ভারতবর্ষ
টি.ভি-তে খবরটা দেখাতেই আনন্দে চেয়ার ছেড়ে লাফ মেরে উঠলাম l দুই মুঠ আবির আকাশে উড়িয়ে দিয়ে মুখে আওড়ালাম, ‘জয় শ্রীরাম’l মনে মনে রামলালার বিগ্রহটা কল্পনা করলাম l টুক করে একটা প্রণাম সেরে ফেললাম l
ঘর থেকে বেরোতেই পাশের মসজিদ থেকে আজানের মিঠেসুর কানে ভেসে আসলো l শ্রদ্ধায় মাথা নত হলো অজান্তে l দূর থেকে দেখতে পেয়ে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছিপছিপে লম্বা আকৃতির ছেলেটা হাত তুলে আমাকে ইঙ্গিত দিল l চিনতে ভুল হলো না l পাড়ার বন্ধু, ইসমাইল l আমিও হাত তুলে প্রতুত্তর দিলাম l মনে পড়ল, গত ঈদে ইসমাইলের বাড়িতে বন্ধুরা মিলে কি মজাটাই না করেছিলামl আমিনা চাচী আদর করে আমাদেরকে সেয়াই-এর পায়েস খাইয়েছিলেন l ইসমাইল, আসলাম ও ওদের ভাইরা মিলে সুন্দর জিকির গেয়েছিল l অটো করে একটু পথ এগোতেই শুনতে পেলাম, দূরের গুরুদ্বারাতে বাজছে সেই চিরপরিচিত সুরেলা গুরুবাণী l সামনে গুরুপরব যে l এবার গুরু নানকজীর জন্মের 550 তম পূর্ণ তিথি l তাই বড় করে লঙ্গরের আয়োজন থাকবে এবার l ভাণ্ডারায় মানুষের আগমন হয় লাখ খানেক l খুব ভালো ব্যবস্থা l করসেবকদের নিষ্টা ও পরিশ্রম করার ক্ষমতা দেখার মতো l বিশাল কর্মকাণ্ড মেশিনের মতো হয়ে যাচ্ছে, কোথাও একচুল অবাবস্থার চিহ্ন দেখা যায় না l তাদেরকে মনে মনে কুর্নিশ জানালামl ভান্ডারার সুজি-লুচি আমার সবচেয়ে প্রিয় l অনেকদিন আসা হয় নি l এবার যেতেই হবে l অটো থেকে নেমে বাজারের দিকে এগোচ্ছি l পথের পাশে পুরোনো একটি গির্জাঘর, ব্রিটিশ আমলের l দেখতে পেলাম, কয়েকজন খ্রীষ্টানধর্মাবলম্বী লোক জমবেত হয়েছেন রোববারের বিশেষ প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে l নজরে এলো, পরিচিত সহকর্মী এন্ড্রোস সাহেব ও আছেন সেখানে l আমাকে দেখে মাথা ঝাঁকিয়ে একটু হাসলেন, আমিও হাসলাম l মনে পড়ল, ছোটবেলার শিলঙের কথা l ক্রিস্টমাসের পবিত্র বড়দিনে আমিও বন্ধু ম্যাক্রোস, ডেভিডদের সাথে লাইতুমখরার বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল চার্চে যেতাম বিশেষ প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে l প্রার্থনা সংগীতের দুইটি কলি গুনগুন করে স্মরণ করলাম l
দু’পা এগোতেই দেখলাম, সামনে বিরাট শোভাযাত্রা : পুলিশ রাস্তা আটকে দিয়েছে l কারণটা জানতে ভিড় ঠেলে সামনের দিকে চলে এলাম l শুনলাম, শহরে জৈন সম্প্রদায়ের গুরু মহারাজের আগমন ঘটেছে, তাই শোভাযাত্রা l মনে পড়ল, ফি বছর এমনটাই হয় l মহিলাদের পরনে লাল পাড় দেওয়া গেরুয়া রঙের শাড়ি, পুরুষদের পোশাক সাদা পায়জামা ও উপরে হাল্কা গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবী l সারিবদ্ধভাবে সুশৃখল ভক্তরা নামকীর্তন করতে করতে শহর পরিক্রমা করছে l কি অপরূপ দৃশ্য l দুই এক করে কপালে ঠেকালাম l চলাচলে অসুবিধা হলেও দেখলাম, লোকেরা বেশ উপভোগ্য করছে এই রঙীন উৎসবের পরিবেশ l কেউ কেউ মোবাইল বের করে ফটো তুলছে, কেউ বা ভিডিওগ্রাফিও করছে l
ভিড়টা একটু হাল্কা হতেই আবার হাঁটা শুরু করলাম l গন্তব্য শহরের এক কোণে পাহাড়ের টিলায় অবস্থিত পুরাতন বৌদ্ধ মন্দির l প্রায় প্রতি রোববার সময় পেলেই চলে আসি বৌদ্ধ মন্দিরে l একটু সময় ধ্যান করলে সারা সপ্তাহের ক্লান্তি নিমিষে যেন দূর হয়ে যায় l মন্দিরটি বেশ পুরানো l দীর্ঘদিন সংস্কারের কাজ হয়নি মন্দিরে l কিছু জায়গায় ফাটল ধরেছে l তার দিয়ে বাঁধা রয়েছে l চারদিকটা গাছপালায় ভর্তি l তার মধ্যে আমলকি গাছও আছে l মাটি থেকে গোটা চারেক আমলকি কুঁড়িয়ে পকেটে ভরলাম l একটি মুখে দিয়ে হাল্কা চিবুতে পরিচিত স্বাদ জিব্বায় স্পর্শ করলো l বিকেল হলেই পাশের গ্রামের শিশুরা মাঠে খেলতে খেলতে এই দিকটায় চলে আসে আমলকির লোভে l মন্দিরের ভক্তসংখ্যা এমনিতেই কম l দিন দিন আরও কমে যাচ্ছে l হঠাৎ করে যেন ইতিহাসের পাতায় ঢুকে পড়লাম l সম্রাট অশোকের সময় বৌদ্ধধর্ম প্রায় গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল l 1200 খ্রিস্টাব্দ থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোকের সংখ্যা কমতে শুরু করে l বর্তমানে ভারতে 1% ও নিচে বৌদ্ধ ধর্মবলম্বীলোকের সংখ্যা l হিমালয় পার্শ্ববর্তী ভারতের রাজ্যগুলিতে, শ্রীলংকা, চীন প্রদেশের তিব্বত, পূর্ব এশিয়ার জাপান, তাইল্যান্ডে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোকের বাস l
মনে পড়ল কয়েক মাস আগে তাইল্যান্ড ভ্রমনের কথা l ব্যাংককের রাস্তাগুলোর নামকরণ হয়েছে – রামা-দুই, রামা-চার রাজাদের নামে l ব্যাংককের প্রধান গন্তব্যস্তল – গোল্ডেন বুদ্ধা টেম্পল l সুবর্ণ বুদ্ধের সামনে হাঁটু গেড়ে নতজানু হয়ে মাথা ঠেকালাম মাটিতে l প্রার্থনা করছি l পাশেই স্থানীয় একজন জোরে জোরে অবোধ্য ভাষায় মন্ত্রাচারণ করছে l হঠাৎ কানে এলো, চির পরিচিত সেই অমোঘ বাণী -‘বুদ্ধম শরনং গচ্ছামি, ধর্ম্যাং শরনং গচ্ছামি, সংঘম শরনং গচ্ছামি’l গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো l আনন্দাশ্রুতে চোখের কোণটা ঝাঁপসা হয়ে এলো l এই আমাদের মহান ভারতবর্ষ l