ভাঙ্গাগড়ার খেলা
এই তো সেইদিনের কথা— যখন ঘন্টার পর ঘন্টা কাহারো অপেক্ষায় বিকাশবাবু চৌমাথার মোড়ে দাঁড়াইয়া থাকিত। বৃষ্টি কিংবা রোদ্দুর— ছাতা মাথায় করিয়া দুইজনে পদব্রজে বিস্তর পথ হাটিয়া বেড়াইত। কলি যে কিভাবে ফুলে পরিণত হইয়া যায় তাহা এক উপলব্ধির বিষয়। এক এক মুহূর্তের একত্রিকরণের ফল স্বরূপ আমরা এক পরিপক্ক বস্তুর রূপরেখা নয়ন সাগরে ভাসিয়া থাকিতে দেখি। বিকাশ সেই ভাসমান নৌকার মাঝি। রোজ কাজলকে সঙ্গে করিয়া বাড়ী পৌঁছাইয়া দিয়া গভীর সুখ অনুভব করিত। একদিন সেই কাজল বিধিপূর্বকভাবে তাহার গলায় মালা পরাইয়া দিল। সেই হইতেই বিকাশ কাজলকে লইয়া সুখে ঘর বাঁধিতে স্বপ্ন সাগরে ভাসিল।
ভাল লাগার মানুষটিকে ভালবাসিয়া জয় করিতে পারিলে পুরুষ মানুষের আত্মবিশ্বাস যে শতগুণে বাড়িয়া যায় তাহাতে সন্দেহের আর কিছু থাকে না। কাজেই বিকাশ কাজলকে পত্নী হিসাবে পাইয়া ঘূর্ণিয়মান জীবনের আবর্তকে সার্থক বলিয়া মানিয়া লইয়াছে। কিন্তু সুখের মুহূর্ত কখন যে বর্ষার কালোমেঘের আড়ালে আচ্ছন্ন হইয়া পড়ে তাহার আগাম বার্তা অনুমান করা বড়ই কঠিন। হঠাৎ এক দুঃসময় আসিয়া কাজলের মুখের হাসি হরণ করিয়া লইয়া গেল। যে ব্যক্তি সুখে- দুঃখে ছায়ার মতো তাহার সঙ্গে থাকিত তাহার প্রাণবায়ু নিমেষেই বাহির হইয়া গেল। সঙ্গে রইল স্মৃতিতে ভরা এক গচ্ছিত ধন— কাজলের গর্ভে বিকাশের তিন মাসের সন্তান। তিলে তিলে যে সুখের বাগানখানি সজ্জিত করার স্বপ্নে বিভোর ছিল, সেই বাগানের কলিগুলি ফুলে রূপান্তরিত হইবার পূর্বেই মালীর দেহাবসানে অযত্নে পড়িয়া রহিল।
এই কঠিন সময়ে কাজল তাহার স্বামীর চাকুরির পদে যোগ দিল বটে, কিন্তু ভাবী জীবনে চলার পথে মাঝিহীন নৌকার মতো অবস্থা হইল। সেই সমাজের ও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ লোকের একান্ত অনুরোধে একমাত্র দেবর উৎপলের সহিত কাজলের অনাড়ম্বরে বিবাহ হইয়া গেল। উৎপল তখন এম.এ পড়ুয়া। স্বীয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুইটি জীবনকে বাঁচাইয়া রাখিবার উদ্দেশ্যে উৎপলকে এই সামাজিক দায় কাঁধে বহন করিতে হইল। দেখিতে দেখিতে কয়েকটি মাস পার হইলে কাজল এক ফুটফুটে কন্যার মা হইল। নাম রাখা হইল ‘তৃষ্ণা’। তখন হইতেই উৎপল তৃষ্ণার পিতার ভূমিকায় থাকিয়া কন্যাকে স্নেহের স্পর্শে লালন পালনে কাল অতীত করিতে লাগিল।
এতদিন কাজল গৌহাটি শহরের ব্যাঙ্কে নিযুক্তা ছিল। সঙ্গে ছিল তাহার কন্যা ও দ্বিতীয় বর উৎপল। কয়েকটি বৎসর একত্রে কাটাইবার পর কাজল মেঘালয়ের নংপো শহরে স্থানান্তরিত হইল। ইতোমধ্যে উৎপল তাহার পড়াশুনা শেষ করিয়া বহু পরিশ্রমের পর ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়াতে চাকুরি গ্রহণ করিল। চাকুরি পাইয়া প্রথম পোস্টিং হিসাবে তাহাকে আগরতলায় যোগ দিতে হইল। নংপো হইতে আগরতলা অনেক দূরের পথ এবং অনেক সময় সাপেক্ষ। বর্তমান যুগে সরকারী চাকুরি খুঁজিয়া পাওয়া বড় ভাগ্যের ব্যাপার। আবার যদিও ভাগ্যে জুটিল, তাহাতে সাংসারিক জীবনের সুবিধাগুলি অসুবিধায় পর্যবসিত হইল। প্রায়ই উৎপলকে চাকুরির কাজে আগরতলায় ব্যস্ত থাকিতে হয়। ছোট্ট তৃষ্ণা পিতার স্নেহ হইতে দূরে থাকায় মাঝে মধ্যেই মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া থাকিত।
অন্যদিকে কাজল ধীরে ধীরে অন্য এক সহকর্মীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হইয়া দাঁড়াইল। কাজল এক সন্তানের মাতা হইলেও বিগত যৌবনা হইয়া পড়ে নাই। ঠোটের কোণে মিষ্টি হাঁসির ছোঁয়া সর্বদা লাগিয়াই থাকিত। কাজলা চোখে কাজল আর কাহারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাই বলিলে তাহার সৌন্দর্যকে অবমাননাই করা হইবে। প্রতিনিয়তই তাহার রূপের প্রশংসায় বিবিধ বিশেষণ ভাসিয়া শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করে। প্রবল বর্ষায় জলাশয় ভরিয়া গেলে তাহার আবদ্ধ জল যেমন বাহিরে উপচাইয়া পড়ে, আর সেই জলের সহিত যেভাবে অনেকমাছ পাড় টকাইয়া বাহিরে চলিয়া যায় ; ঠিক তেমনই অত্যধিক আশা ও আকাঙ্খায় প্রলুব্ধ হইয়া কাজল তাহার সাংসারিক গন্ডি টপকাইয়া সহকর্মী সুকান্ত বাবুর জীবনে আসিয়া আশ্রয় লইল। পেটের ক্ষিধের তাগিদে অন্যের সম্পত্তি কাড়িয়া লইয়া নিজের প্রাণ বাঁচাইয়া রাখিবার আপ্রাণ চেষ্টাকে নির্মম ও অত্যাচারী বলিয়া পরিভাষিত করা যায়। তবে নিজ কন্যা ও স্বামীকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য কাহাকেও নূতন রূপে মানিয়া লইবার প্রয়াস কাজলের চারিত্রিক নিঃস্বতার পরিচয় বহন করে। ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়া ‘ কুপমন্ডুক ‘ আখ্যা লাভ করাটা অতি সহজ হইলেও উচ্ছৃঙ্খল উন্মাদনায় মত্ত হইয়া স্রোতস্বিনীর মতো প্রবল গতিতে ছুটিয়া চলিয়া যখন সাগর সঙ্গমে মিলিত হয় তখন তাহার অস্তিত্ব হারাইয়া যায়।শুধু তাই নয় — সাগরের নোনা জল তৃষ্ণারও অযোগ্য হইয়া পড়ে।
মাতা হইয়াও মাতৃস্নেহ ত্যাগ করায় তৃষ্ণার যেমন মনঃকষ্ট বাড়িল, অন্যদিকে কাজলের দুঃসময়ের দেবরূপী উৎপল যেভাবে তাহার মানসিক শক্তিটুকুকে ইন্ধন জোগাইয়া ছিল তাহাও অকৃতজ্ঞতার লজ্জাহীন ফুতকারে উড়িয়া গেল। কাজলের এই আকস্মিক ও দৃষ্টিকটু সিদ্ধান্তের সংবাদে উৎপল তৎক্ষণাৎ আগরতলা হইতে তৃষ্ণার কাছে আসিয়া তাহাকে বুকের মাঝে জড়াইয়া ধরিল। পিতৃস্নেহে পালিত তৃষ্ণা অশ্রুপূর্ণ নয়নে গদগদ কণ্ঠে বলিল, “তুমিও কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে বাবা? তোমাকে ছাড়া আমি যে বড্ড একা হয়ে যাব !”
তৃষ্ণার এইরূপ আবেগপূর্ণ কথাগুলি উৎপলের কোমল প্রাণে সূচের মতো বিধিল। অবিলম্বে তৃষ্ণার নয়নযুগল স্বীয় হস্তে মুছাইয়া দিয়া কহিল, “তুমি আমার প্রাণের স্পন্দন ও শক্তির উৎস। আমার সমস্ত অন্তঃকরণ জুড়ে তোমার উপস্থিতি। তুমিই আমার অনুপ্রেরণা। তোমাকে ছেড়ে চলে যাবার মতো পাষান হৃদয় কি আমার আছে? তুমিই আমার সব !”