ভিন্ন মাটির গন্ধ
বয়স তখন তাহার একুশ পার হইয়াছে। তরুণ তখন উদয়ন সংঘের ভারপ্রাপ্ত সচীব। শহরে হঠাৎ এক গন্ডগোল বাঁধিয়া যাওয়ায় মানকাচরের এক টিলার উপর অবস্থিত কামাখ্যা মন্দিরের জঙ্গলে তাহাকে সমস্ত রাত্রির জন্য গা ঢাকা দিয়া থাকিতে হইয়াছিল। সূর্য উদয়ের পূর্বেই সেই জঙ্গল ত্যাগ করিয়া আমপাতি ও তুরা হইয়া বহুকষ্টে ডালুতে মাসীর বাড়ী পৌঁছাইয়া গেল।
ডালু স্থানটি বাংলাদেশ সীমানার সহিত সংলগ্ন হওয়ায় তরুণের মনটি সর্বদাই সেই দেশে ছুটিয়া যাইবার জন্য উদগ্রীব হইয়া থাকিত। সে মাঝে মধ্যেই মেসোতো ভাইদের সঙ্গে লইয়া গোপাল মন্দিরের পার্শ্ববর্তী ভোগাই নদী পার হইয়া বাংলাদেশের চরে তরমুজ খাইতে যাইত। জিনিষের বিনিময়ে প্রায়ই দুই-তিনটি তরমুজ মাসীর বাড়ীতে লইয়া আসিত।
সেই হইতেই সীমানার অপর পারে যাইবার আকর্ষণ ক্রমান্বয়ে বাড়িয়াই চলিল। এই আকর্ষণের কারণ শুধু যে সীমানা পার হইয়া বিদেশের মাটিতে পা রাখা তাহা নহে, বিদেশের মাটিতে আছে তাহার কাকার বাড়ী। এই দুইয়ে মিলিয়া তাহার অদম্য ইচ্ছার সূত্রপাত ঘটিয়াছে। এই জন্য মাঝে মধ্যেই মাসীর কাছে বলিয়া বেড়াইত যে সে বাংলাদেশ যাইবে। ব্যাপারটি অলীক বলিয়া মনে হইলে বাড়ীর সকলেই তাচ্ছিল্য করিয়া উড়াইয়া দিত। তরুণের সুপ্ত মনোবাঞ্ছাটিকে কেহই সঠিকভাবে পরখ করিতে পারিল না।
প্রতি বছরের মতো সেইবারও চৈত্র সংক্রান্তিতে ভোগাই নদীর পারে চরক পূজাকে কেন্দ্র করিয়া এক মেলার আয়োজন হইবে জানিয়া তরুণ দ্বিগুণ উৎসাহে মাতিয়া উঠিল। দুপুর পার হইয়া আসিলেই সে মেসোতো বোনদের সঙ্গে লইয়া সেই চড়ক মেলার ভীড়ে যোগ দিল। অপর পার হইতেও হাজার লোকের ভীড় এই পারে আসিতে মরিয়া। শুধুমাত্র সীমানা রক্ষীদের সংকেতের অপেক্ষা।
ইতোমধ্যেই দুই পারের লোকের মধ্যে কাদামাটির তুমুল ঢেলাঢেলী বাঁধিয়া যাওয়ায় অপর পারের জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙিয়া গেল। কালবৈশাখীর পূর্বে যেমন আকাশের ভাব থমথমে হইয়া যায় চড়ক মেলাকে ঘিরিয়াও একই ভাব দেখা দিল। তরুণ তৎক্ষণাৎ বোনদেরকে বলিল, “যেমন ভাব দেখা যাচ্ছে, মনে হয় একটা তান্ডব বেঁধে যাবে। চল, এখান থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ী চলে যাই। এক মুহূর্ত বিলম্বে যে কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। দেখতে পাচ্ছ না অপর পারের লোকেরা লাঠি- ফালা নিয়ে দলে দলে এদিকে এগিয়ে আসছে।”
তরুণ তাহার কথা শেষ করিতে না করিতেই ভারতের সীমান্তরক্ষীর দল অনুপ্রবেশকারী দলের দিকে গুলি চালাইতে বাধা হইল। সঙ্গে সঙ্গেই সেই গুলিতে একজনের বক্ষ ভেদ করায় সে কিছুদূর ছিট্কাইয়া পড়িল এবং আরও কয়েকজন ভূপতিত হইল। পরের দিন জানা গেল যে মোট চারজন লোক গুলিবিদ্ধ হইয়া মারা যায়।
এই দুর্ঘটনা তরুণের মনে গভীর ভাবে আঘাত করিলেও বিদেশের মাটির টান একবিন্দুও হ্রাস পায় নাই। সে তরমুজ চাষীর অভয়দানে সম্মত হইয়া এক বর্ষণমুখর দিনে কয়েকটি সার্টপ্যান্ট ও কিছু দরকারী বস্তু বোঁচকা করিয়া চুপিচুপি নদী পার হইয়া অপর পারে সেই চাষীর বাড়ী যাইয়া উপস্থিত। তরুণ ভাবিয়াছিল যে অতি শীঘ্রই সে চাষীর পরিচিত কাশেম মিঞার সঙ্গে তাহার কাকার বাড়ী পৌঁছাইয়া যাইবে। কিন্তু তরমুজ চাষী বাড়ীতে আসিয়া তরুণকে বলিল, “তোমার ভাগ্য মদ, আজ যাওয়া হইব না। তুমি বরং আইজ তোমাগো দেশে ফিরা যাও। এহানে তুমার থাকাডা নিরাপদ মনে করি না।”
তাহার কথা শুনিয়া তরুণ চমকিয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করিল, “আজ কেন যাওয়া হবে না?”
—আইজ কাশেম মিঞা জমিতে হালচাষ করতে আসে নাই। তাই আইজ তুমার এইহানে থাকাডা বিপদ মনে করি।
তরুণ জিজ্ঞাসা করিল, “তবে আমি কবে আসব?”
— পরশু বিসসুদ বার, হেইদিন আইস। কাশেম মিঞারে হকলই খুইলা কইছি। তুমার চিন্তা করনের কিছ্ছু নাই।
আর অন্য কোন উপায় না পাইয়া তরুণ তার সাধের বোঁচকা তরমুজ চাষীর বাড়ীতে রাখিয়া অন্ধকার রাত্রি ভেদ করিয়া কাদা মাটির পথ ধরিয়া একাকী ভালুতে প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হইল। আকাশের বিদ্যুতের ঝিলিকই তাহার একমাত্র পথের সাথী।
সীমানা রক্ষীদের চোখে ধূলা দিয়া গোপন পথে হাটিয়া আসিতেই কাদামাটিতে পড়িয়া যাওয়ায় একমাত্র পড়নের কাপড়ও ভিজিয়া গেল। সেই অবস্থাতেই মেসোর দোকানে আসিয়া কর্মচারীকে ডাকিয়া তুলিল এবং পড়নের কাপরটি কোন রকমে পরিষ্কার করিয়া পাখার নীচে রাখিয়া শুকাইতে দিল। আর তরুণ কর্মচারীর এক লুঙ্গী পরিয়া তাহার বিছানায় নিদ্রা গেল। পরের দিন সকলে জানিতে পারিল যে সে বন্ধুর বাড়ীতে নিমন্ত্রণ খাইতে যাইয়া কাপড়জামা ভিজাইয়া আসিয়াছে এবং বাকী সার্টপ্যান্ট সকলই ধোপার দোকানে রাখিয়া দিয়াছে।
বৃহস্পতিবার দিন তরমুজ চাষীর কথা মত তরুণ তাহার বাড়ীতে উপস্থিত হইল। তিনি তরুণকে অনতিবিলম্বে সঙ্গে করিয়া বাড়ীর বাহিরে লইয়া গিয়া অনেকটা দূরে এক বৃক্ষ দেখাইয়া বলিলেন, “তুমি ঐ গাছের নীচে অপেক্ষা কর। ঐহান থিকাই কাশেম মিঞা তুমারে কাকার বাড়ী লইয়া যাইব। এই অঞ্চলে কাশেম মিঞা হকলেরেই চিনে।”
তরমুজ চাষীর কথামত তরুণ দূরের ঐ বৃক্ষের নীচে অপেক্ষায় রহিল যে কখন কাশেম মিঞা তাহাকে লইতে আসে। বর্ষার জল কাদায় শতাধীক চীনা জোঁকের উৎপাতে সেইখানে দাঁড়াইয়া থাকা তাহার পক্ষে দুর্বিসহ হইয়া উঠিল। কিছুক্ষণ পর তপ্তরৌদ্রের মাঝখান হইতে জলকাদা মাখানো এক জন মাঝারি আকারের লোক তাহার নিকট আসিয়া দাঁড়াইলে দুইজনের মধ্যে পরিচয় হইল। কাশেম মিঞার শরীর একেবারে সুঠাম। চোখগুলি বড় বড় ; বেশ মোটা গোঁফ ও ডানগালে লম্বাভাবে কেটে যাওয়ার চিহ্ন তাহার রৌদ্রে পোড়া কালো শরীরকে অতিশয় ভয়াবহ করিয়া তুলিয়াছে।
কাশেম মিঞা তরুণকে বলিল, “অতি সাবধানে আমার সঙ্গে যাইতে হইব। বুকের পাটা বড় করন লাগব। তুমি এই জামাকাপড়ে যাইতে পারবা না। তুমারে বি.ডি.আর সহজেই ধইরা ফেলব যে তুমি ভারত থিকা আইছ। তুমার লংপ্যান্টডা গুটাইয়া লও। হাতের ঘড়িটা খুইলা আমারে দেও। আমি মাথার গামছাডা পইরা লই। আর তুমি আমার কাদামাটি মাহা লুঙ্গীডা পইরা লউ।”
তরুণ কাশেম মিঞার কথামত বাংলাদেশী চাষাভূষার বেশ ধারণ করিল। তরুণ তাহার কাপড়ের বোঁচকা সঙ্গে লইয়া আসিতে চাহিলে কাশেম বলিল, “বোঁচকা সঙ্গে লইলে এদেশের সীমানারক্ষীগো সন্দেহ হইব। হেইডার চিন্তা ছাড়। আমার উপর বিশ্বাস রাখ, আমি সময় মত পৌঁছাইয়া দিমু।”
এই বলিয়া দুইজনে জোর কদমে পাহাড়ের উঁচু নীচু সংকীর্ণ পথ দিয়া হাটিয়া চলিল। কাশেম রীতিমত বি.ডি.আর দের সঙ্গে কথা বলিয়া কয়েকটি ক্যাম্প পার করিতে সক্ষম হইল ।
এই ভাবে পথ চলার পথে হঠাৎ একবার এক টিলা হইতে এক বি.ডি.আর কে তাহাদের দিকে নামিয়া আসিতে দেখিয়া কাশেম মিঞা তৎক্ষণাৎ তরুণকে দৌড়াইতে বলিলে সে প্রাণপণে তাহাকে অনুসরণ করিল। এইভাবে কয়েক মাইল দৌড়াইবার পর হাপাইতে হাপাইতে কাশেম মিঞা তরুণকে তাহার বাড়ীতে লইয়া আসিল। কতটা সময় পার হইয়া গিয়াছে জানিবার জন্য তরুণ তাহার ঘড়িটা চাহিলে কাশেম মিঞা তাহার কোমরে হাত দিয়া বুঝিল যে সেইটা কোথাও পড়িয়া গিয়াছে। বলিল, “চিন্তার কোন কারণ নাই। আমি অহনই যাইতাছি হেইডার খুঁজে। রাস্তায় কোনঠায় পইরা গেছে মনে হয়।”
সময় তখন আনুমানিক দুইটা। পেটেও প্রচন্ড ক্ষিধা। এমন সময় লাল মোটা চাউলের একথালা ভাত ও ছোট মাছের ঝোল তাহাকে খাইতে দিয়া কাশেম তরুণকে বলিল, “তুমি খাইয়া লইয়া এই চকির উপর শুইয়া একটু বিশ্রাম কইরো, আমি ততক্ষণে তুমার ঘড়িডা খুঁইজা আসি।”
খাওয়া শেষ করিয়া তরুণ খালি চকিতে একখানা কাঁথা পাতিয়া তাহাতে বিশ্রাম করিবার জন্য শুইয়া পড়িল। এরই মধ্যে পাড়ার প্রায় শদেরেক লোকজন আসিয়া তাহাকে ঘিরিয়া ধরিয়া তাহার সম্বন্ধে নানান কথা বলিতে লাগিল। তাহার নাম ঠিকানা জিজ্ঞাস করায় সে মিথ্যা বলিয়া বাঁচিবার উপায় খুঁজিয়া পাইল না। পাছে এই ভীড়ের দল তাহাকে মিথ্যাবাদী বলিয়া অভিহিত করে। তাহা ছাড়া এদেশীয় বলিয়া প্রমাণ দিবার সাধ্য তাহার নাই। কেহ বলিল, “এই সুন্দর চেহারার পুলাডার যে আইজ কি হইব?”
অন্য একজন লোক বলিয়া উঠিল, “যে লোকের পাল্লায় পড়ছে, তার হাত থিকা রেহাই পাওয়া আর সম্ভব হইব না মনে হয়?”
—এতক্ষণে বুঝি বি.ডি.আর গো কানে এই খবর পইছা গেছে গা? তাগো হাতে পড়লে পুলাডারে পিটাইয়া মাইরা ফেলব।
—ইস্ ইস্ রে, কি তরতাজা পুলাডা। মায়ে জানি কতই না চিন্তা করবার नইছে?
এইসব কথা শুনিয়া ভীড়ের মধ্যে এক বৃদ্ধার চক্ষু হইতে দর দর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। কহিল, “আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আইসা পুলাডারে কুপাইয়া কাইটা ফেলব। আমাগো চোখের সামনেই তরতাজা পুলাডা শেষ হইয়া যাইব। এই দৃশ্যও আমাগো দেহন লাগব!”
বাড়ী ভর্তি লোকের ভীড় দেখিয়া ও তাহাদের শোকার্ত কথাবার্তা শুনিয়া তরুণ থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। তাহার কানে আসিল, “এহনতরি পুলাডা এইহানেই বইসা রইছে ! পালাইয়া যায় না কে ? এহান থিকা পালাইয়া গেলেই প্রাণে বাঁচব।”
কিন্তু সে পালাইয়া যাইবে কোথায়? সমস্ত দেশটাই যে তাহার অজানা। যে কাশেম মিঞাকে বিশ্বাস করিয়া সে এখানে আসিয়াছে এই বিপদের সময়ে তিনিও পাশে নাই। ভয়ে ভীত তরুণের শরীর হইতে ঘাম ঝড়িতে লাগিল। মনে মনে ঈশ্বর নাম জপিতে আরম্ভ করিয়া দিল।
এমন সময় কাশেম মিঞা বাড়ীতে ফিরিলে তরুণের প্রাণে জল আসিল। সে কাশেমকে কাছে পাইয়া বলিয়া উঠিল, “কাশেম ভাই, এখানে আমার ভীষণ ভয় করছে। দেখতে পাচ্ছ না কত
লোকের ভীড় জমেছে? আমারে এখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাও।”
কাশেম মিঞা তরুণের মানসিক অবস্থা বুঝিতে পারিয়া বলিল, “আমি থাকতে তুমার গায়ে হাত উডায়— এমন ব্যাটা এই অঞ্চলে এহনতরি পয়দা হয় নাই। তুমি দুইদন্ড ধৈর্য ধর, আমি চাইড্ডে খাইয়া লই।”
এই বলিয়া কাশেম তাড়াতাড়ি পেট পুরিয়া লইয়া একখানা সাইকেল বাহির করিয়া বলিল, “তরুণ, তুমি সাইকেলে বস। বেলা পড়নের আগেই তুমারে নালিতাবাড়ী কাকার বাড়ীতে পৌঁছাইয়া দেই।”
দীর্ঘ দশ-বারো কিলোমিটার পথ অতিক্রম করিয়া সন্ধ্যার পূর্বেই কাশেম তরুণকে তাহার কাকা বীরেন বাবুর বাড়ী পৌঁছাইয়া দিল। বীরেনবাবু নালিতাবাড়ীর এক অবস্থা সম্পন্ন ব্যক্তি। কাজেই ঠিকানা খুঁজিয়া পাওয়া কঠিনবোধ হইল না। বীরেনবাবু বড় চালাক প্রকৃতির লোক। নিজের ঠিকানা গোপন রাখিবার জন্য তিনি কয়েকটি বাড়ী পার করিয়া অন্য এক জনের বাড়ী লইয়া যাইয়া তরুণকে আপ্যায়ন করিলেন। এই বাড়ীতেই পরদিন তরুণের বোঁচকা ও ঘড়ি আনিতে বলিয়া কাশেমকে বিদায় করিলেন এবং বলিয়া দিলেন যে সে যেন আগামীকাল তাহার পারিশ্রমীক লইয়া যায়।
বীরেনবাবু অতি গোপনীয় ভাবে তরুণকে বাড়ীতে রাখায় সে অতিশয় মনঃক্ষুন্ন হইল। অতঃপর একদিন তিনি তাহার স্ত্রীর সঙ্গে তরুণকে শেরপুরে শ্বশুরবাড়ী পাঠাইয়া দিলেন। শেরপুরের খোলা আবহাওয়ায় তরুণ কয়েকদিনের মধ্যেই অনেক বন্ধু জুটাইয়া লইল। একদিন সকলের সাথে মোটর সাইকেলে করিয়া ঢাকা যাইবার দিন স্থির হইল। কিন্তু সেই বিকালেই খবর আসিল যে তরুণকে লইয়া যাইতে একজন লোক আসিয়াছে। কাজেই সর্বপ্রকার পূর্বপরিকল্পনা ত্যাগ করিয়া আবারও গোপনীয়ভাবে ভিন্ন দেশের মাটি হইতে স্বদেশের মাটিতে ফিরিতে হইল।