাকা হয়েছে।সামনের সপ্তাহে আসব।মালিক ছুটি দেবে বলেছে।
মলিনা বলে তোমার ছেলের জন্য একটা বন্দুক এনো।সারাদিন তোমার কথা বলে—সবার বাবা আছে—-তার কেন নাই।
তারপর কত সপ্তাহ গেছে আর আসে নি।ছেলে বন্ধুদের বলে রেখেছে তার বাবা বন্দুক আনবে।
কুড়ি বছর পর অপেক্ষার অবসান ঘটে।তখন বড়রা কেউ বেঁচে নেই।মা তো ছেলের শোকে মারা গেলেন।তারপর ঘন্টাদাকে ও কোনদিন দেখিনি ।
গতবছর পয়লা মে —-বছর চল্লিশের এক লোক— দরজা ঠকঠক করে।কুড়ি বছরের বাবুল বলে কাকে চান ?তোমার মাকে বলো বাবা এসেছেন।একটা সুটকেসে ভর্তি টাকা।এত বছরের মজদুরি।এতদিন বাদে ছুটি পেয়েছে সরলার বর।সরলা শাশুড়ীর ছবির কাছে চিৎকার করে বলেন মা, ওমা —বাবুলের বাবা এসেছেন।ঠিক বলেছিলেন মোটা করে সিঁদুর পড়তাম বলেই তোমার ছেলে ফিরেছে।
মলিনা কবেই আসতাম রে—মালিকের কাছে মজদুরির সব টাকা জমানো ছিল—-দিচ্ছি বলে এত বছর লাগিয়ে দিল—-। আমরা কেমন বুড়ো বুড়ি হয়ে গেলাম বল তো ।না গো তুমি এখনো চল্লিশে রাজপুত্র আছো আমি পঁয়ত্রিশে বুড়ি হয়ে গেলাম।দাও দেখি নি আমার শাড়ি আলতা সিঁদুর।
ও মা ওই বলটা কার???
আরে তুমি তো বলেছিলে ছেলের জন্য একটি বল আনতে।
হায়রে সে ষোল বছর আগে তো।
কুড়ি বছরের ছেলে কাজ থেকে এসে বলটা লোফালুফি খেলছে।তার বাবার কেনা প্রথম উপহার।