Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভালো লাগে না || Buddhadeb Guha » Page 3

ভালো লাগে না || Buddhadeb Guha

০৯.

মিলনিতে কিন্তু আর একদিনও যাওয়া হল না।

তাতে অনেকেই নমিতের ওপরে অসন্তুষ্ট হল। তবে মাঝে একদিন মেঘাদা একজনের বাড়িতে নমিতের গানের বন্দোবস্ত করে সকলকে ডেকেছিলেন। শুধু একটি বেহালার সংগতে ও বারোটি গান গেয়েছিল। সঙ্গে একটি তানপুরা এবং তবলা থাকলে অনেক সুন্দর হতে পারত অনুষ্ঠান। তবু মনে হল, খুব একটা অসুন্দর হয়নি। সকলেই দারুণ খুশি।

সরোজাও এসেছিল গান শুনতে। তবে পেছনের দিকে বসেছিল। গানের শেষে বহুজনই এসে নমিতকে অভিনন্দন জানিয়ে গেছিলেন।

কিন্তু সে আসেনি।

সরোজা সেদিন একটা সাদা ভয়েলের শাড়ি পরে এসেছিল। ফিকে-বেগুনি রঙা ব্লাউজ। খোঁপাতে বেঁধেছিল তার প্রবল ঘনকালো কেশভার। খোঁপাতে ফিকে-বেগুনি রঙা ফুল গুঁজেছিল। কী ফুল ঠিক জানে না নমিত। জ্যাকারাণ্ডাও হতে পারে।

দুর্বিনয় কিন্তু একেবারে সামনের দিকে বসেছিল। সবাই মেঝের ফরাশ-এর ওপরে বসেছিলেন। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবিতে ভারি চমৎকার দেখাচ্ছিল ওকে। আলোর মধ্যে খোলা, তরোয়ালের মতন। ও যখন গান শেষে নমিতের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, নমিত ওকে একটা চিঠির কপি দিয়েছিল। চিঠির Textটি ছিল একটি Fax Message। চিঠিটি নমিতের অফিসের কলকাতার হেড অফিস থেকে লেখা। দুর্বিনয়কেই। দুর্বিনয়কে ওদের কোম্পানি শিলচর শহরের চার্চ রোড এবং হাইলাকান্দি এবং করিমগঞ্জের যে নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে তার সোল ইলেকট্রিকাল কনট্রাকটর নিয়োগ করেছে। মাসে তাকে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে অন অ্যাকাউন্ট। তারপর কাজ শেষ হলে বিল করবে। শেষ হওয়ার আগেও করতে পারে। সব ম্যাটেরিয়াল কোম্পানিই দেবে। এই ব্যবস্থাতে তার সম্মতি থাকলে সে যেন কাছাড়ের ম্যানেজার নমিত মুখোপাধ্যায়কে পত্রপাঠ জানায়।

নমিত বলল, একটা স্কুটার অথবা মোটর সাইকেল কিনে নাও। তা কেনার জন্যে অ্যাডভান্সও আমি স্যাংশান করে দেব। হাইলাকান্দি আর করিবগঞ্জ তো যখন-তখন সাইকেলে যেতে পারবে না। দেখো, আমাকে বেইজ্জত কোরো না। ভালো করে কাজ কোরো। আমাদের নির্মীয়মাণ তিনটি বাড়ির প্রত্যেকটির বাইরেই তোমার নামলেখা বোর্ড টাঙিয়ে দাও। সোল ইলেকট্রিকাল কনট্রাকটর হিসেবে। আর একটা ফোন নিয়ে নাও0. Y. T. তে। সেই বোর্ড-এ ফোন নাম্বার দিয়ে দেবে। দেখবে তখন ওই বোর্ড দেখে কত নতুন কাস্টোমার আসে। লোকজনও নিতে হবে। এমন সব লোক কাজে রাখবে যাদের সময়জ্ঞান আছে। যারা খাটতে ভয় পায় না এবং দায়িত্বজ্ঞান আছে। ব্যাবসা অনেক বাড়লেও কোনো আত্মীয়-স্বজনকে নেবে না। যদি কারওকে সাহায্য করতে চাও তবে তাদের অন্যত্র চাকরি করে দিয়ো, যদি পারো। যদি না পারো, তাহলে আর্থিক সাহায্য কোরো মাসে মাসে। ব্যাবসাটা ব্যাবসাই। সেটা খয়রাতির জায়গা নয়। কারওকে নিতে পারো তেমন মনে করলে কিন্তু কাজের সময়ে কোনোরকম আত্মীয়তা দেখানো চলবে না, কোনোরকম অ্যাডভান্টেজ নেওয়া চলবে না। অন্য দশজন কর্মচারীরই মতন কাজ করতে হবে এবং তার কোনোরকম ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে যে সঙ্গে সঙ্গে চাকরি যাবে, একথাও বলে নেবে।

ঠিক। আমি ইতিমধ্যেই শিক্ষা পেয়েছি খুব আবার এক জ্যাঠতুতো দাদাকে নিয়ে। তাঁকে আর আসতে মানা করে দিয়েছি।

দুর্বিনয় বলল।

বেশ করেছ।

দুর্বিনয়ের চোখ-মুখ ঝলমল করছিল। আনন্দে। কিন্তু কেন? নমিত তো কোনো দয়া করেনি ওকে। ও তো ব্যাবসা সত্যিই করে। চিঠির জন্যে তো এত আনন্দ হওয়ার কথা না। বেশ ছটফটও করছিল দুর্বিনয়। লক্ষ করল নমিত।

কী ব্যাপার?

না। আগামীকাল সরোজাদির জন্মদিন। অথচ আগামীকাল শনিবার। কাল মিলনির সভা হবে কি না জানি না অবশ্য কিন্তু কাল যেতে মানা করে দিয়েছে বাড়িতে।

কেন?

তা জানি না। আর সরোজাদি নিজে না জানালে তার মনের কথা জানার সাধ্য তো অন্য কারওই নেই।

তাই?

তাই তো। আরও যদি মেশেন তো বুঝবেন।

তুমি এমন ছটফট করছ কেন?

সরোজাদিকে নিয়ে চাইনিজ খেতে যাচ্ছি।

একগাল হেসে বলল, দুর্বিনয়।

নমিত মুগ্ধ চোখে চেয়েছিল ওর মুখে। অবিমিশ্র সারল্য আজকাল বড়ো একটা দেখতে পাওয়া যায় না। এত সহজে এতখানি খুশি হওয়ার ক্ষমতাও বোধ হয় কমে আসছে মানুষের। ভাবল ও।

সাইকেলে বসিয়েই তাকে নিয়ে যাবে নাকি?

নমিত ওর কথার রেশ টেনে বলল।

না না। সাইকেল আনিইনি। সাইকেল রিকশাতে যাব।

আর ফেরা?

ওই রিকশাকেই রেখে দেব। যা নেবে, তা নেবে।

থাকবে তো? নাকি বলবে, ভাল লাগে না।

হেসে উঠল দুর্বিনয়।

বলল, না। বলবে না।

ভিড় পাতলা হলে মেঘাদা এসে বললেন, এই যে ব্রাদার। ওই একখান গান গাইলা, কী য্যান? হ্যাঁ। আমারো এমনও যে হবে-কার গান সেইটা?

নিধুবাবুর।

কত গান লিখছিলেন সেই গুফো ভদ্দরলোক! লিখযোখা নাই দেহি। আস্তাইটার বাণীটা কও ত দেহি।

আমার এমনো যে হবে, প্রেম যাবে সে কভু মনে ছিল না, ছিল না। আমার এ চিত, নিশ্চিত ছিল এ প্রেমে, বিচ্ছেদ হবে না।

বাঃ বাঃ। তা তুমি এহনে যাবা কই?

কোথায় আবার? মোল্লার দৌড় মসজিদ। বাড়ি যাব।

চলো, আমার সঙ্গে একখানে।

কোথায়?

চলোই না। শিদল শুঁটকি খাওয়াইব অনে।

নমিত যেন ইলেকট্রিক শক খেল। বলল, উরি : ফাদার। না মেঘাদা। প্রাণ যাবে নাকি? আমার মাসিমাকে দেখেছিলাম মেসোমশাই-এর অর্ডারে চাঁটগাইয়া এক বন্ধুর অনুরোধে নাকে ওডিকোলোন মাখানো রুমাল লাগিয়ে শুঁটকি মাছ রাঁধতে। তাঁদের কলকাত্তাইয়া বাড়িঅলা দুদ্দাড় করে ওপর থেকে নেমে এসে বলেছিলেন, আপনারা বাঙাল জানতুম, রেফুজি জানতুম, কিন্তু আপনারা যে, এমন পচা বাঙাল তা তো জানতুম না মহায়।

থোও ওসব কথা। রেফুজি! ই আমাকেও কইছিল একজনে। তা আমি কয়্যা দিচ্ছিলাম যে, আমরা হইলাম নেহরু সাহেবের জামাই। রেফুজি কয়েন না।

তারপর বললেন, ওসব কথা ছাড়ান দাও। কথায়ই আছে যে, যে দ্যাশে যাইবা সে দ্যাশের খাওয়ার খাইবা, সে দ্যাশের মাইয়ারে বিয়া করবা, সেই দেশের ভাষায় কথা কইবা, তবে না ক্যানে! চলো আমার লগে। আজ শিদল খাওয়াইমু। পরে একদিন লইটা। তারপর দ্যাখবাঅনে একথালা ভাত শুদাশুদা শুঁটকি দিয়াই খাইতাছ আহা! আহা! কইর‍্যা।

আজ নয়। আজ অমলবাবুর স্ত্রী আমার জন্যে মুগের ডালের ভুনি খিচুড়ি রান্না করবেন।

তা তুমি কী দিবা তাঁরে, তার বদলে? গান? তুমি ত পোলা গান গাইয়াই জগৎ মাতাইয়া দিতা পারো।

নমিত চুপ করে রইল। আশ্চর্য! অমলবাবুর স্ত্রী, যাঁর ডাক নাম বুড়ি, গান একেবারেই ভালোবাসেন না। এমন কোনো মেয়ে ও জীবনে দেখেনি আগে যিনি গান ভালোবাসেন না। মেয়েরাই তো সরস্বতীর সবচেয়ে বড়ো বাহিকা, ধারিকা। সত্যি! ভগবান কত বিচিত্র রকমের মানুষই না সৃষ্টি করেন পৃথিবীতে! অথচ গান ভালোবাসেন না বলেই যে মানুষটাকে বাতিল করে দিতে হবে তার কোনো মানে নেই। হাতির পেখম নেই, ময়ূরের কেশর নেই, বাঘের শুড় নেই–এসব নিয়ে তো কোনো অনুযোগ চলে না!

সরোজা কেমন আছে? সে যাবে না আপনার সঙ্গে?

আরে না। তারে লইয়া চাইনিজ খাওয়াইতে গেল দুর্বিনয়।

নমিত বলল, চিনারা যদি আবারও ভারত আক্রমণ করে তবে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার আর কোনোই দরকার হবে না।

ক্যান? দরকার অইব না ক্যান?

সারাভারতের পথেঘাটে ফুটপাথে যেখানে যেখানে চাইনিজ নামক খাদ্য রান্না হয়, এবং অবশ্যই বাড়ি-বাড়িতেও, সেইসব চাইনিজ তাদের খাইয়ে দিতে পারলে রিয়্যাল চাইনিজদের মৃত্যু অনিবার্য।

মরব ক্যামনে? পেট খারাপ হইয়্যা?

সরল মেঘাদা প্রশ্ন করলেন।

নমিত হেসে বলল, না, না, পেট খারাপ হয়ে না, নিছক শক-এই মারা যাবে। শিয়োর শক-এ।

হাসতে হাসতে একখিলি পান মুখে পুরে দিয়ে মেঘাদা বললেন, কইছ ব্যাশ। আমি ত এইজন্যেই চাইনিজ-ফাইনিজ ইক্সপেরিমেন্টের মধ্যে এক্কেরে নাই। তা, তুমি যখন শিদল খাইবাই না আমি আউগাইয়া যাই গিয়া। তুমার পথ ত আলাদা। তুমার ই পথ আমার পথের থিক্যা গ্যাছে বাyইকা, তুমার ই পথ। কী কও?

নমিতা হাসতে হাসতে বলল, ঠিক।

তারপরই জুদা হওয়ার সময়ে বললেন, একখান কথা জিগাইমু?

বলুন।

তুমার কি সরোজার লগে ঝগড়া-টগড়া অইছে নাকি? এক্কেরে আসা ছাইড়া দিছ যে, আমাগো অম্বিকাপট্টিতে?

নমিত গলায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত জোর এনে বলল, না, না। আসলে সময় করতে পারি না। তা ছাড়া সরোজা কি ঝগড়া করতে পারে কারও সঙ্গে, আদৌ? আমার তো বিশ্বাসই হয় না।

কও কী তুমি। স্যা ত ইক-নম্বরি ঝগড়াটি।

আরও বলব, নমিত বলল, আগে ভাব হলে তারপরে তো ঝগড়ার কথা! ভাবও তো হয়নি এখনও ভালো করে।

তা নাও অইতে পারে। স্যা এক অদ্ভুত মাইয়া। কোন ধাতুতে যে তৈরি জানি না। এক্কেরে ওর মায়ের মতন হইছে। জিদ্দি যে জিদ্দি। বাপরে।

আপনি যদি মেঘাদা সিলেটি, মানে কাছাড়ি ভাষাটা বলতেন আমার সঙ্গে, তাড়াতাড়ি শিখতে কত সুবিধা হত। আপনি বলেন আপনার ফরিদপুরের ভাষা।

হ। তা কয়টা শব্দ শিখছ? কাছাড়ি ভাষার?

ইটা কিতা? একটা।

খুব জোরে হেসে উঠলেন মেঘাদা। বললেন, গুড় স্টার্ট। গুড় স্টার্ট। আচ্ছা তোমার লগে দেখা হইলে ইবার থিক্যা ওই ভাষাতেই কথা কম অনে।

রিকশা করে যাচ্ছিল নমিত বাড়ির দিকে। কাল সরোজার জন্মদিন। ঠিক করল, সকালে হলুদ গোলাপ কিনে নিয়ে যাবে। হলুদ গোলাপ কি পাওয়া যাবে শিলচরে? অধিকাংশ মেয়েই মিষ্টির চেয়ে নোনতা পছন্দ করে বেশি। এখানে কি দইবড়া-টড়া ভালো পাওয়া যায়? জানে না ও। তার চেয়ে, বড়ো কইমাছ যদি পায় তো কইমাছ আর কচিপাঁঠার মাংস নিয়ে যাবে দু কেজি।

কিন্তু মন যে যেতে চায় না। ও যে আর সরোজার যোগ্য নেই। ও যে ভ্রষ্ট হয়ে গেছে। সরোজা যেন এক মস্ত স্বচ্ছজলের সরসীর একবারে তলের কালোজমিতে পা দিয়ে জলের ওপরে মুখ বের করে ফুটে আছে। ফুটে আছে নিশিদিন কোনো রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে পুঞ্জীভূত মরকতমণির মতন। তাকে স্পর্শ করার মতো হীন নমিত হবে কী করে!

ইশ। এটা তুমি কী করলে নমিত!

ও নিজেই বলল নিজেকে। মা জানলে কী বলবেন? দাদা বউদি, এমনকী তার কোম্পানির এম ডি সেন সাহেবেও? সন্তোষমোহন দেবের ছোটভাই ঝুনুবাবু? ছিঃ ছিঃ। এইজন্যেই কি এত পড়াশুনো করল? যে পরিবারে, যে পরিবেশে সে মানুষ, যেমন মেয়েদের সঙ্গে সে কৈশোর থেকে মেলামেশা করেছে তাদের প্রেক্ষিতে এই বুড়ি! চল্লিশ ছুঁই ছুঁই নারী। ক্লাস এইট অবধি পড়া। ডায়মণ্ড হাবড়ার বুড়ি! ছিঃ ছিঃ।

কিন্তু কী করবে ও। ওর মন যে বড়ো নরম। বুড়িরও তো দোষ নেই কোনো। ঘি আর আগুন একসঙ্গে থাকলে হুতাশন তো চড়চড় শব্দে বাড়বেই। সে আগুনে, সব সংস্কৃতিই ভেসে যেতে যে পারে এক ক্ষণিক দুর্বলতার মুখে সেকথা নমিতের মতো আর কে জানে! দোতলার বারান্দার দাঁড়ে ঝোলা চন্দনাটির চেয়েও তো সে অসহায়। এই নারী! চন্দনাও হয়ত দাঁত দিয়ে শিকল কেটে কোনোদিন মুক্ত হতে পারে কিন্তু অমলবাবুর স্ত্রী বুড়ি তো কখনোই পারবে না।

নমিতের সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে অমলবাবুর ব্যবহার। তিনি কিছুই বুঝতে পারেন না? ওর মনে হয়, বোঝেন। নমিতকে হয়তো পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেবেন উনি সুযোগ-সুবিধে পেলে। আর যদি তাই দেন তবে বুড়ির কী হবে? বুড়ির বয়েসও তো সরোজারই সমান হবে। না, সরোজার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়োই হবে হয়তো বুড়ি।

সরোজা মুক্ত। তার ভবিষ্যতের কত কল্পনাই না তার মনে। আর বুড়ির ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই নেই। বলার মতন তেমন কোনো অতীতও নেই, যা নিয়ে, যা রোমন্থন করে, সে অবসরের বেলা সুন্দর করে তুলতে পারে। ছেলে-মেয়ে দুজনকেই অমলবাবু গতসপ্তাতে শিলং-এর রেসিডেনশিয়াল স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন। তাহলে এখন বুড়ির কী হবে? ওই চন্দনা পাখিটি ছাড়া তার কথা বলার মতন দ্বিতীয় কেউই তো আর রইল না!

নমিতের কোম্পানি ওকে বদলি করতে পারে আরও প্রমোশন দিয়ে। আমস্টার্ডাম থেকে ইওরোবোর্ডের যে ডিরেক্টরেরা এসেছিলেন তিনমাস আগে, নমিত কলকাতাতে থাকাকালীন, তাঁরা নাকি সবচেয়ে ইমপ্রেসড নমিতকে দেখে।

ওকে কাছাড়ে পাঠাবার কারণ ছিল এই যে, ওর কোম্পানি এখানে অনেক জমি কিনে ডায়াসকোরিয়ার চাষ করবে। এখানে নতুন কারখানা বসাবে। ডায়াসকোরিয়া থেকে বার্থ কন্ট্রোল পিল তৈরি হয়। সিপলা, দিল্লির ডাবুর সকলেই কোলাবরেশনে ইন্টারেস্টেড। কলকাতার দেজও। এখানে একেবারে দক্ষযজ্ঞ কান্ড হবে। এশিয়ার বিগেস্ট প্ল্যান্ট বসবে বার্থ-কন্ট্রোল পিল-এর। সে কারণেই তাকে এখানে পাঠিয়েছিলেন সেন সাহেব। এখন নমিত ফোন আর ফ্যাক্স বসিয়ে নিয়েছে বাড়িতেও। একতলার আরও একটি ঘর নিয়েছে–ইন্টার কানেক্টেড করে নিয়েছে দরজা ফুটিয়ে। কিন্তু অনেক অসুবিধে সত্ত্বেও অমলবাবুর বাড়ি ছেড়ে যায়নি। বুড়ির-ই জন্যে।

ওর সঙ্গে দেখা হলেই অমলবাবু হেসে বলেন, আপনি আছেন তাই ঘুরে ঘুরে কাজ করতে পারি। আপনিই তো আমার লোকাল গার্জেন। আমার স্ত্রীর জন্যে কোনোই চিন্তা নেই আর আমার।

বুকের মধ্যেটা ধ্বক করে ওঠে নমিতের কথাটা শুনে।

সপ্তাহে অন্তত তিনসন্ধে বা রাতে যখন অমলবাবু থাকেন না শহরে তখন বুড়ি নমিতের হয়ে যায়। দিনে দিনে এক অদ্ভুত মায়া, এক আচ্ছন্নতা জন্মাচ্ছে নমিতের তার ওপরে। ড্রাগ এর নেশা করে মানুষ যেমন জেনেশুনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়, তেমনই করে সার্বিক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ও। বুঝতে পারে। কিন্তু বুড়ি যখন আসে সুগন্ধি সাবান মেখে স্নান করে, পারফিউম মেখে, স্তনসন্ধিতে-উরুসন্ধিতে পাউডার লাগিয়ে, তখন কে জানে কী ভর করে নমিতের ওপরে। কত বছরের কাম যে জমেছিল বুড়ির ভেতরে তা কে জানে।

মাঝে মাঝে ওর ভীষণ ইচ্ছে করে অমলবাবুর রাখন্তি বা রাখনি বা রক্ষিতা বা রাঁঢ়কে একবার দেখতে। সে যদি না থাকত, তবে তো নমিতের জীবন এমনভাবে বিপর্যস্ত হত না।

ওর শিশুকালে ছাদের কার্নিশে বসে থরথর করে কাঁপতে থাকা বেড়ালের তাড়া-খাওয়া একটা সাদা পায়রাকে ধরে ফেলেছিল। তারপরে তাকে খুব করে দানা-মটর খাইয়ে, জল খাইয়ে তার নিজের ঘরে পাখার তলাতে একটি ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাতে পরমযত্নে রেখেছিল। নটবরদা বারে বারে সাবধান করে বলেছিল, অমন করে ঝুড়ি-চাপা দিয়ে না রাখলে রাতে বেড়াল স্কাইলাইটের বা দরজার পাখির ফাঁক দিয়ে এসে ঠিক পায়রাটাকে খেয়ে নেবে। আট বছরের শিশু নমিত আঁতকে উঠেছিল সেকথা শুনে। নটবরদাই সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। যথাসম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করেছিল নমিত। কিন্তু সকালে ঘুম ভেঙে উঠেই সাদা মাৰ্বল এর মেঝেতে ছোপ-ছোপ লাল রক্ত আর মেঝেময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাদা রক্তমাখা পালক দেখে ভয়ে আর অপরাধবোধে চিৎকার করে উঠেছিল সে। ওর কাছে যে-দুর্বল আশ্রয় চেয়েছিল তাকে নমিত রক্ষা করতে পারেনি শেষপর্যন্ত। সারাটাজীবন নমিতকে সেই অপরাধবোধ কুরে কুরে খেয়েছে। আজ তার মধ্য-যৌবনে অমলবাবুর স্ত্রী বুড়ি ঠিক সেই সাদা পায়রাটার মতনই তার কাছে বাঁচার আবেদন নিয়ে এসেছে। কী করবে নমিত?

নমিত কী করবে?

.

১০.

খুবই সকালে অফিসে পৌঁছেছিল সেদিন।

অনেক ভেবে ও নিজে অম্বিকাপট্টিতে মেঘাদার বাড়িতে সরোজার জন্মদিনে যাবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওদের অফিসের নাইট-দারোয়ান ও বেয়ারার কাছে সব খোঁজখবর নিয়ে হলুদ গোলাপ, ভালো রসগোল্লা, মাংস ও কইমাছের জোগাড় করে বেয়ারাকে দিয়েই সাইকেল রিকশা করে পাঠাবার বন্দোবস্ত করল যাতে সাড়ে দশটা-পৌনে এগারোটার মধ্যে পৌঁছে যায়। যতক্ষণে ওইসব কিনে আনছিল ওরা ততক্ষণে একটা চিঠিও লিখে ফেলল সরোজাকে।

মেঘাদার বাড়ি যে ফোন নেই তা একদিক দিয়ে ভালোই। ভাবছিল ও। এই ফোন, ফ্যাক্স, ই-মেইল মানুষের মনের গভীরতা, চিন্তাশক্তি সব নষ্ট করে দিচ্ছে। একটা চিঠির মাধ্যমে একজন মানুষ যেমন করে নিজেকে পদ্মফুলের পাপড়ির মতন খুলতে মেলতে পারে, তা কি ফ্যাক্স মেসেজ বা ফোনে পারে? না, পারা কখনো সম্ভব? মানুষের হৃদয়বৃত্তি, অন্তর্মুখীনতা সবকিছুই নষ্ট করে দিচ্ছে এইসব বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন। টাকা, আরও টাকা, আরও ব্যাবসা পৃথিবীময়, এইসবের জন্যে হয়তো এইসব উপকারী হতে পারে কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের সম্পর্ক যেখানে, সেখানে এইসব উদ্ভাবন মানুষকে ভোঁতা, matter of fact, mundane, স্থূল করে দিচ্ছে দিনকে দিন। মানুষ সময় নিয়ে বসে একটা চিঠি লিখতেই পারে, তার মনঃসংযোগ আসবে কী করে? সে সাহিত্য বা কবিতা পড়বে কী করে? আর এই সব করে যে-সময়টা মানুষ বাঁচাচ্ছে তা আরও টাকা রোজগার ছাড়া আর কোন কাজে সে লাগাচ্ছে? যে ছেলে আমেরিকাতে আছে, সে বাবার মৃত্যুর খবর সঙ্গে সঙ্গে পাচ্ছে বটে কিন্তু দাহ করতে আদৌ আসছে কি? আসতে হয়তো দশঘণ্টা লাগত মোটে জেট-প্লেনের কল্যাণে। কিন্তু সে বলছে, হোয়াটস দ্যা পয়েন্ট ইন ওয়েস্টিং আ হেল অফ আ লট অফ মানি টু সি আ ডেড পার্সন?

তবে? এই সময়, এই টাকা, মানুষের কোন প্রকৃত হিতে লাগছে। মানুষ যদি হৃদয়হীন অমানুষই হয়ে যায় তবে তার হাতে কত সময় থাকল, কত বৈজ্ঞানিক আর বৈদ্যুতিক গ্যাজেটস তার নিয়ন্ত্রণে থাকল, তাতে কীই বা এসে যায়?

মানুষের সমাজ যুগ-যুগান্ত ধরে যা কিছু সূক্ষ্ম মানবিক বৃত্তি অথবা প্রবৃত্তি হিসেবে গড়ে তুলেছিল, এই বিশ্বব্যাপী টাকা, আরও টাকা রোজগারের অন্ধ আঁধি তার সব কিছুই ধীরে ধীরে নষ্ট করে দিতে বসেছে। অথচ এর বিরুদ্ধে একজন মানুষকেও সোচ্চার হতে দেখে না। ওর মনে হয় যে, একটা দিন শিগগির আসবে যখন মানুষ এই বিজ্ঞানকে সমূলে উৎপাটিত করে তার স্বভাবের, শান্তির মননের দিনে ফিরে যাবে! সেদিন হয়তো নমিত মুখোপাধ্যায়েরা বেঁচে থাকবে না কিন্তু দেশে দেশে সরোজার মতন মেয়ে, দুর্বিনয়ের মতন ছেলেরা বেঁচে থাকবে, প্রেম আবারও ফুটে উঠবে মানুষ-মানুষীর মনে, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাও আবারও মানবিক বৃত্তি হিসেবে স্বীকৃত হবে, নিছকই কম্পিউটারের Data হিসেবে Stored হবে না। এইসব আপাত-চালাক মানুষ, যারা কম্পিউটার আর সুপার-কম্পিউটার নিয়ে লম্ফঝম্ফ করে তারা সম্ভবত জানে না যে, কম্পিটারে যদি Garbage feed করা যায় তবে ফল হিসেবে Garbageই বেরোবে। স্মৃতিশক্তি বা আঁক কষার ক্ষমতা মারাত্মক ভালো হওয়াটাই মানুষের পরমতম উৎকর্ষতা নয়, স্মৃতিতে কী সে ধরে রাখছে, আঁক কষে সে ডুবন্ত সাবমেরিন থেকে। মিসাইল ছুড়ছে, অথবা অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট থেকে কামানের গোলা, না প্রেম বা প্রীতি বা সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছে অন্যের প্রতি, সেটাই বড়ো কথা। আধুনিক মানুষের এই সার্বিক বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির মধ্যেই যে, তার মৃত্যুবীজই আক্ষরিক এবং তাত্ত্বিক অর্থে নিহিত আছে তা যেদিন এই বিজ্ঞানের মদমত্ত অন্ধ মানুষ বুঝবে, সেদিন অনেকই তৈরি হয়ে যাবে।

নমিত লিখল,

সরোজা, না, আয়েষা,

কল্যাণীয়াসু,

তোমাকে তুমি বলেই সম্বোধন করছি। আমি আমার অনুজ ও অনুজাদের মধ্যে আপনি বলে শুধু তাদেরই সম্বোধন করি, যাদের আমি পছন্দ করি না। যারা আমার হৃদয়ের কাছের, তাদের তুমি বলতে পেরে তাদের আরও কাছের বলে ভাবাটা সহজতর হয়।

আজ তোমার জন্মদিন। লোকমুখে জানলাম। লোকমুখে জানলাম বলেই নিজে যেতে সংকোচ হল। তুমিও হয়তো চাও না যে, আমি তোমার কাছের মানুষ হই। তোমার কাছে, তোমার পায়ে পায়ে বাঁধা মৃগশিশুর মতন যে মানুষটি আছে, যার নামের সঙ্গে তার স্বভাবের কোনোই সাযুজ্য নেই, সে বড়োই ছেলেমানুষ। কিন্তু সে বড়ো ভালও।

সংসারে ভালোত্বর, সারল্যর, সতোর কোনোই বিকল্প নেই। যে যাই বলুক এই বিশ্বাসই মানুষের শেষতম মহৎ বিশ্বাস বলে গণ্য হবে, যতদিন সভ্যতা থাকবে। তবে একথাও ঠিক সরোজা যে, ভালোত্বর সংজ্ঞা নিয়ে তর্ক আছে, থাকবেও চিরদিন। তর্ক থাকা ভাল। যে মানুষেরা তর্ক করে না, পরের সঙ্গে তো বটেই, নিজের সঙ্গেও, সে মানুষদের মনুষ্যত্বে অচিরেই মরচে পড়ে যায়।

তুমি আমার জীবনে এক পরমপ্রাপ্তি। তাই নিত্য ব্যবহারে তাকে মলিন করতে চাই না আমি। কখনো কোনো বৈশাখের ভোরে, যখন মিষ্টি হাওয়া বইবে, বকুল ঝরবে তোমাদের বরাক উপত্যকার এই শিলচর শহরের পথের পাশে পাশে, কোকিল ডাকবে পাগলের মতন, তখন তোমাকে মনে করে আমার বুকের মধ্যেটা উঁহু-উঁহু করে উঠবে। ঘোর শ্রাবণের ঘন বরষায়, অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টির পরে যখন রোদ উঠবে, যখন চাপ-চাপ ঘন-সবুজ মুথা-ঘাসে ভরা মাঠে-মাঠে হলুদ ফড়িং উড়বে উদবেল উৎসারে, যখন বাতাবি ফুলের গন্ধ ভাসবে বৃষ্টিশেষের হাওয়াতে তখন তোমাকে বারে বারই মনে পড়বে আমার। তুমি আমার বসন্ত। তাই আমার জীবনে তুমি চিরদিন থাকার নও। তা ছাড়া সবরকম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ততেই আমার তীব্র অনীহা। আসবে ক্ষণকালের জন্য তুমি, ফিরে ফিরে আসবে। আবার ফিরে যাবে। প্রতিবার আসার সঙ্গে সঙ্গে স্বীকৃত নবীকৃত হবে তুমি। Familiarity breeds contempt তাই তোমাকে familiar করব না আমি। তুমি থাকবে আমার কল্পনাতে।

সুন্দরতম ফুল অথবা নারীকে কল্পনাতেই রাখতে হয়। দূরের দুর্গম নিভৃত বনপথেই তারা প্রকৃত সৌন্দর্যের ধারক হয়। ঘরে অথবা ফুলদানিতে সব নারী, সব ফুল আঁটে না। আটাতে গেলে, তাদের প্রতি অন্যায় করতে হয়ই। যারা তাদের সৌন্দর্যে ও গন্ধে মুগ্ধ এবং মোহিত হয়, তাদের প্রতিও অন্যায় করা হয়। জানি না, যা বলতে চাইলাম, তা বুঝিয়ে বলতে পারলাম কি না! না-বোঝাতে পেরে থাকলে নিজগুণে বুঝে নিয়ো।

তুমি সেদিন বলেছিলে যে, তোমরা চিরদিনই উত্তীয়দের বিসর্জন দিয়ে বজ্রসেনদের পায়ে সাষ্টাঙ্গে ভূলুণ্ঠিত হয়েছ। আমার একটিই প্রার্থনা তোমার কাছে। For a change উত্তীয়কে একবার জিতিয়ে দাও না। লক্ষ্মীটি।

তোমাকে দেখে, তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার এই আটত্রিশ বছরের জীবনে শুদ্ধ প্রেম কাকে বলে তা আমি জেনেছি। প্রকৃত প্রেম চিরদিনই অধরা। তা ঘরের মধ্যে কোনোদিনই আঁটেনি। তুমি লক্ষ লক্ষ বিবাহিত দম্পতিকে নির্জনে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, প্রেম তাঁদের জীবনে আছে কি না? তাঁরা অন্য কথা বললেও বুঝে দেখবে, তুমি বুঝতে চাইলে বুঝবে যে, প্রেম নেই। যা আছে, তা প্রেম নয়। প্রেম নেই। যা আছে, তা অভ্যেস, তা পুতুল-খেলা। প্রেম প্রজাপতির মতন, বসন্তেরই মতন ক্ষণস্থায়ী। গুটি থেকে বেরোনোর পরে তারা বেশিদিন বাঁচে না। দৈনন্দিনতা এবং নৈকট্যই প্রেমের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। তাতে প্রেম এমন নিশ্চিতভাবেই মরে যে, তাকে বাঁচায় এমন স্টেরয়েড বা অ্যান্টিবায়োটিক পৃথিবীতে নেই। ওষুধ কোম্পানির সেলস ও ম্যানেজার হয়ে–একথা আমি কবুল করছি।

বরাক উপত্যকায় হঠাৎ পাওয়া আমার জলজ সরোজাকে আমি চিরদিন মহার্ঘ্য আতরের গন্ধের মতনই তুলোর মধ্যে করে আমার মনের গোপন স্থানে রাখা বহুমূল্য বেলজিয়ান কাটগ্লাসের আতরদানিতে সারাজীবনই রাখতে চাই। তোমাকে সুখী দেখে, সুখী হতে চাই। তোমার ভালো করতে পেরে খুশি হতে চাই। আমি তোমাকে তুমি যে তুমিই শুধু সেই কারণেই ভালোবেসেছি। চিরদিনই, ভালোবাসব। আমার সমস্ত হৃদয়ের পাটরানি হয়ে থাকবে তুমি চিরদিন। সেজন্যে আমার খাটরানি হওয়ার কোনোই প্রয়োজন নেই।

ভাগ্যিস সকলে বোঝে না। আমি বলছি যে, দুর্বিনয় বড়ো ভালো ছেলে। তোমার চেয়ে বয়সে সে ছোটো হতে পারে কিন্তু তোমার যোগ্যতম সে। সে শরীর-মনের সব ভালবাসাতে তোমাকে আপ্লুত করে দেবে। তাকে তোমার গ্রহণ করতে হবেই কারণ তাকে যদি তুমি না এল সেই অভিঘাত সে সহ্য করতে পারবে না। হয়তো আত্মহত্যাই করে বসবে। নিষ্পাপ হৃদয়ের পবিত্র ভালোবাসা, একচক্ষু হরিণেরই মতো যা একাগ্র, তার কোনোই বিকল্প নেই সরোজা। এমন ভালেবাসা যারা জীবনে ফিরিয়ে দেয় তাদের আজীবন হাহাকারে কাটে। আমি কম জানি। কিন্তু যতটুকু জানি, তাতে কোনো ফাঁকি নেই।

কালকে আমার গান শুনতে গিয়ে তুমি আমার সঙ্গে দেখা না করে ভালোই করেছ। কাছে না এলেও আমি জানি দূর থেকে কুঞ্চন করে পরমবিরক্তির সঙ্গে তুমি আমার গান শুনে, আলোকিত আসনে আমাকে অনুক্ষণ দেখতে দেখতে রোমাঞ্চিত হয়েছ। যখন সকলে গান শেষে বলেছে আহা! আহা! তখন তোমার বুক শ্লাঘাতে ভরে গেছে। কারণ, তুমি জেনেছ, যে-মানুষটি এত নারী-পুরুষের ভালোবাসা পেল, তুমি পেয়েছ তারই উজাড়-করা ভালোবাসা।

কী? ঠিক বলিনি আমি।

অনেক শিশু আছে, যারা দীর্ঘক্ষণ বায়না করে, ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদে, একটা গ্যাস বেলুন, বা একটি পুতুল বা একটি চকোলেট-এর জন্যে। যে-মুহূর্তে তা তার হাতে পায়, তার পরমুহূর্তেই কিন্তু তা মাটিতে ফেলে দেয়। না, তারা মূর্খ বলে নয়, তারা যোগী বলে। চাওয়াটা অবশ্যই একটা সাধনা। কিন্তু পাওয়াটা নয়। শিশুদের কাছ থেকে আমার-তোমার মতন বড়োদের অনেক কিছুই শেখার আছে সরোজা।

তোমাকে আরও বড়ো চিঠি লিখতে হলে আমার চাকরি যাবে। কোম্পানি তো আমাকে চিঠি লেখার জন্যে মায়না দেয় না। তা ছাড়া, আমি বিশ্বাস করি, একজন পুরুষের জীবনে তার কাজই সবচেয়ে বড়ো। খুব কম পুরুষই জানে যে, মেয়েরা কর্মী-পুরুষকে যতখানি ভালোবাসে, অন্য কোনো পুরুষকেই ততখানি ভালোবাসে না। পুরুষকারের অনেকরকম আছে। তারমধ্যে মস্ত একটা বড়োরকম হচ্ছে To excell in whatever he does. তেমন পুরুষদেরই মেয়েরা মনে মনে চিরদিন বরমাল্য দিয়েছে, জীবনে দিতে পারুক, আর নাই পারুক। কাজই আমার সবচেয়ে বড়ো প্রেম সরোজা। তোমার চেয়েও আমি আমার কাজকে ভালোবাসি। আশা করি, তুমি বুঝবে। এবং বুঝে, ক্ষমা করবে।

কাল চাইনিজ কেমন খেলে?

সত্যি কথা বলতে কী দুর্বিনয়কে আমি তোমার চেয়েও বেশি ভালবেসে ফেলেছি। ও যেন একটি শিমুল গাছ। ঋজু। সটান। দু-দিকে সমান্তরালে ছড়ানো তার হাত। তার মধ্যে কোনো বক্ৰতা, কোনো খলতা নেই, তার হৃদয়ের রং বসন্তের শিমুলেরই মতো। প্রার্থনা করি ঈশ্বরের কাছে, বনহরিণী যেমন ভালোবেসে শিমুলের ফুল খায়, তুমিও তেমনি করেই পরমআহ্বাদে পরিপ্লুত হয়ে দুর্বিনয়ের রাঙা হৃদয় নিয়ে।

সন্ধেবেলায় মিলনির সকলকে মাংস খাইয়ো। আর রসগোল্লাটা তোমার জন্যে রেখো। মেঘাদার কাছে জেনেছি, তোমার রসগোল্লা-প্রীতির কথা।

একদিন তোমার হাতে শিদল শুঁটকি খাব। খেয়ে গন্ধে মরে গেলেও খাব। তুমি নাকি দারুণ রাঁধো। সেদিন দুর্বিনয়কেও ডেকো।

একটা কথা বলি। দুর্বিনয় জীবনে খুব উন্নতি করবে। একদিন ওর ব্যাবসা মস্ত বড়ো হবে। অধিকাংশ পুরুষের সাফল্যের মধ্যেই তার ব্যর্থতার, তার সর্বনাশের বীজ সুপ্ত থাকে। দুর্বিনয় যখন অত্যন্ত সফল হবে জাগতিক অর্থে, সেদিন ওকে সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব শুধুমাত্র তুমিই নিতে পারো।

তোমার এই জন্মদিন অগণ্য অনাগত জন্মদিনকে স্বাগত জানাবে এই প্রার্থনা করি।

ভালো থেকো।

আমার ওপরে রাগ না করে, আমাকে ক্ষমা কোরো।

ইতি তোমার শুভার্থী, নমিত

চিঠিটা বড়ো তাড়াতাড়িতে লিখল। হয়তো অনেক আপাত-বিরোধিতা এবং পুনরাবৃত্তি রয়ে গেল। গেলে গেল। চিঠিও হচ্ছে চুমুরই মতো। নাকের আড়াল সরিয়ে, চুলের আড়াল সরিয়ে যেসব সাবধানী, কপিবুক অথবা পারফেক্ট চুমু খেতে চায়, তাদের চুমুতে ভালোবাসা থাকে না, অঙ্ক থাকে।

অঙ্ক ভালবাসে না নমিত।

চিঠি দিয়ে পাঠিয়ে দিল তার লোককে। জগদানন্দ। সে স্থানীয় মানুষ। শর্টকাট রাস্তাও চেনে। বলল, খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে। রিকশা বাইরে দাঁড়িয়েই ছিল।

মিস্টার পুরকাইতের সঙ্গে ডায়াসকোরিয়ার প্ল্যান্টেশান-এর ডিটেইলস নিয়ে একটা মিটিং ছিল। প্রোজেক্ট রিপোর্ট-এর কপি পাঠিয়েছেন গুহ চক্রবর্তী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস, ওদের কোম্পানির অডিটার এবং ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্টস। ওর কমেন্টস পাঠাতে হবে কলকাতাতে, সাহেবকে। মিস্টার পুরকাইত রিটায়ার্ড ডেপুটি ডিরেক্টর অব অ্যাগ্রিকালচার। কাছাড় থেকেই অবসর নিয়েছেন। বাড়িও লালাতেই। ওঁকে নমিতদের কোম্পানি প্ল্যানটেশানটা সেট-আপ করার জন্যে রিটেইন করেছে।

মিটিং শেষ হয়ে গেল। উনি প্ল্যানটেশানের সাইট-এ যাবেন। হাইলাকান্দির পথে একটি চা বাগানের পাশেই অনেক জমি পেয়েছে ওরা।

মিস্টার পুরকাইত চলে গেলেন।

নমিত বসে বসে সেদিনের ডাক দেখছিল। হংকং থেকে একটা ফিনান্সিয়াল কাগজ আসে। কলকাতা হয়ে আসতে আসতে তিনচার দিন লেগে যায়। তবু, সেন সাহেব ইনসিস্ট করেন যে, ওইটি পড়তেই হবে। উনি বলেন, পৃথিবীটা যে গ্যাস-বেলুনের মতনই কোথায় উড়ে চলেছে, ইনভেস্টমেন্ট অপরচুনিটিজ, লেবার আর র ম্যাটেরিয়ালের অ্যাভেইলেবিলিটি ইত্যাদি সম্বন্ধে সব জানা যাবে পড়লে। তবে পড়তে হবে Between the lines. ব্যাবসাটা কেমন মসৃণভাবে চালানো হচ্ছে তার চেয়েও অনেক বড়ো চিন্তা একজন আন্ত্রাপ্রেনোরের, পরের কারখানাটি পৃথিবীর কোন প্রান্তে খুলতে পারবেন বা পারা উচিত তাই নিয়ে। Lack of expansion means decay. যে-কোম্পানির টার্নওভার প্রতিবছর না বাড়ে, যে খবরের কাগজের সার্কুলেশান প্রতিবছর জেনুইনলি না বাড়ে, তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরা আরম্ভ হয়ে যায়। মাটি যখন সরা শুরু হয়, তখন বোঝা যায় না। যখন পাড় ভেঙে জলে পড়ে তখনই কাল-এর করাল নদীর দংশন টের পায় মানুষে। কিন্তু বড়োই দেরি হয়ে যায় তখন।

এসব সেন সাহেবের মতামত। নমিত এর সত্য সম্বন্ধে এখনও কিছু জানে না। সত্যিই ওর বড়োসাহেব সেন সাহেব ডায়নামিক মানুষ। প্রচন্ড সফল। কিন্তু কবিতা লেখা আর কবিতা পড়া ভীষণই অপছন্দ করেন। রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ মানুষ-এর সংজ্ঞাকে তবু ছুঁড়ে ফেলতে পারে না নমিত। অবশ্য পূর্ণ মানুষ ক-জনই বা হতে পারেন। অধিকাংশই তো বনমানুষ, শিম্পাঞ্জি, হনুমান, নয়তো হাফ অথবা কোয়ার্টার-বয়েলড মানুষ!

এমন সময়ে জগদানন্দ ফিরে এল, হাতে প্লাস্টিকের একটি বড় কৌটো নিয়ে। সঙ্গে একটি চিঠি।

ঠিক আছে। থ্যাঙ্ক ইউ। তুমি যাও।

বলল নমিত।

তারপর চিঠিটা খুলল। সরোজাই লিখেছে।

দুর্বোধ্য নমিতবাবু,

এই সম্বোধনের জন্য মার্জনা করবেন। সম্বোধনে কী লিখব ভেবে পেলাম না। আপনি প্রিয়জন তো নন-ই কিন্তু শত্ৰু কি না সেকথাও বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে দুর্বোধ্য অবশ্যই।

আপনি খুব মহান এবং উদার ব্যক্তি, সন্দেহ নেই। দয়ালুও। আপনার অফিসের পাড়াতে শীতলাদেবীর একটি মন্দির আছে। অনেক ভিখারিনি সেখানে বসে থাকে। আপনার ভিক্ষা তারা পেলে কৃতার্থ হবে। দৈনিক তাদের একবার দেখা দিলেই তো পারেন! বে-পাড়াতে দান-ধ্যান কেন? বে-পাড়াতে প্রেম করাও যেমন বিপজ্জনক, দান-ধ্যান করাও যে, একথাটি কি আপনি জানেন না?

আমার জন্মদিনের কথা কেউই জানে না। দুর্বিনয় একটি বালখিল্য তাই আপনাকে বলেছিল। শুনেছি, আপনি যে-বাড়িতে থাকেন সেই বাড়িতে একটি চন্দনা পাখি আছে। সে নাকি মাঝে মাঝেই বলে ওঠে কটা বাজেরে? ও বউ, কটা বাজে? সেই পাখিকে দয়া করে আমার হয়ে বলে দেবেন যে বারোটা বাজে। এবং দুর্বিনয়কে যদি আপনার এতই পছন্দ তবে আপনি সেই চন্দনার সঙ্গেই দুর্বিনয়ের বিয়ে দিন।

শিলচর শহরের সবদিকে এখন হাতির খুবই উপদ্রব বেড়েছে। বিশেষ করে সন্ধের পর। দশ-বারোজন মারাও গেছেন। গাড়িতেও সন্ধের পরে কোথাওই যাতায়াত করবেন না শহরের বাইরে। যেসব খবর আপনাদের কলকাতা থেকে আসা নামি-দামি ইংরেজি-বাংলা খবরের কাগজে পাবেন না তা শিলচর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জের প্রতিপাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানেই পাবেন। খবর শুধুমাত্র খবরের কাগজেই থাকে না।

কলকাতার মানুষেরা তো বরাক উপত্যকাতে যে প্রায় চোদ্দো লক্ষ বাঙালি বাস করেন সে খবরই রাখেন না। খবরের কাগজেরা যেখান থেকে বিজ্ঞাপন পান না সেখানের খবর ছাপতে সম্ভবত গা করেন না কোনো। আমাদের এই তৃতীয় ভুবন মানুষেরা তবুও আপনাদের কোনোরকম দয়া ব্যতিরেকেই বেঁচে এসেছি, বেঁচে থাকব। কলকাতার মানুষেরা কি জানেন যে, আমাদের এখানে ভাষা আন্দোলনে তেরো-জন শহিদ হয়েছিলেন একষট্টিতে? বাংলাদেশে তো দুজন শহিদ হয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের শহিদ দিবস নিয়ে কাগজেরা কত চোখের জলই না ফেলেন! ফেলবেনই তো! বাংলাদেশে খবরের কাগজ, নানা মাসিক সাপ্তাহিক পাক্ষিক বিক্রি করতে হবে তো! বাংলাদেশ তো বাংলা প্রিন্ট-মিডিয়ার সবচেয়ে বড়ো বাজার। আমাদের কথা মনে রেখে কোন লাভ হবে কলকাতার কাগজওয়ালাদের?

আজ রাতে জেঠু বাড়িতে থাকবেন না। দুর্বিনয়কেও বলব না আসতে। আপনি একাই আসবেন। আমার এখানে খাবেন। কইমাছ। তেলকই। সরষের তেল, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্গা, কালোজিরে দিয়ে রাঁধব আপনার জন্যে। আর দই-মাংস। সকালে পিমা পায়েস করেছে। তাও থাকবে। আপনার পাঠানো রসগোল্লা তো আছেই ফ্রিজ ভরতি। জন্মদিন আমি কখনোই পালন। করি না। আমার মা-বাবা আমার জন্মদিনেই মারা গেছিলেন দুর্ঘটনাতে। দুর্বিনয়-এর নির্বুদ্ধিতা তো বুঝতে পারছেন এখন!

শিদল শুঁটকি আমি রাঁধিও না, খাইও না। তবে খেতে চাইলে রাঁধিয়ে আনাতে পারি। আমার মা তো কলকাতার ঘটির মেয়ে ছিলেন। এসব পৈশাচিক ঝাল-তেলের রান্নার সঙ্গে আমার ঝগড়া।

যদি কোনো দুর্বোধ্য কারণে না-আসতে পারেন তবে আমাকে অবশ্যই জানাবেন। আমি পাশের বাড়ির ছবি বউদির সঙ্গে ভিডিও ফিলম দেখতে যাব পলাশদের বাড়ি। অস্ট্রেলিয়ান ডিরেক্টর পল কক্স-এর একটি ছবি দ্যা আইল্যাণ্ড জোগাড় করেছে ও। তাতে নাকি ঋতু গুহর গাওয়া একটি গান মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না থিম মিউজিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আপনিও দেখতে পারেন। যদি ছবি দেখেন তাহলে পাঁচটা নাগাদ আসবেন। ছবি দেখার পরে আমরা বাড়ি ফিরে আসব। আর অন্য কেউই থাকবে না। মশা-মাছিও নয়। আপনার ছায়াও জানবে না কথা দিলাম।

ইতি/স

পুনশ্চ : ছবি দেখতে একা গেলেও আমি সাড়ে সাতটার মধ্যেই ফিরে আসব। আজ যদি না আসেন, তাহলে আপনার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। সিরিয়াসলি বলছি কিন্তু। অবশ্য আপনার সঙ্গে আদৌ কোনো সম্পর্ক কি হয়েছে?

আপনার গানের রেশ-এ এখনও মন-প্রাণ ভরে আছে। আপনাকে বিপজ্জনক বললেই সব বলা হয় না। আপনি ঘাতক। আপনার জেল হওয়া উচিত। এমনি জেল নয়, যাবজ্জীবন অন্তর্লীন।

.

১১.

গত রাতে ঘুমোবার আগে একটি চমৎকার লেখা পড়েছিল নমিত। স্মরণিকাতে বরাক উপত্যকার জনবিন্যাস সম্বন্ধে। সঞ্জীব দেব নস্করের লেখা। কতকিছু জানা গেল।

নমিত যদি লেখক হত, তাহলে কী ভালোই না হত। এই সুন্দর বরাক উপত্যকা নিয়ে, জাটিঙ্গা উপত্যকা নিয়ে, কুশিয়ারার বেড়ার (মাঝেদি এক বেড়ার) পটভূমিতে সুন্দর একটি উপন্যাস লিখত।

তবে সেরকম একটি উপন্যাস লিখতে হলে বার বার তাকে আসতে হত এখানে, এই অঞ্চলের প্রকৃতি, মানুষ, গান, সাহিত্য, সংস্কৃতি এসব নিয়ে পড়াশুনা করতে হত পাঠগারে। Unless one has a feel of the place সেই অঞ্চল নিয়ে লেখা অত সোজা নয়। সাহেব আই সি এস দের লেখা গেজেটিয়ারগুলোও অবশ্যই পড়তে হত।

সাহেবরা নাকি এ দেশ শোষণ করতেই এসেছিল। ভালো কিছুই করেনি। নমিতের তো মনে হয়, সেই শোষণকারীদের এই দেশের প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি, রীতিনীতি, রূপকথা, বন্যপ্রাণী, লোকসাহিত্য, লোকসংগীত, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, স্থাপত্য, ইতিহাস ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় সম্বন্ধে যেমন আগ্রহ ছিল, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না অধুনা আই এ এসদের মধ্যে।

পঞ্চাশ বছর দেশ স্বাধীন হল কিন্তু এই দেশকে নিয়ে কী করল রাজনীতিক আর দেশবাসীরা?

শিক্ষা আর অনুসন্ধিৎসা সমার্থক। যে যত বেশি শিক্ষিত, প্রকৃতার্থে, তার অনুসন্ধিৎসা তত বেশি এমনই দেখা যায়। এখন আর সেইসব dedicated আমলা দেখা যায় না। অবশ্য dedication কোথায়ই বা আর আছে? গত পঞ্চাশ বছরে জল-না-পাওয়া তৃণ ও উদ্ভিদের মতন সবই প্রায় শুকিয়ে গেছে। নমিত জানে না, কোন জাদুকর এখন এই মৃতপ্রায় বৃত্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেন।

এসব কথা যত কম ভাবা যায়, ততই নিজের শরীর-মনের পক্ষে মঙ্গল। কিন্তু কারও তো ভাবতে হবেই। একজনও যদি না ভাবে, না কিছু করে, তবে এই দেশের কী হবে? এই হতভাগ্য দেশটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার বা লালুপ্রসাদ যাদব বা জ্যোতিবাবুর যতখানি, তার চেয়ে একটুও কম তো নমিতের নয়! একটুও কম নয়। এই দেশ তো সতীনের ছেলে। নয়, যে, চোখের সামনে উচ্ছন্নে গেলে, মনে আহ্লাদ হবে। কিন্তু এমন আত্মবিস্মৃত, নিজ-নিজ সুখপরায়ণ, শুধুমাত্র নিজ নিজ পকেট ভারী করার আকাঙ্ক্ষাতে আকাঙ্ক্ষিত জাত পৃথিবীতে আর আছে কি? জানে না নমিত। এ নিয়ে, না ভাবাই ভালো। রাতে তাহলে ঘুমুতেই পারত না।

ওই স্মরণিকাতেই ইমামদ্দিন বুলবুল-এর ভাষা সংগ্রামের চেতনা; আমাদের উত্তরাধিকার এই নামের প্রবন্ধতে স্থানীয় কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর একটি সুন্দর কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছেন উনিঃ

যে কেড়েছে বাস্তুভিটে

সেই কেড়েছে ভয়,

আকাশ জুড়ে লেখা আমার

আত্মপরিচয়।

হিংসা জয়ী যুদ্ধে যাব

আর হবে না ভুল

মেখলা পরা বোন দিয়েছে

একখানা তাম্বুল

এবার আমি পাঠ নিয়েছি

আর কিছুতে নয়,

ভাষাহীন ভালোবাসার

বিশ্ববিদ্যালয়।

কিন্তু শেষ দুটি পঙক্তি নমিতের ঠিক বোধগম্য হল না। যদি আমাদের মাতৃভাষার অবদমনের অপচেষ্টাই এখানে নানাভাবে করা হয়ে থাকে তাহলে ভাষাবিহীন ভালোবাসা শব্দটিতে নমিতের আপত্তি থাকবে। ভালোবাসতে হবে অবশ্যই মাতৃভাষাকেই। তাতে লজ্জা কী? কার সাধ্য আছে নমিতদের মাতৃভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে? এই বাবদে বাংলাদেশ-এর ভাইবোনেদের কাছ থেকে এবং বরাক উপত্যকার শহিদের কাছ থেকেও প্রত্যেক বাংলা ভাষাভাষীকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে।

আর একটি প্রবন্ধ পড়ল দিলীপকুমার দের লেখা বরাকে বাংলা মাধ্যমে পঠন-পাঠনের ভবিষ্যৎ। পড়ে, মন খারাপ হয়ে গেল। গভীর চিন্তা জাগল ওর মনে।

এরকম সাহসী লেখা আজকাল দেখা যায় না বড়ো, এই ভীরুদের দেশে। ভীরুদের দেশ বলতে বরাক উপত্যকাকে বোঝাচ্ছে না নমিত, বোঝাচ্ছে মূল বাংলা ভাষাভাষী ভূখন্ডকে। সুযোগসন্ধানী, ঘুমন্ত পশ্চিমবঙ্গকে।

বাংলা ভাষাকে তো অন্য একাধিক প্রতিবেশী রাষ্ট্রেও গলা টিপে মারার অপচেষ্টা নিত্যদিন হচ্ছেই কিন্তু দিলীপবাবুর মতন, যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে সোজা কথাটা এমন স্পষ্ট করে বলতে পারার সাহস ইদানীংকার কম বাঙালিরই আছে বলে মনে হয় নমিতের। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে এই উক্তিতে নমিতের চিরদিনই বিশ্বাস ছিল।

ব্যক্তিগত জীবনের ন্যায়-অন্যায়ের পরিণাম চিরদিনই ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মধ্যেই সীমিত ছিল। অমলবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে তার যে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা যদি সত্যিই গর্হিত অপরাধ হয়, তবে তার শাস্তি নমিতকে পেতেই হবে। কিন্তু দেশ ও জাতি এবং মাতৃভাষার প্রসঙ্গে ওইসব তুচ্ছ ব্যক্তিগত ন্যায়-অন্যায়ের কোনোই ভূমিকা নেই। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বরাক উপত্যকার মানুষ যেমন সোচ্চার হয়েছেন, সাহসের সঙ্গে প্রতিবাদ করেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে এখানে কাজ করতে-আসা কিন্তু বাঙালি নমিত যতটুকু সোচ্চার হবে, তাতে সরোজা, দুর্বিনয়, মেঘাদা, পলাশ, অমলবাবু, তাঁর স্ত্রী বুড়ি এবং নমিতের পরিচিত-অপরিচিত সমস্ত বাঙালিকেই শামিল হতে হবে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কে বড়োলোক আর কে গরিব, কে উচ্চশিক্ষিত আর কে অল্পশিক্ষিত, কে সচ্চরিত্র আর কে দুশ্চরিত্র, কে কমিউনিস্ট আর কে কংগ্রেসি, বা কে বিজেপি তার ভেদ করলে চলবে না। এই যুদ্ধে প্রত্যেক বাংলা ভাষাভাষীকেই পাশাপাশি দাঁড়াতে হবে যেমন এঁরা আগেও দাঁড়িয়েছেন।

নানান দেশে নানান ভাষা,

বিনে স্বদেশি ভাষাপূরে কি আশা?

কত নদী সরোবর।

তাহে কী ফল চাতকিরো।

ধারাজল বিনে কভু

মিটে কি তৃষা।

নানান দেশের নানান ভাষা।

নিধুবাবুর এই গানটি গাইলেই নমিতের গায়ের সব রোম খাড়া হয়ে ওঠে। বন্দেমাতরম গাইলে যেমন হয়।

আজকে ওদের চার্চ রোডের অফিস-কাম-রেসিডেন্সের একতলার ছাদ ঢালাই হচ্ছিল। যদিও ভালো এবং বড়ো ঠিকাদার এবং অফিসের ছেলেরা আছে তবু নমিতের আধঘণ্টার জন্যে গিয়ে সেখানে দাঁড়ানোটা জরুরি ছিল।

ছাদ পেটাই-এর গান গাইছিল যারা, তারা স্থানীয় অধিবাসী। তাদের ছাদ পেটাই-এর গান শুনতে শুনতে অন্য এক জগতে চলে গেছিল নমিত। এই দোলানি সুরের সঙ্গে লালাবাই এর মিল আছে। বেশিক্ষণ শুনলে সত্যিই ঘুম পেয়ে যায়। এই ছাদ পেটাই-এর গান লোকসংগীতের এক বিশেষ ধারা। দুর্বিনয় সেদিন বলছিল যে, এই বিষয়ে মহম্মদ ফজলুল বারী নাকি একটি সুন্দর প্রবন্ধ লিখেছেন বরাক উপত্যকা সাহিত্য এবং সংস্কৃতি সম্মেলনের স্মরণিকাতেই। গানগুলি ছোটো ছোটো, যদিও বারংবার গাওয়া হচ্ছে। মনে হয় যেন পুরোটাই ধুয়ো। শুনে টুকে নিল নমিত। পরে, রাতে গিয়ে প্রবন্ধটি বের করে পড়বে এবং এই গানের কোনো উল্লেখ আছে নাকি দেখবে।

তুমরা দেখ (অ) আইয়ারে
নদিয়ার চান্দ আমার উদয় হইয়াছে। (ধুয়া)
নিমাইচান্দে গীত গায়, জগাই মাধাই পিছে যায়
পন্থপানে চাইয়া কান্দে গর্ভধনী মায়রে
নদিয়ার চান্দ আমার উদয় হইয়াছে। (ধুয়া)
চুল নাই চুলুয়া বেটি চুলর লাগি কান্দে
কচুপাত্তা চিপা দিয়া উচচা খুফা বান্দে
হিরে হয় হয় হইয়া।
উম্মারিয়া মারে কিল গুম্মরিয়া উঠে
বেটিয়ে বলে মাইগো মাই পিঠা বার করে
হিরে হয় হয় হইয়া।

গর্ভধনী শব্দটির সঙ্গে কি রত্নগর্ভার কোনো মিল আছে?

ভাবছিল নমিত। তারপরই বুঝল যে, গর্ভধনী শব্দটির অর্থ এখানে গর্ভধারিণী। যাই হোক, মহম্মদ ফজলুল বারী সাহেবের প্রবন্ধতে দেখবে এই গানের কথা আছে কি না এবং থাকলে গর্ভধনী শব্দটি কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে? শব্দটি ভারি মিষ্টি।

আরও একটি দ্বিপদী গাইছিল ছাদ পেটাই করা মানুষগুলি–

তেলি আয় তেল বেচে ছট্টাক ছট্রাক।
আন্ধাইর ঘর (অ) বউ মারে ভট্টাত ভট্টাত।

.

১২.

অম্বিকাপটিতে সাইকেল রিকশা নিয়ে গিয়ে যখন পৌঁছোল তখন প্রায় পৌনে আটটা বাজে। বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল সাতটার সময়। দিনে-রাতের সবসময়েই ও গাড়ি পেতে পারে। মারুতি এস্টিম বুক করা আছে। সাদা রং বেছেছে। দু-একদিনের মধ্যেই এসে যাবে। যতদিন না আসে, প্রাইভেট ট্যাক্সি ও সর্বক্ষণ রাখতে পারে। কিন্তু রাখে না। রাখে না, কারণ গাড়ি চড়া মানুষের স্বাধীনতা সবচেয়ে কম। এবং পায়ে-হাঁটা মানুষের স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি। পায়ে হেঁটে না ঘুরলে কোনো দেশেরই কিছু দেখা হয় না। জানা যায় না। Feel of the place পাওয়ার জন্যে জনারণ্যে পায়ে হেঁটে ঘোরাটা ভীষণই দরকার। তাই নমিত গাড়ি আর পা গাড়ির মাঝামাঝি সাইকেল রিকশার সঙ্গে রফা করেছে। কিণ্ডারগার্টেন স্কুলের শিশুর মায়েদের মতো করে রিকশা রাখার কোনো প্রয়োজন বা ইচ্ছে নেই ওর। তাই রাখেও না। কিন্তু শিলচরের কোন রিকশাওয়ালা যে কখন বলে বসবে ভাল্লাগে না তা তো আগে থাকতে জানা যাবে না।

সরোজাই দরজা খুলল।

বসার ঘরটা ফুল দিয়ে সাজিয়েছে সুন্দর করে। সর্বত্রই ফুল। আজকে বেণী করেছে সেই প্রথম দিন যেমন করেছিল তেমন। হলুদ একটি তাঁদের শাড়ি। নতুন। কোরা-গন্ধর। এই গন্ধটির সঙ্গে পুজো আর নববর্ষের গন্ধ মিলেমিশে যায় নমিতের নাকে। অনেকের জন্মদিনও। সদ্যপ্রকাশিত সদ্য বাঁধাই করা নতুন বইয়ের গন্ধের সঙ্গে–কোনো নতুন তাঁতের শাড়ি পরিহিত কোনো বাঙালি মেয়ের গায়ের গন্ধ গুলিয়ে ফেলে নমিত। বই এবং নারী দুজনকেই চুমু খেতে ইচ্ছে করে।

বেণীতে লাগিয়েছে হলুদ অমলতাস ফুল। অমলতাস ফোঁটা প্রায় শেষ হয়ে এল। কালো ব্লাউজ। হলুদ প্লাস্টিকের গোল গোল বল গেঁথে বানানো উজ্জ্বল মালা। হলুদ বলেরই বালা। পায়ে অ্যানোডাইজড স্টিল-এর পায়জোর। হালকা হলুদ-রঙা শায়া শাড়ির নীচ থেকে তার আভাস দেখা যাচ্ছে। কালো টিপ পরেছে। কাজলের কী? গাঢ় করে কাজল দিয়েছে দু চোখে। কলকাতার অধুনা-জনপ্রিয় গায়িকা স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত যেমন দেন। কাজলদানিতে বা কলাপাতাতে পাতা পেতলের প্রদীপের টাটকা কাজল একজন নারীর সৌন্দর্যে যে আলাদা মাত্রা এনে দেয়, তা যাদের দেখার চোখ আছে, তারাই জানে। তবে, চোখ সুন্দর হলে, সে চোখকে কাজল এক রহস্যময়তা দান করে। কালো কাজলের পটভূমিতে চোখের সাদা কনীনিকা অন্য এক অর্থ পায়। জীবনের অনেক ক্ষেত্রের খোলনলচে যে পালটে দিতে পারে, এই contrast, এই কথাও কম মানুষই জানেন হয়তো। Contrast-এর বাংলা প্রতিশব্দ কী? জানে না নমিত। কোনো ভাষাই ভালো করে জানে না। সাহিত্য ও ভাষা পড়ার সুযোগ জীবনে আর পেল কোথায়?

নতুন কচি কাঁচা আম উঠেছে মনে হয় বাজারে সবে। নতুন গরমও সবে পড়েছে, কিশোরীর সবে-জাগা কামেরই মতন। কাঁচা আমপোড়া শরবত এনে দিল সরোজা। মধ্যে কাগজী লেবুর টাটকা-পাতা আর শুকনো-লঙ্কা পোড়া। বানানোবানিয়ে ফ্রিজ-এ রাখা ছিল। এনে দিল সরোজা। নিজের গ্লাসটাও নিয়ে এল। নমিত হাতে গ্লাসটি নিয়ে সরোজার দু চোখে চেয়ে বলল, এটা কী? বশীকরণী?

আপনি তো আফ্রিকার হাতি। বশ তো মানেন না কারওই আপনি! নিজে বশীকৃত না হলে, আপনাকে বশ মানায় এমন কে আছে!

নমিত উত্তর না দিয়ে সরোজার চোখে চেয়ে রইল। ঠিক এইরকম সুন্দর মুখ সে তার জীবনে আর দেখেনি। দুটি চোখের মধ্যে কী এক আশ্চর্য ঘুমলীন ভাব। অথচ সে চোখে একটুও সস্তা ঢলানি নেই। যে-সুন্দরী নারী তার অপরূপ সৌন্দর্য সম্বন্ধে অবহিত তার সব সৌন্দর্যই মাঠে মারা যায়। বাইজি বা গণিকার সমতুল সেই মানসিকতা। কিন্তু যে সুন্দরী জেনেও জানে না, বিধাতা তাকে কী দিয়েছেন, সেই সুন্দরীর সৌন্দর্য অন্য এক বিশেষ মাত্রা পায়।

নারীরা কতটুকু জানে তাদের আশ্চর্য সুন্দর প্রভাবের প্রকৃতি একজন পুরুষের ওপরে? তা তিনি শারীরিক সৌন্দর্যর অধিকারীই হন কী মানসিক সৌন্দর্যর? সৌন্দর্য সবসময়ে শারীরিক নাও তো হতে পারে। তবে যদি শরীরের সৌন্দর্যর সঙ্গে মানসিক সৌন্দর্যর মেলবন্ধন ঘটে তবে তো তা রাজযোটক মিলেরই সমার্থক। সরোজার বা নমিতের আয়েষার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে।

কিছু বলুন? কী দেখছেন অমন করে?

সরোজা বলল।

কী আর দেখব! দেখছি আমার সর্বনাশকে। ভাগ্যিস এখন প্রহরশেষের রাঙা আলো নেই।

ওই কবিতাটি না হয় থাক। রবীন্দ্রনাথকে যাঁরা ক্লিশে করে তুলতে চান আমি তাঁদের। বিরোধী।

আমিও। তবে রবীন্দ্রনাথ যে ধমনিতে ঢুকে গেছেন! হাজারিবাগে একজন রসিক বনচারী ছিলেন, যাঁর নাম ছিল মহম্মদ নাজিম। তিনি একটা কথা বলতেন তাঁর পরিচিত, এন সি ডি সি-র একজন এঞ্জিনিয়র সম্বন্ধে।

কী বলতেন?

বলতেন গোলি ব্রেইনসে ঘুসকে, ভেইনকে যাকর, টোসে নিকাল যাতা থা।

কী? কী? আবার বলুন। উচ্ছল হাসি হেসে বলল, সরোজা।

কী সুন্দর যে দেখল ও সেই হাস্যময়ী সরোজাকে। নমিতের বুকের মধ্যে হায়! হায়! করে উঠল। সৌন্দর্যর মার যে, রাইফেলের গুলির মারেরও বাড়া একথা নমিতের মতন আর ক জন জানে!

নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, বুঝলেন না? রাইফেলের গুলি মস্তিষ্ক দিয়ে ঢুকে, ধমনি দিয়ে গিয়ে, পায়ের পাতা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

মানে কী হল?

কী আর হবে? আপনার হাসিরই মতন, যে সেই রাইফেলের গুলি অথবা হাসিতে মরল সে জানলও না যে, সে মরল, মৃত্যুর মুহূর্তের আগেই মৃত মৃততর হয়ে গেল। দ্যুলোক ভূলোক স্বর্গলোকের কোনো বিশল্যকরণীই আর তাকে বাঁচতে পারবে না।

সরোজা বলল, আপনার মুখটি না থাকলে আপনার যে কী হত?

কী হত?

কাকে-চিলে তুলে নিয়ে ভাগাড়ে ফেলে দিত। আপনার কথা শুনলে মনে হয় কুর্চিবনে এসেছি বসন্তে বা শিউলিতলায় এসেছি পুজোর আগে।

বাঃ। আপনি লেখেন না কেন?

ওসব আমার জন্যে নয়। আমি এ জন্মে ড্যাগমাস্টারি করতেই এসেছি।

সেটা আবার কী জিনিস?

ড্যাগ মানে ডেকচি তাও জানেন না? মানে রান্নাঘরে জীবনপাত করার জন্যেই এসেছি।

ব্রতটি খারাপ কীসে! শুধুমাত্র রসিক জনে, প্রকৃত প্রেমিকই জানে ড্যাগমাস্টারের ভূমিকা। কবিতা লেখা কি রান্না করার চেয়ে কঠিন নাকি? রান্নাও তো একধরনের কবিতাই! কবিতাও যেমন সকলে বোঝে না, রান্না করাটাও যে কবিতা লেখারই মতন এক মহান সারস্বতসাধনা সেকথাও সকলে বোঝে না। আসলে আপনার মতো ভার্সেটাইল নারী আজেবাজে পুরুষের ঘরনি হয়ে বরবাদ হয়ে যাবেন এমন ভাবনা মনে এলেও আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। আপনার যোগ্য পুরুষ, শিলচর তো দূরস্থান, বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে আছে কি না সন্দেহ।

থ্যাঙ্ক ইউ। সত্যি! পরমমিথ্যেকেও আপনি এমন সুন্দর করে বলেন না। মনে হয় যেন চরম সত্যি কথা শুনছি।

বলেই, কুশিয়ারা নদীর মতন হেসে উঠল সরোজা।

উপমাটা মনে এল নমিতের, কারণ আজই বিকেলে সে কুশিয়ারা নদী দেখে এসেছে।

নমিত বলল, কুশিয়ারার এ পারো তুমি, হিপারো আমি/মাজেদি এক বেড়া।

কবিতাটি যেন প্রথম শুনল ও এমন মনে হল নমিতের।

সেকী? আপনি জন্মজিৎ রায়ের এই কবিতাটি শোনেননি? আমি যেদিন প্রথম এলাম এ বাড়িতে সেদিনই তো পড়া হল। আপনি কোথায় ছিলেন তখন?

সরোজা নিজেও জানে যে সে শুনেছিল। তবু আবার সে শুনতে চাইল কবিতাটা, নমিতের মুখ থেকে। মুখে বলল, কোথায় আবার? হয়তো চা করছিলাম। কবিতা-টবিতা তো ড্যাগমাস্টারের জন্যে নয়। এমনিই কী বলি!

তারপরে বলল, বলুন না কবিতাটি শুনি।

আহা! বলব কী আর! আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে প্রতিরাতেই তো এই কবিতাটিই আবৃত্তি করি। বরাক উপত্যকার ভাষায়। পাছে আপনি আমার ভাষা না বোঝেন।

কবিতাটি বলুন।

কাইল মাজ-রাইত কিতা যে
অইল আমার মনো,
একবার ই কাইত একবার হি কাইত
ঘুম আইল না তেবো।
আলপিন একটা খুচা দিল বুকুর জেব।
আসলে আলপিন নায়।
ই তোমার চেরা
কুশিয়ারার এ পারো তুমি, হিপারো আমি,
মাজেদি এক বেড়া।

কবিতাটি শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল সরোজা।

সত্যিই প্রতিরাতে একবার করে আবৃত্তি করি বিছানাতে শুয়ে শুয়ে।

আবার বলল নমিত।

শুনুন।

গলার স্বর বদলে গেল সরোজার। গম্ভীর হয়ে গেল।

বলল, শুনুন। আপনাকে একটা কথা বলব। সব সিরিয়াস ব্যাপারকেই লঘু করার এক আশ্চর্য প্রবণতা এবং ক্ষমতাও আপনার মধ্যে আছে। সেই ক্ষমতার অপব্যবহার যত কম করেন ততই ভালো।

কেন এমন কথা বলছেন আমাকে? এমন রূঢ় কথা?

আপনি ভালোবাসার কিছু বোঝেন না।

ঠিকই বুঝেছেন আপনি।

কী ঠিক বুঝেছি।

যে, আমি ভালোবাসার কিছু বুঝি না। কিন্তু আমি তো এমন দাবি কখনো করিনি যে, আমি ব্যাপারটা বুঝি। তা ছাড়া তাত্ত্বিক আলোচনা করে জন্মদিনের সন্ধেটা মাটি করে কী লাভ। জন্মদিনে বাড়ির কুকুরকেও মানুষে কটু কথা বলে না। আর আপনি কি আমাকে…

বড়ো বাজে কথা বলেন আপনি।

বিরক্ত হল সরোজা।

ঠিক আছে। কথা থাক। আপনার গান কখনো শোনাননি? আজ জন্মদিনে আমাকে এই উপহারটা না হয় দিলেনই। অনেকের মুখেই শুনেছি যে, আপনি খুব ভালো গান করেন।

তারা জানে না। তা ছাড়া জন্মদিনে, যার জন্মদিন উপহার তো তাকেই দেবার কথা। সে-ই উপহার দেয় এমন তো শুনিনি।

এই রে! একদম ভুলে গেছি। উপহার এনেছি। For the birthday baby.

বলেই, দাঁড়িয়ে উঠে ওর পাঞ্জাবির ডানপকেটে হাত ঢুকিয়ে একটি ছোটো প্যাকেট বার করল নমিত। আর ক্যাডবেরির একটি বড়ো চকোলেট। তারপর দোষীর গলাতে বলল, শিলচরে ভালো র‍্যাপিং-পেপার কোথায় পাওয়া যায় বলুন তো? আমি যে কিছুই জানি না। জনার্দনও জানে না বলল। তাই ন্যাংটো বাক্সতেই নিয়ে আসতে হল।

বাক্স ন্যাংটো হলে দোষ নেই। আপনার শুভেচ্ছা ন্যাংটো না হলেই হল। কিন্তু এসব তো আমি নেব না। কিছুতেই নেব না। তা ছাড়া চকোলেট! আমি কি ছোটো খুকি?

আমার চোখে তাই। ঈশ্বর করুন। আপনি যেন কখনো বুড়ি না হন।

বুড়ি শব্দটি উচ্চারণ করেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও।

তারপর বলল, দেখুন। আমাকে হয়তো বম্বেতে বদলি করে দেবে। যে কোনো দিন। আমি আপনাকে হয়তো আর বেশিদিন জ্বালাব না। এটা নিয়ে আমাকে সুখী করুন। আমার ওপরে দয়া করুন। না নিলে ভারি দুঃখ পাব কিন্তু।

সরোজা নিজের জায়গা ছেড়ে না উঠেই বলল, কী আছে ওতে?

এতে?

হ্যাঁ।

মাছি-গোলাপ।

কী?

তিনটি মাছি-গোলাপ।

কী যে হেঁয়ালি করেন বুঝি না।

হেঁয়ালি নয়, হেঁয়ালি নয়। প্রথম যেদিন এখানে আসি, আপনাকে প্রথম দিন দেখি, সেদিন আপনি যে রঙের মাছি-গোলাপ বেণীর শেষে গেঁথেছিলেন, যে-রঙের শাড়ি পরেছিলেন তারই সঙ্গে মিলিয়ে দুটি রুবির দুল এবং একটি আংটি এনেছি। আন্দাজেই এনেছি। পরে দেখুন। আপনার আঙুলে ঠিক হবে তো?

বাবা: আপনার মনেও থাকে এত কথা! আমি তো ভুলেই গেছি কী রঙের শাড়ি পরেছিলাম সেদিন।

আমিও ভুলে যেতে চাই কী শাড়ি পরেছিলেন। কিন্তু সেই কপাল করে কি এসেছি?

তার মানে?

মানে, আমি তো মনে মনে আপনাকে কোনো শাড়ি না-পরাই দেখতে চাই।

আপনি অত্যন্ত অসভ্য। কোনো ভদ্রলোক, কোনো ভদ্রমহিলার সঙ্গে এভাবে কথা বলেন না।

আমি ভদ্রলোক এমন দাবিও তো করিনি কখনো।

ইশ। রুবি! এ তো ভীষণ দামি! না, না। আমি এ নিতে পারব না। আমি আপনার কে? এত অল্পদিনের আলাপ। এ দেবার অধিকার আপনার নেই। নেবার অধিকারও আমার নেই।

তাই?

বসে পড়ল নমিত বাক্সটি হাতে ধরেই।

বলল, দেখুন আমার যা সামান্য অভিজ্ঞতা এই সংসার সম্বন্ধে তাতে জেনেছি যে, খুব কম মানুষই এখানে স্বার্থহীন ভাবে কারওকে কিছু দেয়। দেওয়াটা খুবই কঠিন। কিন্তু দেওয়ার চেয়েও অনেক বেশি কঠিন নেওয়াটা। দিতে যদি বা কিছু মানুষ জানেন তার চেয়েও অনেকই কম মানুষে জানেন নিতে।

আপনি যাই বলুন। এটা বাড়াবাড়ি। ও আমি নিই কী করে?

যেমন করে আমার চুমু নিয়েছিলেন আপনার দুই বন্ধ-চোখের পাতাতে।

তারপর একটু থেমে বলল, এই জিনিসটার দাম কি তার চেয়েও বেশি? আপনি কি আমার কাছ থেকে কিছুই নেননি? যা চোখে দেখা যায়, হাতে ছোঁওয়া যায়, আমি সেইসবের কথাই বলছি। যা দেখা-ছোঁয়ার বাইরে সেইসবের দাম আপনি বোঝেন বলে মনে হয় না। তার দাম যদি বুঝতেন একটুও তবে এই তুচ্ছ উপহার এমন করে ফিরিয়ে দিতে পারতেন না।

সরোজা বিড়বিড় করে কী যেন বলল নীচু স্বরে।

কী হল? ডাইনির মতন কীসব মন্ত্র বিড়বিড় করছেন? নিপাতন মন্ত্র নাকি? আপনি বলুন না। এখুনি আপনার সামনেই নিজেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে মরছি। মন্ত্র পড়ার দরকার কী?

আপনি কি যাত্রা করতেন?

সরোজা উঠে এসে ওর হাত থেকে বাক্সটা তুলে নিল।

নমিত বলল, ইয়েস। কিন্তু আপনি ধরলেন কী করে?

উত্তর না দিয়ে সরোজা বলল, কী যাত্রা? কী ধরনের ভূমিকাতে অভিনয় করতেন?

একটিই ভূমিকাতে। সব যাত্রাতেই একটি ভূমিকা।

তার মানে?

মানে, বিবেকের। মাঝে মাঝেই সাদা-পোশাক পরে বিবেক এসে গানের মাধ্যমে বিবেকের বাণী শুনিয়ে যান-না যাত্রাতে। গাঁয়ের যাত্রা দেখেছেন কখনো? আমি সেই বিবেক।

হাসল অনেকক্ষণ পরে সরোজা। অনেকক্ষণ ধরে।

তারপর বলল, আপনি যাত্রার বিবেক! আপনার নিজের বিবেক কি হারিয়ে গেছে? কই? কোনো কাগজ বা টিভিতে তো হারানোদের তালিকার মধ্যে আপনার বিবেককে লক্ষ করিনি!

আমার বিবেক যে, অলক্ষ্যে হারায়। যে-বিবেক লক্ষ্যহীন সে তো চিরতরেই নিরুদ্দিষ্ট তাকে লক্ষ করবেন কী করে!

আপনাকে কী ধন্যবাদ দেব? এই দুর্মূল্য উপহারের জন্যে?

আমার উপহার অতিসস্তা। আপনি পরলেই তা দুর্মূল্য হবে। তা ছাড়া ধন্যবাদ কি মুখে। ছাড়া জানানো যায় না?

কীসে আর জানানো যায়?

কেন? চোখে। চোখ দিয়ে ধন্যবাদ জানানোটাই তো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। Thank you-এর সংস্কৃতি তো বেনে! ইংরেজদের। তাদের খদ্দর পরে তেরঙা ঝাণ্ডা নিয়ে ছাগলের দুধ খেয়ে অপ্রত্যক্ষ সংগ্রাম করে দেশছাড়া করে আমরা কী দারুণ অনুকরণ করেছি তাদের। কাকের ময়ূরপুচ্ছ পরার মতন আর কী!

তাদের অপ্রত্যক্ষ সংগ্রামে তাড়িয়ে আমরা প্রত্যক্ষভাবে তাদের পরাধীন হয়েছি। গ্রামে গঞ্জে, শহরে-নগরে, ইঁদুরের ল্যাজ-এর মতো রঙিন টাই-পরা বাচ্চারা অপার-অশিক্ষিত শিক্ষিকাদের কাছে সকাল বিকেল ড্যাড্ডি, মাম্মি, থ্যাঙ্ক ইউ শিখতে যাচ্ছে। যেন শিক্ষার এই পরাকাষ্ঠা। ঘুস খেতে আর ঘুস দিতে যতটুকু ইংরেজি জানলে চলে ততটুকু জানলেই যথেষ্ট। আমরা যথার্থই স্বাধীন জাত, শিক্ষিত জাত। নইলে নিজেদের যা-কিছু নিজস্ব সবই এমন ঘৃণাভরে ত্যাগ করি! ভাষা, পোশাক, সংস্কৃতি।

ঠিকই বলেছেন আপনি।

সরোজা বলল।

সচরাচর আমি ঠিকই বলে থাকি।

আপনি বড়ো বেশি দাম্ভিক।

আদৌ নই। St. augustine-এর একটা উক্তি আমি সর্বক্ষণ মনে রাখি।

কী সেটা?

The sufficiency of my knowledge is to know that my knowledge is not sufficient.

বাঃ।

একটু চুপ করে থেকে সরোজা বলল, রাত গড়িয়ে যাচ্ছে। আপনি গান শোনাবেন না আমাকে একটা?

মাত্র একটা? সারারাত ধরে শোনাব।

সারারাত কেন? আজ কি আপনার ফুলশয্যার রাত!

যদি শয্যা একটা থাকে এবং শয্যাতে ফুল, তাহলেই তো ফুলশয্যা। ঠেকাচ্ছেটা কে? আমি সপ্তাহে কমপক্ষে দু-তিন দিন ফুলশয্যা করে থাকি। অফিসফেরতা মোড়ের দোকান থেকে ফুল কিনে নিয়ে যাই। আসল ফুলশয্যা তো কোনোদিনও হবে না। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই।

কী ফুল? মানে, কেনেন কী ফুল?

কী ফুল মানে, যে-কোনো ফুল। তবে রং আলাদা আলাদা। যেদিন আমার মনের যেরকম। রং থাকে, সেদিন সেই রঙের ফুল কিনি।

বা:।

সবই দেখি বাঃ। আপনি আমার দিদিমণি হলে বেশ হত। সব বিষয়েই একশো পেতাম তাহলে।

.

১৩.

এখন কত রাত কে জানে! খুব বেশি নয়। তবু শিলচর-এর মতন শান্ত শহরে রাত দশটাই অনেক রাত।

রিকশাটা যেন দিগভ্রষ্ট হয়ে গেছে। নিস্তব্ধ রাতে ক্যাঁচর-কোঁচোর করে চলেছে নির্জন মফসসল শহরের পথে।

একটা লোক, বেশ তুরীয় অবস্থা, সাইকেলে চড়ে উলটোদিক থেকে আসছিল আস্তে আস্তে। তার মুখে মদের হালকা গন্ধের সঙ্গে একটি গানের সুরও আলতোভাবে ঝুলে ছিল।

লোকটার গলাতে সুর আছে। গানটাও চমৎকার। স্থানীয় ভাষাতে লেখা। লোকটা গাইছিল, যার তার সঙ্গে প্রেম কইরো না।

গানটা দু-দিন আগেই শুনেছে নমিত। ওদের অফিসের সেলসম্যান গানপাগলা নবীন ভট্টাচার্যি পরশুদিনই তার ওয়াকম্যানের ইয়ারফোনটা ওকে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, এই গানটা শুনুন, স্যার।

ইটা কী?

নমিত বলেছিল হেসে, স্থানীয় নবীনকে।

উষা দস্তিদার। দারুণ গায়।

সত্যিই ভালো লেগেছিল। কথা, সুর এবং গাওয়াও।

যে লোকটা মাতাল অবস্থাতেও সাইকেলে চড়ে টালমাটাল না হয়ে সুরে গান গাইতে গাইতে চলে গেল তার প্রতিও শ্রদ্ধা হল। জাতে মাতাল, তালে ঠিক। ওর নিজের কানে বিধাতা সুর দিয়েছেন বলেই কারও বেসুরো গান শুনলে বড়োই শাস্তি বলে মনে হয়। বিধাতা, সৌভাগ্যক্রমে শুধু ওর কানেই সুর দেননি, আরও অনেকের কানেই দিয়েছেন। সুরে সুরে ভুবন ভরে উঠুক, ভরে উঠুক এই বরাক আর কুশিয়ারা আর জাটিঙ্গার উপত্যকা।

আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে। সপ্তর্ষি, কালপুরুষ, আরও কত তারা! কী সুন্দর সুন্দর সব নাম তারাদের। ইংরেজি Mars, Saturn, Jupiter, Sagaritus এইসব ইংরেজি নামই জানে আজকালকার ছেলে-মেয়েরা কিন্তু তারা দেশি নাম জানে না, সংস্কৃত নাম। স্বাতি, শতভিষা, পুলহ, ক্রতু, বিদিশা আরও কত সুন্দর সুন্দর সব নাম।

কলকাতার আকাশে আজকাল আর তারা-টারা দেখা যায় না। ছেলেবেলাতে যেত। শিলচরের আকাশে শুধু তারাই নয়, অনেক উপগ্রহও দেখা যায়। যারা জানে না, তারা ভাবে তারাই বুঝি। কিন্তু উপগ্রহদের রাতের বেলা তারাদের মতনই দেখতে লাগলেও তারা অনেক কাছে থাকে আসল তারাদের তুলনাতে। আর তারা আস্তে আস্তে চলেও। স্থবির মনে হয় না তাদের তারাদের মতন।

আমাদের পৃথিবীটার আর আব্রু বলে কোনো জিনিস রইল না। বিজ্ঞানের এই অগ্রগতির কারণে। ভাবছিল নমিত, শোবার ঘরে শুয়ে আছে কন্যা, তার শাড়ি উঠে গেছে, ব্লাউজের বোতাম খুলে গেছে, চিলে-ঢালা নাইটিই পরে আছে হয়তো, আর সেই ঘরে অনুক্ষণ উঁকি মারছে এদিক-ওদিক থেকে স্যাটেলাইটগুলো। শুধু পৃথিবীই নয়, পুরো মহাকাশই এইসব কারণে বে-আব্রু হয়ে গেছে।

কে যে কোটি কোটি বছর ধরে এই অগণন গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে এক অসীম নিয়মবদ্ধতায় চালিত-পালিত করছেন, আবর্তিত করছেন, প্রজাপতির পাখায়, পাখির পালকে কে যে এত রং লাগিয়েছেন এসবের উত্তর দিতে কেউ পারুক আর নাই পারুক সেই ধারক বাহককে অনুকরণের প্রতিযোগিতার শেষ নেই কোনো।

বিজ্ঞান আজ অবধি কিছুমাত্র উদ্ভাবন করেনি, শুধুমাত্র আবিষ্কারই করেছে। যা ছিল, তাকে চিনেছে অপার বিস্ময়ের সঙ্গে। আর নিজের পরমমূর্খতাজনিত শ্লাঘাতে ভর করে ভেবেছে যে, সে নিজেই ঈশ্বর। কেন ভোলো, মনে কর তাঁরে। সে সৃজন পালন করেন এ সংসারে।

গভীর রাতে তারাভরা আকাশের দিকে চাইলে এমন অনেক আপাত অপ্রাসঙ্গিক কথা মনে আসে। যেসব কথা ভেবে মানুষের আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। হয়নি কোনোদিনও। কে জানে! হয়তো আত্মিক উন্নতি হয়। হয়তো সেইজন্যেই মানুষে এইসব কথা ভাবে।

আসবার সময়ে দরজা খোলার আগে সরোজার ডানহাতের পাতাতে চুমু খেয়েছিল একটা। তাতেই হাওয়া-লাগা সজনে গাছের মতন সরোজার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠেছিল।

বারে বারে সরোজার মুখটি মনে পড়ছিল নমিতের। সে অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত সুরুচিসম্পন্না, শালীনমেয়ে। তবু তার জন্মদিনে নমিতকে একা বাড়িতে ডেকে সে হয়তো আন্তরিকভাবেই চেয়েছিল যে, নমিত তাকে সোহাগভরে একটা চুমু অন্তত খাবে। বিশেষ করে, প্রথম দিনেই তার রূপ ও গুণে মুগ্ধ নমিত যখন তার চোখের পাতাতে চুমু খেয়েছিল। সেই চুমুর আবেশ এখনও রয়েছে সোজার। হয়তো।

সরোজা কি কখনো জানবে যে, যা নমিত ওকে দিতে পারল না আজ রাতে, তা না দেওয়ার কষ্টটা নমিতকে সরোজার কষ্টের চেয়েও অনেক বেশি বেজেছে? কী করে সরোজার মতন সরসীজাত পবিত্র কুমুদিনীকে ও স্পর্শ করবে? ও যে নষ্ট হয়ে গেছে! নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে।

ও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অনুক্ষণ। প্রতিদিন।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা কবিতা ছিল না? প্রভু নষ্ট হয়ে যাই?

তাঁর আর একটি কবিতার কথাও এমন এমন মুহূর্তে মনে পড়ে

তখনও ছিল অন্ধকার তখনও ছিল বেলা।
হৃদয়পুরে জটিলতার চলিতেছিল খেলা।
ডুবিয়াছিল নদীর ধার আকাশে আধোলীন
সুষমাময়ী চন্দ্রমার নয়ান ক্ষমাহীন?
কী কাজ তারে করিয়া পার যাহার ভ্রূকুটিতে
সতর্কিত বন্ধদ্বার প্রহরা, চারিভিতে
কী কাজ তারে ডাকিয়া আর এখনও এই বেলা
হৃদয়পুরে জটিলতার ফুরালে ছেলেবেলা।

ক্ষমা কোরো। ক্ষমা কোরো সরোজা। ভালো লাগে না আমার। আমার ভালো লাগে না, ভালো লাগে না, ভালো লাগে না।

বাইরে আমি নষ্ট হয়ে গেছি। আমার অভ্যন্তরের অভ্যন্তরতম স্থলে আমাকে পবিত্র থাকতে দাও। যেখানে একমাত্র অন্তর্যামী ছাড়া আর কারও স্পর্শ পৌঁছোয় না।

সরোজা!

নমিত বলল, মনে মনে বলল, তুমি আমার মন্দির। ময়লা জুতো পায়ে যেতে পারি কি আমি তোমার কাছে?

ভালো লাগে না। ভালো লাগে না। ভালো লাগে না।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress